মধুরেণ_সমাপয়েৎ
৫ম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
বেশকিছুক্ষণ বাজার পর কেউ ফোনটি রিসিভ করে। আয়াত হ্যালো বলতেই শুনতে পায় একজন মহিলা কন্ঠ। অপরপাশের মানুষটি বলে,
– হ্যালো, কাকে চান?
– আমি আয়াত, আপনি কে বলছেন?
– আপনি কি প্যাশেন্টের কেউ হোন?
– প্যাশেন্ট মানে?
কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে আয়াত, তখন অপরপাশ থেকে শুনতে পায়,
– আমি মেডিক্যাল হাসপাতাল থেকে বলছি, মোবাইলটি প্যাশেন্টের সাথে পাওয়া গেছে কিন্তু উনার যা অবস্থা তাই আমি ই মোবাইলটা আমার কাছে রেখেছি।
– প্যাশেন্ট বলতে? কি হয়েছে ওর?
– উনি একটা ছোট এক্সিডেন্ট করেছেন; দুটো বোন ফ্রাকচার হয়েছে। আজ দুদিন হয়েছে উনি এখানে এডমিট, উনার সাথে কোনো আত্নীয় বা পরিবারের কেউ আসেন নি। আমি আজকে মোবাইলটা অন করলাম যাতে কেউ ফোন করলে জানাতে পারি।
– এটা কোন মেডিক্যাল?
– ঢাকা মেডিক্যাল
– ও ভালো আছে তো?
– হ্যা, টেনশনের কোনো কারণ নেই, এক মাসের মধ্যে নরমাল হয়ে যাবে।
– ঠিক আছে,ও কি ঘুমোচ্ছে?
– হ্যা। উনার তো রেস্ট দরকার।
– বেশ, আমি কাল সকালেই আসবো আপনি ফোনটা রিসিভ করবেন প্লিজ।
– আচ্ছা।
ফোনটা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে, যেটার ভয় পাচ্ছিলো ঠিক সেটাই হয়েছে। ইফাদ এতো বড় একটা বিপদে ছিলো। আর সে কিনা জানতোই না। কি ভুলটাই না বুঝেছিলো। সকাল হতেই ঢাকা মেডিক্যালে যেতে হবে নয়তো সত্যি দেরি হয়ে যাবে। সারারাত দুশ্চিন্তাতেই কাটিয়ে দিলো, ঘুম যে টুকু এসেছিলো তাও পালিয়ে গেছে, না জানি ইফাদকে কি অবস্থায় দেখবে।
সকাল ৫টা,
আযানের সাথে সাথেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো সাফওয়ানের। চোখ খুলতে বেডের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো আয়াত নেই। এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসলো, আশেপাশে চোখ ফিরিয়ে দেখলো না মেয়েটি নেই। ব্যাতিব্যস্ত হয়ে খুজতে লাগলে দেখতে পেলো, দরজার ফাঁক দিয়ে নীল শাড়ির আচল দেখা যাচ্ছে। তারমানে আয়াত ছাদে রয়েছে, মেয়েটি কি তবে রাতে ঘুমোয় নি? ধীর পায়ে ছাদের দিকে এগিয়ে গেলে দেখতে পায় বিষন্ন চিত্তে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আয়াত। সূর্যের প্রথম কিরণে দীপ্তময়ী মুখটা যেনো বুকে যেয়ে লাগার ক্ষমতা রাখে, চুলগুলো হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে আপন মনে উড়ছে। গ্রিক গোডেস Aphrodite কেও হার মানাবে এই মানবীর সৌন্দর্য। নিজেকে সামলে গলা খাকাড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– সারারাত কি চোর পাহারা দিচ্ছিলে?
– ইফাদ হাসপাতালে।
– কিহ!!!
– কাল রাতে ওর ফোনে ফোন দিয়েছিলাম।
ভারাক্রান্ত গলায় রাতের নার্সের সাথে কথোপকথন সম্পূর্ণ বিস্তার ভাবে বললো সাফওয়াকে। চিন্তায় ভ্রু কুচকে আসে সাফওয়ানের। তাহলে ইফাদকে ভুল বুঝেছিলো এই দু দিন? আয়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– ৭টার মধ্যে রেডি হয়ে নাও, মেডিকেলে যেতে আধা ঘন্টা লাগবে জ্যাম এ না পড়লে। মুখটা ভালো করে ধুয়ে নিও। এরকম জম্বি লুক দেখলে ভয় পাবে ইফাদ
– সাফওয়ান ভাই
আয়াত চেঁচিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো সাফওয়ানকে।
সকাল ৮টা,
জেনারেল ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আয়াত এবং সাফওয়ান। নার্স এই রুমের পথ দেখিয়ে চলে গেছেন। বেড নাম্বার ১৩ এর সামনে দাঁড়িয়ে আসে তারা। ইফাদ তখন কাঁথা মুরি দিয়ে শুয়ে আছে।
পিঠের দিক থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না। চোখে পানি নিয়ে আস্তে করে পাশে বসে ইফাদের। কাথা না সরিয়ে বলতে লাগলো,
– তুমি এতোটা কেয়ারলেস কেনো? তোমার কিছু হলে আমার কি হতো? কখনো কি আমার কথা ভাববে না? আমাদের তো সেদিন বিয়ে করার কথা ছিলো। জানো আমি লাল বেনারসি পড়ছিলাম। ঠিক তুমি যেমনটা পছন্দ করো তেমন ভাবে সেজেছিলাম অথচ দেখো কি হয়ে গেলো! কথা বলবে না আমার সাথে? ওগো
আয়াতের কথাগুলো শুনে অজান্তেই বুকের বা পাশে তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূত হতে লাগলো সাফওয়ানের। এমন তো হবার কথা ছিলো না, তাহলে কেনো এমনটা হচ্ছে? দ্বিধা দন্দে জর্জরিত সাফওয়ান ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেলো, দম বন্ধ লাগছিলো ওই মূহুর্তে তার।
অপরদিকে, কথাবার্তা শেষে আয়াতের আকুতি মিনুতিতে পাশে শোয়া লোকটির ঘুম ভেঙে যায়, কাঁথাটা সরিয়ে বলে,
– ওগো কবে বিয়ে করবে আমায়?
কাঁথা সরানোর পর রীতিমত শক খায় আয়াত। চিকন, ছিপছিপে বডির একটি লোক সেখানে শুয়ে আছে। মুখভর্তি দাঁড়ি, চোখের নিচের কাঁটা ঘা যেনো তার কুকামের সাক্ষী দিচ্ছে।
– কে আপনি?
– আমি শওকত
– ইফাদ কোথায় তাহলে?
– আমি কি জানি?
– একমিনিট, নার্স, নার্স। কোথায় আপনি?
নার্স দৌড়ে এলে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে?
– এটা আমার ইফাদ না?ইফাদ কোথায়?
– মানে?
– মানে যার ফোন দিয়ে আপনার সাথে আমার কথা হয় উনি কোথায়?
– ইনি ই তিনি, ইনার কাছেই আমি ফোনটা পেয়েছি।
– আর ইউ শিওর?
– হ্যা।
এবার তেড়ে এসে শওকতের কলার চেপে জিজ্ঞেস করে আয়াত,
– এই ফোন আপনার কাছে কিভাবে এলো? বলেন, নয়তো পুলিশে দেবো।
ওয়ার্ডের ভেতরে সোরগোলে সাফওয়ান দৌড়ে ভেতরে যায়। সেখানে যেয়ে দেখতে পায় আয়াত রীতিমত একটা রোগা পটকা লোককে গলা ধরে ঝাকাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আয়াতকে সেখান থেকে সরিয়ে আনে সাফওয়ান। নয়তো দেখা যেতো লোকটা ওখানেই অক্কা পেতে হতো।
সকাল ৯.৩০
একটা নাস্তার দোকানে মুখোমুখি বসে নাস্তা করছে সাফওয়ান এবং আয়াত। কারো মুখে কোনো কথা নেই, সাফওয়ান আপন মনে পরোটা, ডাল খেয়ে যাচ্ছে। আর আয়াত শুধু পরোটা নাড়াচড়া করছে। শওকত মোবাইলটা সিএনজিতে করে ইফাদের মিরপুর থেকে উত্তরা যাবার পথে পকেট থেকে চামেচুমে চুরি করে নেয়। অনেক আকুতি করে ইফাদের সাথে একই সিএনজিতে উঠেছিলো সে। ইফাদ নেমে যাবার পর ভেবেছিলো চোরাই বাজারে বিক্রি করলে ভালো দাম পাবে, কিন্তু সেটা হবার আগেই রাস্তা পার হতে গিয়ে বাইকের নিচে চাপা পড়ে হাড় ভেঙ্গে মেডিক্যালে ভর্তি হয়। কাহিনী শুনার পর থেকে মুখটা শূকিয়ে গেছে আয়াতের। তারমানে ইফাদ তার বাসার দিকে যাচ্ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো ইফাদ মিরপুর এসেও কেনো আবার তার বাসার দিকে রওনা দিয়েছিলো। এই দুইদিন সে একবার ও খোঁজ ও নেয় নি আয়াতের। সাফওয়ান বেশকিছুক্ষণ ধরে আয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, শুকনো ফ্যাকাসে মুখটা দেখতে একদম ভালো লাগছে না তার। হুট করে একজনকে ফোন করে জানিয়ে দিলো,
– ভাই আজকে শরীরটা ভালো নেই, আজ অফিসে আসতে পারবো না। খুব জ্বর। একা মানুষ কেউ দেখাশোনার ও নেই।
-……………
– আচ্ছা, আচ্ছা। রাখি।
ফোনটা রেখেই আয়াতকে বললো,
– বাসে চড়তে পারো?
– কেনো?
অবাক হয়ে আয়াত প্রশ্ন করলে উত্তরে সাফওয়ান বলে,
– উত্তরা যাবো, হাতে দুশো টাকা আছে। এসি বাসে নিতাম, কিন্তু আবার ফেরত বাসায় যেতে হবে তো। তাই বলছি, যাবে খাটাড়া বাসে?
– হুম, চলুন। আমার কোনো সমস্যা নেই।
উৎসাহিত হয়ে বললো আয়াত। যেই ভাবা সেই কাজ, বিল দিয়ে মোড়ে যেয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর বাস আসলো। ধাক্কাধাক্কি করে কোনোমতে একটা সিট যোগাড় করে দিলো আয়াতকে সাফওয়ান। গন্তব্য এখন ইফাদের বাসা।
বিকেল ৫টা,
বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছে আয়াত এবং সাফওয়ান। আয়াতের চোখ থেকে না চাইতেও পানি পড়ছে। সাফওয়ান যাতে না দেখে তাই লুকিয়ে অন্যদিকে ফিরে পানিফেলছে সে। প্রথমে ইফাদের বাড়ি গিয়েছিলো, বাড়িতে তালা মারা। আশেপাশের লোকেরা জানে না তার কোথায়, গতকাল সকালে নাকি ফুল ফ্যামিলি ব্যাগ বস্তা বেধে চলে গিয়েছে। প্রথমে অনেকবার ইসরাতকে ফোন করার চেষ্টা চালিয়ে কিন্তু ফলাফল শূন্য। তারপর সাফওয়ান তাকে বলে বাড়ি ফিরে যেতে। খুব সাহস করে শারমিন বেগমকে ফোন লাগায় সে। কিন্তু ভাগ্য এতোটাই খারাপ ফোনটা রামিম সাহেব ধরেন,
– হ্যালো কে বলছেন?
– ব…বাবা আমি আয়াত
– আপনি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন, আমি আয়াত নামের কাউকে চিনি না
– প্লিজ, বাবা কথাটা শোনো, প্লিজ
– ………
– হ্যালো, হ্যালো বাবা, হ্যালো
রামিম সাহেব ঠাস করে ফোন কেটে দেন, এখন আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে পুনোরায় রওনা দিচ্ছে সাফওয়ানের চিলেকোঠায়।
সিড়ি বেয়ে উঠতেই সাফওয়ানের পা আটকে যায়। নিজের ঘরের দরজার সামনে আজাদ সাহেবের সাথে একজন মহিলা আর পুরুষকে দেখে মাথা যেনো ফাঁকা হয়ে যায়। সাফওয়ানকে থেমে যেতে দেখে আয়াত ও অবাক হয়। আজাদ সাহেব তাদেরকে সিড়িতে দেখেই বলে উঠেন,
– ওই যে সাফওয়ান আর বৌমা চলে এসেছে।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারী তখন……………
চলবে