মধুরেণ_সমাপয়েৎ
৩য়_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
দরজাটা খুলতেই মূহুর্তে শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল রক্ত বয়ে গেলো সাফওয়ানের। ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো সে। আয়াত তখন বেঘোরে ঘুম; শাড়ি এলোমেলো, আঁচলের কোনো হদিস নেই, সাদা ধবধবে পেটটা উন্মুক্ত। মেয়েটা এতো কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারে, ঘুমে কারো শাড়ি এতোটা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে! দরজাটা আটকিয়ে পুনরায় ছাদে চলে এসেছে সাফওয়ান। চোখ বন্ধ করলে এখনোও আয়াতের প্রতিচ্ছবি ভাসছে, এই প্রথম কোনো নারীকে এতোটা কাছ থেকে দেখেছে সে। এতো সুন্দর নারীও হতে পারে? যেনো ভাস্করের নিপুন হস্তের শিল্পকর্ম। মাঝে মাঝে ছেলেদের পক্ষেও নিজেকে আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে। আর সবথেকে আকর্ষনীয় ছিলো নাভির পাশের গাঢ় তিলটি, যেকোনো ছেলের মাথা ঘুরানোর জন্য সেটা যথেষ্ট। ছাদের পানির নলটি ছেড়ে মাথা ঢুকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো সাফওয়ান। একেই সকাল, উপরে কালকে রাতে বেশ শিশির পড়েছিলো, পানিটা বেশ ঠান্ডা। এখন এই ঠান্ডা পানি থ্যারাপি ই তাকে কুচিন্তা থেকে রক্ষা দিতে পারবে। বেশকিছুক্ষণ পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাতটা বাজতে চলেছে। মাথা ভেজানোর কারণে অর্ধেক শরীর এমনিতেই ভিজে গেছে। এবার ভেতরে যেতেই হবে, এখন না বের হলে অফিসের লেট হয়ে যাবে। মিনিট বিশেক জোরে জোরে কড়া নাড়লে আয়াতের সাড়া পায় সে। বেশ দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– আঁচলটা ঠিক করো, আমি ভেতরে আসছি।
সকাল সকাল এমনিতেই ঝটলা পেকে থাকে আয়াতের মাথা, উপরে মনে হচ্ছে মাথায় কেউ হ্যামার দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তবলা বাজিয়েছে। আশেপাশের দৃশ্য দেখে হাবলার মতো বেশকিছুক্ষণ বসে ছিলো সে। কাল রাতে পুলিশের গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো; তারপর কিছু মনে নেই তার। চোখটা চারিদিকে ঘুরালে খেয়াল করে পুরানো একটি স্টোর রুমের মতো ঘরের চৌকির মতো বেডে বসে আছে সে, রুমের দেয়ালের রঙ খসে গেছে; লাস্ট হয়তো তিন বছরর একবার ও রং করা হয় নি। তারমানে এটা সাফওয়ানের চিলেকোটার রুম। এবার ধীরে ধীরে বাস্তবে ফিরে আয়াত; বুঝতে পারে রাতে সাফওয়ান এখানেই তাকে নিয়ে এসেছিলো। রুমটা খুব ছোট; এক পাশে একটা থার্ড হ্যান্ড স্টিলের আলমারি, তার পাশে একটা কম দামী ছোট্ট টেবিল তাতে রঙ, তুলি, স্কেচবুক এলোমেলো করে পড়ে রয়েছে। ঘরে দক্ষিণ দিকে বেশ বড় জানালা। জানালা দিয়ে আকাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাথে গাড়ির হর্ণ ও শোনা যাচ্ছে মানে বাড়িটা রোডের খুব কাছে। সারা ঘর অগোছালো, কিন্তু নোংরা নয়। ফ্লোরে সাফওয়ানের পেন্টিং এবং ফাঁকা ক্যানভাস ভর্তি। জানালার ঠিক পাশে একটা ঘুন ধরা আলনা আছে তাতে সাফওয়ানের নোংরা কাপড় রাখা। ঘরটা পর্যবেক্ষন শেষ হলে শুনতে পায় সাফওয়ান কড়া নেড়েই যাচ্ছে। সাফওয়ান যখন কথাটা বলে তখন নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই লজ্জা পেয়ে যায় সে। রাতে অস্বস্তির জন্য কখন আঁচল খুলে ফেলেছিলো খেয়াল ই নেই তার। কোনো মতে শাড়িটি দিয়ে নিজেকে পেঁচিয়ে সাফওয়ানকে ভেতরে আসতে বলে সে। সাফওয়ান একবার ও আয়াতের দিকে না তাকিয়েই আলমারির কাছে চলে যায়। শার্ট, প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমে ছুট লাগানোর সময় পিছন থেকে আয়াত ডাকলে বাধ্য হয়ে আয়াতের দিকে তাকায় সে,
– আমাকে আপনার একটা টিশার্ট দিবেন? আমার কাছে পড়ার মতো কোনো জামা নেই শাড়ি বাদে।
– আলমারি খোলাই আছে, নিয়ে নিও। আমার লেট হচ্ছে।
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে ধাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো সাফওয়ান। এলোমেলো চুল, ঘুম ঘুম চাহনি আর লাল হয়ে থাকা গাল দেখে কয়েকবার হার্টবিট মিস হয়েছে সাফওয়ানের। এই মেয়েকে খুব দ্রুত ইফাদের হাতে তুলে দিতে হবে। নয়তো পাগল হয়ে যাবে সাফওয়ান।
সকাল ১১টা,
আয়াত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, মনটা তার ভালো নেই। তানির কাছে সকালে ফোন দিয়েছিলো। তানির কাছ থেকে জানতে পারে রামিম সাহেব তাকে অনেক কথা শুনিয়েছেন। তিনি তানির সামনেই বলে দিয়েছেন,
– আয়াতকে সামনে পেলে এর শেষ দেখে নিবো
আয়াতের মা শারমিন বেগমের শরীরটা নাকি ভালো নেই। মেয়ে নিখোঁজ দেখে প্রেসার লো হয়ে দু-তিন বার অজ্ঞাব হয়েছেন। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে, কিন্তু নিজের কর্মফল যে নিজেকে ভোগ করতে হচ্ছে। ইফাদের আশায় ঘর ছেড়ে আসার সময় একবার ও কল্পনা করে করে নি আজ ভালোবাসার শাস্তি এভাবে পেতে হবে তাকে। ইফাদের ফোন এখনো বন্ধ, ইফাদের কিছু বন্ধু-বান্ধবদের নাম্বার সাফওয়ানের কাছ থেকে নিয়ে রেখেছিলো। তারা কেউ জানে না ইফাদ কোথায়!
– আচ্ছা ইফাদের কোনো বিপদ হয় নি তো? বাবা ওর কোনো ক্ষতি করে নাই তো? ধুর আর ভাবতে পারছি না। একবার ইশরাতের সাথে কথা বলতে পারলে হয়তো জানতে পারতাম কিন্তু ওর নাম্বারটাও বন্ধ। উফফ এই ভাই বোন নিজের ফোনটা কেনো বন্ধ করে রেখেছে। আমি এখন কি করবো? তানির বাসায় যেতে পারবো না; বাবা তানির বাসার সামনে পাহাড়া লাগিয়েছে। সাফওয়ান ভাইকে জ্বালানোর কোনো মানে হয় না। কিন্তু কোথায় যাবো আমি?
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে যাচ্ছে আয়াত। সামনে যে ডেড এন্ড; যাওয়ার পথটুকু খুঁজে পাচ্ছে না। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা চোখে নোনা জলের আবির্ভাব ঘটাচ্ছে বারংবার। সাফওয়ান মাঝে এক বার ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে যে সে খেয়েছে কিনা। সে বন্ধু হিসেবে তার দায়িত্বের অধিক পালন করে যাচ্ছে। আর অসহায়ের মতো আয়াত তার সাহায্য নিয়ে যাচ্ছে। চোখ মুছে দৃঢ় পরিকল্পনা করলো সে। এবার কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে আয়াতের, খুব কঠোর। সোজা ইফাদের বাড়ি যেয়ে উঠবে সে। তাতে তার পরিবারের লোকেরা রাগ করলেও কিছু করার নেই। তারপর ইফাদকে মুখের উপর জিজ্ঞেস করবে সে কি তাকে বিয়ে করবে কি না। এই পরিকল্পনা আজকের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু হাতে টাকা নেই; ইফাদদের বাসায় যেতে হলেও ৬০০-৭০০ টাকা লাগবে সি.এন.জি তে। সেই টাকাটা হাতে নেই। সাফওয়ান আসলে তাকে পরিকল্পনার কথাটি জানাতে হবে। পাশের দোকান থেকে পরোটা, ডাল দিয়ে গেছে সাফওয়ান। ডাল ঠান্ডা হয়ে গেছে আর পরোটা শক্ত। কিন্তু পেটের ইঁদুরদের এইটা দিয়েই শান্ত করতে হবে। যে মেয়ে সামান্য ঠান্ডা পানি আঙ্গুলে ছোয়াতে পারে না আজ সে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছে। ব্রেড জ্যাম আর ব্লাক কফি ব্যাতিত যার নাস্তা হয় না, আজ তৈলাক্ত চুপচুপে পরোটা আর ঠান্ডা পানির মতো ডাল খেতে হচ্ছে। জীবন কতোকিছু শিখায়!!
বিকেল ৫টা,
সারাদিন শুধু সাফওয়ানের পেন্টিং দেখেই দিন কেটেছে আয়াতের। ইফাদের ম্যাসেঞ্জার, ওয়াটস অ্যাপে ভয়েজ ম্যাসেজ দিয়েছে বেশ কিছু কিন্তু লাভ হয় নি। কেঁদে কেঁদে মাথা ধরে আসলে ছাদের রাখা সাফওয়ানের ছোট স্টবে প্রথম কফি বানানোর ট্রাই করেছে; ফলাফল হাতে দু তিনটা ফোস্কা পড়েছে। কিন্তু কফি সে বানানো শিখে গেছে। সাফওয়ানকে অনেকবার বলেছে তার পোর্ট্রেইট ড্র করতে; কিন্তু লোকটা মুখের উপর বলে দিয়েছে তার চেহারা ক্যানভাসে তোলার যোগ্য নয়। কফি হাতে জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে যখন ব্যস্ত আয়াত তখন ক্রমাগত দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। দরজা খুলতেই হুরমুড় করে একটি মেয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে, মেয়েটির হাতে একটি পিয়াজুর বাটি। এভাবে ঘরে ঢুকে পড়ায় অবাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় আয়াত। মেয়েটি উচ্চতায় আয়াতের সমান, গোলগাল মুখ, চুল একপাশে বেনুনি করা। দেখে মনে হচ্ছে কলেজে পড়ে। মেয়েটি আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে আয়াতের দিকে নজর দেয়। চোখে একরাশ কৌতুহল আর অপছন্দের আভা নিয়ে মাথা থেকে পা অবধি চোখ বুলায় সে। আয়াত তখন সাফওয়ানের একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়েছিলো; টিশার্ট টা বেশ বড়, গলাটা বেশ নেমে যাচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই, বিয়ের শাড়ি, আর জিন্স বাদে পরিধানের কোনো কাপড় তার নেই। কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে মেয়েটি আয়াতকে,
– কে তুমি? সাফওয়ান ভাইয়ার জাম পরে আছো কেনো?
– আ……আমি
– কি আমি আমি? কি হলো বলো?
– তোমাকে বলবো কেনো? আগে তুমি বলো তুমি কে?
– আমি মায়া, এই বাড়ি আমার বাবার। তুমি কে? বলো নয়তো বাবাকে বলে দিবো।
– আমি সাফওয়ানের স্ত্রী।
এই মূহুর্তে মাথা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায় আয়াতের। দুম করে মনে যা এসেছে তাই বলে দেয় সে। মেয়েটি প্রথমে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, পরে কান্না কান্না মুখ করে দৌড়ে চলে যায় রুম থেকে। ঘটনার আকর্ষিকতায় কিছুই মাথায় ঢুকছে না আয়াতের। মেয়েটি ঝড়ের গতিতে এলো আবার টর্নেডোর গতিতে চলে গেলো। হচ্ছে টা কি!!
রাত ৮টা,
আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে সাফওয়ানের। না জানি আয়াত একা একা কি করছে? সকালের পর থেকে কথাই হয় নি। প্রথমে ভেবেছিলো দরজা বাহিরের থেকে আটকে যাবে পরে ভাবলো অজান্তে বিপদ আসলে আয়াত বের হতে পারবে না। আর মোটা ষাড় উপরে আসবে না রাতের আগে, সে জানে সাফওয়ানের অফিস টাইম। কিন্তু মায়াকে নিয়ে একটু চিন্তা থেকে যায় মেয়েটি ধুমধাম চলে আসে। রাস্তায় আসার পথে কিছু কম দামী থ্রিপিস, লেডিস গেঞ্জি আর রাতের খাবার কিনে বাড়ির দিকে রওনা দেয় সাফওয়ান। বাড়িতে এসে সিড়িঘর থেকেই খুব সোরগোল শুনা যাচ্ছে। ভালো করে খেয়াল করলে বুঝতে পারে শব্দগুলো তার রুম থেকেই আসছে। দ্রুত পাঁচ তলায় এসে দেখে দরজা হা করে খোলা। ভেতরে যেয়ে যেনো মাথার উপর বাজ ভেংগে পড়ে সাফওয়ানের। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখে…………
চলবে