মধুরেণ_সমাপয়েৎ ২য়_পর্ব

0
867

মধুরেণ_সমাপয়েৎ
২য়_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

পুলিশেরা তাদের কাছে এসেই একজন সাফওয়ানের ঘাড় চেপে ধরলো। আরেকজন রুক্ষ ফ্যানফ্যানে গলায় বললো,
– রাত বাজে ১১.৪৫, এই রাতে এমনে ঘুরতেছো কেন? নষ্টামির জায়গা পাও না, না?? দুইটা ডান্ডা খাইলে সব পিরিতি বাইর হইয়ে যাবে।
– আপনারা আমার কথা বুঝার ট্রাই করেন, আসলে হয়েছে কি…(সাফওয়ান)
– চুপ, আব্দুল এগোরে এখনই থানায় নিতে হইবো।

থানার কথা শুনেই আয়াতের হাত পা ঠান্ডা হতে লাগলো। হড়হড় করে বলতে লাগলো,
– থানায় কেনো? আমরা তো বাসার দিকে যাচ্ছি। ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলাম; রিক্সা না পাওয়ায় দেরি হয়ে গিয়েছে। ট্রাস্ট আস আমরা কোনো নষ্টামি করতেছি না।
– ওই মাইয়া, তুমি রাত ১১.৪৫টায় বিয়ার শাড়ি পইড়া ঘুরতে বাইর হইছো?
– না মানে…
– আচ্ছা আমাদের ছেড়ে দেবার জন্য মালপানি কতো নিবেন?(সাফওয়ান)
– দেখছোস শফিক, আমাদের ঘুষ দেয়, কত্তোবড় সাহস! এইবার এগোরে থানায় নিতেই হইবো চল।

রাত ১২.১৫টা,
থানায় ইন্সপেক্টরের সামনে বসে আছে সাফওয়ান এবং আয়াত। একটু পর পর অগ্নিদৃষ্টি দিচ্ছে আয়াত সাফওয়ানকে। তখন ওয়াকি টকিতে কথা বলে ওদের থানায় নিয়ে আসে কন্সটেবল শফিক এবং আব্দুল। ইন্সপেক্টর মেহরাব হাতের তর্জনি দিয়ে টেবিলে ক্রমাগত টকটক শব্দ করে যাচ্ছেন সাথে একবার আয়াতের দিকে আর একবার সাফওয়ানের দিকে তাকাচ্ছেন। গলা ঝেড়ে এবার বললেন,
– কেস কি? এতো রাতে বাইরে কি করছিলেন আপনারা?
– স্যার নষ্টামি করতেছিলো, বললাম না হাতে নাতে ধরছি উপরে ঘুষ দেবার চায়!(আব্দুল)
– তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি আব্দুল?? না তো, একটু ঠান্ডা থাকো। হুম বলে মি.
– জ্বী সাফওয়ান, সাফওয়ান ইসলাম। আসলে হয়েছে কি……
– আমরা পালিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কাজী অফিস বন্ধ থাকায় বিয়ে করতে পারি নি। (আয়াত)

আয়াতের কথা শুনে হতবাক হয়ে আয়াতের দিকে তাকায় সাফওয়ান। এই মেয়ে তাকে একটা ঝামেলায় ফেলবে। অবশ্য এটা নতুন না, এর আগেও মেয়েটা এভাবেই ঝামেলায় ফেলেছে। আয়াতের হাতে চিমটি কাটতেই আয়াত উহ করে চেঁচিয়ে উঠে,
– উফ, উনারা পুলিশ, উনাদের কাছে লুকিয়ে লাভ নেই। উনারা আমাদের হেল্প করতে পারবে। আসলে হয়েছে কি স্যার, আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসি কিন্তু আমার বাবা ওর প্রফেশন আর গরিবীর জন্য ওকে মেনে নেন নি। আজ আমাকে একটা বলদের সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো। তাই আমি পালিয়ে আসি। আমার বাবাকে চিনবেন রামিম রহমান, রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল। আমি তার একমাত্র মেয়ে। সাফওয়ান তো অনেক গরীব তাই বাবা ওর সাথে আমার বিয়ে দিবেন না। এই যে দেখুন আমার ভোটার আইডি সব আছে, আমরা আজই বিয়ে করতাম।

সাফওয়ান হা করে আয়াতের অভিনয় দেখে যাচ্ছে। জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী অভিনেত্রীর মতো অভিনয় করছে মেয়েটি, কি নিপুন ভাবে কাঁদছে। ইন্সপেক্টর সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তাহলে আপনি কন্সটেবলদের ঘুষ কেনো দিতে চেয়েছেন?
– উনারা আমার কোনো কথা শুনতেই রাজী ছিলেন না। আর সত্যি বলতে এতো রাতে, আমরা অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। উপরে আমাদের বিয়ে হয় নি। একটা কনে কে বিয়ে থেকে পালিয়ে নিয়ে এসেছি। আই থিংক ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি খুবই সতর্ক নাগরিক, আয়াত না থাকলে আমি এমনটা কোনোদিন করতাম না।
– আচ্ছা আচ্ছা, আপনাদের নাম, ঠিকানা দিয়ে যান। আমি কন্ট্যাক্ট করবো। আর যদি এটা প্রমাণ হয় যে আপনারা মিথ্যা বলছেন তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।
– কোথায় লিখবো?(আয়াত)
– আব্দুল, উনাদের সব ঠিকানা নিয়ে বাড়ি পৌছে দাও, এই রাতে ট্রান্সপোর্ট পাবেন না। আর সাফওয়ান সাহেব আপনার অফিসের ঠিকানাটাও দিয়ে যাবেন। যদি এই রাতে কাজী পাওয়া যেত আমি নিজেই আপনার বিয়ে দিয়ে দিতাম।

নিজের মাথা চাপরাতে ইচ্ছে করছে সাফওয়ানের, এই আয়াতের জন্য কি এক ঝামেলায় না পড়লো। মিথ্যে তো বলে দিলো কিন্তু এখন এই মিথ্যে ধরা পড়লে যে কি ঝামেলা পোহাতে হবে আল্লাহ জানে। উপরে রামিম রহমানের মেয়ে, তিনি একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার; শহরে উনার চেনা জানার শেষ নেই। এক রাতে তার জীবনে এতোটা উতার চড়াই এর মুখোমুখি হতে হবে কে জানতো! আর এদিকে ইফাদের ফোন এখনো বন্ধ। ইফাদ কেয়ারলেস, কিন্তু এতোটা যে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্যের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে এখন নিজে লাপাত্তা। কাধে ভারী ভারী অনুভব হলে পাশে তাকিয়ে দেখে আয়াত তার কাধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে, সারাদিন কম ধকল তো যায় নি। রাতের আলো আঁধার খেলায় আয়াতের মুখটা কোনো শিল্পকর্ম থেকে কম লাগছে না। খুব যত্নে নিপুন শিল্পকর্ম। এলোকেশি, চন্দ্রমার ন্যায় মুখখানা, উপরে গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় ঠোঁটখানা যে কাউকে আকর্ষন করবে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষনীয় ঠোঁটের নিচে ছোট তিলটি, যেন নজর ফোঁটা। অজান্তেই আপন মনে তাকিয়ে রয়েছে সাফওয়ান তার দিকে। কন্সটেবল আব্দুল জোরে ব্রেক কষলে সাফওয়ানের হুশ ফিরে, নিজের কাজে নিজেরই বিরক্ত লেগে গেলো। কি করছিলো সে, আয়াত ইফাদের আমানত, যতই সুন্দরী হোক না কেনো তার প্রতি অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেওয়াই পাপ। নিজেকে নিজে শান্ত করার জন্য মনে মনে বলতে লাগলো,

– আয়াত একটা চালতা ফিরতা ঝামেলা, ওর মধ্যে ভালো লাগার কিছুই নেই। মনে নেই, একবার তোর এক্সিবিশন ওর জন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। ওর জন্য আজকে তোর থানায় যেতে হইছে। সাফওয়ান, ওকে ইফাদের হাতে তুলে দিলেই তোর কাজ শেষ; সো নো মোহিত হওয়া হওয়ি। তুই একজন আর্টিস্ট তাই তোর ওকে দেখে ভালো লেগেছে এটাই। আর কিচ্ছু না।

পানের পিকটা ফেলে আব্দুল বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
– এখানে বইসে রাত কাঁটাইবেন?? নাকি যাইবেন ও। আইয়া পড়ছে আপনার বাসা।
– ধন্যবাদ। এই আয়াত, এই আয়াত উঠো। বাসা এসে গেছে।

আয়াতকে নাড়াচড়া দেয়ার পর অবশেষে বিরক্তি এবং ঘুমঘুম গলায় বলে উঠে,
– কি হইছে, আরেকটু ঘুমাইতে দেও। তুমিও ঘুমাও
– ধুর, উঠো না। বাসা চলে আসছে তো।

কে শুনে কার কথা আয়াত তো বেঘোরে ঘুম। উপায়ন্তর না পেয়ে আয়াতকে কোলে করে নিয়ে উঠা লাগলো সাফওয়ানের। দোয়া পড়তে পড়তে পাঁচতলায় উঠলো সে, বাড়িওয়ালা দেখলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। যদিও ঘড়ির কাঁটা ২ টার ঘরে এসে পড়েছে। তবুও বলা যায় না, ওই লোকের ভরসা নেই। কোনোমতে আয়াতকে নিচে বসিয়ে দরজার লক খুলে সে। একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে পাঁচতলা উঠা চারটে খানি কথা না, যদিও আয়াতের ওজন তুলার মতো তাও। আয়াতকে বেডে শুইয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো সাফওয়ান। আজকে দিনটা খুব ধকলের ছিলো। দুপুরের পর থেকে খাবারের কনাও পেটে পড়ে নি। কালকে সকাল ৮টায় অফিস আছে, এখন না ঘুমালে কালকে জম্বি হয়ে যেতে হবে। ফ্রেশ হয়ে একটা নীল থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর কালো টিশার্ট পড়ে নিলো সাফওয়ান। আয়াত বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, ওর উপর হাতি হাটলেও টের পাবে কিনা সন্দেহ। অবশ্য মেয়েটিও না খাওয়া। অনেকবার সেধেছিলো সাফওয়ান কিন্তু খায় নি। ওর উপর কতোটা প্রেসার যাচ্ছে, সেটা না বললেও বুঝতে বাকি নেই সাফওয়ানের। চঞ্চল মেয়েটি নিজের কষ্টগুলো হাসির মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। বাবা-মাকে না বলে ভালোবাসার খাতিরে ছুটে এসেছে কিন্তু সেই ভালোবাসাও কথা রাখে নি।

রুমে একবিন্দু জায়গা নেই শোয়ার, সাফওয়ানের পেন্টিং আর ক্যানভাসে ফ্লোর ভর্তি। শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে এখন এগুলো গুছানো একটা এভারেস্ট অভিযানের কাজ হবে, তাই উপায়ন্তর না পেয়ে ছাদে চলে যায় সে। আজ রাত নির্ঘুমই কাটবে, বোঝা যাচ্ছে। বেনসন ধরিয়ে বাহিরে নজর দিলো সে, খারাপ স্বভাবের এই একটাই আছে তার; সিগারেট খাওয়া। নিকোটিন সব খারাপের মধ্যে একটি ভালো কাজ ও করে তা হলো স্নায়ু শান্ত করে। আর আর্টিস্ট মানুষদের এটা খুব দরকার। সাফওয়ানের জীবনটা খুব এলোমেলো, আয়াত যেন এই এলোমেলো জীবনে আরো ঝড় এনে দিয়েছে। আর্টিস্ট হবার ঘর ছেড়ে শহরে আসে সে। কিন্তু অভাবের শহরে শখের দাম নেই। পড়াশুনায় ভালো হওয়ায় একটা সতেরো হাজারের চাকরি ম্যানেজ তো হয়ে গেছে। কিন্তু সতেরো হাজারে ঢাকা শহরে কি হয়! সকাল আটটা থেকে রাত সাতটা অবধি চাকরি করে এসে রাতে নিজের কল্পনার দুনিয়াতে তুলি ঘোরায় সে। দুই তিনটা আর্ট গ্যালারিতে আঁকাও দিয়েছে, তাতে বেশি একটা লাভ হয় নি। একবার তো এক্সিবিশন ও পেয়েছিলো কিন্তু ঐ আয়াতের জন্য সব আর্টগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে মেয়েটাকে সাফওয়ানের সহ্য হয় না। অতীতের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কখন সকাল হয়ে গেছে খেয়াল ই নেই সাফওয়ানের।

সকাল ৬টা,
রুমের দিকে হাটা দেয় সাফওয়ান। চিলেকোঠা আর ছাদ পাশাপাশি, একটা দরজা দিয়েই ঢোকা যায়। দরজাটা খুলতেই মূহুর্তে শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল রক্ত বয়ে গেলো সাফওয়ানের। ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো সে। অয়ায়াত তখন……………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here