মধুরেণ_সমাপয়েৎ ১১তম_পর্ব

0
1120

মধুরেণ_সমাপয়েৎ
১১তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

দরজা খুলে সিড়িতে যেতেই মনে সে যেনো হাওয়ায় ভাসছে। কিছুক্ষণ করে খেয়াল করে দেখে কেউ তাকে কোলে করে ছাদের সিড়ি বাইছে। রাতের অন্ধকারে লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না আয়াত। ছাদে নিয়ে লোকটি তাকে কোল থেকে নামালে আয়াত দেখতে পায় পুরো ছাদ জোৎস্নায় আলোকিত। ফুলের মিষ্টি গন্ধ, জ্যোৎস্নার মাতাল করা পরিবেশে ভেতরের সত্ত্বাটাও বারংবার উম্মাদনায় মেতে উঠে। আরো মাতাল করে তুলছে পাশে থাকা মানুষটি; মানুষটি যে আর কেউ নয় সাফওয়ান। তার শরীরের মাতাল করা গন্ধটি আয়াতকে জানান দিয়েছে মানুষটি যে সে। জ্যোৎস্নার আলোতে মানুষটিকে একটি জীবন্ত নেশার স্তুপ মনে হচ্ছে; লোকটির সবকিছুতেই মাতাল করে দেবার ক্ষমতা রাখে।
– এমনভাবে হা করে থাকলে মাছি ঢুকে পড়বে তো

সাফওয়ানের কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো আয়াত। প্রচন্ড কাটা ভাষায় বললো,
– রাত বিরাতে মানুষকে ধুমধাম কোলে নিয়ে নিচ্ছেন, কিডন্যাপ করে ছাদে আনছেন; মতলব কি শুনি?
– ইচ্ছে হলো, বলা তো যায় না দেখা যাবে রাতের অন্ধকারে ধুপধাপ করে পড়ে দাঁত ভেঙে ফেলবে। আমি কিন্তু বাবা ফোকলা বউ বিয়ে করবো না।
– বয়েই গেছে আপনাকে বিয়ে করতে আমার।
– চেষ্টা করে দেখো, আমি আটকাবো না। তবে বিয়ে তো আমাকেই করতে হবে।

মুচকি হেসে ছাদের রেলিং এ গিয়ে বসে সাফওয়ান। আয়াতের কাছে আজ যেনো অন্য সাফওয়ান উপস্থিত। লোকটার মাঝে কি এমন আছে যা চুম্বকের ন্যায় আকর্ষন করে তাকে। নীরব রাতে মৃদু হাওয়ায় জ্যোৎস্না বিলাস বুঝি এমনই হয়। নীরবতা ভেঙে আয়াত বলে উঠে,
– সাফওয়ান ভাই, সেদিন বলেছিলেন

কথাটি শেষ হতে না হতেই হ্যাচকা টানে আয়াতকে নিজের কাছে নিয়ে আছে সাফওয়ান। ঠোঁটে হাত দিয়ে বলে,
– হুশ, বড্ড বেশী কথা বল। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছো? রাতের নীরবতার সাক্ষ্ণী দিচ্ছে তারা। আজ যদি একটু বেহায়া হই, তুমি কি রাগ করবে?

সাফওয়ানের দিকে একরাশ বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে আছে আয়াত। আজ তার চোখে নেশা কাজ করছে; এ যেনো অন্য সাফওয়ান। সাফওয়ানের চোখে তাকাতেও ভয় হচ্ছে তার, এ চোখে যে হাজারো ভালোবাসা, মায়া, প্রণয়ের নেশা। আয়াতকে ভাসিয়ে তলিয়ে দিতে সক্ষম এই চোখের ঘোর। সাফওয়ানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে সে কারো কাছে টেনে নেয় তাকে। কানে মুখ লাগিয়ে ধীর নেশা কন্ঠে বলে,
– একটা গোপন কথা আছে শুনবে?

সাফওয়ানের চোখে চোখ রেখে ঘোরের মধ্যে উত্তর দেয় আয়াত,
– বলুন

আরো নেশাযুক্ত কন্ঠে বলে উঠে সাফওয়ান,
– এই বেহায়া আমি যে তোমার প্রেমে পড়ে গেছি গো। কখন, কিভাবে জানি না; তবে আমার প্রেম প্রেম জেগেছে। বিয়ের পর হয়তো ভালোবাসাটাও হয়ে যাবে।
– আপনি জানেন তো কি বলছেন?
– জানতাম না, এখন জানি।
– আমার যে আর প্রেমের উপর ভরসা হয় না সাফওয়ান ভাই, আমি যে বড্ড এলোমেলো হয়ে রয়েছি। আমার এলোমেলো জীবনকে সাজিয়ে দিতে পারবেন কি? আমি আপনার জীবনে কি মেল খাই?
– জীবন তো তোমার যেমন এলোমেলো আমারও যে একই রকম। একে অপরেরটা নাহয় সাজালাম। এবার তোমায় ভালোবাসতে হবে না, শুধু আমায় ভালোবাসার অধিকারটা দিও।

বলে চোখের সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। আজ সাফওয়ানের চোখে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আয়াতের। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে লোকটিকে। জ্যোৎস্নার আলোতে আয়াতে মুখখানি একটুকরো চাদের ফালি লাগছে সাফওয়ানের কাছে, যার চোখে, ঠোঁটে আফিমের চেয়েও মারাত্নক নেশা। দু হাতে আলতো করে মুখটি ধরে নিজের আরো কাছে নিয়ে আসে, আয়াতের কাঁপাকাপা ঠোঁট যেনো আরো ঘোরের মাঝে ফেলে দিচ্ছে তাকে। আজ একটু বেহায়া হতে কি খুব দোষ হবে! দুই ওষ্ঠযুগলের মাঝের দূরুত্ব মিটিয়ে নিজের পিপাসা মিটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাফওয়ান। নিজের ঠোঁটের উপর আরেক জোড়া উত্তপ্ত ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে অজানা আবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলে আয়াত। অজান্তেই হাতজোড়া সাফওয়ানকে আকড়ে ধরে। অজান্তেই চোখ বেয়ে নোনাজলের আগমণ ঘটে। আজকের রাত্রি যেনো সাফওয়ান এবং তার অনুভূতিগুলোর মিশ্রণের সাক্ষ্ণী।

কিছুসময় পর সাফওয়ানের ঠোঁট তার ঠোঁট জোড়াকে ছেড়ে দিলে আয়াতের হুশ ফিরে। এতোক্ষণ যেনো একটি ঘোরে মাঝে ছিলো সে, ঘোর কেটে যেতেই আবারো হাজারো প্রশ্নের ভিড় জমে আয়াতের মনে। আবেশের বশে ভুল করছে নাতো সে? এক মূহুর্ত দেরি না করে দৌড়ে বেরিয়ে যায় সে। সাফওয়ান হতভম্ব চোখে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।

দুদিন পর,
সকাল ১১টা,
হলুদের অনুষ্ঠান ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত হবার পর এখন অপেক্ষা কালকের বিয়ের। এই দুইদিন আয়াত না পারতে সাফওয়ানের সামনে আসে নি। সাফওয়ান হাজারোবার তার সামনে যাবার চেষ্টা করছে কিন্তু তাতে লাভ হয় নি। অনুতাপ এবং একরাশ অভিমানে ভেতরটা তীব্র আগুনে দদ্ধ হচ্ছে সাফওয়ানের। তবে কি আয়াত এখনো ইফাদকেই ভালোবাসে। এখনো সে ইফাদের অপেক্ষায় আছে? তবে সাফওয়ানের ভালোবাসার সামান্যতম মূল্যটি তার কাছে নেই? প্রণয়ের ডাকে সাফওয়ানের হুশ ফিরে,
– তোকে বড়মা, নিচে যেতে বলছে তো।
– এখন কেনো?
– আরে কে জানে এসেছে তোকে খুজছে। যা না
– আচ্ছা, বেশি বকিশ না।

নিচে যেতেই দেখে সেলিনা বেগমের সাথে হাসি মুখে একটি ছেলে কথা বলছে। ছেলেটির পিট তার দিকে, তাই মুখটি দেখতে পাচ্ছে না। সাফওয়ান নিচে নামতেই সেলিনা বেগম বলে উঠেন,
– সাফওয়ান চলে এসেছে

ছেলেটি পেছন ফিরতেই আকাশটা ভেঙ্গে পড়ে সাফওয়ানের। সামনে দাঁড়ানো শ্যাম বর্ণের, লম্বা, চিপচিপে গড়নের ছেলেটি যে আর কেউ নয় ইফাদ। মুচকি হেসে টিটকারির ছলে বলে উঠে,
– বিয়ে করছিস দাওয়াত ও দিলি সাফওয়ান, এই বুঝি আমাদের বন্ধুত্ব।

বেলা ১২টা,
মুখোমুখি বসে আছে আয়াত এবং ইফাদ। আজ দুই সপ্তাহ পর ইফাদকে দেখছে সে, একরাশ ঘৃণা আয়াতের চোখে ফুটে উঠেছে। কোথায় ছিলো সে যখন সারারাত কাজী অফিসের বাহিরে এক কাপড়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে? কোথায় ছিলো সে যখন পুলিশের থানায় জেলে যাবার ভয়ে মিথ্যে বলতে হচ্ছিলো? কোথায় ছিলো সে যখন বাবা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো, থাকার জায়গা নিয়ে চিন্তা করতে হতো তাকে। এখন যখন মনটাকে স্থির করে ফেলেছে, এখন কেনো তার আগমণ ঘটলো?
– আয়াত, তুমি নাকি আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না? তা এখন কি করছো, দুই সপ্তাহে ভালোবাসা উবে গেলো? আরে বাবা একটা জমির কাজে ইমিডিয়েটলি সিলেটে বাবার সাথে যেতে হয় আমাকে। মোবাইল হারিয়ে যাওয়ার জন্য কন্ট্যাক্ট করতে পারছিলাম না, তাড়াহুড়ো করে ফিরে এসেছি তোমার জন্য। এসে শুনছি সাফওয়ানের গলায় ঝুলে গেছো তুমি। এই তোমার লয়ালিটি? এই তোমার ভালোবাসা?
– মুখ সামলে কথা বলো ইফাদ, এতোদিন পর আমি কেমন আছি না জিজ্ঞেস করে তুমি আমার কাছে জবাবদিহিতা চাইছো?
– কি সামলাবো? আমার জিএফ আমার বন্ধুকে কাল বিয়ে করতে যাচ্ছে আর আমি কিনা এখানে তোমার সাথে প্রেমালাপ করবো? আচ্ছা কেমন আছো?
– তুমি কি আদৌও জানো এতোদিন আমরা কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম? তুমি কি আদৌ জানো আমি তোমাকে খুজতে তোমার বাসা অবধি পর্যন্ত গিয়েছিলাম? ইসরাতকে পাগলের মতো ফোন করেছি, তোমার বন্ধুদের। যে চোর ফোন চুরি করেছে সে হসপিটালে ভর্তি ছিলো, তাকে তুমি ভেবে দৌড়ে গিয়েছি। এখন তুমি কিনা আমার লয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন করছো? কি রাইট আছে তোমার। আমি লয়াল নই, রাস্তার মেয়ে, যে কিনা যখন যে পুরুষ পাই তার গলায় ঝুলে পড়ি।

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো আয়াত। ইফাদ তখন আয়াতকে জড়িয়ে ধরে শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো,
– জানো তো কতোটা ভালোবাসি তোমায়, সাফওয়ান যদিও আমাকে সব বলেছে তবুও তোমাদের বিয়ের কথাটা শুনে পাগল পাগল লাগছিলো। সরি বাবু, আর হবে না সরি।

এই দৃশ্যটি একজনের চোখ এড়ালো না। সেদিন রাতের উত্তর আজ তার কাছে পরিষ্কার। শুধু দুজন প্রেমিক প্রমিকার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কি লাভ। সাফওয়ান আর দাঁড়িয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

বিয়ের দিন,
সন্ধ্যা ৭টা,
বর বেশে স্টেজে বসে র‍্যেছে সাফওয়ান। ইফাদ বিয়েতে উপস্থিত, কিন্তু কালকের দুপুরের পর আর সাফওয়ান তার সামনে যায় নি। বুকের ব্যাথাগুলো তীব্র হয়ে যাচ্ছে তাকে দেখলে। কাজী সাহেব তার কাছে বিয়ের সব কথা বলে জিজ্ঞেস করে,
– আপনি কি এই বিয়েতে রাজী, রাজী থাকলে বলুন কবুল

তখন…………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here