মনের নদী বেশি গভীর,০২,০৩
আমিনা তাবাস্সুম
(২)
ট্রেনে উঠে আমি কিছুক্ষন গুম হয়ে বসে থাকলাম। হঠাৎ করে কী হলো যেন বুঝে উঠতে পারছিনা। মেয়েটি হুমকি দেবার পর আর কথা বাড়াইনি। সোজা মেয়েটাকে সেখানে রেখে টিকেট ব্যারিয়ারে আমার কার্ড টাচ করে প্ল্যাটফর্মে চলে এসেছি। ভয়ে আমার বুক ধুকপুক করছিলো। কী রকম একটা ভয় তা আমি ঠিক বুঝাতে পারবো না। মনে হচ্ছিলো মেয়েটি পিছে পিছে আসবে। তারপর পিছন থেকে আমার পিঠে একটা ছুরি বসিয়ে দিবে। ভয়ে প্ল্যাটফর্মে গিয়েই দৌড়ে যেই ট্রেন চোখের সামনে পেয়েছি সেটাতে উঠে বসেছি। তারপর পরের স্টেশনে নেমে কিছুক্ষন অপেক্ষা করে আবার ঠিক ট্রেনে চড়ে বসেছি।
ট্রেনে বসে একটু নিজেকে ধাতস্ত করে তারপর পুরো ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছি। এটা পরিষ্কার যে মেয়েটা কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ছিল। কোনো মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে এরকম আচরণ করতে পারে না। কিন্তু ঘটনা কী তা তো কিছুই জানা হলো না। এইটুকু কথা থেকে কি আর কিছু বুঝা যায়? মেয়েটা নিশ্চয়ই আমার সংস্থা থেকে কোনো সাহায্য নিতে আসেনি। তা হলে বার বার অফিসের সামনে আমার জন্য না দাঁড়িয়ে থেকে সোজা অফিসের কারো সাথে কথা বলার চেষ্টা করতো। তার মানে মেয়েটা শুধু আমার সাথে দেখা করতেই এসেছিলো।
এই ভাবতেই আমি আমার হাজবেন্ডকে মেসেজ করে দিলাম,
– খুবই সরি। ফিরতে দেরি হচ্ছে। রাস্তায় এক মেয়ে আমার ফেসবুক ফলোয়ার বলে পরিচয় দিয়ে আমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছে। কোনো রকমে তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আমি এখন ট্রেনে উঠেছি। এখন অন-লাইনে পুলিশে একটু রিপোর্ট করে দিবো। যদিও কিছু লাভ হবে না। মেয়েটা সম্পর্কে আমার কোনো তথ্যই নেই। যাই হোক, তোমার জন্মদিনে তোমার জন্য একটু রান্না করতেও পারলাম না। কী খেতে চাও বলো, আমি অন-লাইনে অর্ডার করে হোম ডেলিভারি নিয়ে নিবো।
সাথে সাথেই ওর রিপ্লাই,
– কী হেনস্থা করেছে? তুমি ঠিক আছো তো?
– আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না। এসে সব বলবো। কী খাবে বলো?
– আমার খাবারের জন্য চিন্তা কোরোনা। আমি বাসায় চলে এসেছি। আমি কিছু একটা রান্না করছি। তুমি তাড়াতাড়ি আসো।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ওর রোজ কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়। আজকে আমিই বলেছিলাম একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে। ওর জন্মদিন উপলক্ষে একটু রান্না করে সবাই একসাথে খাবো। ঠিক ঠিক ও তাড়াতাড়ি ফিরেছে। আর আমিই ফিরতে পারলাম না।
স্টেশনে নেমেই একটা বেকারি খোলা পেয়ে সেখান থেকে একটা কেক কিনে নিলাম ওর জন্য।
বাড়ি ফিরে দেখি রায়ান, রিদা আর ওদের বাবা ডিনার তৈরি করে আমার অপেক্ষায় আছে। ডিনার মানে এক হাড়ি চিকেন পাস্তা। ঝাল ঝাল করে থাই স্টাইলে রান্না। এটা আমার হাসবেন্ডের সিগনেচার ডিশ। রায়ান আর রিদা টুইন ভাই বোন। সতেরো বছর বয়স ওদের। ওরা দুইজন আমাদের বাসার প্রাণ। যতক্ষণ বাসায় থাকে, ওদের খুনসুটিতে বাসাটা একেবারে জমজমাট থাকে। এমনিতে আমরা একেকজন একেক সময় বাসায় ফিরি। মাঝে মাঝেই আমাদের একসাথে ডিনার করা হয়না। আজকে বিশেষ উপলক্ষ্যে সবাই পরিকল্পনা করেই একসাথে হয়েছি। ইশ, কেন যে আগে রান্না করে রাখলাম না? কতকিছু রান্না করার প্ল্যান করেছিলাম। বাজারও করে রেখেছিলাম।
সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া শেষে কেক কাটা হলো। সেই কেক দেখেও আমার মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। কেকের উপর লিখে এনেছিলাম, “হ্যাপি বার্থডে টু আশফাক”। কেকটা বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসার সময় ধাক্কা লেগে “আশ” লেপ্টে মুছে গিয়েছে। নামের শেষ অংশটুকু শুধু কোনোরকমে ঝুলে আছে। এই দেখে রায়ান আর রিদা তো হেসেই কুটি কুটি। সাথে ওদের বাবাও যোগ দিয়েছে দেখি। হাসার কী আছে বুঝলাম না। এদের মাথায় খালি খারাপ জিনিস ঘুরে কেন? তবে এই হাসাহাসির জন্য সেই নদী মেয়েটার কথা কিছুক্ষনের জন্য ভুলে ছিলাম।
রাতে মন খারাপ করে আশফাককে বললাম,
– তোমার জন্মদিনে কিছুই করতে পারলাম না। তুমিই রান্না করে খাওয়ালে।
আশফাক দুষ্টু হেসে বললো,
– কিছু করার সময় তো আর চলে যায়নি। সারা রাত পড়ে আছে। তুমি চাইলেই সব পুষিয়ে দিতে পারো। আমি মানা করবো না।
– ধুর, তোমার মাথায় শুধু আজেবাজে জিনিস ঘুরে কেন? বয়স হয়েছে না এখন।
– বয়স কোথায় হলো? আমার তো মনেহয় আমি এখনো যুবক।
– হ্যাঁ, ৪৫ বছরের যুবক।
– ঘরে সুন্দরী বউ থাকলে হাসবেন্ডদের কষ্ট করে হলেও যুবক সেজে থাকতে হয়।
আমি মোটেও তেমন সুন্দরী না। তাছাড়া ঘরে সুন্দরী বউ থাকতেও অনেক স্বামীদের চোখ যে বাইরে থাকে সেটা আমার অজানা না। তারপরও আশফাক মাঝে মাঝে আমাকে খুশি করার জন্য এরকম প্রশংসা করে। ওর এই খুশি করার চেষ্টাটা আমার ভীষণ ভালো লাগে।
তারপরই আশফাক নিজেই আবার বলে উঠলো,
– অবশ্য তোমার প্রাণের রিদওয়ান ভাইয়ের মতো হলে আলাদা কথা। উনি তো মনেহয় অন্যের বউদের জন্য কষ্ট করে যুবক সেজে থাকে।
– উফ, তুমি এত হিংসুটে একটা মানুষ।
আমি যে রিদওয়ান ভাইয়ের ভক্ত এটা আশফাকের একেবারে দুই চোখের বিষ। রিদওয়ান ভাইকে পচানোর কোনো সুযোগ আশফাক ছাড়ে না। আজকের ঘটনা শুনে সে তাই মহা উত্তেজিত। ও নাকি পুরোপুরি নিশ্চিত যে ওই নদী মেয়েটার সাথে রিদওয়ান ভাইয়ের কিছু একটা গড়বড় আছে। আমি আশফাককে সব বলেছি কিন্তু বলিনি যে নদী বলেছে আমার সাথে তার সম্পর্ক আছে। আশফাককে বলেছি যে আমি তার বন্ধু বলে আমার সাহায্য নিয়ে রিদওয়ান ভাইকে ফিরে পেতে চায় মেয়েটা। কিন্তু ও যে আমার কাছে এসেছে সেটা রিদওয়ান ভাইকে জানাতে পারবো না। জানালে মেয়েটা নাকি আত্মহত্যা করবে।
কেন এই কথাটা লুকালাম আমি জানিনা। আমার এখন খারাপ লাগছে। কিন্তু এমনিই আশফাক মনেকরে আমি অযথা রিদওয়ান ভাইকে বেশি পাত্তা দেই। এর উপর আবার বাইরের মানুষ যদি এসে বলে তার সাথে আমার কিছু চলছে, তাহলে ও আবার যদি কোনো সন্দেহ করে বসে?
আজকের সব ঘটনা শুনে আশফাক আমাকে বলেছে যে সোজা রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। তাকে বলে দিতে যে তার উটকো সমস্যা যাতে নিজে সামলায়। এসবের কারণে আর যাতে আমাকে হেনস্তা না হতে হয়। আর আমি যাতে এরপর এই নদীকে দেখা মাত্র সোজা পুলিশ কল করে দেই। আমার মাথা এখন কাজ করছে না। পরে ঠান্ডা মাথায় সব চিন্তা করে দেখতে হবে।
আপাতত আমি আশফাককে খুশি করায় মনোযোগ দিলাম। বেচারার জন্মদিনে ওর জন্য কিছুই করা হয়নি।
আশফাক ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি মোবাইল ফোনটা হাতে নিলাম। একটুও ঘুম আসছেনা আমার। ফেসবুকটা খুলে নিয়ে আমি বন্ধু লিস্টে নদী নামের কেউ আছে নাকি খুঁজে দেখলাম। নাহ, কেউ নেই। ফলোয়ার লিস্টেও নেই। রিদওয়ান ভাইয়ের পুরো বন্ধু লিস্ট দেখা যায়না। হাইড করে রাখা। তাও তার প্রোফাইলে গিয়ে “নদী” টাইপ করে সার্চ করে দেখলাম। কিছু পেলাম না। এরপর ফেসবুকে “নদী” নাম দিয়ে সার্চ করলাম। শত শত নদী আছে। আমি তো ভেবেছিলাম এটা একটা আনকমন নাম। পৃথিবীতে এত “নদী” আছে কেন? আর ওই মেয়ের নাম আসলেই কি নদী নাকি? ওর ভালো নাম কী? কিছুই তো জানিনা। মেজাজ খারাপ করে এক এক করে সব নদীর প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা শুরু করলাম। নাহ, এইভাবে কিছু হবে না। অনেকের প্রোফাইল লক করা। অনেকের প্রোফাইলে নিজেদের কোনো ছবি নেই। অনেকের প্রোফাইলে পাবলিক পোস্ট নেই বললেই চলে। তাই বন্ধু না হলে কোনো কিছুই দেখা যাবে না। ইশ, মানুষজন কত গোপনীয়তা মেনে, সচেতন হয়ে ফেসবুক ব্যবহার করে। আর আমি? আমার প্রোফাইলটাকে একেবারে হাট বাজার বানিয়ে রেখেছি। টম, ডিক এন্ড হ্যারি – সবার অবাধ বিচরণ।
এই ভাবতেই আমার প্রোফাইলে চলে এলাম। খেয়াল করলাম গত তিন চার মাসের বেশিরভাগ পোস্টের সাথে কোনো না কোনো ভাবে রিদওয়ান ভাই জড়িত। আমার ফেসবুক প্রোফাইল দেখেই কি নদী মেয়েটার এরকম উদ্ভট ধারণা হয়েছে?
আমি লন্ডন ভিত্তিক একটা চ্যারিটি সংস্থার পার্টনার কাম ম্যানেজার। আমাদের চ্যারিটি মূলত দক্ষিণ এশীয় মহিলাদের বিভিন্ন ধরণের সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। যদিও দক্ষিণ এশীয় বলি, আসলে বাংলাদেশি মহিলাদের নিয়েই আমরা বেশি কাজ করে থাকি। সেই কাজের ব্যাপ্তি বিশাল – অ্যাডভাইজ, সাপোর্ট, কাউন্সিলিং থেকে শুরু করে শিক্ষা, চাকরি, বাসস্থান এবং বিভিন্ন ধরণের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। বেশ ছোট চ্যারিটি হিসেবে শুরু করেছিলাম কিন্তু ধীরে ধীরে এর প্রসার ঘটছে। ডোমেস্টিক অ্যাবিউজ, ফোর্স ম্যারেজ, মেন্টাল এবং সে*ক্স*চুয়াল হেলথ থেকে শুরু স্বনির্ভরতা অর্জন সব ব্যাপারে মহিলারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। পনেরো বছরের পাকাপোক্ত সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার আরেক সহকর্মী এবং বন্ধু রিতা আপার সাথে পার্টনারশিপে এই চ্যারিটিটা শুরু করি। আমার এখানে বহুমুখী কাজ। টিম ম্যানেজ করা, বাজেট ম্যানেজ করা, রিপোর্ট লেখা, পরিসংখ্যান বের করা, রিসার্চ, মিডিয়া কাভার থেকে শুরু করে প্রয়োজনে ক্লায়েন্টদের সাথে সরাসরি কাজ করতে হয়। আর আমার একটা বড় কাজ হচ্ছে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে ফান্ডিং জোগাড় করা। ছোট এবং বড়ো, অনেক সংস্থার সাথে পাল্লা দিয়ে বড়ো বড়ো ফান্ড জোগাড় করা সহজ কোনো ব্যাপার না। ফান্ডিংয়ের অ্যাপ্লিকশন খুব পাকাপোক্ত হতে হয়। আর সেই জায়গায়ই আমার রিদওয়ান ভাইকে দরকার।
আমরা সাধারণত প্রথমে সামান্য বাজেটে ছোটখাটো প্রজেক্ট শুরু করি। তারপর রিদওয়ান ভাইয়ের মতো প্রভাবশালী সাংবাদিক আমাদের প্রজেক্টের ফলাও করে মিডিয়া কাভারেজ করে। এতে করে শুধু আমাদের পরিচিতিই বাড়ে না, অনেক অনেক মহিলারা সাহস করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। এসব সবকিছু আমাদের আরো ফান্ড পেতে সাহায্য করে। প্রজেক্ট বড়ো করতে সাহায্য করে।
আর রিদওয়ান ভাই বিভিন্ন বিষয়ের সাংবাদিকতা করলেও তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন বাংলাদেশি মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপর কাজ করে। আমাদের মতো সংস্থার সাথে যুক্ত থাকতে পারলে নারীর ক্ষমতায়নের উপর নতুন নতুন নিউজ কাভার করা তার জন্য সহজ হয়। গত দুইবছর ধরে আমরা একজোটে বেশ ভালো কিছু কাজ করেছি। আর গত তিনমাস ধরে যেই প্রজেক্টে কাজ করেছি সেটা তো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খুবই প্রচার এবং প্রসার লাভ করেছে। আমাদের হ্যাণ্ডসাম, ক্যারিশম্যাটিক, ইয়ং লুকিং রিদওয়ান ভাইও মহিলাদের মাঝে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, আর আমরা জোগাড় করেছি বড়ো বড়ো ফান্ড। আর স্বীকার করতেই হবে যে এর সাথে আমি নিজেও একজন জনপ্রিয় সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। আর এসব কাজের প্রয়োজনেই আমাদের এই উন্মুক্ত ফেসবুক, হাট বাজারের মতো ফ্যান ফলোয়ার।
এই দুইবছরে আমি রিদওয়ান ভাইকে যত দেখেছি তত মুগ্ধ হয়েছি। অসাধারণভাবে আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে গাইড করেছেন তিনি। নারী সমাজের এই জনপ্রিয়তা তিনি ভীষণভাবে উপভোগ করেন। সময় এবং পারিপার্শ্বিকতা বুঝে তাকে আমি মহিলাদের সাথে হালকা পাতলা ফ্লার্ট করতেও দেখেছি। আমার সাথেও কালেভাদ্রে করেন। আমিও তা বেশ উপভোগ করি এবং সময় বুঝে রেসিপ্রোকেটও করে থাকি। কিন্তু সবসময় লিমিট বুঝেই সেটা করেন তিনি। সীমার সামান্য বাইরে তাকে কখনো যেতে দেখিনি আমি। কখনও না। তাছাড়া তিনি ভীষণ ইমেজ সচেতন। সেকারণেই মনেহয় নিজেকে একজন আদর্শ পুরুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন – একজন আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা এবং আদর্শ পুরুষ। প্রেম ভালোবাসার প্রতি তার আকর্ষণ আছে। কিন্তু প্রেম তার কাছে স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক যা নাকি এমনিতেই বয়ে চলে। কিন্তু যেই ইমেজ তিনি তৈরি করেছেন তা তার কাছে মহা মূল্যবান। স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিকভাবে অর্জিত না, কষ্টার্জিত প্রাপ্তি। কোনো উপায়ই সেই ইমেজের সাথে আপোষ করার মানুষ তিনি না।
সে কারণেই এই নদীর ব্যাপারটা নিয়ে আমার এত সংশয়। অপরদিকে চোট খাওয়া মেয়েদের নিয়ে আমার কাজ। প্রেমে পাগল হয়ে কাউকে বিশ্বাস করে নিজেকে দেউলিয়া করে দেওয়া মেয়েদের দেখলে আমি চিনতে পারি, নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দেবার পর অপমানিত, লাঞ্চিত হয়ে ফিরে আসা মেয়েদের দেখলে আমি ধরতে পারি, কোনো উপায়ান্ত না পেয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে হাতের কাছের খড়কুটো আঁকড়ে ধরে শেষ চেষ্টা করা মেয়েদেরও আমি বুঝতে পারি। নদীকে আমার সেরকম একজন মেয়ে মনে হয়েছে।
কত বয়স হবে মেয়েটার? বিশ বড়োজোর পঁচিশ? কত বয়স হবে রিদওয়ান ভাইয়ের? পঞ্চাশের কাছাকাছি তো হবেই।
আমি ফেসবুকে আবার নদীর খোঁজে মনোনিবেশ করলাম।
সেই সময় হঠাৎ নতুন নোটিফিকেশন। কাকতালীয়ভাবে রিদওয়ান ভাইয়ের কমেন্টের নোটিফিকেশন। গত উইকেন্ডে আমার একটা শাড়ি পরা ছবি পোস্ট করেছিলাম। নীল জমিনের উপর সাদা কাজ করা একটা সুতির শাড়ি পরা ছবি। সেখানে তিনি ছোট্ট একটা কমেন্ট করেছেন,
“ভালোবাসার রং নীল”
কমেন্টটা দেখে আমার কেন যেন বুক কেঁপে উঠলো। অল্প কিছুক্ষণ চিন্তা করে আমি রিপ্লাই করলাম,
“আমি তো জানতাম বেদনার রং নীল”
প্রায় সাথে সাথেই জবাব পেলাম।
“ভালোবাসার অপর নামই তো বেদনা। তাই না নাফিসা?”
একটা পাবলিক পোস্টের নিচে আমাদের এই কমেন্ট চালাচালি। আমার হঠাৎ মনে হলো, নদী মেয়েটা কি এই মুহূর্তে এসব দেখছে?
আমি মোবাইলটা তাড়াতাড়ি বেডসাইড টেবিলে রেখে আশফাকের সাথে লেপ্টে শুয়ে থাকলাম। আমার কিছু ভালো লাগছেনা।
(চলবে)
মনের নদী বেশি গভীর
(৩)
বৃহস্পতিবার আমাদের অফিস ডে। অন্যান্যদিন যে যেখান থেকেই কাজ করুক না কেন, বৃহস্পতিবারে সবাই অফিসে একত্রিত হয়ে কাজ করে। এই ডিজিটাল যুগে আমাদের কাজগুলো একদিকে কঠিন হচ্ছে আবার আরেকদিক থেকে বেশ সহজ হয়ে যাচ্ছে। কাজের জন্য আজকাল অফিসে আসা লাগেনা। ক্লায়েন্টদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ জুম, টিমস, হোয়াটস্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার এসবের সুবাদে ঘরে বসেই সেরে ফেলা যায়। আর এই টেকনোলজির সুবাদে আমাদের নতুন নতুন ক্লায়েন্ট পেতেও সুবিধা হচ্ছে। অনেক মহিলাই অফিসে এসে আমাদের সাথে দেখা করতে পারেনা। বাড়িতেও নানা সমস্যার কারণে আমাদের যেতে বলতে পারে না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে সেবা দান এবং সেবা গ্রহণ সহজ থেকে সহজতর হয়ে যাচ্ছে। আর সাথে হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে আমাদের ক্লায়েন্ট বা সার্ভিস ইউজার।
প্রতি বৃহস্পতিবার সারাদিন আমরা সবাই মিলে সব প্রজেক্টের পরিকল্পনা, বাজেট, টাইম টেবিল, অগ্রগতি, পরবর্তী পদক্ষেপ এসব নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করি। আমাদের এখানে অল্পকয়েকজন বেতনভোগী কর্মচারী। আর বাকিরা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। বিশেষকরে মহিলারা যারা আগে এধরণের চ্যারিটি সংস্থা থেকে উপকৃত হয়েছে তারা অনেকেই পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় কাজ করে যায়। এছাড়া নতুন চাকরি বাকরি খুঁজছে এমন মহিলা অথবা এইদেশে নতুন এসেছে এরকম অনেক মহিলাও আমাদের সংস্থায় ভলানটারি কাজ করে থাকে। এখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, তারপর জব মার্কেটে নামা সুবিধা হয়।
এই স্বেচ্ছাসেবীদের কারণেই আমরা অনেক ভালো ভালো কাজ করতে সক্ষম হচ্ছি। আমি এখানকার পার্টনার হলেও আমি একজন বেতনভোগী কর্মচারী। মানে চ্যারিটির রেজিস্ট্রেশনে আমি একজন পেইড ডিরেক্টর। ফুল টাইম কাজের চেয়েও অনেক বেশি সময় এর পিছনে আমাকে দিতে হয়। আমাদের আরেকজন পার্টনার রিতা আপা একটা বিশাল হাই প্রোফাইল থিয়েটার ক্লাব চালান। এটা তার শখের চ্যারিটি। বেতনের তার প্রয়োজন নেই। বরং তার থিয়েটারের লাভের কিছু অংশ তিনি এই চ্যারিটিতে নিয়মিত দান করেন। তিনি মাঝে মাঝে এসে আমাদের কাজ দেখে যান আর গল্পগুজব করে যান। তাই ম্যানেজমেন্টের বেশিরভাগ কাজ আমাকেই করতে হয়।
এখন বেলা বারোটা প্রায় বাজে। টানা সকাল নয়টা থেকে মিটিং চলছে। এখন কিছুক্ষনের চা, নাস্তার ব্রেক। আমরা বেশিরভাগই এখানে বাংলাদেশি। আমার মতো ফার্স্ট জেনারেশন ইমিগ্রেন্টই বেশি, কিন্তু ইংল্যান্ডে বড়ো হওয়া বাংলাদেশি কয়েকজনও আছে। মিটিংয়ের প্রথম অংশে সাধারণত যেই কাজগুলো হাতে আছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। আর তারপর ব্রেকের পর ভবিষ্যতে কী নিয়ে কাজ করা যায় সেই নিয়ে ব্রেইন স্টর্মিং চলে।
মিটিং আবার শুরু করতেই দেখলাম ফারাহ খুবই উত্তেজিত। ওর মাথায় নাকি এমন এক প্রজেক্টের ভাবনা আছে যা নিয়ে ওর জানা মতে আনুষ্ঠানিকভাবে আগে কখনও কেউ কাজ করেনি। কিন্তু এই নিয়ে কাজ করা নাকি এখন খুবই দরকার। কারণ এই সমস্যা নাকি মহামারী আকার ধারণ করেছে।
ফারাহ কোনো কিছু সোজাসুজি বলতে পারেনা। কিছু বলার আগে এত ভূমিকা দিতে থাকে যে মূল বক্তব্যে যাবার আগেই সবাই ওর কথা শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মিটিং এ মাঝে মাঝে ওকে থামিয়ে আবার লাইনে আনতে হয়। নাহলে ওর ভূমিকা লতাপাতা গজিয়ে কোথায় চলে যায় যে আসল কথা আর শুনা হয়না। তবে মেয়েটা সাংঘাতিক কাজের এবং ওর আইডিয়াগুলো সবসময় চমৎকার। বর্তমান নারী সমাজের সমস্যাগুলো সম্পর্কে ওর খুব আগ্রহ, অনেক পড়াশুনা করে আর ওর অন্তর্দৃষ্টি এবং দূরদৃষ্টি দুটাই প্রখর। ওর কাজ এবং কাজের আইডিয়া দুইটার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে।
ফারাহ এখনো এই মহামারী সমস্যার সমাধানের যে কত প্রয়োজন তা বলেই যাচ্ছে। সমস্যা টা যে কী তার টিকিও এখনো দেখা যায়নি।
আমি অগত্যা ফারাহ কে থামিয়ে দিলাম। বললাম,
– আচ্ছা বুঝলাম যে আমাদের এখন সব কাজ বাদ দিয়ে এই মহামারীর দিকে মন দেওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা টা যে কী তা না বললে মন দিবো কেমন করে?
ফারাহ বললো,
– খুব পরিচিত সমস্যা। একেবারে ঘর ঘর কা কাহিনী। এমনকি আমি, আপনি এবং আমরা সবাই হয়তোবা এই সমস্যার কোনো এক পর্যায়ে আছি অথবা যে কোনো সময় এর কবলে পড়ে যেতে পারি। তাই আগে থেকেই সুরক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়োজন সচেনতা – awareness raising।
– সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু সমস্যাটা কী সেটা তো আগে বলবে।
– সমস্যা টা খুবই কমন। অন-লাইনে পরকীয়া।
রুবিনা ওর কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো। আমিও একটু আশাহত। এই সমস্যা আবার কী এমন সমস্যা। আর এই নিয়ে আমরা কীই বা করতে পারি।
ফারাহ, আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে বলা শুরু করলো,
– আচ্ছা, আপনারা মনেহয় ব্যাপারটার ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন না। আমি গত তিনমাসে ছয়জন মহিলার সাথে কাজ করেছি। এর মধ্যে চারজনই এই মহামারীর শিকার, ভুক্তভোগী। কিন্তু এই মহিলাগুলো এই সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে নি। সবাই এসেছে ডিপ্রেশন, মানসিক সমস্যা, সেলফ হার্ম, আত্মহত্যার প্রবণতা এসব নিয়ে। কেউ স্বামী, পরিবার, সন্তান সব হারিয়ে একেবারে পথে নেমে এসেছে। কেউ উদ্ভ্রান্ত হয়ে এসেছে। কিন্তু এদের সাথে কাজ করে দেখতে পেলাম যে এই সব সমস্যাগুলো হলো রোগের উপসর্গ। আসল রোগ না। আসল রোগ অন-লাইন পরকীয়া। এরা সব পরকীয়া করে এই অবস্থায় এসেছে।
এই শুনে কেউ কিছু বলছেনা। সবাই মনেহয় কিছুটা কনফিউজড। রুবিনা বলে উঠলো,
– তোমার কথা বুঝতে পারছি ফারাহ। আমার কয়েকজন পরিচিত এইসব নিয়ে নানান ঝামেলায় পড়েছে। জীবন একেবারে তছনছ হয়ে গেছে।একজনের তো আঠারো বছরের সংসার ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু এই নিয়ে আমরা কী করতে পারি? একহাতে কখনো তালি বাজে না। এসবক্ষেত্রে দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জড়িত। যারা এসবে জড়িত তারা সবাই জানে যে তারা অনৈতিক কিছু করছে। তারপরও নিজেদের ভাসিয়ে দেয়। এর পরিণতি তো সবাইকে ভোগ করতেই হবে।
এটা শুনে ফারাহ বলে উঠলো,
– একদম ঠিক কথা রুবিনা – “এর পরিণতি তো দুই পক্ষকেই ভোগ করতেই হবে”। কিন্তু সমস্যা হলো এর পরিণতি দুই পক্ষ সমানভাবে ভোগ করেনা। সব ক্ষেত্রে আমি বলছিনা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলারা বেশি সাফার করে। পুরুষরা কেমন করে জানি পার পেয়ে যায়। তাছাড়া এমন অনেক মহিলা আছে যারা শিশুদের মতোই ভালনারেবল, অজ্ঞাত, অন-লাইন জগৎ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। তাদেরকে টার্গেট করে এক্সপ্লয়েট করা হয়। যেমন আমার ক্লায়েন্টদের কথাই ধরা যাক। তাদের যদি এসব সম্পর্কে ধারণা থাকতো তাহলে হয়তোবা, আমি আবার বলছি “হয়তোবা” এত সহজে এভাবে ফাঁদে পা দিতোনা। তাছাড়া এই বিষয় নিয়ে কোনো ভুক্তভোগী কখনো কথা বলবেনা। কারণ আমাদের সমাজ অনেক জাজমেন্টাল। অনেকেই গোপনে নিজেদের ধ্বংস করে দেবার চেষ্টা করে। সেকারণেই এই ব্যাপারে মহিলাদের মধ্যে আমাদের সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং যারা সাফার করছে তাদের সাহায্যের জন্য একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরী করতে হবে।
সাদিয়া আপা বলে উঠলো,
– যেইসব মহিলারা এই ফাঁদে পা দেয় এদের মন নোংরা। মহিলাদের জন্য কাজ করি দেখে মহিলাদের ব্যাপারে একেবারে অন্ধ হয়ে গেলে তো হবে না। সবসময় শুধু পুরুষদের দোষ ধরলে তো হলো না। অনেক মহিলারা পুরুষদের সাথে ফেসবুকে এত ঢলাঢলি করে যে দেখলে একজন মহিলা হিসেবে আমার নিজেরই লজ্জা লাগে। দেখে মনেহয় এরাই তো পুরুষদের এক্সপ্লয়েট করছে। এই কারণে আমি তো ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এসেছি। এতই যখন রিস্ক, এতই যখন মহামারী তখন এসবের মধ্যে থাকা দরকার কী?
ফারাহ দেখি নাছোড়বান্দা। সবাইকে বুঝিয়েই ছাড়বে। ও বলে উঠলো,
– সাদিয়া আপা, এত সহজ সরল ব্যাপার এটা না। তাহলে তো অন-লাইন সেফটি নিয়ে সারা পৃথিবীতে এত সচেতনতা তৈরির কাজ চলতোনা। সোজা অন-লাইনের ব্যবহার ব্যান করে দেওয়া হতো। সব পুরুষদের দোষ আমি বলছি না। অবশ্যই এক হাতে তালি বাজে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ফ্রড করে মহিলাদের ব্ল্যাকমেইল করা হয়। অনেক সময় মহিলাদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে অনেকে শুধু কিছুদিন মজা নেয়। মাঝখান দিয়ে মহিলারা ইমোশনালি ইনভল্ভড হয়ে অনেক সিরিয়াস হয়ে যায়, নিজেদের বিলিয়ে দেয়। তারপর ধরা খায়।
আমি বললাম,
– আচ্ছা, ফ্রডদের কথা না হয় বুঝলাম। তাদের ব্যাপারে সচেতনা তৈরির কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু যারা শুধু মজা নেয়, তাদের জন্য মহিলারা দিওয়ানা হলে আমাদের কী করা?
– আপা, এখানে গরুমিংয়ের ব্যাপার আছে। ধরেন আপনি একজন লোনলি মানুষ। অথবা আপনি সংসার জীবনে অসুখী। বা আপনার মনেহয় আপনার জীবন অপূর্ণ। পরিবার, স্বামী, সন্তান কারো কাছ থেকে কোনো ভালোবাসা পান নি। একটা বয়সে এসে আপনি ক্লান্ত। আপনার ধারণা আপনি কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্য না, আপনার জীবন বৃথা। সেসময় আপনার মনের অবস্থা বুঝে কেউ যদি দিনের পর দিন সুন্দর সুন্দর সব কথা ফেসবুকে আপনাকে বলতে থাকে যা শুনার যোগ্য আপনি নিজেকে কোনোদিন মনে করেন নি, তখন আপনার কেমন লাগবে?
আমি হঠাৎ কী মনে করে মজা করে বলে উঠলাম,
– ফেসবুকে পুরুষরা সুন্দর করে কথা বলতে জানে নাকি? কোথায় সব মিষ্টভাষী পুরুষরা? এই আজ সকালেই এক পুরুষ আমাকে মেসেজ করেছে, “নাফিছা ছারমিন, আপনাকে আমার বাল লাগে।” মেজাজটা কেমন খারাপ হয় বলতো?
আমার কথায় সবাই হেসে উঠলো।
ফারাহ থমথমে মুখে বসে আছে। আমি ফারাহকে বললাম,
– ফারাহ, আমি জানি তুমি সিরিয়াস ব্যাপার না হলে কোনো বিষয়ের কথা বলবেনা। কিন্তু এটা ভীষণ বিতর্কিত একটা বিষয়। এর সাথে জড়িত সবাই কঠোর গোপনীয়তা মেনে চলে। এসবে জড়িত কেউ সামনে আসবে না, কেউ কথা বলবেনা। তুমি ঠিক কী করতে চাও, কিভাবে করতে চাও, তোমার পরিকল্পনা আমাদের জানাও। আর আমাদের কিছু এভিডেন্স লাগবে। আসলেই এটা মহামারী সমস্যা কিনা তা প্রমান করতে হবে। না হলে এই প্রজেক্টে আগাতে পারবোনা।
– আপা, আমি বলছি যে এই সমস্যা ঘরে ঘরে। আপনি ঠিক বলেছেন। কেউ তো স্বীকার করবে না। কিন্তু যারা নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করে তাদের মধ্যে জরিপ চালালে দেখবেন অনেকেই পরকীয়ায় লিপ্ত।
রুবিনা বলে উঠলো,
– আমি survey questionnaire তৈরি করে দিতে পারি।
“আপনি কি ফেসবুকে লুকিয়ে লুকিয়ে কারো সাথে প্রেম করেন?
উত্তর হ্যাঁ হলে ১ থেকে ১০ এর মধ্যে আপনার প্রেম-ভালোবাসার পর্যায় নির্ণয় করেন।
১ – প্রেমের অভিষেক (হালকা পাতলা ফ্লার্টিং)
.
৫ – প্রেমের সাগরে হাবুডুবু (পৃথিবী এখন রঙিন, এইসময় কোনো জ্ঞান দান কাজে দিবেনা)
.
১০ – প্রেমের পরাজয় (দেহ মন সব বিলিয়ে দিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে আপনি এখন নিঃস্ব)।”
আবার সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
ফারাহ চোখমুখ লাল করে বসে আছে। মেয়েটা অল্পতেই রেগে যায়। মিটিং এর শেষ পর্যায়ে অবশ্য ভালো কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ফারাহ কিছু কেস স্টাডি তৈরি করবে। কয়েকজন ভিকটিমের কনসেন্ট নিয়ে তাদের পরিচয় গোপন করে তাদের গল্প শেয়ার করার জন্য তৈরি করবে, সাথে আমাদের সংস্থার ক্লায়েন্টদের একটা পরিসংখ্যান তৈরী করতে পারলে ভালো হবে।
সাদিয়া আপা যদিও এই ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী না, তারপরও জানালো তার দুইজন ক্লায়েন্ট জানিয়েছে তাদের স্বামীরা মনেহয় অন-লাইনে কারো সাথে প্রেম করছে। গভীর রাতে মোবাইলে কার সাথে জানি চ্যাট করে। স্ত্রীরা জিজ্ঞেস করলেই এমন ভাব করে যে স্ত্রীরা কিছু জানেনা, বুঝেনা, ঘরে বসে বসে নিম্নমানের নাটক সিরিয়াল দেখে দেখে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই স্বামীদের অকারণ সন্দেহ করে। সেই মহিলারা নাকি বিশাল সংসারের কাজ নিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ঘরে বসে সিরিয়াল দেখার সময় তাদের নেই। সাদিয়া আপারও ধারণা তাদের স্বামীরা প্রেম করছে।
ফারাহ উৎফুল্লচিত্তে আবার বলে উঠলো,
– বলেছি না, এটা একটা মহামারী।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলো,
– আপা, আমি কেস স্টাডিগুলো রেডি করছি। স্টোরি লাইন তৈরি করা, কনসেন্ট জোগাড় করা এসব সব দায়িত্ব আমার। আপনি শুধু রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলে রেখেন। এর উপর একটু ভালোমতো নিউজ করে দিতে হবে উনার। পরিকল্পনামতো সব হলে দেখবেন আপনারা সবাই আমাকে মাথায় করে নাচবেন।
রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে মনে করে আমার কেমন যেন অস্থির লাগা শুরু করে দিলো। সেই নদী মেয়েটার সাথে দেখা হবার প্রায় মাসখানেক হয়ে গেলো। মেয়েটা একেবারে গায়েব। আর কোনোভাবেই আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। শুধুমাত্র ওর সাথে দেখা হবার আশায় আমি এই মাসে দরকারের বেশিই অফিসে এসেছি। ফেসবুকের স্প্যাম মেসেজ অকারণে চেক করেছি। নাহ, মেয়েটার কোনো টিকিও দেখা যায় নি।
মাঝখান দিয়ে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। দরকারে টুকটাক কথা হচ্ছে, সবই ফেসবুকে। কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ রাখতে আমি কেমন যেন সংকোচ বোধ করছি। আগের মতো সহজ সরল কাজের সম্পর্কটা যেন আর নেই। যেই সম্মান আর পছন্দের আসনে আমি তাকে বসিয়েছিলাম, সেই আসনটা কেমন নড়বড়ে হয়ে গেছে।
তারপরই আমার মনে হলো, তার সাথে আমার কাজের সম্পর্ক। সেই নদীর সাথে তার যাই চলুক না কেন, তাতে আমার কী? আর শুধু নদী কেন, নদীর মতো দশজনের সাথে তার গড়বড় থাকলেও আমার কিছু না। আমার সাথে তো সে কিছু করে নি। আমিও তার সাথে কিছু করি নি। শুধু শুধু আমি আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটাবো কেন? আমি ঠিক করলাম ফারাহ কেস স্টাডিগুলো রেডি করলেই তার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবো। আচ্ছা, নদীর সাথে কি তার ফেসবুকে প্রেম? যদি তাই হয়, তাহলে এই প্রজেক্টের কথা শুনে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?
হঠাৎ করেই আমি ফারাহর এই প্রজেক্টের ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ বোধ করছি। শুধুমাত্র রিদওয়ান ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। এটা মনে হতেই আমার মনে হলো আশফাক ঠিকই বলে। অযথা আমি লোকটাকে বেশি পাত্তা দেই। তা না হলে অন্যদের উপকার করার চেয়ে একজনের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য প্রজেক্টে আগ্রহ হওয়া কি ঠিক? তারপরও কাজ থেকে বের হবার আগে আমি রিদওয়ান ভাইকে একটা মেসেজ করে দিলাম,
– আমাদের ফারাহ একটা ইন্টারেষ্টিং প্রজেক্টের প্ল্যান করছে। আমার মনেহয় আপনিও এই ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী হবেন।
– তাই নাকি? কী প্রজেক্ট?
– ফারাহ কিছু কেসস্টাডি তৈরি করছে। সেই কাজটা শেষ হোক, তারপর আপনাকে সব দেখাবো।
– কেন, এখন বলা যাবে না?
– নাহ। ফারাহর আইডিয়া, আমি চাই ওই আপনাকে সব বলুক।
– সিক্রেট ব্যাপার স্যাপার দেখি।
– জ্বি, টপ সিক্রেট (হাসির ইমোজি)।
– ভালো ভালো। সিক্রেট ব্যাপার আমার ভালো লাগে। রহস্য আমার ভালো লাগে।
আমি কী লিখবো ঠিক বুঝে পাচ্ছিনা। আমি সময় নিচ্ছি দেখে রিদওয়ান ভাই আবার লিখে পাঠালো।
– ঠিক আছে। যখন আপনার প্রজেক্ট টিম সব নিয়ে রেডি হবে জানাবেন। আমি দেখবো কী করা যায়।
– ধন্যবাদ।
– আপনি ভালো আছেন তো নাফিসা? আজকাল বেশ চুপচাপ আপনি।
– চুপচাপ? না তো। আমি ঠিক আছি।
– ঠিক থাকলেই ভালো। আপনাকে আজকাল কেমন যেন রহস্যময়ী মনে হচ্ছে।
আমি শুধু লাজুক হাসির ইমোজি পাঠালাম। সেখানেই কথাবার্তা শেষ হয়ে গেলো।
ট্রেনে উঠে ফেসবুকের নিউজফীড স্ক্রল করা শুরু করেছি। শুরুতেই রিদওয়ান ভাইয়ের পোস্ট নজরে পড়লো। স্বরচিত একটা কবিতা পোস্ট করেছেন মিনিট পাঁচেক আগে।
“যতই যাবে সরে,
হৃদয়ে অভিমান ভরে,
ততই বাড়িবে আকর্ষণ।
ছিলে তুমি লাস্যময়ী,
কেন হলে রহস্যময়ী?
করিয়া আমারে অকিঞ্চন।“
(চলবে)
আমিনা তাবাস্সুম