মনময়ূরী,৭,৮
Anamika
এশা মূর্তির মতো বসে আছে বিছানায়। তার চেহারায় না আছে হাসির ছাপ আর না আছে কষ্টের ছাপ। সে যেন এই জগতেই নেই। এ জগতের বাইরে কোথাও নিজের জগৎ তৈরি করে বসে আছে মেয়েটা। মাহিরের বেশ অবাক লাগে ওকে দেখে। সকলে আজ যা করলো তাতে মেয়েটাকে চাবি দেওয়া পুতুল ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না তার কাছে। চাবির কন্ট্রোল পুরোটা মাহিরের বাবার হাতে ছিল। মাহিরের এখন আফসোস হচ্ছে ও কেন ফিরে এলো! ওরই বা দোষ কী? একটা দিনের ব্যবধানে এতো কিছু ঘটে যাবে ও তো আর জানতো না। ও না আসলে হয়তো মেয়েটার সাথে জোর করা হতো না। উহু…. এই বাড়িতে কী ও একাই প্রাপ্তবয়স্ক ছিল! না তো। মানে ওকে না পেলে তো অন্য কাউকে এশার সাথে বেঁধে দেওয়া হতো। কী একটা সিস্টেম এই সমাজের। একটা মেয়ে যাকে চিনে না জানে না তার সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নিজেকে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিনের ভেতরে তৈরি করে ফেলে। আর যখন সেই ব্যক্তি প্রতারক বের হয় তখন তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই আরো একটাকে খুঁজে এনে তার সাথে সারাজীবন এক বন্ধনে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
মাহির গেটের পাশে দাঁড়িয়ে এশা’কে দেখে যাচ্ছে। বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য নেই মেয়েটার মাঝে, যা একসময় ছিল। আর আজকের পরে মনে হয় না থাকবে। সে ভেবে পাচ্ছে না এশার কাছে যাবে কিনা। গেলেও গিয়ে কী বলবে সে, কিছু কী আছে বলার! ও হ্যা, আছে তো। মাহির যে আর পাঁচ দিন পরেই ফিরে যাবে সেটা তো কাউকে জানানোই হয়নি। আর এখন এই মুহুর্তে সর্বপ্রথম এই বিষয় সম্পর্কে জানার অধিকার একমাত্র এশার রয়েছে। মাহির এগিয়ে গিয়ে বিছানা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ায়। এশা তখনও আগের মতোই বসে আছে। তবে কী তাকে খেয়াল করলো না মেয়েটা। মাহির মৃদু স্বরে ডাক দেয়।
-এশা?
এশা ওইভাবেই বসে থেকে উত্তর দেয়,
-আমি শুনছি।
-তুই ঠিক আছিস?
-উউ…
এবার সে মাথা তুলে দেখে। মাহির আবার বলে,
-তোকে এমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে কেন?
-যেখানে ভেতরটাই আর স্বাভাবিক নেই সেখানে বাইরে থেকে অস্বাভাবিক দেখালে কী ক্ষতি হয়ে যায়?
এশার কথার অর্থ বুঝতে পারলো আবার পারলো না। এশা আবার প্রশ্ন করে,
-কোই উত্তর দিলে না যে?
-এর উত্তর আমার কাছে নেই। যদি কখনো খুঁজে পাই জানাব তোকে।
এশা হাসলো। হাসির মাঝে অস্বাভাবিক কিছু নেই। যেমন মানুষ হাতে তেমনই ভাবে হাসলো। হেসে বললো,
-আমার খুব ঘুম পেয়েছে কিন্তু আজকে এতো মানুষের এতো কথা কানের এই ফুটো দু’টো দিয়ে মগজে ঢুকেছে না কী বলবো তোমায়! এখন একজনের কথা আরেকজনের কথার সাথে লড়াই করছে আর বলছে আমি ঠিক, ও বলছে না আমি… আমি ঠিক। উফফ!
এশা হাত নেড়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কথাগুলো বলে দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে বসে। মাহির তাকে তখনও বোঝার চেষ্টা করতে ব্যস্ত। এশা বলে,
-আরে আমি তো খেয়ালই করিনি তুমি সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো। এসো এসো বসো।
এশা পরনের শাড়িটা গুটিয়ে নিয়ে মাঝখান থেকে বাম পাশে সরে গিয়ে মাহিরকে জায়গা করে দেয়। নিজের পাশের ফাঁকা জায়গাটার দিকে ইশারা করে বলে,
-এই নাও ফাঁকা করে দিয়েছি। এখানটাই বসো। স্যরি হ্যা। কোনো রকম প্ল্যান ছাড়াই বিয়েটা হলো বলে আজ তোমাকে অনিচ্ছা শর্তেও এক সাইড আমার জন্য ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
মাহির এশার কথা শুনে ভাবে মেয়েটা কী পাগল হয়ে গেল শোকে। এমন আচরণ করতে তাকে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। আবার এমনও হতে পারে সে এমন আচরণ আগেও করেছে তবে মাহির দেখতে পায়নি। এশা বিরক্ত হয়। বেড সাইড থেকে একটু দূরে একটা জানালা আছে এই ঘরে। সে সেইদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আবার মাহিরকে দেখে।
-তুমি তো দেখছি বসলেই না। যাই হোক বসোনি যখন ওই জানালা একটু খুলে দিয়ে এসে তারপর বসো। উফফ যা গরম। আর একটু হলেই তুমি মশলা মাখিয়ে আমাকে দিয়েই ডিনার সারতে পারবে।
অবাক কান্ড, এই মুহুর্তেও মেয়েটা মজা করছে। নাকি এ শুধু মাত্র একটা নাটক নিজেকে স্বাভাবিক প্রমাণ করার! মাহির গিয়ে জানালা খুলে দিয়ে ফিরে এসে বিছানার ডান পাশে বসে। এশা বলে,
-তুমি কি খুব টায়ার্ড?
মাহির ভ্রুজোড় একত্রে কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
-অন্নেক ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু ওই যে বললাম মগজের মধ্যে কথার লড়াই চলছে। কী যে যন্ত্রণা! বলে বোঝানো সম্ভব হবে না।
এশা মাথা ধরে কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
-একটা আবদার করবো রাখবে?
মাহির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
-বল।
-আমায় চুলে বিলি কেটে দেবে। একটুখানি ঘুমোবো। এই জাস্ট একটুখানি।
হাতের দু’টো আঙুলের মাঝে হাফ সেন্টিমিটার সমান গ্যাপ রেখে সেটা দেখিয়ে বলে এশা। তারপর মাহিরের দিকে তাকায় মাহির তাকেই দেখছে। সে আবার মাথা নিচু করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,
-আমি না আর সহ্য করতে পারছি না। মনে হচ্ছে মাথার উপর দিয়ে কয়েক হাজার সূঁচ ফুটিয়ে দিই।
মাহির এশার দুই কাঁধে হাত দিয়ে ধরে ওকে শুইয়ে দিয়ে চুলের মধ্যে হাত দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করে এশা ঘুমিয়ে পড়েছে তাই সে উঠে গিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যালকনিতে গিয়ে বেতের চেয়ারে বসে পরে সে। ল্যাপটপটা এখনো খোলা তার। সেখানেই টেবিলের উপরেই আছে৷ ওটা তখন থেকেই এখানে আছে। হয়তো অনেকটা সময় অন থাকার কারণে নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে ওটা। সে ল্যাপটপটা অন করে আরেকবার মেইলবক্সে গিয়ে টিকিটটা চেক করে। তারিখ আর সময়টা চোখে পড়ে তার সে মাথা ঘুরিয়ে এশা’কে একবার দেখে নেয়। দু’হাতের তালু দিয়ে মুখে ঘষে থুতনির কাছে নিয়ে গিয়ে রাখে। সে ভেবে পাচ্ছে না পরবর্তী পদক্ষেপ কীভাবে নেবে? কী করলে সবার জন্য ভালো হবে। বিশেষ করে এশার জন্য।
রাতটা ব্যালকনিতেই কেটে যায় মাহিরের। সকালের দিকে ঘরে আসে সে। এসে এশার মাথায় হাত রেখে এক পলক দেখে নেয়। এখনও ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। ঘুমোক সে। ঘুম তার সকল কষ্ট লুকিয়ে রাখুক তার থেকে। মাহির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সোজা ছাদে চলে যায়। সকালের দৃশ্যটা মাহিরের কাছে খুব ভালো লাগে কিন্তু আজ কেমন এই ভালোলাগার বিষয়গুলোকে বিরক্তির কারণ বলে মনে হচ্ছে। দেড় ঘণ্টা কেটে যায়। মাহির তখনও ছাদে।
এশার চোখে আলো এসে পড়ে। ব্যালকনির গেট খোলা তাই এই আলোটা ভেতরে এসে ঘুমের সমস্যা করছে। ধীরে ধীরে উঠে বসে সে। মাথার ব্যথা চলে গেলেও কেমন ভার অনুভব হচ্ছে। শাড়ী গয়না গুলো এখনো তার গায়ে৷ রাতে এমন মাথা যন্ত্রণা হলো যে ইচ্ছেই হয়নি ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করতে। কিন্তু গয়না গুলোর জন্য গলায় গালে হাতে দাগ হয়ে গেছে। আর হালকা ব্যথাও করছে। সে ধীরে ধীরে সব গয়না খুলে রাখে বিছানার মাঝখানে তারপর ফ্রেশ হতে চলে যায়। মুখে পানি দিতেই তার খেয়াল হয় তার কোনো কাপড়ই তো এই ঘরে নেই। তাই সে কাপড় নেওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরোয়। যাওয়ার সময় খেয়াল হয় মাহির ঘরে নেই। বেলকনির গেট খোলা ছিল হয়তো সেখানেই আছে। রাতে কী ঘুমায়নি সে! কে জানে! সে আবার ঘরে ফিরে আসে বেলকনির দিকে পা বাড়ায়।
মাহির ছাদের রেলিং ধরে একধ্যানে তাকিয়ে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা নিয়ে বেশ গভীরভাবেই ভাবছে সে।
-কী ভাবছো, তুমি চলে গেলে আমি কী করবো সেটা?
এশা’র কণ্ঠে হঠাৎ এমন কথা শুনে সচকিত হয়ে পেছন ফেরে মাহির৷ এশা দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে বিয়ের শাড়ি এখনও পরে আছে সে। তবে গয়না গুলো মিসিং। হয়তো খুলে রেখেছে৷ কিন্তু গনার কারণে র্যাসের মতো কিছু হয়েছে ওর গায়ে। মাহিরের সেটা দেখে বেশ অপরাধবোধ হয়। সে চেয়েছিল গয়না গুলো খুলে রাখতে কিন্তু এশা তো শুরু তার কাছে মাথায় বিলি কেটে চেয়েছিল। গয়না খোলার পারমিশন তো সে পায়নি।
-কোথায় হারিয়ে গেল?
মাহির ভাবনা জগৎ ত্যাগ করে বাস্তবে ফিরে আসে। এশা এখনও অপেক্ষা করছে মাহিরের উত্তরের। মাহির উত্তর দেয় না। উত্তর না দিয়ে চলে যেতে চায় সে।
Continued…..
Anamika
#মনময়ূরী
৮.
-সবকিছু ঠিকই চলছিল। বিয়েটা হয়ে গেলে কি-ই বা হতো বলো তো। যা হতো আমার সাথে হতো। নাহ! আপনার তো হিরো সাজতে হবে। এখন বোঝো। নিজেই ফেঁসে গেলে। আর ফেঁসে যাওয়ার পরেও নিজের, নিজের ক্যারিয়ারের, নিজের পছন্দের, নিজের ইচ্ছের চিন্তা না করে আমার কী হবে তা চিন্তা করছো। তোমাকে দেখলে না আমার বেশ অবাক লাগে জানো?
মাহির এশার কথাগুলো শুনছে। এশা ঘাড় ঘুরিয়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আবার সামনে দেখে। একটু একটু করে এগিয়ে আসে সে। মাহিরের থেকে দু কদম দূরে দাঁড়িয়ে যায় সে।
-রাতে ঘুমাওনি মনে হচ্ছে! কী হলো উত্তর দাও।
মাহির বলে,
-বলেছে তোকে। বেশ ঘুমিয়েছি আমি।
-বসে বসে আরামের ঘুম হয় সেটা আজ জানলাম। কোনো ব্যাপার না একদিন ট্রাই করে দেখবো বুঝলে। সে যাই হোক, আপাতত পরের কথা পরের জন্য তুলি রাখি। তুমি চলো তো গিয়ে ঘুমোবে কিছুক্ষণ। আমি তোমার বিছানায় আরামসে ঘুমিয়েছি আর এইদিকে তুমি….
মাহির এখনো একই জায়গায় স্থির। সে নড়ছে না। এশা কোমরে হাত রেখে বলে,
-কথা কানে যায় না বুঝি? এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো চলো।
মাহিরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় সে। বলে,
-চলো না বাব্বা।
ওরা মাহিরের ঘরে উপস্থিত। অবশ্য এখন এটা ওদের দু’জনেরই ঘর। এশা মাহিরকে টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে দেয়। বলে,
-এখন কি শুইয়ে দিতে হবে?
মাহির এশার প্রশ্ন শুনে সচকিত হয়। সে আর দেরি না করে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে যায়। এশা মাহিরের পিঠের দিকে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে তারপর বেরিয়ে যায়। নিচে নেমে দেখে এখনও কেউ ওঠেনি। কাল যা কিছু ঘটলো এরপর হয়তো রাতে কেউ ঘুমোইনি। তাই সকালে উঠতে এতো দেরি হচ্ছে। এশা আর দাঁড়িয়ে থাকে না সেখানে। নিজের ঘরে গিয়ে আলমারি খোলে সে। এক সেট পোশাক নিয়ে বেরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
গোসল সেরে ছাদে উঠে যায় এশা। কাপড়গুলো শুকোতে দিয়ে রেলিং ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। মিষ্টি হাওয়া বইছে চারিদিকে। সে চোখ বুঁজে কিছুক্ষণ সেই বাতাসের মিষ্টি মিষ্টি ভাবটা অনুভব করতে থাকে। সকালের মিষ্টি বাতাসের সাথে মিষ্টি রোদ ছুঁয়ে দেয় এশাকে। সময় পেরিয়ে যায়। রোদের মিষ্টি ভাবটা কেটে কঠিন ভাব এশা নিজের মাঝে অনুভব করে। বাতাসটাও কেমন গরম মনে হচ্ছে। ছাদে আর থাকা যাবে না। সে নিচে নেমে আসে। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে যখন নিচে আসার উদ্দেশ্যে চারটে সিঁড়ি পার করেছে তখন মনে হয় তার ঘর তো এখন উপরেই।
এশা ঘরে প্রবেশ করে। মাহির ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে হাসে এশা। এর নাকি ঘুমের প্রয়োজন নেই, সে নাকি ঘুমিয়েছে আর এখন… এখন বিছানা পেয়ে তার প্রমাণ ভালো মতোই দিচ্ছে। এশা একটু এগোয়৷ স্টাডি টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারের উপর মাহিরের পাঞ্চাবীটা পড়ে আছে। গতকাল এই পাঞ্জাবীটাই পরে ছিল মাহির। এশা সেটা উঠিয়ে নিয়ে ভাঁজ করে রাখে। এখন থাক পরে নাহয় পরিষ্কার করে আলমারিতে রেখে দেবে। এশা এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে। সেখানে থাকা ল্যাপটপটা ঘরের ভেতরে এনে রাখে। এরপর ল্যাপটপ সাট ডাউন দিয়ে চার্জে লাগিয়ে দেয়। চার্জ হোক এটা। ততক্ষণ এশা বেলকনিতে বসবে। কিন্তু এখানে বসার জায়গায় সোজাসুজি ভাবে রোদ পড়ছে। সে বেতের চেয়ারটা তুলে ছায়াতে নিয়ে রাখে এরপর সেখানে বসে।
বেলা এগারোটা বাজতে যাচ্ছে। এশা-মাহির কারোও নিচে আসার আভাস না পেয়ে এশার মা বলে,
-কী হলো বলেন তো ভাবি, এখনও জাগেনি ওরা?
-আহা, এতো ভাবছিস কেন? জাগলে তো নিচে আসতোই।
-আমার মনে হয় কী জানেন, এসবের পরে হয়তো দু’জনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে তাই আমাদের সামনে আসছে দ্বিধাবোধ করছে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মাহিরের মা। তিনি বলেন,
-আচ্ছা অপেক্ষা কর। আমি গিয়ে দেখে আসি।
মাহিরের মা মাহিরের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরের গেট অর্ধেক খোলা আছে। সেখান দিয়ে উঁকি দিয়ে বিছানার উপর শুয়ে থাকা তার ছেলের পা দু’টো দেখতে পান তিনি। বেশ দ্বিধাদন্দের মাঝে দিয়ে গেটে নক করেন কিন্তু কোনো সাড়া পান না দেখে বাধ্য হয়ে তাকে গেটটা আরেকটু খুলতে হয়। এইটুকু গেট সরিয়েই বুঝতে পারেন বিছানার উপর মাহির একা শুয়ে আছে। তবে এশা গেল কোথায়? এই বিষয়ে ছেলের উপর একেবারেই ভরসা নেই তার। হঠাৎ মনে হয়, রাতে মেয়েটাকে বকাঝকা করে ঘর থেকে বের করে দেয়নি তো! তবে কি একবার নিচে গিয়ে দেখে আসবেন তিনি। এশা নিজের ঘরে আছে কিনা। তিনি তাই করেন। ফিরে যেতে নেন। পরেই আবার ভাবেন কোথাও এশাকে মেঝেতে শুতে দেয়নি তো মাহির! কিছুক্ষণ ভাবেন। ভাবেন ভেতরের যাবেন কিনা। কিন্তু ডেকেও তো কোনো কাজ হচ্ছে না। কেউ সাড়া দিচ্ছে না। তিনি ভেতরে যান। এপাশ ওপাশ সবটা দেখেন। নাহ, এশা কোথাও নেই। এশা নেই দেখে আগে ওয়াশরুম চেক করেন তারপর জানালা দিয়ে বেলকনির বসে থাকার জায়গাটাও দেখে নেন। এখানেই নেই এশা। এবার মাহিরকে ডাকেন।
-মাহির।
মাহির সাড়া দেয় না। কী করে দেবে। ঘুমিয়েছে বেশি সময় হয়নি। তিনি আবার ডাকেন। নাহ, মাহির উঠছেই না। কাঁধে রাত রাখেন তারপর ডাকেন। তাতেও সাঁড়া নেই। পিঠে আস্তে করে চাটি মেরে ডাকেন তখনও সাড়া নেই। কী করবেন না করবেন ভেবে এবার পিঠের উপর বেশ জোরেই চাপড় মারেন তিনি। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মাহির। একটা হাত পিঠে রেখে পাশে তাকায় সে। মাকে দেখতে পায়। ব্যথিত চেহারার ভাব আর চোখে প্রশ্নের ভাব নিয়ে তাকায় সে। তার মায়ের সোজা প্রশ্ন,
-এশা কোথায়?
-এশা, এখানেই তো ছি…..
ছিল বলতে গিয়ে বলতে পারলো না সে। সত্যিই তো এশা নেই এখানে। সে লাফ দিয়ে বিছানার উপরে হাঁটু ভরে বসে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ ভাবে। চিন্তিত মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে তার।
-মা, এশা ঘরে নেই তো কি হয়েছে বলো তো। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখো না। এতটুকুও কমনসেন্স নেই তোমার! ঘুমন্ত ছেলেকে এইভাবে মেরে জাগাও তুমি। যাও তো ঘুমোতে দাও।
বলেই শুয়ে পড়ে মাহির। আবারও পিছে ব্যথা পায় সে। এবারও মা চাটি মেরেছে। এবারেরটা আরও জোরে। সে মায়ের দিকে ব্যথাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
-ওরে কমনসেন্সের বাচ্চা। ওঠ। তোর কী মনে হয় আমি ওয়াশরুমে দেখিনি। ওয়াশ রুমে দেখেছি আর বেলকনিতেও। কোথাও নেই মেয়েটা। সত্যি করে বল, তুই রাগের মাথায় কিছু করিসনি তো।
মাহিরের মেজাজটা বিগড়ে যায়। সে কণ্ঠস্বর উঁচু করেই বলে,
-আরেএএ ধ্যাত! এই কথাটা তুমি আমায় আস্তে ভালো করে বলতে পারতে না?
-এখানে একটা মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না আর তুই পড়ে আছিস ঘুম নিয়ে।
মাহির নিজেকে শান্ত করে। সে তো ঘুমোতে চায়নি। কিন্তু একবার ঘুম চোখে যখন ভর করেছে এখন আর ছাড়তে চাইছে না। সে নিজেকে শান্ত করে বলে,
-মা, তুমি কি এশার ঘরটা দেখেছ?
-না।
-তবে সেখানে গিয়ে দেখো। আমি আসছি।
মাহিরের মা গেটের দিকে এগোন আর মাহির ওয়াশরুমের দিকে।
মাহিরের উঁচু আওয়াজ শুনে এসা রুমে ছুঁটে এসে দেখে বড় মা গেটের কাছে। উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। এশা পেছন থেকে ডাক দেয়।
-কিছু বলছিলে বড় মা?
মাহিরের মা পেছন ফেরেন। এশা’কে দেখে স্বস্তি অনুভব করেন তিনি। এগিয়ে এসে এশার হাতটা ধরে বলেন,
-কোথায় ছিলিস তুই?
এশা বেলকনির দিকে ইশারা করে। তিনিও দেখেন সেদিকে তারপর বলেন,
-আমি তো দেখলাম তুই ওখানে নেই।
-ও। আসলে ওইখানে রোদ পড়ছিল তো তাই আমি চেয়ার টেনে অন্যপাশে বসেছিলাম। গেটের আড়ালে ছিলাম বলেই হয়তো দেখতে পারোনি। কিন্তু তুমি আমায় ডাক দাওনি কেন?
-টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম রে মা।
এশার গালে হাত দিয়ে বলেন। এশা কথাটা শুনে তার বড় মা’কে জড়িয়ে ধরে৷
মাহিরের মা ওদের দু’জনকে একসাথে নিচে এসে খেয়ে নিতে বলে স্থান ত্যাগ করেন। মাহির এতক্ষণ নিরব দর্শকের মতো চেয়েছিল। এবার সে এশাকে বলে,
-যখন এইভাবেই আমার ঘুম নষ্ট করার ছিল তখন ঘুমোতে বললি কেন?
-সরি।
-রাখ তোর সরি।
বিরক্ত হয়ে মাহির ওয়াশরুমে ঢোকে। গেট লাগাচ্ছিল তখন এশার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে। এশা বলে,
-মাঝখানে আর মাত্র চারটা দিন। আমায় এই চারদিন সহ্য করে নাও তারপর তো চলেই যাবে।
মাহির কথাটা শুনে গেট লাগানো থামিয়ে দেয়। এশা বলে,
-যাই হোক আমি নিচে যাচ্ছি। তুমিও চলে এসো।
মাহির যখন গেট খুলে দেখলো ততক্ষণে এশা বেরিয়ে গেছে। এশার ওড়নার একটা কোণা দেখতে পেল শুধু। হয়তো গেট খুলতো না মাহির কিন্তু এশার বলা শেষের কথাটা শুনে মনে হলো এশার গলাটা ভেঙে আসছে। এশা কী কাঁদছিল তবে! মাহিরের মনে প্রশ্ন জাগে। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর নেই।
Continued…..