মনময়ূরী,২৫,২৬
Anamika
মাহির একবার ঘড়ির দিকে দেখে নিলো, সময় তো গেছেই অলরেডি আর কিছু মিনিট লেইট হলে মনে হয় না তেমন কোনো সমস্যা হবে। সে নামে গাড়ি থেকে, চালককে অপেক্ষা করতে বলে চার্চের গেইট পার করে ভেতরে প্রবেশ করে সে। একটি মেয়ে পরনে তার সদা ড্রেস, ব্ল্যাক জিন্স আর ব্ল্যাক স্কার্ফ। চুল বাঁধার স্টাইল, পোশাকের ধরন এখনও সেই আগের মতোই আছে দেখে মাহির হাসে। মেয়েটি সেই সময় ছোট্ট দু’টো পরীর সঙ্গে খেলা করছে। পিচ্চি মেয়ে দু’টো দেখতে একই রকম। যমজ তারা, দেখেই বোঝ যায়। কম করে হলেও এদের বয়স পাঁচ বছর তো হবেই। মাহিরের যতদূর মনে আছে ওর সাথে শেষবার চার বছর আগে দেখা হয়েছিল সেই সময় তো তার বিয়েই হয়নি তবে এই বাচ্চারা! মাহির আর ভাবতে চাইলো না, সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছে ডেকে প্রশ্ন করলেই হলো। এমনিতেও হাতে সময় কম। যেতে হবে কাজে, কাজ না থাকলে এই দেশে টেকা মুশকিল। এশা’র ও তো পড়াশোনা বাকি। মাহির আর দেরি না করে করে ডাক দেয় মেয়েটিকে।
-নিহু।
মেয়েটি পেছন ফিরে তাকায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চেহারায় অবাক চাহনি থাকলেও মুহুর্তেই খুশির ঝলক দেখা যায় তার চোখে। মেয়েটি এগিয়ে আসে। মাহিরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
-মাহিইইর, তুইই! সিরিয়াসলি তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস!
-ইয়েস।
-কিন্তু তুই এইখানে? চার বছর মাহির, পুরো চার বছর পরে তোকে দেখলাম। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই? আর এইখানে কী করে!
মাহির হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,
-কুল, বলছি। সব বলছি। এতো প্রশ্ন এক সাথে করলে কোনটা ছেড়ে কোনটার উত্তর দেবো বল তো!
মেয়েটি কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে কেউ ‘নিহা’ বলে ডাক দেয়। মেয়েটি ফিরে তাকায়। প্রশ্ন করে,
-পেয়েছ?
হাতে একটা কাগজ দেখিয়ে বলে,
-হ্যা।
-যাক বাবা বাঁচা গেল।
বলেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দেয় বাইরের পরিবেশে। এরপর মাহিরের দিকে চোখ যায় তার৷ মাহিরের চোখে প্রশ্ন। সে বুঝতে পেরে উত্তর দেয়,
-উনি আমার বড় বোন। স্পৃহা। আসলে ওনার জন্যই এখানে আসা।
-ঠিক বুঝলাম না!
নিহা উত্তর দেবে তার আগেই তার বড় বোন প্রশ্ন করে বসে,
-উনি কে?
-আপি হি ইজ মাহির।
-ওহ, তুমিই মাহির।
-জি আপু৷ আপনার কথা আগেও ওর থেকে শুনেছিলাম তবে দেখা করার সুযোগ হয়নি কখনো।
-সেম হেয়ার। নিহা তোমার ব্যপারে প্রায়ই বলতো। ভেবেছিলাম আমার বিয়েতে আসবে তখন দেখা হয়ে যাবে কিন্তু তুমি আসলেই না।
-ওই সময় একটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই আরকি..
স্পৃহা খেয়াল করেন সেই পিচ্চি মেয়ে দু’টির একটি চার্চের একেবারে ভেতরে চলে যাচ্ছে। সেটা দেখেই তিনি মাহিরের থেকে বিদায় নেন।
-মাফ করো ভাই এই যে আমার মেয়ে দু’টো একেবারে বদমাশ তৈরি হয়েছে বুঝলে। ওই দেখো না কতদূরে ছুটেছে। তোমরা কথা বলো আমি আসছি।
-সমস্যা নেই, এইটাই তো বয়স।
স্পৃহা চলে যেতেই নিহা বলে,
-কিরে বললি না যে এইখানে কী কাজ তোর?
-অফিসের একটা কাজে এই পথ ধরেই যাচ্ছিলাম, তোকে দেখে থেমে গেলাম ব্যস।
-তার মানে তুই এইখানেই সেটেলড! দেশে ফিরে যাসনি আর! হোয়ায়?
-আরে বাবা ফিরবো না কেনো, ফিরেছি বাট ছুটিতে।
বলেই হাসে মাহির। নিহা বলে,
-চুপ কর। তুই ভালো করেই বুঝেছিস আমি কী বলতে চাইছি।
মাহির কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার বসের ফোন আসে। তাড়া দেয় তাকে লোকেশনে পৌছোতে। সেও বেরিয়ে পড়ে। নিহা’কে নিজের কন্ট্যাক্ট নাম্বার আর এড্রেস দিয়ে সে বেরিয়ে যায়৷ পরে কন্ট্যাক্ট করবে, কথাও হবে তখন। কিন্তু এখন লেইট করলে নির্ঘাত চাকরিটা যাবে। নিহাও বিদায় জানালো মাহিরকে। মাহিরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো সে। ঠোঁটের কোণে হাসি, মলিন হাসি। স্পৃহা এসে মাহিরকে চলে যেতে দেখলেন। নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-যেতে দিলি ওকে!
-হুম।
-আগেও একই কাজ করেছিলি বলেই আজ একা তুই।
-উফফফ, তুমিও না। শুরু হয়ে গেলে, চলো তো যাই।
-এড়িয়ে যাস না বোন আমার। কথা শোন আমার। এতো বছর পরে আবারও দেখা হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ লুকিয়ে আছে। হয়তো নিয়তি চায় তোদের এক সুতোয় বেঁধে দিতে।
-ওসব জানি না আমি।
-জানতে হবে না, কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা দিয়েছিস ওকে?
-না।
-কেনো?
-কেনো না ও নিজেরটা দিয়ে গেছে।
স্পৃহা ও নিহা দু’জনেই হাসে। তারাও রওনা দেয়, গন্তব্য হসপিটাল। এখানের বেস্ট কার্ডিওলজিস্ট এর সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছে তাদের।
-তোর কফি।
-থ্যাংকস।
-মাহিরের সাথে কথা বলেছিস?
-না।
-কেনো?
-ও থাক না ওর মতো।
-তুই… দে আমাকে ফোনটা দে দেখি। আমিই কথা বলবো।
-তুমি আবার কী বলবে?
-বিরক্ত হচ্ছিস যে, ভালোর জন্যই বলছি আমি। বিরক্ত হওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
স্পৃহা বলেই যাচ্ছে থামার নাম নেই তার। এইভাবেই চলতে থাকবে নিহা জানে। সে স্পৃহা’কে চুপ করাতেই ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করে৷ স্পৃহার দিকে ফোনটা ধরে তাকে দেখায়, বোঝাতে চায় তার কথা শুনেই সে মাহিরকে কল দিচ্ছে। কয়েকবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হয়। মাহির তখন অফিসে, কাজে ব্যস্ত সে।
-হ্যালো?
-মাহির, আমি বলছি।
-কে?
-নিহা।
নিহার নাম কানে আসতেই মাহির ফোন কান থেকে নামিয়ে একবার স্ক্রিনে দেখে নেয় নাম্বারটা। তারপর বলে,
-ওহ তুই।
-হ্যা আমি। কণ্ঠস্বর ভুলে গিয়েছিস দেখছি।
-তেমনটা নয়, আসলে কাজে ব্যস্ত তাই সেইভাবে খেয়াল করিনি।
-ইট’স ওকে। দেখা করি।
-আজ?
-হ্যা, কোনো সমস্যা?
-আজ তো একটু ব্যস্ত আছি রে।
-আচ্ছা তবে রাখছি।
-ওয়েট, রাতে ফ্রী থাকবি?
-হ্যা, কেনো বলতো?
-রাতে কথা হবে তবে। এখন রাখছি অনেক কাজ।
-আচ্ছা।
মাহির ফোন রেখে কাজে মন দিলো। এদিকে স্পৃহা চাতক পাখির মতো নিহাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। সে জানতে চায় মাহির ঠিক কী বলেছে? নিহা বোনের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বলে,
-রাতে ফোন দেবে বললো। এখন ব্যস্ত আছে।
-আচ্ছা, ঠিক করে কথা বলিস।
-আচ্ছা আপি। এবার তুমি যাও তো।
-হু।
নিহা বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। পৃথিবীর নিয়ম কী অদ্ভুত! কথায় বলে পৃথিবী গোল, চলার পথে যে কোনো পথে ঘুরে ফিরে দেখা হয়েই যায়। নিহাও একসময় অপেক্ষা করতো মাহিরের দেখা পাবে কিন্তু সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেনি কখনো। তাই তো অপেক্ষা করাই ছেড়ে দিয়েছিল সে আর গতকাল হঠাৎই মাহির এসে তার সামনে দাঁড়ালো তাও আবার নিজে থেকে। অদ্ভুত সব খেলা খেলে জীবনটা। যখন পথ চেয়ে বসে থাকা হয় তখন কারো খোঁজ পাওয়া যায় না আবার যেখানে আশা থাকে না সেখানেই ফল মেলে। যেমনটা নিহার সাথে হয়েছে।
মাহির তখন বসে ছিল একা। সে চায়নি বসে থাকতে। একা একা ঘরে বসে থাকতে কারই বা ভালো লাগে? কাজ করতে করতে টায়ার্ড সে তাই একটু রুম থেকে বেরিয়েছিল সে। এই কিছু সময় পূর্বের কথা এটা। ওকে বেরোতে দেখেই এশা দ্রুত এসে পথ আটকে বলে,
-ঘরে যাও।
-কেনো?
-যাও না প্লিজ।
বাচ্চাদের মতো অনুরোধ করতে শুরু করে সে। কী জানি কোন খিঁচুড়ি পাকাচ্ছে সে যে মাহিরকে ড্রয়িংরুমে এলাও করছে না। মাহির নরম স্বরে বলে,
-আমি খুব টায়ার্ড এশা, অনেকটা সময় ঘরে বসেই কাজ করছিলাম এখন একটুখানি বেরিয়েছি প্লিজ আবার ঘরে পাঠাস না আমায়।
-উহু, আমি যা বলেছি তাই করো।
-বললাম তো ঘরে আর ভালো লাগছে না।
-বসে বসে বোর হয়েছ তো!
-হুম।
-এবার যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো।
-তোর মতলব কী বলতো?
এশা দমে যায়, তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-কার মতলব? কীসের মতলব? কোনো মতলব নেই তো। যাও না প্লিইইজ।
-যাবো না।
এক প্রকার জেদের সাথেই কথাটা বলে মাহির তারপর এগিয়ে যেতে চায় সে। এশা তাকে আটকায়, গলা জড়িয়ে ধরে গালে টুপ করে চুমু দিয়ে বলে,
-একটা মাত্র বউ তোমার, তার কথা তুমি এইভাবে ফেলতে পারবে!
-এখন একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছে এশা। সর না বাবা।
-তোমার বাবা বাড়িতে আছে, যাও সেখানে। টিকিট বুক করে দেই?
-প্লিজ বউ, কথা শোনো আমার। দেখলে তো এসে থেকে ঘরে বসে কাজই করে যাচ্ছি, তার উপর বউ আমার চোখের সামনে ছিল না সে আরেক বড় ব্যপার। একা একা বসে থেকে বোরিং কাজ করতে কার ভালো লাগে বলো?
-এই দেখো একেবারে এসব ট্রিক এপ্লাই করবে না বলে দিচ্ছি।
-তা কী করবো?
-কিছু করতে হবে না।
-ওকে। তবে আমি এগোই?
-নায়ায়ায়ায়া…
এশা চেঁচিয়ে ওঠে। মাহির কানে হাত দিয়ে ওর দিকে দেখে। এই মেয়ে মানবে না বোঝা যাচ্ছে। আর তা আরও স্পষ্ট হলো যখন সে বললো,
-তুমি যদি এই মুহুর্তে ঘরে না যাও তবে আমি… আমি.. আমি কী করবো? হ্যা, আমি আজ তোমায় এই ড্রইং রুমে রেখে একাই ঘরে গেট লক করে শোবো।
-এটা অত্যাচার বউ।
-কোনো অত্যাচার নয়। শোনো না প্লিজ।
মাহির এরপর আর কথা বাড়ায়নি সে ঘরেই বসে আছে সেই তখন থেকে। বোর হচ্ছিল সে, আর তখনই নিহার ফোন আসে।
-ব্যস্ত ছিলি? ডিস্টার্ব করলাম না তো?
-না, উল্টো বাঁচিয়ে নিলি আমায়। বোর হচ্ছিলাম একা একা।
-তবে কথা বলা যাবে তাই তো?
-হু, বল।
নিহার কথা শোনা গেল না দেখে মাহির প্রশ্ন করলো,
-আমার এখানে থাকার কারণ তো শুনলি এখন বল তুই এইখানে কী করছিস?
-তোকে খুঁজতে এসেছি।
কথাটা শোনার পরে মাহিরের আওয়াজ আর শোনা গেল না। সে স্তব্ধ।
২৬.
ওপাশ থেকে শব্দ করে হাসির আওয়াজ শোনা গেল। নিহা হাসছে। হো হো করে হাসছে। মাহির অবাক তবে কথা বলে না। নিহাই বলে,
-উফফ, তোর চেহারাটা নিশ্চয়ই দেখার মতো হয়েছে এখন। আই উইশ আমি দেখতে পারতাম। তোর এক্সপ্রেশনটা মিস করে গেলাম রে।
-হয়েছে হয়েছে, এবার বল তো কি হয়েছে?
-কাল তো আমার বোনের মেয়েদের দেখলিই।
-হ্যা, কিউট বাচ্চা দু’টো।
-কে বলবে এই কিউট বাচ্চা দু’টোর একটার প্রাণ সংশয় রয়েছে।
-মানে?
চিন্তিত কণ্ঠ মাহিরের। নিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
-ওইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে তার হার্টে সমস্যা মাহির। জানিস ওদের দেখলেই খুব কষ্ট হয়। বিশেষ করে আপিকে দেখলে। তার চেহারার দিকে মাঝেমধ্যে দেখা যায় না। পাঁচ মাস হয়েছে স্বামী’কে হারিয়েছে আর তারই পর পরেই এই বিষয়টা ধরা পড়ে।
মাহির নিহার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়। তার ঠিক কী বলা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। নিহা বুঝতে পারে তাই বলে,
-অবশ্য ডাক্তাররা বলেছে ওর প্রপার চিকিৎসা করালে সুস্থ হয়ে যাবে তাই তো এই দেশে আসা।
-এতোটা পথ যখন এসেছিস তখন নিরাশ হয়ে ফিরবি না নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ভালো কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছেন।
-হুম।
-খেয়েছিস?
-না, এই তো বাচ্চাদের খাইয়েছি সবে। তোর সাথে কথা বলে তারপর আমিও খেয়ে নেবো।
-ওহ।
কথা আর খুঁজে পেল না মাহির। নিহাও চুপচাপ রয়েছে দেখে মাহির বলে,
-তবে আজ রাখ ফোন। আমি দেখছি কাল পরশুর মধ্যে সময় বের করে তোর সাথে দেখা করছি।
-আচ্ছা।
-শুভ রাত্রি।
-শুভ রাত্রি, ভালো থাকিস।
নিহার সাথে কথা বলে মাহিরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। ফুটফুটে দুটো বাচ্চা মেয়ে। দেখতে একেবারে পুতুলের মতো। প্রথমবার দেখে মনেই হয়নি যে এদের মাঝে একজনের এমন মারাত্মক অবস্থা হতে পারে। এইটুকু বয়সে কত না কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে বাচ্চাটার! আবার তারা বাবাকেও হারিয়েছে মাত্র কয়েক মাস গেছে। এ কেমন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ওদের! ভাবলেই কেমন মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।
এশা যখন রুমে আসে তখন দেখে মাহির বিছানায় পা দু’টো মেলে দিয়ে পেছনে বালিশে পিঠের ভার ছেড়ে দিতে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। আজকাল অনেক ব্যস্ততার মাঝে দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। হয়তো মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে তাই এমন শুয়ে আছে। মাহির এমনই যে ওর যদি কোনো সমস্যাও হয় তবুও মুখ ফুটে কিছু বলবে না কাউকে। আর এই জায়গায় তো এশা একা৷ এখানে তো আরও লুকোবে সে। এশা এগিয়ে গিয়ে মাহিরের কপালের উপর থাকা হাতের উপর হাত রাখে৷ মাহির স্পর্শ টের পেয়ে নিজের হাতটা নামিয়ে নেয়। হাত নামাতেই এশা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মাহিরের কপালে গালে স্পর্শ করে তারপর প্রশ্ন করে,
-শরীর খারাপ লাগছে?
মাহির হাসে, হাসিটা মলিন। এশা আবারও প্রশ্ন করে,
-মাথা ব্যথা? কফি বানিয়ে দেই তোমায়?
মাহির এশার কথা শুনে তার হাতটা ধরে তারপর একটু সরে গিয়ে তাকে পাশে বসিয়ে দেয়। নিজে এশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে যায় আর সেই সময় বলে,
-কিছু আনতে হবে না তোর। তুই শুধু থাক এইখানে। আমার কাছে।
মাহির এশার হাতটা নিজের গালের উপর রাখে। এশা তার অন্য হাতটা দিয়ে মাহিরের চুলগুলো আস্তে আস্তে টেনে দিতে থাকে। এমনটা হওয়ায় বেশ আরাম বোধ করে মাহির। চোখ বুঁজে বলে,
-তুমি কী করে বুঝে যাও আমার কখন কী চায়?
-বুঝি না। এখনও পুরোপুরি বুঝি না তবে চেষ্টা করি বোঝার।
-আচ্ছা কী করছিলে যে আমায় ড্রইংরুমে যেতে দিলে না?
-বলবো রাগ করবে না তো?
-রাগ করার মতো হলে অবশ্যই করবো।
-তাহলে থাক কিছু শুনতে হবে না।
-তুই না বললে এখুনি তোর গলায় কামড়ে দেবো।
-তুমি সবসময় এমন হুমকি দাও কেনো! ভাল্লাগে না।
মাহির হেসে পাশ ফিরে শোয়৷ কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে সে। এশা বলে,
-কেক বানানোর চেষ্টা করছিলাম তখন।
মাহির খুশির ভাব নিয়ে তাকায় এশার দিকে তারপর সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করে,
-সে তো ভালো কথা, রাগের কথা আসছে কেনো? এই তুই কী আকাম করেছিস শুনি?
এশা ঢোক গেলে তারপর উত্তরে বলে,
-কেকটা পুড়ে গেছে।
কান্না কান্না ভাব এসে যায় এশার মাঝে আর সেটা তার কণ্ঠে স্পষ্ট। মাহির রাগ দেখাতে গিয়েও পারে না। কী করে পারবে! বেচারি তো আগেই ভয়ে চুপসে আছে। সে এশা’কে শান্তনা দিতে বলে,
-হয়েছে, কেঁদো না। প্রথম প্রথম এমন মিস্টেক হয়ে যায়। সবার হয়, শুধু তোমার একার হয়েছে এমন নয়।
-কিন্তু আমি তোমায় সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
এশা কাঁদে। মাহিরের সেটা একেবারেই ভালো লাগে না। সে এশার কান্না সহ্য করতে পারে না যে তাই উঠে বসে এশাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তাকে বোঝাতে শুরু করে।
-আমাকেও সাথে নাও না।
-না, সিচুয়েশন তেমন ভালো নয়। এখন গেলে কবে ফিরতে পারবো সেটাও জানি না। তোর তো আবার ফাইনাল এক্সাম শুরু হবে কিছুদিন বাদেই। এইসময় তোকে নিয়ে যাওয়া মানে তোর পড়াশোনার ক্ষতি।
-কিন্তু না নিয়ে গেলেও তো একই হবে বলো। আমি তো চিন্তায় পড়াশোনায় মন দিতেই পারবো না।
-আমি আছি কীসের জন্যে শুনি?
-মানে?
-আমি প্রতি মুহুর্তে তোকে আপডেট দিতে থাকবো।
-কিন্তু….
-কোনো কিন্তু নয় এশা। এমনিতেই ইমার্জেন্সি বলে কোনো মতে একটাই টিকিট এরেঞ্জ করতে পেরেছি এখন তোকে কী করে নিই বল তো!
এশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। মাহির এগিয়ে এসে ওর গালে হাত রেখে বলে,
-জেদ করো না এশা।
এশা মাহিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। মাহির তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ব্যস্ত। গতকাল সন্ধ্যের ঘটনা, একটা ফোনকল আসে মাহিরের কাছে। দেশ থেকে আসে কলটা। জানতে পারে তার বাবার খুব বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, কন্ডিশন ভালো নয় তার। মাহিরের বাবার এই অবস্থা দেখে তার মাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাহির সবটা শুনে দ্রুত দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময় অফিসে থাকার ফলে কয়েকজন কলিগ ঘটনা শুনে দ্রুতই টিকিট এরেঞ্জ করতে সক্ষম হয়৷ ফিরে এসে এশা’কে কিছু জানায়নি সে। তবে বেরোনোর সময় জানাতে হয় এশা’কে। এশাও যেতে চায়। এমন অবস্থায় পরিবারের থেকে দূরে থাকাটা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু তার ফাইনাল এক্সাম সামনে সেই কথা মাথায় রেখে মাহির তাকে সাথে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আরও একটি কারণ হলো এখন টিকিট পাওয়াও মুশকিল। সবদিক বিবেচনায় এশা’কে এখানেই রেখে যাওয়াটা ঠিক মনে করে মাহির।
-এশা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এশা মাহিরকে ছেড়ে দেয়। এই সময় জেদ নয় প্র্যাক্টিক্যালি ভাবতে হবে তার। মাহির যাক বরং। মাহির রওনা দেয় সেই সাথে এশা’কে বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে যায়। কোনো সমস্যা হলে যেনো সাথে সাথে মাহিরকে জানানো হয় এও বলে যায় মাহির। সাথে এশা প্রমিসও করিয়ে নেয় যে গিয়েই যেনো এশা’কে পরিস্থিতি সম্পর্কে সবটা ঠিকঠিক বলা হয়। কোনো কিছু লুকোনো যাবে না এশার কাছে। মাহির শর্ত মেনে নিয়ে তারপর বেরিয়ে যায়। রয়ে যায় এশা, একা এই ফ্ল্যাটের মাঝে।
পনেরোটা দিন কেটে যায়। মাহিরের বাবা এখন ভালোই আছেন। সম্পূর্ণ রূপে ঠিক হতে আরও মাস দু’য়েক সময় লাগবে তবে তিনি আর দুই সপ্তাহ পরেই বাড়ি ফিরতে পারবেন। মাহির মাও এখন সুস্থ আছে। রোজ নিয়ম করে মাহির এশার কাছে সমস্ত খবর পৌঁছে দেয়। এশাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পড়ায় মন দেয়। সবকিছু ঠিক গেলেও রাতটা এশার খুব কষ্টে কাটে। মাহিরের সাথে থাকাটা অভ্যেসে পরিণত হয়েছে তার। একা একা রাতটা আরও লম্বা মনে হয় তার কাছে। ঠিকমতো ঘুমও হয় না। একা বাড়িতে ভয় তো করবেই। মাহির অবশ্য বলেছে আর কিছুদিন পরেই ফিরে আসবে তারপর এশার পড়াশোনা কমপ্লিট হতে যতটা সময় লাগে ততটাই এই দেশে তাদের সময়সীমা। এরপর দু’জনেই দেশে ফিরে যাবে, পরিবারের কাছে। আর দূরে থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। সিদ্ধান্তটা অবশ্য দু’জনে মিলে নিয়েছে। যাতে পরবর্তী কখনো এমন কোনো সিচুয়েশন আসলে সঙ্গে সঙ্গে পরিবারকে সামলাতে পারে। যদিও এমন পরিস্থিতি আসুক সেটা কেউ চায় না। কেউই চাইবে না তার কাছের মানুষগুলো কখনো কোনো খারাপ পরিস্থিতির শিকার হোক।
মাহির বসে আছে তার বাবা’র পাশে। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। আবারও অবস্থার অবনতি ঘটে তার বাবার শরীরের। এদিকে তার যাওয়ার ডেইটও কাছে আসছে। সব মিলিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সে একবার বাবার দিকে তাকায়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকে উনি একেবারে শুকিয়ে গেছেন। দেখে চেনাই যায় না। মাহির বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের কোণা চেপে ধরে। সে চাইছে না পানিটা গড়িয়ে পড়ুক। কখনো কল্পনাও করেনি বাবা’কে এই অবস্থায় দেখবে সে। বাবা’র হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিয়ে বসে থাকে সে। বিকেল থেকে সন্ধ্যে নামে। বাবার চোখ খুলতে দেখতে মাহির নড়েচড়ে বসে।
continued…
Anamika