মধুরেণ_সমাপয়েৎ
৭ম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
ভেতরে যেতে না যেতেই একটি মেয়ে দৌড়ে এসে সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। ঘটনার আকর্ষিকতায় সবাই অবাক হয়ে গেলো। মেয়েটি তখন সাফওয়ানকে ছেড়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– তোমাকে কত মিস করেছি জানো ? একটা যোগাযোগ করলে কি হতো?
– অন্না, তুই বড় হয়েছিস। এখন তুই আর বাচ্চা নেই। সবাই দেখতেছে।
– তো? বিয়ে ত করলে তোমাকেই করবো তাই না? কে দেখছে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
– তোর মত মেয়েকে আমি বিয়ে করবো কে বলেছে তোকে?
– মানে? আমার মতো মেয়ে মানে?
– আমি না বাল্যবিবাহের পক্ষপাতী না, এখন ছাড় আমাকে। আর একবার ধারে কাছে আসবি ত দেখিস কি করি।
বলেই অন্নার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সাফওয়ান। মেয়েটা এক নাম্বারের চিপকু। সম্পর্কে তার ফুফাতো বোন। এখনও কলেজের গন্ডি পার হয় নি অথচ বিয়ে স্বপ্ন বুনছে। অন্নার এমন সাফওয়ানের সাথে ঢলাঢলি আয়াতের বিরক্ত লাগছে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। সুহানার সাথে সোহাগ আয়াতের পরিচয় করিয়ে দিলো। সুহানাকে সব খুলে বলতেই এক লাফে বলে উঠলো,
– সত্যি করে বলতো আপু তুমি সত্যি সত্যি দাদাকে পছন্দ করো না?
– মানে?
– মানে দেখো আমার দাদাভাইটা ফুল একটা প্যাকেজ, ইনকাম কম কিন্তু মানুষটা ভালো। একটু রাগী কিন্তু ভালো শিল্পী। দেখতেও খারাপ না। তোমার সাথে কিন্তু খারাপ মানাবে না। আমি বলি কি ইফাদ ভাইকে ছেড়ে দাদাভাইকে বিয়ে করে নেও। এই দুই দিনে কি আমার ভাইটাকে একটু ও ভালো লাগে নি?
– সাফওয়ান ভাই আর আমি?? অসম্ভব। আমার জীবনে ইফাদ না থাকলেও উনি আর আমি সম্ভব ই না। সারাটাক্ষন উনার সাথে আমার ছত্রিশের আকড়া লেগে থাকে। জানো একবার শখ করে বলেছিলাম আমার একটা ছবি একে দিতে। সে বলে কিনা আমার ছবি ক্যানভাসে তোলার অযোগ্য।
– ধুর, ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
আয়াতের এখানে বেশ লাগছে। সাফওয়ানদের একান্নবর্তী পরিবার। লোকে লোকে ভরপুর। সাফওয়ানের মা সেলিনা বেগম খুবই নরম কিসামের মহিলা। এত আদুরে মানুষ ও হয় তাকে না দেখতে ,মনেই হতো না। আসার পর থেকে আয়াতের যত্নে কোনো কমতি রাখেন নি। সাফওয়ানের বাবার সাথে এখনো পরিচয় হয় নি। সাফওয়ানের দিদুন এখনো বেঁচে আছেন, হোসনেয়ারা বেগম। প্রচন্ড দাপটে মহিলা, সোহাগ আর তার স্বভাব পুরো এক। এছাড়া সাফওয়ানের দুই চাচা এবং এক ফুপু ও এখানেই থাকেন। সাফওয়ানের ফুপু নিপা বেগম বিধবা, অন্না খুব ছোট থাকতেই তার বাবা মারা যায় তখন থেকে নিপা বেগম এবং অন্না এখানে থাকেন। নিপা বেগম প্রচুর খিটখিটে স্বভাবের একজন সারাক্ষন সবার কিছু না কিছু ভুল ধরবেই সে। সাফওয়ানের চাচীরা এক এক জন এক এক রকম। একজন সারাক্ষন রান্নাঘরে দিন কাটায় তো আরেকজন ড্রেসিং টেবিলের সামনে। সাফওয়ানের অন্না বাদেও চার জন কাজিন ও রয়েছে, সব স্টুডেন্ট। মোটামুটি একটা বিশাল পরিবার, সবাই নিজাম সাহেবকে জমের মতো ভয় পায়। চার বছর আগে, সাফওয়ানের গ্রাডুয়েশন যখন শেষের পথে তখন নিজাম সাহেবের ইচ্ছা ছিলো সাফওয়ান যাতে ব্যবসার হাল ধরে। কারণ বাড়ির সব ছেলেদের মধ্যে সাফওয়ান ই বড় কিন্তু সাফওয়ানের ইচ্ছে ছিলো আর্টিস্ট হওয়া। ব্যাবসাতে বসে নিজের স্বপ্নকে জ্বলাঞ্জলি দিবে না বিধায় সে সেদিন ঘর ছেড়েছিলো। সুহানা যখন সাফওয়ানের এই বাড়ি ছাড়ার গল্পটি বলছিলো আয়াতকে তখন আয়াতের নজর ছিলো উঠানে বসে আড্ডারত সাফওয়ানের দিকে। লোকটার প্রতি সম্মান যেনো আরো বেড়ে গেলো আয়াতের।
দুদিন পর,
সন্ধ্যা ৭টা,
আজ সুহানার হলুদ। আয়াতের কাছে পড়ার মতো কিছু ছিলো না বলে সোহাগের একটি কাঁচা হলুদ জামদানী শাড়ি তাকে পড়িয়ে দেয় সোহাগ। ঘন কালো চুল গুলো খোঁপা করে তাতে বেলী ফুলের মালা পড়িয়ে দেয়। হালকা সাজে আয়াতকে যেনো সদ্য ফুটোন্ত হলুদ গোলাপ লাগছিলো। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে তাই সব মেয়েরা টেবিল সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। সেলিনা বেগমের হাতে যে অনেক কাজ, এখনো ফলের ডালা সামনে যায় নি। কিন্তু মেয়েগুলোও হয়েছে এমন যে তাদের খুজে পাওয়া ভার। অগত্যা সামনে আয়াতকে পাওয়ায় আয়াতের হাতে ফলের ডালা দিয়ে বললেন,
– মা, এটা একটু স্টেজে রেখে আয় তো।
– আচ্ছা, আন্টি।
– এর পর আমার সাথে এসে একটু হলুদের ডালাও নিতে হবে, দেখ না সব গুলো সাজতে বসছে। যেনো মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় যাবে। তোকে মাশাল্লাহ কি সুন্দর লাগছে না সেজে। তুই আমাকে একটু সাহায্য কর মা। আর বেশি সময় ও নেই।
– আচ্ছা আন্টি। তুমি টেনশন করো না।
বলেই ফলের ডালা হাতে নিয়ে নিলো আয়াত। বলে তো দিয়েছে ডালা নিয়ে যাবে কিন্তু এত ভারী ডালা তার একার পক্ষে নেওয়া অসম্ভব। খুব কষ্টে স্টেজ অবধি নিতে নিতেই যখন ডালা পড়া পরা ভাব ওমনি কেউ এক জন এসে ডালাটি ধরে নেয়। সেই পরিচিত মিষ্টি গন্ধ, মানুষটি আর কেউ না সাফওয়ান। হলুদ পাঞ্জাবী, কালো মুজিব কোর্টে আর সাদা চুড়িদারে তাকে বেশ মানিয়েছে। হাতে কালো ঘড়ি, চুল গুলো কপাল ঢেকে দিয়েছে। যেকোনো মেয়েকে ফ্লাট করার ক্ষমতা রাখে সে। আয়াতের হাত থেকে ডালা নিয়ে নিজেই রেখে দেয় স্টেজের টেবিলে। পরমূহুর্তে বলে,
– যা পারো না, শুধু শুধু ভাব নিয়ে সেটা করার কি আছে?
– আমি তো তাও কাজ করার চেষ্টা তো করছি, আপনার হবু বউ অন্নার মতো আটা ময়দা সুজি ঘষাঘষি তো করছি না।
– এই মুখে মুখে তর্ক করবা না। কোথায় হেল্প করেছি, ধন্যবাদ দিবে তা নয়।
– বেশ করেছি, কিসের হেল্প বলুন তো। সারাক্ষন ঠেস দিয়ে কথা বললে সেটাকে হেল্প বলে না আর যাই বলুক!
– তুমি আস্তো একটা ঝগরুটে।
– এখন আমি তো ঝগরুটে হবোই; আসলে কি বলুন তো আপনার অন্না আছে না?
– এই কি অন্না অন্না লাগিয়েছো, ও আমার ফুফাতো বোন।
– তাই বুঝি! ন্যাকা।
বলেই সেখান থেকে চলে যায় আয়াত। ইচ্ছে করে সাফওয়ানের সাথে বাধালো সে, আসার পর থেকে একবারো আয়াতের খোঁজ নেয় নি সে উপর থেকে যখন তার সাথে কথা বলতে গিয়েছে আয়াত পিছনে লেগেই ছিলো। আর সাফওয়ান তাকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। যদি তার অন্নার প্রতি দরদ ই না থাকে তবে কেনো কিছু বলছে না মেয়েটিকে। মনে মনে হাজারো বকাঝকা করেই যাচ্ছে সাফওয়ানকে। রান্নাঘর থেকে হলুদের ডালাটা নিয়ে না দেখে আপনমনে হাটতে হাটতে কখন যে নিপা বেগমের সাথে ধাক্কা লেগে যায় সেদিকে খেয়ালই নেই আয়াতের। এদিকে ধাক্কা খেয়ে তার হাতে থাকা হলুদের ডালা নিচে পড়ে যায়; সব হলুদ নিচে পড়ে একাকার হয়ে যায় সাথে নিপা বেগমের শাড়িতে খানিকটা হলুদ পড়ে। এমনেই নিপা বেগমের মেজাজ তিরিক্ষি থাকে উপরে উনার শাড়ী নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আরো মেজাজ বিগড়ে যায় তার। ফোসফোস করে বলে উঠেন,
– এই মেয়ে কানা নাকি তুমি? দেখে চলতে পারো না
– সরি আন্টি, আমি সত্যি দেখি নি।
– তোমার জন্য আমার শাড়ী তো নষ্ট হলোই সাথে সব হলুদ নষ্ট হয়ে একাকার অবস্থা। এই মেয়ে তোমার জন্য এখন আমার ভাতিজীর হলুদটা লন্ডফন্ড হয়ে যাবে। অলুক্ষনে মেয়ে
– আন্টি, আমি এখনই হলুদের ব্যবস্থা করতে বলছি।
– হ্যা নিপা, সামান্য হলুদ ই তো। আরো হলুদ আছে রান্নাঘরে। তুমি ড্রেস বদলে নাও, শুধু শুধু সিন বানিয়ো না। হলুদ শুরু হবে। আয়াত তুমি আমার সাথে আসো মা। (সেলিনা বেগম)
– কি বলেন ভাবী, সামান্য হলুদ। এই মেয়ের জন্য আমার এতো সুন্দর শাড়িটা নষ্ট হয়ে গেলো তার বেলায়? তুমি এই মেয়েটার দোষটা দেখছো না, একটা বাহিরের মেয়ের সামনে আমাকে বলছো আমি সিন বাণাচ্ছী?
– আন্টি দোষ আমি করেছি, ক্ষমাও চাচ্ছি। তাহলে কেনো অহেতুক আন্টিকে কথা শুনাচ্ছেন
– মুখে মুখে তর্ক করে যাচ্ছো, এই শিক্ষা দিয়েছে তোমার বাবা-মা এই শিক্ষা দিয়েছে?
বাবা মা তুলে কথা বলার পর আয়াত আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না, যেই কিছু একটা বলতে যাবে অমনি পাশ থেকে সাফওয়ান বলে উঠলো,
– ফুপি, আয়াতের মা-বাবা তাকে শিক্ষা দিয়েছে বিধায় সে এতোক্ষন নিজের দোষ না থাকা সত্ত্বেও তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছে। একে ওর হাতে হলুদের ডালা ছিলো তবুও তুমি ওর সামনে দিয়ে হাটছিলে। ও যদি না দেখে থাকে তুমিও কিন্তু ওকে দেখো নি। তাহলে ওর যদি দোষ থাকে তবে তোমারো আছে। আর আজ সুহানার হলুদ জেনেও তুমি সিন ক্রিয়েট করছো, মা এটা তোমাকে বলার পর তুমি উলটো মাকে কথা শুনাচ্ছো। তাহলে বেশি দোষটা কার বলো?
– আজকাল বাহিরের মেয়ের জন্য আমাকে তোরা কথা শুনাচ্ছিস বেশ আমি থাকবোই না এই হলুদে।
বলেই নিপা বেগম যেতে লাগলে নিজাম সাহেব সেখানে উপস্থিত হয়। নিজাম সাহেবকে সবাই জমের মতো ভয় পায়। উনার এক হুংকার ই সব ঠান্ডা করার জন্য যথেষ্ট। উনাকে দেখে সাফওয়ান আর কথা বাড়ায় না কারণ সে জানে তার কোনো কথা তার বাবার পছন্দ নয়। তখন নিপা বেগম তার কাছে এসে সব বললে সে বলেন…………
চলবে