মনময়ূরী,পর্ব-১
Anamika
সন্ধেবেলা থেকে হৈ-হুল্লোড় লেগে থাকা বাড়িটা এখন স্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। গভীর রাত। প্রায় তিনটা বাজে। সকলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম নেই শুধু এশার চোখে। শুধুমাত্র কালকের দিন। উহু কাল তো আর নেই। রাত ১২টা সেই কবেই পেরিয়ে গেছে। এখন তো বলতে হয় আজ। হ্যা শুধু আজকের দিনটা। আজকের দিনটা সে এই বাড়িতে কাটাবে তারপর অচেনা শহরে কিছু অচেনা মানুষের ভীড়ে কাটাতে হবে তাকে। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো দুএকবার কথা হয়েছে যেই মানুষের সাথে তাকে সারাজীবনের জন্য আপন মেনে নিতে হবে কালই। অদ্ভুত না! যাকে সে চেনে না৷ যার সম্পর্কে শুধু নাম আর কোয়ালিফিকেশন ছাড়া আর কিছুই জানে না তাকে নাকি একটা শব্দের দ্বারা একান্ত কাছের মানুষ বলে মেনে নিতে হবে। হয়তো মেনে নেওয়া সম্ভবও হতো কিন্তু মনে কাউকে রেখে অচেনা আরেক ব্যক্তির সাথে পথ চলা কী খুব সহজ হবে! না। অনেক কঠিন। আর এই কঠিন মুহুর্তে সে একা দাঁড়িয়ে আছে।
এশা যখন পুরোপুরি চিন্তায় ডুবে আছে ঠিক তখন একটা শব্দ কানে ভেসে আসে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সে। একটা সিএনজি এসে থেমেছে ওদের বাড়ির সামনে। জানালা উপরে হওয়ায় নিচে ঠিক বোঝা গেল না কে নামলো। এখন হয়তো কলিং বেল বাজবে। সবাই অনেক ক্লান্ত। এতো এতো ব্যস্ততা বিয়ে বাড়িতে। এখন কলিং বেলের আওয়াজ শুনে তাদের ঘুমটা ভেঙে যাবে। তার’চে বরং সে নিজে গিয়ে গেট খুলে দিয়ে আসুক। যেই ভাবা সেই কাজ। চেয়ারের উপর থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয় এশা। ধীরে গেট খুলে বেরিয়ে আসে যাতে আশেপাশের রুমের কেউ জেগে না যায়। ধীর পায়ে নিচে নেমে এসে দরজার সামনে দাঁড়ায় সে।
সিএনজি থেকে নেমে আগে বাইরে থেকে বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করে নিলো মাহির। কী সুন্দর সাজানো হয়েছে বাড়িটা! তিন বছর। তিন বছর পরে সে দেখছে বাড়িটা। তিন বছর পূর্বে সে এই বাড়ির বাইরে পা রেখেছিল। ঠিক করেছিলো কখনো ফিরবে না। আর এই তিন বছর নিজের কথায় অটল ছিল। এক মাস আগের কথা। ছোট চাচ্চু ভিডিও কলে তার সাথে কথা বলছিল সেই সময় পেছনে খেয়াল করে দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের চেহারা দেখে বুঝে যায় মা আর একটু হলে কেঁদে ফেলবে। আসলে সেদিন মাহিরের কপালে ব্যান্ডেজ লাগানো ছিল। আর সত্যি সত্যি মা কেঁদে ফেলে। মাহির ‘মা’ বলে ডাক দিতেই তার মা সরে যায়।
– মাহির।
– জি চাচ্চু।
– অনেক তো হলো এবার ফিরে আয়।
– কিন্তু চাচ্চু আমি কাজ ছেড়ে আসতে পারবো না।
– পারবি না কেন? তিন বছর কম সময় নয়। এবার লিভ এপ্লিকেশন দিয়েই দেখ না বাপ।
– চেষ্টা করবো চাচ্চু।
– হুম। খেয়াল রাখিস নিজের।
এরপর মায়ের কথা ভেবেই মাহির অফিসে লিভ এপ্লিকেশন দেয়। ছুটি তো পেয়েই গিয়েছিল সে তবে ভিসার ঝামেলায় আসতে পারেনি তখন।
ঝামেলা ক্লিয়ার হতে দুই সপ্তাহ গেল আর তারপর আবারও লিভ এপ্লিকেশন দিলে সেটা এপ্রুভ হলো তিন দিন আগে৷ এরপর সাথে সাথে টিকিট বুক করে গতকাল রাতের ফ্লাইটে দেশে ফেরে সে। যার ফলস্বরূপ এখন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অনেকটা রাত হয়েছে কলিং বেল দেবে নাকি কাউকে ফোন করে বলবে গেট খুলে দিতে। চিন্তায় পড়ে যায় সে। ফোনটা পকেট থেকে বের করে চিন্তা করছিলো কাকে ফোন দেবে এমন সময় গেট খুলে যায়। তাকিয়ে দেখে এশা দাঁড়িয়ে।
– তুই!
– ভেতরে এসে কথা বলো, অনেকটা জার্নি করে এসেছো।
মাহির ভেরতে গেল। এশা গেট লক করে রান্নাঘরের দিকে গেল। কিছুক্ষণ পরে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে মাহিরের সামনে ধরলো। মাহির পানির গ্লাস হাতে না নিয়ে প্রশ্ন করে,
– আমাকে দেখে অবাক হসনি?
– কেন বলো তো!
– আমি যে আসব সেটা তো কাউকেই জানাইনি।
– আগে পানি খাও।
– ওহ, হ্যা দে।
পানির গ্লাস নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে গ্লাসটা টি টেবিলের উপর রাখে মাহির।
– তুই জাগছিলি কেন?
– ঘুম পায়নি তাই।
– ওহ।
মাহির কিছু ভাবছে দেখে এশা বলে,
– তুমি অপেক্ষা করো আমি গিয়ে তোমার ঘরটা ঠিক করে দিয়ে আসি।
– এখন ঠিক করবি! সেকিরে, অনেক সময় লাগবে তো।
– তেমন সময় লাগবে না। বড়’মা তোমার ঘর ক’দিন পরপরই ঠিক করে রাখে।
– আচ্ছা যা। যাওয়ার সময় মা’কে একটু ডেকে দিয়ে যাস তো।
– আমি বলি কী, তুমি এখন রেস্ট নাও। কাল সকালে কথা বলো। এমনিতে বড়মা অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছে। এখন ডাকা ঠিক হবে না।
– আচ্ছা। তুই যা তবে আমি আসছি।
এশা চলে যায় মাহিরের রুমে। মাহিরও কিছুক্ষণ বসে থাকে তারপর যায় নিজের রুমে। যেখানে এশা উপস্থিত। এশা মাহিরকে দেখে বেরিয়ে আসতে নেয় তখন মাহির বলে,
– তোকে অমন দেখাচ্ছে কেন?
– কেমন?
– সামথিং নট রিয়াল।
– বুঝলাম না।
– বুঝে না বোঝার ভান করে থাকাটা কবে থেকে শিখলি?
এশা কিছু বলতে যাবে তখন মাহির বলে,
– ওকে ওয়েট। লেট মি গেস।
কিছুক্ষণ ভাবে মাহির। তারপর বলে,
– প্রেম করলে সবাই একটু আকটু ড্রামা শিখে যায়, কেউ তো আবার ওয়ার্ল্ড বেস্ট ড্রামাবাজ হয়ে ওঠে। কিন্তু তুই দেখছি কিছুই শিখিসনি।
এশা চুপ করে থাকে কিছু বলে না। মাহিরই প্রশ্ন করে,
– ইভান কেমন আছে?
এশার ইভান নামটা শোনার পরে থতমত খেয়ে যায়। কী বলবে এখন!
continued…………