#মধুবালা,২২,২৩
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২২
নীলার বাবা জনাব রায়হান সাহেব খুব রুক্ষ মেজাজ নিয়ে আশরাফির সামনে বসে আছেন। উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, পারলে এইমুহূর্তেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন আশরাফিকে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। এইমুহূর্তে আশরাফিকে বের করে দেওয়া মানে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলা। সেটা তিনি করতে চাইছেন না। আবার মেজাজও শান্ত রাখতে পারছেন না।
আশরাফির নতমুখে বসে আছে। তার যা বলার ছিলো ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে সে। রায়হান সাহেব হুঙ্কার দিয়ে বললেন,’আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই জানে তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আর তুমি এখন বলছো বিয়েটা করতে পারবে না? এটা কোন ধরনের তামাশা? আমার মেয়েকে কি ফেলনা পেয়েছো? তোমাকে আমি পুলিশে দেবো!’
-‘আপনি চাইলে আমাকে পুলিশে দিতেই পারেন কিন্তু তাতে তো আর আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে যাবে না?’ নতমুখেই জবাবটা দিলো আশরাফি।
রায়হান সাহেব সপাটে চড় তুলে এগিয়ে এলেন তাঁর দিকে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,’তুমি আমার মেয়ের শিক্ষক না হলে এইমুহূর্তে চড়িয়ে তোমার গাল লাল করে দিতাম। অসভ্য, ইতর, বেয়াদব ছেলে! বিয়ে কি মশকরা? যখন খুশি হলো রাজি হবে আবার যখন খুশি বারণ করে দেবে! আমার মেয়ের কোন মানসম্মান নেই?’
আশরাফি চুপচাপ বসে রইলো। বিন্দুমাত্রেও প্রতিবাদ করলো না। পেছন থেকে নীলার গলা শুনে চমকে উঠলেন রায়হান সাহেব। অশ্রুসজল চোখে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর আদরের মেয়েটা। বাবা হয়ে এই দৃশ্য সহ্য করার মতন মানুষ তিনি নন। অতএব ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন,’জালিয়াত টা কি বলছে শোন? বলছে তোকে নাকি বিয়ে করতে পারবে না। এত সোজা? আমি ছেড়ে দেবো? আমিও দেখবো কি করে বিয়ে না করে? আমার মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে আমি চুপ করে থাকবো এটা তো হতে পারে না!’
আড়াল থেকে আশরাফির কথাগুলো সবই শুনেছে নীলা। চোখের পানি মুছে মলিন কন্ঠে বললো,’তুমি একটু ভেতরে যাও বাবা। আমি উনার সঙ্গে একটু কথা বলবো!’
রায়হান সাহেব অবাক হয়ে মেয়ের দিকে চাইলেন। প্রতিবাদ করে উঠে বললেন,’কোন কথা বলার দরকার নেই। যা বলার আমি বলবো।’
-‘প্লিজ বাবা।’, অনুনয় করলো নীলা।
মেয়ের অনুরোধে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভেতরে চলে গেলেন রায়হান সাহেব। নীলা আশরাফির মুখোমুখি গিয়ে বসলো। তাঁর চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না আশরাফির। অপরাধীর মত মাথা নিচু করে মেঝের দিকে চেয়ে রইলো সে। নীলা বৃথা হাসার চেষ্টা করে বললো,’কেমন আছেন আপনি?’
-‘ভালো।’
-‘মেহের? তিনি কেমন আছেন?’
মুখ তুলে চাইলো আশরাফি। তার চোখেমুখে বিস্ময়! ক্ষণকাল স্তব্ধ থেকে বললো,’ও ভালোই আছে।’
নীলা কান্না চাপতে নিচের ঠোঁটে কামড়ে ধরলো। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বললো,’তিনি কি আপনার কাছে ফিরে আসতে রাজি হয়েছেন?’
-‘না।’
নীলা যেন এই উত্তরটার অপেক্ষাতেই ছিলো। তাড়াহুড়ো করে বললো,’তবে?’
-‘আমার ধারণা আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে বলেই মেহের রাজি হচ্ছে না। ও খুবই চাপা স্বভাবের। নিজের কষ্টের কথা কখনো মুখ ফুটে বলে না।’
নীলা অসহায়ের মত চেয়ে থেকে বললো,’সমস্তটাই তো আপনার অনুমান? এর বিপরীতটাও তো হতে পারে।’
★
দুদিন আগের ঘটনা, মধুর ওপর রাগ করে বেরিয়ে আসার সময় আশরাফির হাত চেপে ধরলো মধু। তাঁকে অবাক করে দিয়ে বললো,’আমাকে রেখেই যাবে?’
হতবিহ্বল হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো আশরাফি। মধুর মুখে মিটিমিটি হাসি। বললো,’কি হলো?’
আশরাফির ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না। মধু কি ঠাট্টা করছে নাকি সত্যি? বললো,’কি?’
-‘কি আবার? যাওয়ার কথা বলেছি?’
আশরাফি তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলো না। ফ্যালফ্যাল করে মধুর দিকে চেয়ে রইলো সে।
মধু দুপা এগিয়ে গেলো তাঁর দিকে। দুহাতে আশরাফির গলা জড়িয়ে ধরে বললো,’সত্যি বলছি আমি যাবো। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে!’
-‘কি?’
-‘আমি একা যাবো না।’
-‘মানে?’
-‘মানে এখানকার যত মেয়ে আছে সবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ওরা আমাকে মা ডাকে। ওদের একা ফেলে আমি যাই কি করে?’
আশরাফি হাসলো। বললো,’আরমানের বিরুদ্ধে যেই মামলাটা করা হয়েছে তাতে আমার সাথে কিছু নারীবাদী সংগঠনও যুক্ত আছে। বাড়িটা সরকার সিল করে দেওয়ার পর এখানকার সব মেয়েদের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব ওরাই নেবে বলেছে।’
-‘কিন্তু আমার আরো একটা শর্ত আছে।’
-‘বলো।’
-‘তুমি নীলাকে বিয়ে করবে। আমি আমার মত করে নিজের ব্যবস্থা করে নেবো।’
এতক্ষনে মধুর রাজি হওয়ার আসল কারণটা বুঝতে পারলো আশরাফি। হাসিহাসি মুখটা কালো হয়ে গেলো তাঁর। তাঁর গলা জড়িয়ে রাখা মধুর হাত দুখানা সরিয়ে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’সম্ভব না!’
-‘আমার জন্যেও নয়? তুমি তো বলছিলে আমি এখান থেকে বেরোলেই তোমার সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যাবে। সেজন্যই তো আমি রাজি হয়েছি। কিন্তু এখন তুমি বলছো সম্ভব না? কেন? তারমানে তোমার মূল উদ্দেশ্য আমাকে এখান থেকে বের করা নয়? আমাকে নিজের করে পাওয়া? ‘
আশরাফি বুঝলো তাঁর কথার জালে তাকে ফাঁসিয়েছে মধু। হতাশ কন্ঠে বললো,’কেন আমার ভালোবাসার কোন মূল্য তোমার কাছে নেই মেহের? কেন তুমি বারবার আমাকে এভাবে অপমান করো?’
মনে মনে সব বুঝলেও কৃত্রিম রেগে যাওয়ার ভান করলো মধু। গম্ভীর গলায় বললো,’সব তো তোমার ইচ্ছেমত হতে পারে না। কেন তোমার জন্য সারাজীবন লোকের কাছে আমাকে খোঁটা শুনবো? এখানে সবাই পতিতা কেউ কাউকে ছোট করে না। কিন্তু বাইরের জগৎ। আলাদা। সেখানে সবাই প্রতিনিয়ত তোমার সঙ্গে আমার তুলনা করবে। পদে পদে আমাকে শুনতে হবে তুমি বড়! তুমি মহান। আমি তোমার চাইতে অনেক বেশি নীচ, হীন। কেন আমি এসব সহ্য করবো? নিজের ইচ্ছেতে তো আমি এখান থেকে যেতে চাইছি না? তুমি বাধ্য করছো। তাই আমি চাইনা কেউ তোমার জন্য আমাকে কথা শোনাক।’
-‘কেউ তোমাকে কথা শোনাবে না মেহের। আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।’
-‘কেন? কেন আমি সারাজীবন এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচবো?’
আশরাফি এগিয়ে গেলো মধুর কাছে। বললো,’তবে তুমিই বলে দাও আমি কি করবো?’
-‘নীলাকে বিয়ে করো। তুমিও শান্তিতে থাকতে পারবে। আমিও নিজের মত করে থাকতে পারবো।’
তাঁকে ছেড়ে দিলো আশরাফি। অভিমানী কন্ঠে বললো,’তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো মেহের। এরজন্য হয়ত একদিন তোমাকে পস্তাতে হবে।’ কথা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। গটগট করে বেরিয়ে গেলো। মধু মূর্তির মতন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর আর কি দিয়ে আশরাফিকে বোঝাবে সে? এতকিছুর পরেও ঘুরেফিরে বারবার তাঁর কাছে আসে মানুষটা। আর কতদুঃখ দেওয়া যায় একটা মানুষকে! এবার না ফিরলে যে অন্যায় হয়ে যাবে!
★
বসে বসে পুরোনো কথাগুলো ভাবছিলো আশরাফি। তাঁকে নিরুত্তর দেখে পুনরায় প্রশ্ন করলো নীলা,’কি হলো চুপ করে আছেন যে? কেন আপনার মনে হচ্ছে বিয়েটা ভেঙ্গে দিলেই উনি আপনার কাছে ফিরবেন?’
-‘কারণ শেষবার তাঁর সঙ্গে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম ও আমাকে খুব ফোর্স করেছিলো তোমাকে বিয়ে করার জন্য। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছিলো। ‘
-‘তাতে কি হয়েছে? এতে কি কোনভাবে প্রমাণ হয় যে উনি এখনো আপনাকে ভালোবাসেন ? শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে আপনি বিয়ে ভাংতে চলে এলেন? কেন? হতেও তো পারে সত্যিই আপনার প্রতি উনার আর কোন ফিলিংস নেই? আপনি না বুঝে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছেন?’
-‘তুমিও তো অনুমান করেই বলছো নীলা? এও তো হতে পারে তোমার কথা গুলো ভুল। আমার ধারণাটাই সঠিক?’
নীলা সম্মতিসূচক মাথা দোলালো। সে জানে তাঁর কথাগুলো সত্যি মিনতিভরা কণ্ঠে বললো,’কিন্তু আমরা কেন এসব হতে পারে নিয়ে বসে আছি বলুন তো? যে আপনাকে চায় না আপনি কেন তাঁর পিছনে পড়ে আছেন? যে আপনাকে চায় আপনি তাঁকে গ্রহণ করুন!’ বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো নীলা। ইউনিভার্সিটির গুরুগম্ভীর প্রকৃতির স্যারের তাঁর প্রতি ক্ষনিকের ভালোলাগাটুকু যে দিনে দিনে এতটা কঠিন ভালোবাসায় রূপ নেবে সে নিজেও বুঝতে পারে নি। কিন্তু এখন আর ফিরে আসার পথ নেই। মনপ্রাণ দিয়ে মানুষটাকে ভালোবাসে সে। তাই নিজের আসন্ন দুরবস্থার কথা ভেবে কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারলো না সে। ছোট শিশুদের মত কান্না জুড়ে দিলো।
আশরাফির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কষ্ট হচ্ছে তাঁর। মেয়েটাকে অনেক বেশি দুঃখ দিচ্ছে সে। নরম গলায় বললো,’আমি তোমার ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করি নীলা। আমি এও জানি তোমার চাওয়াটা ভুল নয়। কিন্তু আমি নিরুপায়! সব দোষ আমার। আমি অক্ষম। আমি মতিচ্ছন্ন নতুবা তোমার পাহাড়সম ভালোবাসা কেন আমি গ্রহণ করতে পারছি না। মেহের সত্যিই আমার বুদ্ধিভ্রষ্ট করে দিয়েছে। নিজেকে সত্যিই খুব নগণ্য মনে হচ্ছে!’
নীলা চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,’আপনার কোন দোষ নেই জেনেও শুধুমাত্র আমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কেন নিজের ঘাড়ে সব দোষ চাপাচ্ছেন বলুন তো? আপনি নিজেও জানেন দোষটা আসলে কার।আমার ভালোবাসাটা কতটা একতরফা। কোনদিন, কোন একমুহূর্তের জন্যেও আপনি আমাকে ভালোবাসেন নি। আমার ভালোবাসায় সাড়া দেন নি। অথচ তারপরেও আমি নিষ্ঠার সাথে ভালোবেসে গেছি আপনাকে। আমিই ভুল!’ ফের কেঁদে ফেললো নীলা। কষ্টে তাঁর বুকটা ফেটে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটা মানুষ কি করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?
নীলার চোখের পানি বাস্তবিক বড় পীড়া দিচ্ছিলো আশরাফিকে। কোথাও যেন মনে হচ্ছিলো মেয়েটার সাথে অন্যায় করছে সে। নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। বললো,’আমি আসি নীলা। ভালো থেকো তুমি!’
নীলা জবাব দিলো না। যেমনি বসে ছিলো তেমনি বসে রইলো। আশরাফি বেরিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনি সিংহের ন্যায় গর্জন করে উঠলেন রায়হান সাহেব। বাসার ভৃত্যকে নির্দেশ দিলেন গেটে তালা দেওয়ার জন্য। আজ! এইমুহূর্তেই আশরাফির সঙ্গে নীলার বিয়ে দেবেন তিনি। কারো কথা শুনবেন না।
নির্দেশ দেওয়ার পর আর একমুহূর্তও দেরী হলো না। সঙ্গে সঙ্গেই তালা পড়ে গেলো গেটে। আশরাফি বিস্ফোরিত নয়নে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রায়হান সাহেব কাজি ডাকতে লোক পাঠিয়েছেন। তার মেয়েকে তিনি কিছুতেই কষ্ট পেতে দেবেন না। বুঝিয়ে কাজ না হলে বলপ্রয়োগ আসল অস্ত্র!
নীলা মেঝেতে বসে সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে মূর্তির মত বসে ছিলো। আশরাফির তারপাশে গিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো,’তোমার বাবা এসব কি করছেন নীলা? তুমি উনাকে বারণ করো। আমি কিছুতেই তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।’
নীলা টুঁশব্দটিও করলো না। মাথা নিচু করে রাখায় তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছেনা আশরাফি। পুনরায় অসহায় কন্ঠে বললো,’প্লিজ নীলা। তুমি তোমার বাবাকে বোঝাও। তিনি আমাকে যা শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেবো কিন্তু বিয়ে আমি করতে পারবো না।’ তথাপি কোন জবাব এলো না নীলার। উপুড় হয়ে পড়ে রইলো সে। রায়হান সাহেব আড়চোখে সবই দেখছিলেন। কাছে এসে মেয়ের মাথা হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন,’ওঠ মা তৈরী হয়ে নে। আমি কাজি ডাকতে লোক পাঠিয়েছি।’
অনেকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে মাথা তুললো নীলা। করুণমুখে বাবার দিকে চাইলো। রায়হান সাহেব হাসলেন। বললেন,’আমার মেয়ের খুশির জন্য আমি সব করতে পারি। তোর কোন ভয় নেই মা!’ বাবা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো নীলা। পাশে বসে থাকা আশরাফির উপস্থিতি যেন সম্পূর্ণ উপেক্ষিত! অতঃপর আশরাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তৈরী হতে চলে গেলো সে। অবাক হয়ে চেয়ে রইলো আশরাফির। উত্তেজনায় মাথা কাজ করছে না তাঁর। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে। নীলা কি করে এমন করতে পারে? তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিলো স্বপ্ন দেখছে সে! দুঃস্বপ্ন! ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।
মিনিট দশেক বাদেই উপরতলা থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেলো। রায়হান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর নীলার নাম ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন। ভৃত্যরা সব দৌড়াদৌড়ি করছে। ঘাবড়ে গেলো আশরাফি! বুকের ভেতর অশনি সংকেত বেজে উঠলো! নীলা কিছু করে বসে নি তো? কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য দ্রুত উপরে গেলো সে।
.
.
.
চলবে
#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৩
স্টেজে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বসে আছে মধু।সামনে বিভিন্ন নারীবাদী সংঘটনের বেশ কিছু নেতাকর্মী, মিডিয়ার লোকজনও আছে। মিডিয়ার লোকজন বলতে জার্নালিস্ট শ্রেণীর লোকজন। তাদের পাশে সম্মুখের সারিতে একেবারে মধ্যমনি হয়ে বসে আছে আশরাফি। হাতের রাখা ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ! তাঁর চিন্তা অন্যদিকে!
আর কিছুদিনের মধ্যেই ব্রোথেলটা সরকার দখলে নিয়ে নেবে। তাই সরকারি আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত মেয়েদের কাউকে স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। যদিও ব্যাপারটা একদমই ভালো লাগে নি আশরাফির। আরমান পালানোর পর আর একটা মুহূর্তও মধুকে ঐ নোংরা জায়গায় রাখতে রাজি ছিলো না সে। কিন্তু উপায় নেই। সরকারি আদেশ!
আজকের ব্রিফিংয়ে মধু এবং মধুর মত মেয়েদের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত যেমন, কিভাবে তারা এখানে এসেছে, কার মাধ্যমে এসেছে, তাদের ওপর কি ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হতো, এখানে কোন শ্রেণির লোকজন বেশি আসতো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। সবাই নিজনিজ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছে।
মেয়েদের জীবন কাহিনী বর্ণনা ছাড়াও এখানকার মোট তেইশজন মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে নতুন একটা সমিতি গঠনের যে প্রস্তাবনা আশরাফির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিলো তাঁর নাম এবং তালিকাভুক্ত মেয়েদের লিস্ট জমা নেওয়া হয়েছে মধুর কাছ থেকে। মেয়েদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সমিতির প্রধান হিসেবে মধুকেই নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নিজের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা দেওয়ার পর সমিতির ব্যপারে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য স্টেজে উঠলো মধু। মেয়েরা সবাই দারুণ খুশি! নতুন করে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে সবাই। একটা সুস্থ জীবন কে না চায়? সবাই তো চায় একটু সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে!
নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে বারবার আত্মবিস্মৃত হলো মধু! সে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি তাঁর মত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ের জীবনে এমন দিন আসবে। তাঁর আপনজনেরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে! কিন্তু এমনটাই হয়েছে! স্বার্থের লোভে প্রিয়জনরা অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এদের মধ্যে আপন জন্মদাতা পিতাও বাদ যান নি! এরজন্যেও হয়ত অনেকাংশে আমাদের সমাজই দায়ী! এই সমাজ পতিতাদের ভালো চোখে দেখে না! এই কলুষিত সমাজ মেহেরদের মধুবালা হয়ে উঠার জন্য হাজার পথ সৃষ্টি করলেও মধুবালাদের মেহের হয়ে উঠাতেই তাদের যত আপত্তি। তাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নির্মম নিয়তির স্বীকার হতে হতে ভাগ্যদোষে ভুক্তভোগী অসহায় মধুবালাদের!
বক্তৃতার একেবারে শেষ পর্যায়ে মধু আশরাফির দিকে এক ঝলক চাইলো। গম্ভীরমুখে বসে আছে মানুষটা। কি যেন ভাবছে! কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাটিয়ে অবশেষে বলেই ফেললো মধু,’আমার জীবনের এই কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসার পেছনে সমস্ত অবদান আমার স্বামীর! জনাব আশরাফি বিন আবদুল্লাহ! তিনি না থাকলে আমার,আমার মত মেয়েদের, এই সমতির সমস্ত দুঃখি মেয়েদের এই দুর্বিষহ জীবন থেকে পরিত্রাণের কোন উপায়ই ছিলো না। সারাজীবন একটা নষ্ট জায়গায় পঁচে মরতাম আমরা! তাই আমি আন্তরিক ভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ!’
সাথে সাথেই করতালিমুখর হয়ে উঠলো বিশাল অডিটোরিয়াম। সবগুলো ক্যামেরা আশরাফির দিকে ঘুরে গেলো। আশরাফি হাতের মুঠোয় থুতনি চেপে ধরে চুপচাপ বসে রইলো। মধু হাসলো! সাহস করে কথাটা বলতে পারবে সে নিজেও ভাবতে পারে নি। কিন্তু বলার পর ভীষণ আত্মতৃপ্তি লাগছে!
বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে নেমে এলো সে। আশরাফি হাতের ফোন পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মধুর দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ হেসে বললো,’একি করলে মেহের? সবার সামনে আমাকে স্বামী বলে পরিচয় দিলে? এবার যে বিয়ে না করে উপায় নেই? সবাই শুনেছে তুমি আমার বউ! চাইলেও আর না করতে পারবে না।’
মধু হাসলো। বললো,’সারাক্ষণ জোঁকের মত পিছনে লেগে থাকলে না করে উপায় আছে?’
আশরাফির সঙ্গে অলিখিত চুক্তি হয়েছিলো মধুর। আশরাফি বিয়ে করুক বা না করুক মধুকে মধুর মত থাকতে দিতে হবে। আশরাফির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য তাঁকে কোনরকম জোর করার যাবে না। নতুবা সে ব্রোথেল থেকে বেরিয়েই যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে, আশরাফির সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না। তাঁর হুমকিতে বাধ্য হয়ে, অগত্যা আশরাফিকে সব শর্ত মেনে নিতে হয়েছিলো। কিন্তু মধুর মুখ থেকে ‘স্বামী’ শব্দটা শুনে বেশ অবাক হলো সে। সুযোগটা কাজে লাগালো। এই সুযোগ! প্রিয়তমার মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা আদায় করে নেওয়া যাবে! একমুহূর্তও দেরী না করে বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,’বুঝি! বুঝি আমি সবই বুঝি! ভাবটা তুমি শুধুশুধুই নাও।
-‘কচু বুঝেছো তুমি।’
মাছ জালে আটকা পড়েছে ভেবে আশরাফি ভ্রজোড়া দুষ্টুভবে নাচিয়ে বললো,’ঠিক আছে তাহলে তুমিই বলো, আমাকে স্বামী বলে পরিচয় দিলে কেন? কেন আমি কি তোমার স্বামী?’
জবাবে মধু তাঁকে হতাশ করে দিয়ে বললো,’আমার মর্জি!’
-‘কেন? তোমার মর্জি মতন আমাকে কেন চলতে হবে? কে হই আমি তোমার?’
মধু হাসলো। বললো,’চলতে হবে কেন? হুহ! চলতে হবে, মানে হবে। কেন হবে? সেই প্রশ্ন করার অধিকার আমি কাউকে দেই নি! মনে রাখবে আমার সেবাই তোমার কর্তব্য!’
হাল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশরাফি।
এতকিছুর পরেও মধুর মুখ দিয়ে ভালোবাসি শব্দটা বের করতে পারলো না সে। মধু যে সবার চাইতে আলাদা। সর্ব সমুখে আশরাফিকে স্বামী বলে স্বীকার করে নিতে পারবে কিন্তু একা আশরাফিকে ভালোবাসি বলতেই তাঁর যত কষ্ট! তাঁকে ছটফট করাতে পারলেই যেন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়।
কিন্তু এতকিছুর পরেও আশরাফির ক্লান্তি আসে না। এমনি করে আরো হাজারবছর মধুকে ভালোবেসে যেতে পারবে সে। মুচকি হেসে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বললো,’যথা আজ্ঞা!’
মধুও হুকুম করার ভঙ্গিতে বললো,’হ্যাঁ! এবার আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো।’
বোকা ধরণের মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো আশরাফি! ভাবখানা এমন যেন, সে অনেক আশা করে ছিলো শেষমেশ মধু তাঁকে ভালোবাসি বলবে! কিন্তু সেটা হলো না দেখে মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেয়েছে সে! কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে চাইছে না। তাই চুপচাপ গাড়ির পেছনে দরজা খুলে হাত ইশারায় ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিলো মধুকে।
তাঁর কাঁচুমাচু চেহারা দেখে হাসলো মধু। মনে মনে হাজারবার বললো,’ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি! আমি তোমাকে ভালোবাসি! ভীষণ ভালোবাসি!’
কিন্তু মুখে বললো না। কারণ সে চায় আশরাফি এমনি করে সারাজীবন তাঁর মুখ থেকে ভালোবাসি শোনার আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করুক। এমনি করে সারাজীবন তাঁর পেছনে লেগে থাকুক, তাঁকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উতলা হোক! এসব দেখে আনন্দ পায় মধু। ভীষণ আনন্দ পায়! কেউ একজন নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাঁকে চাইছে ভাবতেই আত্মতৃপ্তিতে বুকটা ভরে যায়। অথচ সে জানে না তাকে খুশি করার জন্যই আশরাফির সব জেনেবুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে! তাঁর মুখের হাসি দেখার জন্যই নিজের মনের কথাগুলো সব লুকিয়ে রাখে!
★
দুদিন ধরে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে নীলা। রায়হান সাহেব মেয়ের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তার মেয়েটা কি শেষমেশ পাগল হয়ে যাবে? সারাদিন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে, রাত হলে কি যেন বিড়বিড় করে। গতকাল রাতে অস্ফুট গোঙ্গানির আওয়াজও পেয়েছেন মেয়ের ঘর দেখে । অথচ এসব দেখেও চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না তিনি। নীলা নিজ দায়িত্বে আশরাফিকে সেদিন পালাতে সহযোগিতা করেছিলো। অথচ আশরাফি! নিষ্ঠুর পাষন্ডটা একবারও বুঝলো না কতটা, যন্ত্রণা, কতটা কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে কাজটা করেছে নীলা। শেষমুহুর্ত পর্যন্ত সে আশা করে বসেছিলো আশরাফির হয়ত যাবে না। হয়ত তাকে বিয়ের পোশাকে দেখে মায়ায় পড়ে যাবে! একটা মেয়ে সাধ করে তাঁর জন্য বউ সেজেছে, তাঁকে ছেড়ে যেতে একটু হলেও কষ্ট হবে আশরাফির! কিন্তু না সেসব কিছুই হলো না। আশরাফির তাঁর দুহাতভর্তি ভালোবাসাকে নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত করে বেরিয়ে গেলো। একবার পিছু ফিরে চাইলো না পর্যন্ত! কি নির্মম! কি পাষন্ড!
সে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই মূর্ছা গেলো নীলা। তারপর থেকেই টাকা দুদিন ঘরবন্দি করে রেখেছে নিজেকে। কারোসঙ্গে কথাবার্তা বলছে না। সারাক্ষণ একা একা। রায়হান সাহেব ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না। মেয়েটা অত্যাধিক শোকে যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে। এই ভয়ে রাত জেগে মেয়ের ঘরের সামনে বসে থাকেন তিনি। তার এই একটিমাত্র মেয়ে। এর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারেন তিনি। নীলা যদি সেদিন নিজে আশরাফির পক্ষ না নিতো তবে কারো ক্ষমতা ছিলো রায়হান সাহেবের হাত থেকে আশরাফিকে রক্ষা করে। যে করেই হোক নীলার সঙ্গেই আশরাফির বিয়েটা দিতেন তিনি। কিন্তু মেয়েটা জেনেশুনে, নিজের সর্বনাশ করেছে! এখন আর চাইলেও কিছু করা সম্ভব না।
.
.
.
চলবে