মনময়ূরী,২৭,২৮
Anamika
এশা’র আজ দেরিতে ঘুম ভেঙেছে। রাত জেগে পড়েছে সে। আজ প্রথম পরীক্ষা আর আজই উঠতে দেরি হয়ে গেল সে এতোটা কেয়ারলেস হলো কী করে! এখন খাওয়া বাদ দিয়ে দৌড়াতে হবে নয়তো মিস যাবে। সে তৈরি হয়ে যখন বেরিয়ে যাবে তখনই কলিং বেল বাজে, কে এসেছে এই সময়! মাহির তো ফেরেনি আর ফেরার কথাও না তবে কে এলো? এশা সব গুছিয়ে গেল গেইট খুলে দিতে। গেইট খুলতেই তার বুকের মাঝে শূণ্যতায় ছেয়ে গেল। এ কাকে দেখছে সে! নিহা, এইখানে! কেনো? অনেক প্রশ্ন ঘুরছে মাথার মধ্যে কিন্তু ওসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এখন নেই তার যে যেতে হবে। পরীক্ষা আছে তার।
নিহা গত কয়েকদিন ধরে মাহিরকে ফোনে ট্রাই করেও পায়নি অন্যদিকে তার বোনের মেয়ের অপারেশন এর ডেইট দেওয়া হয়েছে। অনেক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো সে, ভেবেছিল মাহিরের থেকে যদি কিছু হেল্প পাওয়া যায়। অনেক দিকে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে তার। বোন এখন মেয়েদের সামলাবে নাকি তার সাথে ছুঁটবে এই ভেবে সবটা সে একা হাতে সামলে যাচ্ছে। তবে একজন বন্ধুর পাশে থাকাটা এই সময় সব থেকে জরুরি হয়ে পড়েছে দেখেই আর না পেরে মাহিরের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী তার ফ্ল্যাটে এসে যায়। সে যখন কলিং বেল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তখন মনে একটা আশা ছিল এই আর কিছুটা সময় এরপর মাহিরকে সে পেয়ে যাবে। যখন গেইটের লক খোলার শব্দ হলো তখন আশাটা সত্যি হতে দেখতে পেল কিন্তু গেইট খোলার পরে এশার মুখটা দেখে সে হতবাক হয়ে রইলো। সে এশা’কে কল্পনাও করেনি এই মুহুর্তে। সে বুঝতেই পারছে না এখন ঠিক তার কী বলা উচিত?
নিহাকে চুপ থাকতে দেখে এশা তাকে বলে,
-আপনি!
নিহা বুঝতে পারে এশা যে তাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে সেটা। সে ভেতরে আসে, এশা তাকে এগিয়ে আসতে দেখে সরে দাঁড়ায়। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করে নিহা,
-তুমিও এই দেশে সেটেলড আগে জানতাম না। মাহিরের সাথে দেখা হলো সেও জানালো না। আমি আজ এতোটা পর হয়েছি এখানে না আসলে বুঝতামই না।
নিহার কথাগুলো এশার কাছে ঠিক ভালো লাগলো না। সে এখন পাল্টা জবাব দিতে পারে কিন্তু মন চায় না ঝামেলার মাঝে জড়াতে তাই সে বলে,
-আপনি যার খোঁজে এসেছেন সে দেশে ফিরেছে আজ প্রায় কুড়ি দিন হলো। আসলে তার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছিল যার ফলে যেতে হয়েছে তাকে।
-এমনভাবে বলছো যেনো তার বাবার এই অবস্থায় তোমার কিছুই হয়নি!
-আমার কী গেছে কী হয়েছে সেটা না-হয় আমার মাঝেই থাক। আপনি যে আসবেন সেটা আমি জানতাম না আসলে আমার আজ একটা পরীক্ষা আছে। মিস গেলে পুরো সেমিস্টার কিল হয়ে যাবে তাই কথা বলার সময় নেই। আর আপনাকে এখানে একা রেখে যাব তেমন বেয়াদবি আমার দ্বারা করা সম্ভব নয়। আফটার অল আপনি আমার বড়ো বোন সম।
-খুব কথা শিখেছো দেখছি।
-সে তো আমি সেই ছোট বেলায় শিখেছি, একটু একটু করে।
-তুমি মাহিরের কাজিন বলে বেঁচে গেলে নয়তো তোমার বেয়াদবির জবাব আমি ঠিক জায়গা মতো বুঝিয়ে দিতাম।
-আরে না সেইসব ভেবে ছেড়ে দিতে হবে না, আপনি বরং বিকেলে আসুন আমি অপেক্ষা করবো। ওই যে জায়গা মতো বোঝার জন্য। সরি আপনাকে চা কফি কিছুই অফার করতে পারলাম না, আমাকে এক্ষুণি বেরোতে হবে।
নিহা কিছু বলতে গিয়েও খেয়াল করলো এশা তাকে এড়িয়ে ভেতরে চলে গেল তার কাছে বিষয়টা অপমানের মনে হতে লাগলো তাই আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল। এশা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে গেইট লক করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই সিচুয়েশনে এসে এই মেয়েটাকে আবারও নিজের জীবনে দেখতে হবে ভাবেনি সে। কখনো ভাবেনি। এর কেনো ফিরতে হলো। তার আর মাহিরের মাঝে সবটা সবে গুছিয়ে এসেছে আর এখনই একে আসতে হলো। এর সাথে যে মাহিরের দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছে, কথাও হয় কোই তা তো একবারের জন্যও বলেনি মাহির। ভয় করছে, খুব ভয় করছে। হারানোর ভয়। এশার ভাবেনি সে এইভাবে কথা বলে বসবে, কিন্তু তার করারই বা কী ছিল! নিহা ই তো শুরুটা করেছে। এখানে তার ভুলটা কোথায়? আর ও কী বলে গেল, এশা মাহিরের কাজিন বলে ভালো করে কথা বলছে! মানে মাহির ওকে বিয়ের কথাটা বলেইনি। কেনো বলেনি? কেনো? এশা পুরোটা রাস্তা প্রশ্নের সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এসেছে। চোখের জলও বয়ে গেছে তার। মুছেও থামতে চায়নি।
আজকে আন্সারগুলো কতো কষ্টে দিয়েছে এশা তা একমাত্র সেই জানে। প্রশ্নের উত্তর আসার বদলে তার মাথায় শুধু নিহা ঘুরছিল। নিহা, এই মেয়েটাকে তার কখনোই পছন্দ ছিল না। গায়ে পড়া ভাব ছিল সবসময় এর মাঝে। তার মাঝে যে মাহিরের প্রতি অনুভূতি আছে সেটাও ভালোই বোঝে এশা। তার ভয় হয়। মাহির যদি তাকে ফেলে চলে যায়। এইসব চিন্তার মাঝে কী আর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় ঠিকমতো! তারপরেও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে উত্তর গুলো দেওয়ার। কতটুকু সফল হয়েছে জানে না। হয়তো এর জন্য রেজাল্ট খারাপ হবে। যেখানে জীবনটাই থমকে যেতে বসেছে সেখানে এই পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না এশার। সে বাড়ি ফিরেই মাহিরকে ফোন করে। মাহির অফলাইন, এখন মন তো মানতে চায় না। কখন অনলাইনে আসবে আর কখনই বা কথা হবে। অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে না ঠিক। সে মাহিরকে তার নাম্বারেই কল করে। কিন্তু বন্ধ। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়। গলায় কিছু একটা আটকে আছে মনে হয়। মাহির তাকে ভালোবাসে সে জানে তবুও মাহিরের অতীত তো ওই মেয়েটা। অতীতের স্মৃতি খুব গভীর হয়। এখানেই তো এশার ভয়। সে উঠে গিয়ে একটা গ্লাস নিয়ে তাতে পানি ঢালে তারপর ঢকঢক করে একবারেই খেয়ে ফেলে। পরিবেশ ঠান্ডা কিন্তু সে ঘামছে। অসহ্য লাগছে তার কাছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে খুব। তার এখন ঠিক হতে মাহিরকে প্রয়োজন। একবার তাকে আকড়ে ধরতে পারলেই ঠিক হয়ে যাবে। হতেই হবে। মন যে বলছে একবার এসো তুমি, তোমার দর্শনে আমি ঠিক শান্ত হয়ে যাবো। চলে এসো।
-তুই চিন্তা করিস না, আমরা আছি তো। আমরা দাদার খেয়াল রাখবো। নিশ্চিন্তে ফিরে যা।
-আমি জানি তোমার চেয়ে ভালো বাবার খেয়াল কেউ রাখতে পারবে না চাচ্চু। ইভেন আমিও না। তারপরেও।
-চিন্তা সব এইখানে ফেলে যা। এখন তো প্রায় পুরোপুরি সুস্থই হয়ে উঠেছে তোর বাবা। শরীরে কিছু দূর্বলতা এসে গেছে ঠিকই কিন্তু ঠিকমতো খেয়াল রাখলে সেগুলোও আর থাকবে না।
ফাইনাল এনাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে। মাহিরের কাছে হাত রাখেন এশার বাবা। চোখের ইশারায় তাকে আস্বস্ত করে এগিয়ে যেতে বলেন। মাহির বিদায় নিয়ে এগোতে থাকে। আজ সে ফিরে যাবে। বাবার অবস্থাও এখন স্টেবেল চিন্তার বিষয় নেই। তবে মা’কে কথা দিয়েছে যতদিন এশার পড়াশোনা চলবে ঠিক ততদিনই সে ওই দেশে থাকবে তারপর একেবারের জন্য ফিরে আসবে তার মায়ের কাছে। ছেলের কথা শুনে মায়ের মুখে হাসি দেখার মতো ছিল সেই দৃশ্য।
মাহির বেল্ট বেঁধে নেয় আর কিছু সময় পরেই সে থাকবে আকাশ পথে। চোখ বুঁজে এশার কথা ভাবছে সে। তাকে দেখতে পেয়ে মেয়েটা নিশ্চয়ই লাফিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে। আচ্ছা সে কী কাঁদবে? সম্ভাবনা তো আছেই। এতোগুলো দিন দূরে থাকার পরে এমনটাই হওয়ার কথা। যখন প্রচন্ড সুখে মানুষকে ঘিরে ফেলে তখন সে কাঁদে৷ কিছু অনুভব হতে মাহির চোখ খুলে তাকায়। এইতো টেক অফের সময় হয়েছে। রানওয়েতে চলতে আর একটু পরেই এয়ারপোর্টের বাইরে উড়ে যাবে প্লেন। তারপর ধীরে ধীরে অনেকটা উঁচুতে গিয়ে গন্তব্যের দিকে এগোতে থাকবে।
এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মাহির। ফোন বের করে অন করে সে। সিম চেঞ্জ করে নিয়ে এশাকে কল করার জন্য কি-প্যাডে নাম্বার টাইপ করে ডায়াল করতে যাবে তখনই খেয়াল হয় এশার তো আজ পরীক্ষার তৃতীয় দিন। তাকে এখন কল করলে পাওয়াও যাবে না। মাহির একটা ট্যাক্সি নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। এশা ফিরবে না এখন। তাই সে অপেক্ষা না করে লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে। অফিসে থেকে ঘুরে আসা যাক। সে দেশে থেকেও কাজ করেছে তবে সেগুলো সাবমিট করতে হবে। তারপর ফিরে এসে এশার সাথে সময় কাটানো যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
এশা ফিরে আসে, রুমের দিকে এগোয় সে। যতো এগিয়ে যাচ্ছে ততোই যেনো পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কে আছে তবে? দরজা ঠেলে পা বাড়াতেই তার কিছু একটা মনে হয়। ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে তার।
continued…
Anamika
#মনময়ূরী
২৮.
এশা তখন বইয়ের মাঝে ডুবে আছে একেবারে। একটু পরপর সাইডে ফিরে মুখ খুলছে আর মাহির তার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, খাবার দেওয়া মাত্রই সে আবারও বইয়ের দিকে চোখ দিচ্ছে। এইভাবেই খাওয়া শেষ হলো তারপর মাহির উঠে গিয়ে নিজের জন্য খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করে। আর একটা মাত্র পরীক্ষা আছে এশার। তারপর তার মাথা থেকে একটা টেনশন নেমে যাবে। মাহিরও অপেক্ষায় আছে পরীক্ষা শেষ হওয়ার কেনো না তার মনে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যার উত্তর এশার কাছেই পাবে সে। উত্তর তো সে চায় ই কিন্তু তার সাথে এটাও চায় যেনো এশার পরীক্ষার উপর সেসবের কোনো ইফেক্ট না পড়ে। তাই ফিরে আসার পরে যেই প্রশ্ন করা উচিত ছিল তার সেই প্রশ্ন নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে দিয়েছে সে। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করে যাচ্ছে সে।
খাওয়া শেষে মাহির রুমে এসে দেখে এশা তখনও পড়ায় ব্যস্ত। সে ডাকে এশা’কে। এশা তার দিকে তাকাতেই সে বলে,
-হয়েছে পড়া। এখন আয় ঘুমোবি।
-হয়নি তো, আর একটু প্লিজ।
-কাল পরীক্ষা আর আজ বলছিস হয়নি। ফাঁকিবাজের দাদী কোথাকার।
-এই দেখো একেবারে আমায় ফাঁকিবাজ ডাকবে না বলে দিচ্ছি তোমায়।
-ডাকবো, একবার কেনো একশো বার ডাকবো।
-ধুত।
বিরক্তি নিয়ে আবারও বইয়ের দিকে নজর দেয় এশা। মাহির বুঝে গেছে ওকে ওইখান থেকে উঠিয়ে আনা সম্ভব নয় তাই সে আর চেষ্টা করে না। একটা নভেল নিয়ে পড়তে শুরু করে সে এমন সময় তার ফোনে একটা কল আসে। নিহার কল। সে ফোন রিসিভ করেই বলে,
-হ্যা, নিহা বল।
মাহির একবার আড়চোখে এশা’কে দেখে নেয়। এশা তখন বইয়ের মাঝেই ডুবে রয়েছে এখানে কথা বললে ওর সমস্যা হতে পারে ভেবে মাহির রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বিষয়টা এশা ঠিক খেয়াল করে।
নিহার নামটা শোনা মাত্র এশা’র ভেতরে ঝড় বইতে শুরু করে তার উপর সেই ঝড়ের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় মাহিরের এইভাবে রুমের বাইরে চলে যাওয়াটা। কী এমন কথা বলার আছে যা এই রুমের মধ্যে এশার সামনে বলা যাবে না! এশা কী অচেনা কেউ? সে তো মাহিরের বউ। তার কী এতোটুকুও জানার অধিকার নেই যে মাহির এই সময় তার পুরোনো বান্ধবীর সাথে কী কথা বলছে? আর কেনোই বা কথা বলছে? এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো ঠিক তখনই তার মনে হয় সে তো নিহার এই বাসায় আসার কথাটা মাহিরকে জানায়নি। জানাতে ভুলে গেছে এমন নয়, আসলে সে ইচ্ছে করেই জানায়নি। সে চায়নি মাহির ওই মেয়েটার সাথে যোগাযোগ রাখুক। কিন্তু মানুষ চাইলেই কী সব হয়! যে মানুষ নিজের চাওয়াটা নিজের ক্ষেত্রেই কন্ট্রোল করতে পারে না সে কী করে অপর একজনের চাওয়া কন্ট্রোল করতে পারে! এশাও পারবে না মাহিরের এই বিষয় গুলোতে ঢুকতে।
এশা যা ভয় পাচ্ছিলো ঠিক সেটাই হলো, মাহির এলো ঘরে আর এসেই প্রশ্ন করলো,
-নিহা এই বাড়িতে এসেছিল তুই আমায় জানাসনি কেনো?
এশা এতোক্ষণ ভাবছিল কী উত্তর দেবে কিন্তু মাহিরের কাছে প্রশ্নটা শুনে তার মাথায় রাগ চড়ে গেল। সে উল্টো প্রশ্ন করে বসলো,
-তোমার পুরোনো বন্ধুর সাথে নতুন করে দেখা হয়েছে, কথা হচ্ছে প্রতিনিয়ত কোথায় তুমি আমাকে তো সেসব বলোনি কখনো! আমিও তো প্রশ্ন করতে পারি কেনো বলোনি আমায়?
এশা আশা করেছিল মাহির রেগে যাবে কিন্তু হলো তার উল্টো। সে রাগলো না, শব্দ করে হাসতে শুরু করলো। এশা ভ্রু জোড়া কুঁচকে চেয়ে রইলো তার দিকে। মাহির হাসতে হাসতে তার পড়তে পড়তে ছেড়ে যাওয়া বইটা একপাশে সরিয়ে রেখে বিছানার প্রস্থ বরাবর শুয়ে পড়লো। এশার দিকে দেখে তার থেকে জানতে চাইলো,
-জেলাস?
-কী!
-তুই কী জেলাস, বউ?
-বয়েই গেছে আমার। আমি কেনো জ্বলতে যাবো।
এশা মুখে কিছু বললো আর তার চেহারাটা অন্যকিছু দেখালো। মাহির সেই চেহারা পড়ে হাসলো আবারও। এশা রেগে গেল। বই সাইডে রেখে উঠে এলো সে। মাহিরের পাশে উবু হয়ে শুয়ে তার গলাটা চেপে ধরে বললো,
-মেরেই ফেলবো আমি তোমায়। খুব হাসি পাচ্ছে তাই না!
এশার রাগ তখন কান্নায় রূপ নিয়েছে। মাহির তাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয়। সে বলে,
-আমি ভেবেছিলাম তোর পড়ায় ডিস্টার্ব হবে তাই বাইরে গিয়ে কথা বলেছি। বিলিভ মি। আমি তো আর জানতাম না ঘরে থাকা আমাত পড়ুয়া বউটা জেলাস বউয়ের রূপ ধারণ করবে নয়তো তার সামনেই কথা বলতাম।
এশা চুপটি করে শুয়ে আছে। মাহির প্রশ্ন করে,
-কেনো বলিসনি আমায় ও এসেছিল?
-ভুলে গেছিলাম।
-সত্যি?
-না মিথ্যে, আমি চাইনি জানাতে তাই জানাইনি। হয়েছে, উত্তর পেয়েছ তুমি?
এশা রেগে উঠে যায়। সে আসলে বুঝতেই পারছে না তার রাগটা সে কেনো মাহিরের উপরে ফেলছে। সে তো মিথ্যেই বলছিল মাহিরকে। সেই অনুযায়ী ভাবলে রাগ মাহিরের দেখানো উচিত সে কেনো দেখাবে! মাহির বুঝতে পারে বিষয়টা। সাথে এটাও বুঝতে পারে এশা আসলে শেষ কথাটা তাকে সত্যি বলেছে। সে এগিয়ে যায়, বেরোয় রুম থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে এশা। মাহির সেখানে গিয়ে ফ্লোরিং এর ব্যবস্থা করে। এশা’র হাত ধরে, এশা সেই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকটা সময়। মাহির তাকে বলে,
-এসো আমার সাথে।
এশা এতোক্ষণ খেয়ালই করেনি যে মাহির এখানে শোয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এশা বেশ অবাক হয়েই প্রশ্ন করে,
-এসব কখন করলে?
-তখন, যখন আপনি ওই আকাশটা দেখতে ব্যস্ত ছিলেন।
মাহির এশা’কে নিয়ে বসে। এশা খেয়াল করে দেখে একটা মাত্র বালিশ সেখানে। সে প্রশ্ন করে,
-একটা বালিশ যে!
-হু।
-তুমি শোবে না?
-তোর এমন কেনো মনে হলো?
-তবে কী আমি বসে থাকবো?
-বলেছি আমি?
-না।
-তুই কী মুভি দেখিসনি কখনো?
এশা এখন বুঝলো আসলে মাহির কী চায়। এতোকিছুর মাঝে এখন এসে এশা ঠোঁটে হাসি দেখার সুযোগ হয় মাহিরের। সে শুয়ে একটা হাত বাড়িয়ে দেয় এশার দিকে। এশা তা খেয়াল করে এগিয়ে যায়। শুয়ে পড়ে সেও। মাথাটা তার মাহিরের বুকে। মাহির তার একটা হাত দিয়ে এশাকে জড়িয়ে রাখে অন্য হাত দিয়ে তার চুল নিয়ে খেলা করতে থাকে। সে বলে,
-আজ তোকে একটা গল্প শোনাবো। শুনবি?
-আমার ঘুমোতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এশার মন বলছে মাহির তাকে নিহাকে জড়িয়ে তার যেই অনুভূতি ছিল সেগুলো শোনাবে। এশা জানে নিহা মাহিরের পাস্ট ছিল কিন্তু এখন সেই পাস্ট নিয়ে কোনো গল্প শোনার ইচ্ছে তার নেই। ইচ্ছে নেই নাকি শক্তি নেই! সে জানে না। আগে নিজের মনকে সে বুঝতে পারতো। ভালো করেই বুঝতে পারতো কিন্তু এখন পারে না। মন কী চায় সে জানে কিন্তু সব চাওয়া এলোমেলো হয়ে পেঁচিয়ে রয়েছে। সেই জট খুলতে পারে না সে।
মাহির বলে,
-আমি যতটুকু তোকে জানি সেইখান থেকে আমি শত ভাগ নিশ্চিত তুই এখন না তো পড়ায় মন দিতে পারবি আর নাই ঘুমোতে পারবি। এর চেয়ে কী এইটা ভালো নয় যে আমার কথাগুলো শুনবি তুই! আচ্ছা আমায় একটা কথা বল, পাস্ট ফিউচার সব বাদ তুই শুধু এখন এই মুহুর্তের কথা ভাব। ভেবে আমায় বল আমি কী এমন কিছু বলতে পারি বা করতে পারি যাতে তুই কষ্ট পাবি বা যার কোনো মানে নেই এই সময় বলার।
-উহু।
-তবে?
-তুমি বলো আমি শুনছি।
এশা নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। যতো যাই হয়ে যাক ওদের অতীতটা যেমনই হোক ওদের বর্তমানটা খুব সুন্দর আছে এবং ভবিষ্যৎ ও সুন্দর হবে। এই মুহুর্তে এসে মাহির এশাকে কখনোই ঠকাতে পারে না। এশা শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করছে।
মাহির একবার এশার দিকে মাথা তুলে তাকায়। যেহেতু এশা তার বুকের মাঝে তাই তার মাথা হালকা তুলে তারপর দেখতে হচ্ছে। শুয়ে যাওয়ার পরে মাহির বলতে শুরু করে,
-তুই তো জানিসই আমার পড়াশোনার সময়টা হোস্টেলে কেটেছে। শুরুতে আমার সেই লাইফের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। কলেজ লাইফটা পুরোটা কীভাবে পার করেছি আমিই জানি। আমার কোনো বন্ধু ছিল না তখন, কেনো জানিস? কেনো না আমি কারো সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতাম না। ওদের লাইফস্টাইল আর আমার লাইফস্টাইলের মাঝে ছিল বিস্তর তফাৎ। বন্ধু হলেও কাজ ফুরিয়ে গেলে হারিয়ে যেতো কোথাও একটা। এইভাবেই আমার কলেজ লাইফ পার করলাম। ভার্সিটি লাইফের তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরে একদিন আমি নিহা’কে দেখেছিলাম। ওদের একটা গ্রুপ ছিল বুঝলি, ওই গ্রুপে নিহা সহ আরও ছয় জন ছিল। শুরুতে নিহার সাথেই আমার বন্ধুত্ব হয় তারপর ধীরে ধীরে ওদের সাথেও। ওরা একটু চঞ্চল টাইপের ছিল ঠিকই কিন্তু মনের দিক থেকে ওরা ছিল সেরা। বন্ধুত্বের সঠিক মানে যদি জানতে হয় তবে ওদের সাথে সময় কাটালেই হবে। ওদের মাঝে আরও একটা গুণ রয়েছে জানিস, সে কাউকে সহজেই আপন করে নিতে পারতো ওরা।
continued…..