মনময়ূরী,২৯,৩০
Anamika
আমার যখন সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল একজন বন্ধুর পাশে থাকাটা তখন নিহা ছিল আমার পাশে ইভেন ওর কারণেই আরও কয়েকজন বন্ধু পেয়ে গিয়েছিলাম। তোর মনে আছে আমাদের এনিভার্সারির দুই দিন পরে আমি তোকে ভার্সিটির গেইটে ড্রপ করে এসেছিলাম। সেইদিন আমার কাজ ছিল বিপরীত সাইডে তারপরেও তোর সাথে আমি ওইটুকু পথ একসাথে যাওয়াটা মিস করতে পারিনি। আসলে আমি চাইনি মিস করতে। সেইদিন তোকে রেখে যখন যাচ্ছিলাম আমি তখন চার্চের সামনে নিহা’কে দেখি। লাস্ট যেবার এলাম আমি, আমাদের বিয়ের আগের কথা বলছি আমি। সেইবার ও আমায় এয়ারপোর্টে সী অফ করতে এসেছিল এই যা। এরপর আর দেখা হয়নি তো সেইদিন হঠাৎ ওকে দেখে আর চলে যেতে পারিনি। মনে হলো এতোদিন বাদে দেখছি একবার গিয়ে কথা বলা উচিত। তাই গেলাম, কথাও হলো। ওর সাথে দু’টো পিচ্চি মেয়ে ছিল। ওরা কী যে মিষ্টি তোকে বলে বোঝাতে পারবো না।
এই জায়গায় এসে এশার মনে হয় বাচ্চা দু’টো হয়তো নিহার। তার মানে নিহা বিবাহিত। ও শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলো তবে। মন থেকে একটা বড় পাথর নেমে গেল। স্বস্তি অনুভব করতে শুরু করেছিল সে কিন্তু মাহিরের পরের কথাতে তার মন আবারও বিষাদে ছেয়ে যায়।
-নিহার বড় বোন স্পৃহার মেয়ে ওরা। কিন্তু বাচ্চা দু’টোর ভাগ্যটা খারাপ জানিস তো, এইটুকু বয়সে বাবা’কে হারিয়ে বসে আছে। এইটাই শেষ নয়, ওদের মধ্যে একজনের আবার হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওইটুকুন একটা বাচ্চা তার এই বয়সেই এমন মারাত্মক সমস্যা! ভাবলেই খারাপ লাগছে। ওরা দুই বোন আর ওই বাচ্চা দু’টো, এখন বাচ্চা সামলাবে নাকি ছুঁটোছুঁটি করবে! তো আমি বলেছিলাম প্রয়োজনে যেনো মনে করে। এরই মাঝে বাবার এক্সিডেন্ট এর খবর পেয়ে আমি দেশে ফিরে গেলাম আর ও আমার ফোনে ট্রাই করতে থাকলো। না পেয়েই এই বাড়িতে এসেছিল। আমি জানি না তোর মনে ওকে নিয়ে ঠিক কী সমস্যা রয়েছে তবে এইটুকু বুঝতে পারি তুই ওকে নিয়ে ইনসিকিউরড। কেনো সেটাও বুঝতে পারছি না আমি। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। হ্যা মাঝখান দিয়ে পুরো চারটে বছর যোগাযোগ ছিল না তবুও বন্ধুত্ব তো আছেই তাই না। এখন আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি আমায়?
-কী?
-আমি যতদূর নিহা’কে জানি ও কারো সাথে খারাপ বিহেভ করবে না, আর যদি করেও থাকে তবে এই পরিস্থিতিতে টেনশনে পড়ে করে ফেলেছে তাই বলে তুই কেনো খারাপ বিহেভ করবি?
-আমি খারাপ বিহেভ করেছি! হয়তো করেছি। আমি তো খারাপ তাই খারাপ ব্যবহারটাই আসে আমার থেকে। আমি বলি কী আমার থেকে ভালো কিছু আশা করো না। ছাড়ো আমি রুমে যাবো। ঘুমাতে হবে আমার।
এশা নিজেকে ছাড়াতে চাইলো কিন্তু পারলো না ছাড়াতে। মাহির বুঝতে পারছে না এতো কিছু বলার পরেও, এতো বোঝানোর পরেও এশা এমনটা কেনো করছে!
এশা উঠতে চেয়েও যখন পারলো না তখন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,
-প্লিজ ছাড়ো।
-আমার কথা এখনো শেষ হয়নি এশা। আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই।
-যা বলার কাল বলো। এখন আমায় যেতে দাও।
-তুই যে ঘুমোবি না সেটা আমার জানা আছে।
-ঘুমোবো কী করে হ্যা! একটা মেয়ে যাকে আমার স্বামী নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড বলে দাবি করছে সেই মেয়েটা এসে আমার সাথে এমনভাবে কথা বলে যেনো আমি নেই সেই তার স্ত্রী। ইভেন আমার স্বামী তার সেই সো কলড বান্ধবীকে এটাও জানায় না যে আমি তার বউ হই। বাইরে থেকে একজন এসে আমারই বাড়িতে ঢুকে আমায় কথা শুনিয়ে যায় সেটা কোনো ফ্যাক্ট নয় তাই না! আমি কিছু বললেই সেটা দোষের হয়ে যায়। যেই জায়গাটা আমার সেই জায়গায় সে নিজেকে ভাবতে পারে কী করে? বলো?
এশার কথা যেনো মাহিরের মাথায় ঠিকমতো ঢুকতেই চায় না। নিহা যে এমন কিছু করতে পারে তা তার কাছে অবিশ্বাস্য। বিষ্ময়ে তার হাতটা আলগা হয়ে যায় সেই সুযোগটা নেয় এশা। সে উঠে চলে আসে সেখান থেকে। মাহিরও পেছনে আসে। আজ এশার সাথে খোলাখুলিভাবে সব কথা বলতেই হবে নয়তো এই যে সন্দেহ তার মনে ঢুকেছে সেটা রয়েই যাবে। বেরোনোর বদলে উল্টো বাড়তে থাকবে।
মাহির রুমে এসে গেট লাগিয়ে দেয়। এশার পাশে শুয়ে পড়ে সে। এশা অন্যপাশ ফিরে একটা সাইডে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। শরীরটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে তার যাতে বোঝা যাচ্ছে সে কাঁদছে। মাহির তার কাঁধে হাত রাখলে সে একটা হাত দিয়ে সেই হাত সরিয়ে দেয় কিন্তু ফিরে তাকায় না। মাহির বলে,
-তোকে যে বললাম একটা গল্প শোনাবো সে তো তুই শুনলিই না।
এশা ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে,
-তোমার গল্প তোমার কাছেই রাখো, আ’ম নট ইন্টারেস্টেড।
-আরে বাবা শোন না, আমার লাভ স্টোরি শোনাবো আজ তোকে।
লাভ স্টোরি শোনাবে শুনেই এশা দুই হাত দিয়ে নিজের কান ঢেকে নেয়। মাহির হাসে। এখন এমন সিরিয়াস মুহুর্তেও তার হাসি পাচ্ছে। এশা যে জেলাস তা বুঝতে পেরেই এমন হয়েছে। মাহির আর এশার ফেরার অপেক্ষা করলো না শুধু কান থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে সেই হাতটা ধরে রাখলো যাতে আবারও কান ঢাকতে না পারে। মাহির গুনগুনিয়ে গাইলো দুই লাইন, ‘ছুপানা ভি নাহি আতা, যাতানা ভি নাহি আতা। হামে তুমসে মোহাবাত হে বাতানা ভি নাহি আতা।’
মিষ্টি একটা সকাল, ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সময়ের আগের। আমার আবার ঘুম ভাঙে না এতো দ্রুত তুই তো জানিস। শীতের সকালে আমার শুধু বাহানা প্রয়োজন হতো শুয়ে থাকার। সেইদিন নিয়মের বাইরে ছিল আমার আচরণ। ঘুম ভাঙার পরে আমি যে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে রই সেইদিন আর ইচ্ছে করেনি শুয়ে থাকতে। অনেক চেষ্টা করেও শুয়ে থাকতে পারিনি। হয়তো পরিবেশ ভিন্ন ছিল তাই অমন অনিয়ম হয়েছিলো সেদিন। জানিস তো সেইদিন ঘুম ভাঙার পরে যখন আর ঘুম আসছিল না আমি তো নিজের চোখকে বকাঝকা করতে ব্যস্ত কেনো তার মাঝে ঘুম নেই! কেউ জাগেনি তখন আর আমি জেগে বসে আছি। এমন নয় যে অনেক ঘুমিয়েছি বলে আর ঘুম আসছিল না আমি তো সেইদিন অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম।
ঘরে আর থাকতে পারিনি আমি। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভাবতে থাকি কী করা যায়? বাইরে তখন অন্ধকার ছিল। আসলে শীতের সকাল তাই এমন মনে হচ্ছিলো। বাড়ির মাঝেই পায়চারি করতে থাকি আমি। উপরে থেকে ধপ ধপ শব্দ কানে আসে। মনে হচ্ছিলো যেনো ছাদে কেউ লাফাচ্ছে। আমার ইচ্ছে হলো একবার গিয়ে দেখতে আসলে কী হচ্ছে ছাদে। মই বেয়ে উপরে উঠি। সিঁড়ি ছিল না সেই বাড়িতে। মনে আছে আমার, নানা বাড়িতে ছিলাম সেইদিন। ছোট মামার দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো। মামি মারা যাওয়ার পরে মামা পুরোপুরি একা হয়ে যাওয়ায় নানা সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছলেন। তুই তো জানিসই। সে যাই হোক আমি যখন উপরে উঠলাম তখন দেখলাম মেজ খালামনির মেয়ে তুলি সেখানে বসে পড়লো। হাপাচ্ছিল সে। সামনে আরও অনেকেই ছিল, যে আবছা দেখা সম্ভব হচ্ছিল তাতে মনে হয়েছিলো ওরা নাচ প্র্যাকটিস করছে। তখন বুঝলাম তুলি নাচতে গিয়ে হাঁপিয়ে গিয়েছিল তাই বসেছে। আমি আবারও দেখলাম সেইদিকে। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম ওখানে তিনজন আছে। একটু সামনে এগিয়ে গেলাম আমি। মাঝের জনের ডান পাশে আর আমার বাম পাশে যে মেয়েটি নাচছিল তার চুলের খোপাটা খুলে যায় সেই মুহুর্তে। নাচতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনবার ঘুরতে হয় এমন স্টেপ আসে। সে যখন ঘুরছিল তখন চুলগুলো তার মুখে পেঁচিয়ে গেল। সে নাচ থামিয়ে দেয় সেই কারণে। আমার জন্য ভালোই হলো চেহারা দেখতে পারবো এবার। সে চুল সরায়, চোখটা আগে দেখতে পাই আমি। মন থেকে একটা নাম শুনতে পেলাম ‘ময়ূরী’। আচ্ছা আমার মন তার নাম দিলো ময়ূরী তবে আমার তাকে কী নাম দেওয়া উচিত। ভাবতেই একটা নাম মাথায় এলো। আমি আস্তে করেই উচ্চারণ করলাম, ‘মনময়ূরী’।
continued…
Anamika
#মনময়ূরী
৩০.
মাহিরের কথা শোনা মাত্রই এশা তার দিকে ফিরে শোয়। এশার চোখে বিষ্ময়। মাহির তা খেয়াল করে বলে,
-ঠিক শুনেছিস। মেয়েটা তুই ছিলি এশা। তখন আমার অনুভূতি গুলো সবে জাগ্রত হয়েছিল। খুশি হবো নাকি চিন্তা করবো পরিবারের সেই সবের কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি অনেকটা সময় বসেই ছিলাম ওইদিন। ঘর থেকে বেরোইনি আমি। কেউ আমায় বের করে নিয়েও যেতে পারেনি। ভাবলাম, অনেক ভাবলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম এই যে আজ যা হলো তা নিয়ে আর কখনো ভাববো না। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম তারপর বেরোলাম ঘর থেকে কিন্তু যেই তুই সামনে এলি আবারও সব এলোমেলো হয়ে গেল। আমি বুঝতেই পারছিলাম না যে এমন অনুভূতি আমার মাঝে আসলো কী করে? আগেও তো তুই আমার সামনে এসেছিস অনেকবার ইভেন অনেকটা সময় সামনে বসেও থেকেছিস কিন্তু সেই কয়েক মিনিট আমার উপর ভারী হয়ে গেল। কিছুতেই নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে সক্ষম হলাম না আমি। গভীর রাতে ছুঁটে যেতাম তোর ঘরে তোকে একবার দেখব বলে। আমার নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে কিছু একটা করতে হবে ভেবে আমি আবারও হোস্টেলে ফিরে যায়। ছুটি তখনও বাকি ছিল দেখে বাবা-মা নানান প্রশ্ন করেছিল আমায় কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারিনি। কেনো পারিনি জানি না। হয়তো সত্যি লুকোতেই কিছু বলতে পারিনি। মিথ্যে বলাটা উচিত হতো না আবার সত্য আমি বলতে পারতাম না। আমি ওইদিন উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে এসেছিলাম। পেছন থেকে বাবা বলেছিলেন ‘বেয়াদব ছেলে’ কথাটা আমার কানে এসেছিলো ঠিকই আমি কোনো পতিক্রিয়া দেখাইনি। পেছনে ফিরতে ইচ্ছে করছিল আমি ফিরিনি। বাবার ঠিক পাশেই তুই যে দাঁড়িয়ে ছিলি। বেরোনোর আগে অবশ্য আমি তোকে দেখেছিলাম। তোর ঠোঁটে হাসি ছিল কিন্তু আমার মনে হয়েছিল তোর হাসিটার আড়ালে কিছু লুকিয়ে আছে। যেতে যেতে ভেবেছিলাম মানে আমার মনে হয়েছিল হয়তো তুইও আমার জন্য কিছু ফিল করিস তাই আমার তোকে দেখে অমন মনে হয়েছিল। কিন্তু পরেই আবার মনে হলো যে না, হতেও তো পারে আমার মনের ভুল। তোর মনে আছে আমি তোকে বলেছিলাম আমি তোর মন পড়তে পারি। তারপরেই বলেছিলাম আগে পারতাম না এখন পারি। সত্যিই এখন পারি, আগে যদি পারতাম পড়তে তাহলে হয়তো আমাকে যেতে হতো না আবার যেতে হলে মনের মধ্যে আশা থাকতো না যে তোর মনেও হয়তো আমার জন্য কিছু আছে। আমার প্রতি কোনো অনুভূতি আছে।
এইটুকু বলে মাহির হাসে। হাসিটার মানে ঠিক কী ছিল এশা তা বোঝেনি। মাহির এশাকে দেখে নেয় একবার, ও এখনও অপেক্ষায় আছে বাকিটা শোনার জন্য। মাহির বলে,
-ফিরে তো গেলাম আমি তবে কিছুতেই কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছিলাম না আমি। আমার বন্ধুরা সেটা খেয়াল করেছিল। খেয়াল করতো কিনা জানি না তবে পরপর দুটো ক্লাস টেস্টে আমি লোয়েস্ট নম্বর পাই। যেখানে আমি সবসময় হায়েস্ট নম্বর পেয়ে এসেছি সবসময়। ভাগ্যিস সেটা ফাইনাল এক্সাম ছিল না নয়তো আমি তো শেষ। মনের সাথে সাথে ব্রেনটাও যেতে বসেছিল আমার। ওরা এসে প্রশ্ন করার পরেও আমি কিছু বলিনি তবে পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এখন থেকে গ্রুপ স্টাডি করা হবে। আমিও সুযোগ ছাড়তে চাইলাম না। সবার মাঝে থেকে যদি আমি নিজেকে সামলে নিতে পারি। মন থেকে যদি সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে পারি মন্দ হয় না। আমি পারলাম, পড়ায় আবার মনোযোগ তো এলো কিন্তু মনের মাঝে আমার ময়ূরী থেকেই গেল। বেরোতে চাইলোই না সে।
মনের মধ্যে যে ছিল তাতে আমার সমস্যা ছিল না কিন্তু যখনই আমার চোখের সামনে দিয়ে কোনো কাপল হেঁটে যেতো বা পার্কে কাউকে কারো হাতে হাত রাখা দেখতাম তখন সেই মনের মধ্যেই সে পেখম মেলে নাচতে থাকতো। কেমন লাগে তুই বল! শান্ত হয়ে থাকতেও তার সমস্যা ছিল। আমার দেহ বড় হতে পারে কিন্তু মনটা সেই ছোট্টই ছিল। এর মাঝে আস্ত একটা মানুষ নিয়ে ঘোরা অবধি তো সবই ঠিক ছিল কিন্তু তাকে নাচতে হতো কেনো? আমার বুকে বোঝা সমান মনে হতো। ব্যথা হতো। তবুও সে তো তিড়িংবিড়িং নেচেই যাবে। সহ্য করা মুশকিল ছিল আমার কাছে। আমি আবারও অমনোযোগী হয়ে পড়লাম। বাড়িতেও ফেরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমি। যেয়ে আরোও অস্থিরতা বেড়ে যেতো তো।
আমাকে অমনোযোগী দেখে বন্ধুরা আবারও চেপে ধরলো। আমি এবার আর লুকোলাম না। নিজের মনে ব্যথা লুকিয়ে দেবদাস হয়ে মরার থেকে তো ভালোই ছিল যে আমি বিষয়টা তাদের সাথে শেয়ার করি। ওদের বলেও দিলাম। ওরা শোনার পরে আমাকে নিয়ে মজা করা শুরু করলো তারপর সকলে সিরিয়াস মুখভঙ্গি বানিয়ে চিন্তা করতে থাকলো। আমাকে এসব থেকে বের করে আনতে একজন বলে ভার্সিটিতে তো মেয়ের অভাব হবে না। একজনকে ডেট করা শুরু করলেই এসব ভুত মাথা থেকে নেমে যাবে। আমি না করে দিই কেনো না আমি জানতাম আমি পারবো না অমন করতে। একেক জনের একেক উদ্ভট আইডিয়া শুনে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল ঠিক সেই সময় নিহা আমায় বলেছিল ‘প্রপোজ করে ফেল ওকে। যদি একসেপ্ট করে তখন তো ভালোই হবে আর যদি না করে তখন তোর এগিয়ে যেতে সুবিধে হবে। তুই যে এখন তাকে ভুলতে পারছিস না কেনো জানিস? আসলে তোর মনে একটা আশা আছে। সেই আশাটাই তোকে তিলে তিলে মারছে। উত্তর হ্যা হলে তো হলোই। প্রেম করবি জমিয়ে আর যদি না হয় তবে মনে কোনো আসা থাকবে না আর। আর আশা না থাকলে মানুষটা তো মনের মাঝে থেকে যায় কিন্তু জীবনে এগোতে কোনো সমস্যা হয় না। হ্যা, মাঝে মাঝে মনে পড়ে যাবে কিন্তু তখন নিজেকে সামলানোটাও সঠিক হবে।’ ওর কথাগুলোর মাঝে আমি নিজের সমাধান পেয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি ফিরে যাব। প্রপোজ করবো, উত্তর যাই হোক শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিই আমি। বাড়িও ফিরে আসি। তুই সামনে ছিলি, ইচ্ছে করছিল বলে দিই তখনই কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ভেতরে চলে যাই আমি।
দু’দিন পরে আমার বন্ধুরাও আসে সেখানে গ্র্যান্ড ওয়েতে প্রপোজ করার ইচ্ছে ছিল আমার তাই ভেন্যু ঠিক করি। ডেকোরেশন দ্বায়িত্ব ছিল ওদের উপর। ওরা সব খুশি খুশি সম্পন্ন করে আমায় রেখে চলে যায়। ওই দিনটা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। তোকে ডেকে নিয়েছিলাম ফোন করে। তোর মনে আছে বলেছিলাম একটা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য, জলদি আয়। বেশি অপেক্ষা করাস না। তুইও বলেছিলি পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাবি। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। যতো সময় পেরোচ্ছিলো আমার নার্ভাসনেস বেড়েই যাচ্ছিলো। আমি প্রপোজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে তোকে ডাকা অবধি তো কনফিডেন্ট ছিলাম যে না যতো যাই হয়ে যাক আজ আমি প্রপোজ করেও ছাড়বো। কিন্তু সেই পনেরো মিনিট আমার নার্ভাসনেস কতগুনে যে বাড়িয়ে দিয়েছিল আমি বলে বোঝাতে পারবো না তোকে। প্রতিটি প্রহর অপেক্ষায় কাটিয়েছি, নার্ভাসনেস ছিল আমার সঙ্গি। ভয় ছিল মনের মাঝে যদি না শুনতে হয় আমার।
পনেরো মিনিট পেরোলো। ঘড়ি দেখলাম আমি। আমি যেইখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেইখান থেকে গেইট দেখা যায় স্পষ্ট। তুই ঢুকলেই আমি দেখতে পাবো। মনটা সেদিন বাচ্চামিতে মেতেছিল। ভেতর তা ধিন তা ধিন নাচছিল সে। আমি শান্ত করেও পারছিলাম না। নিজের চুল ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সবকিছু আবারও চেক করতে থাকলাম ঠিক আছে তো?
আমি অপেক্ষা করেই গেলাম। পনেরো মিনিট পেরোলো তারপর আরও পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। এইভাবে একেক সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিট, মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা পেরোতে থাকলো। আমি তোকে কল দেই তুই রিসিভ করে আমার কথা শুনলি না শুধু বললি, ‘মাফ করো ভাই, আমি আজ আসতে পারবো না। সারপ্রাইজটা তোলা রইলো অন্য কোনোদিন এসে নিয়ে যাব।’
continued……