মধুরেণ_সমাপয়েৎ
৬ষ্ঠ_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
আজাদ সাহেব তাদেরকে সিড়িতে দেখেই বলে উঠেন,
– ওই যে সাফওয়ান আর বৌমা চলে এসেছে।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারী তখন এগিয়ে এসে সাফওয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঠাস করে সাফওয়ানের গালে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় এবং বলে,
– এতো বড় হয়ে গেছো যে বাড়িতে না জানিয়ে বিয়ে অবধি করে ফেলছো? বাহ!! এটা তোমার থেকে আশা করি নি সাফওয়ান। ইচ্ছে করছে
– সোহাগ থামো, কি করছো? ওর ওয়াইফ পাশে। আমরা ভেতরে যেয়ে কথা বলি। চলো
পুরুষটি মহিলাটিকে কোনোমতে শান্ত করে থামালো। অবস্থা বেগতিক দেখে আজাদ সাহেব ও দাঁড়ালেন না। সাফওয়ান একটা ঢোক গিলে বললো,
– আপা ভেতরে যায়ে কথা বলি প্লিজ?
– কথা বলার মতো কোনো পরিস্থিতি রাখছো? তাই তো বলি এক সপ্তাহ হয়ে গেছে বাসায় পা রাখো না কেনো তুমি?
– প্লিজ, দুলাভাই বোঝান না
– সোহাগ ভেতরে চলো, আমরা ভেতরে যেয়ে কথা বলি। প্লিজ, সিন ক্রিয়েট করো না।
বিকেল ৬টা,
মুখোমুখি বসে রয়েছে আয়াত এবং সোহাগ। সাফওয়ানের মুখে সব শুনে ভ্রু কুচকে তাকালো আয়াতের দিকে। আয়াত মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
– এই মেয়েটাকে নিজের বাড়ি কোন আক্কেলে রাখলি তুই?? প্রবলেম হয়েছে আমাকে বলতে পারতি। আমার বাসায় থাকতো। এমন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে বিনা বিয়েতে একরুমে থাকাটা কি খুব ভালো দেখায়?
– আপা, পরিস্থিতি এমন ছিলো যে তোমাকে জানানোর সময় পায় নি। এখন রাত ১.৩০টায় তোমার বাড়িতে ওকে নিয়ে কিভাবে যেতাম বলো। উপর থেকে প্রতিদিন নতুন ঝামেলা।
– কিন্তু তুমি তো অবুঝ নও সাফওয়ান! একটা মেয়ে তোমার বাড়িতে আছে, ওকে তো ওর বাড়ি ফিরতে হবে। তখন লোকে নানা কথা বলবে। তখন সেটা হ্যান্ডেল কিভাবে করবে? আর ইফাদের খোঁজ ও তো জানো না।
– সোহাগ, শান্ত হও
– রবিন একটা কথাও বলবা না, ওকে প্রশ্রয় দিতে দিতে এই অবস্থা করেছো তোমরা। তুমি আর মার প্রশ্রয়ে ও আজকে ঘর ছেড়েছে।
সোহাগ, সাফওয়ানের বড় বোন। সাফওয়ানের থেকে ৪ বছরের বড় সে। ছোটখাটো গোলগাল মানুষটি সবদিকে ঠিক থাকলেও মাথাটা খানিকটা গরম। হাতের তুরির সাথে সাথে মাথাটা তার গরম হয়ে যায় তার। রবিনের সাথে বিয়েটা হয়েছিলো আজ থেকে ছয় বছর আগে। এখনো বাচ্চা হয় নি তাদের৷ রবিন খুবই শান্তশিষ্ট একজন পুরুষ। সোহাগকে অসম্ভব ভালোবাসে সে। কিন্তু সোহাগের রাগকে প্রচুর ভয় পায়। সাফওয়ান অনেক চেষ্টা করেও যখন সোহাগকে থামাতে পারছেনা তখন আয়াত শান্ত এবং ধরা গলায় বলে,
– আপা, আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমার এক বান্ধবীর বাসায় থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা তাকে এতোটা অপমান করেছে যে সে আমার সাথে কথাও বলতে চাচ্ছে না। বাবাকে ফোন করলে বাবা ফোন কেটে দিচ্ছেন। আপা আমি কি করবো বলুন? আমার কাছে টাকাও নেই। কোনো হোটেলে থাকার মতো।
– ইফাদ এতোটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারে। একটা মেয়ের ইমোশন নিয়ে এভাবে খেলার আগে ওর একবার বিবেকে বাধলো না।
– আপা শান্ত হও, বিপি বাড়িয়ে ফেলবে তো (সাফওয়ান)
– রাখ তোর বিপি, মেয়েটার মুখ দেখেছিস। ইশ বেচারি। শোনো আয়াত তোমার এই বোন আছে, তুমি কিচ্ছু চিন্তা করো না। কে বলেছে তোমার কেউ নেই, তুমি আমাদের সাথে খুলনা যাবে। সেখান থেকে আসার পর আমি নিজে আংকেলের সাথে কথা বলবো।
না চাইতেই আয়াতের চোখ ভিজে আসে৷ নিজের কোনো ভাই বোন না থাকার কারণে বড় বোনের কমতিটা সবসময় খলতো আয়াতের কাছে। আজ যেন সেই জায়গাটা পূরণ হয়েছে সোহাগের জন্য। জড়িয়ে ধরে সোহাগকে। তাদের এই মধুর মিলন দেখে সাফওয়ান এবং রবিন হতবাক। এই না সোহাগ মাথা গরম করে অস্থির করে ফেলছিলো সবাইকে। অথচ এখন আবহাওয়া কি শীতল কি মধুর।
রাত ১০টা,
নিজ হাতে আজ রান্নাবান্না করেছে সোহাগ। তাকে সাহায্য করেছে আয়াত। খাওয়া দাওয়া শেষে লুডু খেলার তাল তুললো রবিন। রবিন খুব মজার মানুষ। আয়াতের সাথে খুব ভাব হয়েছে তার। লুডু খেলার তাল তুলায় আয়াত ও নেচে উঠে। তারা যখন লুডু খেলায় ব্যস্ত তখন সাফওয়ান আর সোহাগ ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। সাফওয়ান সোহাগকে জিজ্ঞেস করে,
– আপা, তুমি আমার চিলেকোঠায় ভুলেও পা রাখো না, আজ কি মনে করে?
– সুহানার বিয়ে করেছে বাবা।
– কবে বিয়ে?
– সামনের সপ্তাহে। মা খুব কান্না করছিলো। বলেছে তোকে না নিয়ে যাতে বাড়ি না ফিরি। আমাদের একমাত্র ভাই তুই, ওর বিয়েতে তুই থাকবি না না কিভাবে হয়।
– বাবা কি বলেছে?
– তার শেষ কথাছিলো, এখন কি আমার সাফওয়ানের পা ধরতে হবে আমার মেয়ের বিয়েতে আনানোর জন্য?
– বুঝলাম, কবে যাচ্ছি?
– কাল বিকেলের বাসে। ভাগ্যিস টিকিট কাটিনি, নয়তো আয়াতের জন্য টিকিট কাটতে সমস্যা হয়ে যেত।
– আয়াত ও যাবে নাকি?
– ওকে কোথায় রেখে যাবি?
– বাবাকে হ্যান্ডেল করতে পারবে তো।
– সেটা আমি বুঝে নিবো। এখন চল ওখানে যেয়ে দেখি কি করছে ওরা।
সারারাত লুডু, আড্ডাতে কাটলো তাদের। কয়েক মূহুর্তের জন্য সকল চিন্তা যেন উবে গিয়েছিলো আয়াতের। ছোটবেলা থেকে ঢাকা থেকে বের হয় নি সে। যখন খুলনা যাবার তাল উঠেছে সেও একপায়ে রাজী খুলনা যাবে তাই। সাফওয়ান শুধু ফাঁকতালে আয়াতকেই দেখছে। মুক্তোর মতো হাসিটা তীর্যক তীরের মতো বুকে যেয়ে লাগছে। সাফওয়ানের মুগ্ধ চাহনি সোহাগে চোখ এড়ালো না।
পরদিন বিকেল ৫.৩০টা,
অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় এসেছে। একটা ব্যাগ কিনে এসেছে আয়াতের জন্য যাতে সেটায় আয়াতের জামাকাপড় গুছাতে পারে। আজাদ সাহেবকে বলে ৪টার দিকে গাবতলির দিকে রওনা দেয় তারা। জ্যাম কম থাকায় দেড় ঘন্টায় পৌছেও যায়। বিকেল ৬টার বাস, সোহাগরা অনেক আগেই এসে পড়েছে। বাসে উঠে প্রথম গোল লাগলো কিভাবে বসবে! সোহাগদের পুরো পরিবার যাচ্ছে, শ্বশুর-শাশুড়ি, সোহাগের দুই দেবর, তাদের ওয়াইফ এবং বাচ্চারা। রবিনের বাসার সবাই জানে, আয়াত সুহানার বান্ধবী। ভাগ্যক্রমে আয়াত আর সাফওয়ান পাশাপাশি বসলো। সোহাগ যদিও বারবার আয়াতের পাশে বসতে চাইছিলো কিন্তু রবিন জিদ করায় সেটি আর হয়ে উঠলো না। কেনো জানে আজ বারংবার চাচ্ছিলো যাতে আয়াতের পাশেই যেন সে বসতে পারে। আজকাল মেয়েটিকে বড্ড বেশি ভালো লাগতে শুরু করেছে। আগেও যে এমনটা হতো না তা নয়। কিন্তু আগে যতবার এই খেয়াল মাথায় এনেছে, ততবার বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে নিজের সুপ্ত আশাকে ধামাচাপা দিয়ে দিতো। কিন্তু আজকাল বেহায়া মনটাকে নিয়ে যেন একদম পেড়ে উঠছে না।
রাত ১২টা,
ফেরির জন্য দাঁড়িয়ে আছে বাসটি। বিগত দুই ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, এখনো সিরিয়াল পায় নি। এদিকে বাসের সবাই ঘুমে বিভর। বাসের হালকা ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আয়াতের। একটা সুন্দর মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছে, কানে কিছু বিট হবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখে সে সাফওয়ানের বুকের উপর ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে রয়েছে। সাফওয়ানের হার্টবিটের শব্দ স্পষ্ট শুনছে, যখনই সাফওয়ানের কাছে আসে এই মাতাল করা মিষ্টি গন্ধটা সে পায়। হয়তো তার পার্ফিউমের গন্ধ। লোকটাকে কোনোকালে সহ্য হতো না আয়াতের, অথচ আজ এই লোকটাই বড্ড ভরসার জায়গা। এই লোকটা না থাকলে, আজ কোথায় থাকতো কে জানে? আস্তে করে উঠে যেতে নিলে সাফওয়ানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কিছু লাগবে?
– উহু
– তাহলে?
– ঘুম ভেঙ্গে গেছে, ফেরিতে উঠবে হয়তো বাস। আর কতোক্ষণ?
– সকালের মধ্যে পৌছে যাব
– ওহ
– ঘুমিয়ে পড়ো
– হুম
বলেই চোখ বন্ধ করে নিলো; বেশকিছুক্ষণ পর ঘুমের সাগরে তলিয়ে পড়লো আয়াত।
সকাল ১১টা,
সাফওয়ানের বাড়ির সামনে সবাই। রীতিমতো মুখ হা হয়ে আছে আয়াতের। বিশাল বাংলো টাইপ দো তালা বাড়ি। খুলনার নামকড়া চাল ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর ছেলে সাফওয়ান। আয়াতের হা করা মুখটি বন্ধ করে দিয়ে সাফওয়ান বলে,
– মুখখোলা রাখলে মাছি ঢুকে যাবে।
– আপনি তো বলেছেন, আপনার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তাহলে এসব কি?
– আমি তো বলি নি আমার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, বলেছি আমার আর্থিক অবস্থা তো ভালো নয়। এসব বাবার, আমার নয়।
– ভাগ্যিস আপনার সাথে বাবার কোনোদিন যোগাযোগ হয় নি। মাথায় করে রাখতো আপনাকে।
– তাই বুঝি? তাহলে শ্বশুর আব্বাকে বলে সত্যি সত্যি বিয়েটা সেড়ে নেই?
বলেই টিপ্পনী কেটে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভেতরের দিকে রওনা দিলো সাফওয়ান। ভেতরে যেতে না যেতেই একটি মেয়ে দৌড়ে এসে সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। ঘটনার আকর্ষিকতায় সবাই অবাক হয়ে গেলো। মেয়েটি তখন সাফওয়ানকে ছেড়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে…….
চলবে