মনের নদী বেশি গভীর,০৪,০৫

0
237

মনের নদী বেশি গভীর,০৪,০৫
আমিনা তাবাস্সুম
(৪)

দুইদিন ধরে আমার মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। “আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু” নামের এক প্রোফাইল থেকে আমার ফেসবুকের আদার (স্প্যাম) ইনবক্সে একটা মেসেজ এসেছে।
“আচ্ছা আপু, জীবনে যে একবার ভুল করে, সে কি বার বার ভুল করে? এটাই কি নিয়ম? নাহলে আমি কেন বার বার ভুল করবো? কেউ তো আমাকে কখনো জোর করে নি। আমি নিজেই ভুল করি। বার বার করি। আর সেই ভুলের মাশুল তো আমাকে দিতে হবেই। আমি আমার জীবনটা দিয়েই সেই মাশুল দিবো। আমার এই নষ্ট জীবন রেখে কোনো লাভ নাই।
কিন্তু আমি একা একা ভুলের মাশুল দিবো কেন? আমার সাথে ভুলে যারা জড়িত, তাদেরও মাশুল দিতে হবে। তাই না?
আচ্ছা আপু, আপনি আর আপনার সংস্থা তো সবসময় “ফেয়ারনেস” প্রমোট করেন। তাহলে আপনিই বলেন, আমার একা একা কষ্ট পাওয়া কি ফেয়ার? আমি যে একা একা ধুঁকে ধুঁকে মরছি, এটা কি ঠিক?”
আমি নিশ্চিত যে এটা সেই নদী মেয়েটাই পাঠিয়েছে। শুধু এইটুকু মেসেজ করে শেষ করে দিলেও হতো। মেসেজের নিচে আবার একটা ছবি পাঠিয়েছে। সেই ছবিতে আমি আর রিদওয়ান ভাই হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছি।
মাস খানেক আগের ছবি হবে এটা। আমিই ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। আমাদের শেষ প্রজেক্টের সাফল্যের পর এখানকার এক জনপ্রিয় বাংলা টিভি চ্যানেলে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। সেখানে আমি আর আমাদের চ্যারিটির সাদিয়া আপা দুইজন আমাদের প্রজেক্ট সম্পর্কে কথা বলেছি। আমরা ছাড়াও আরো দুইজন অতিথি ছিল। সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন রিদওয়ান ভাই আর সাথে ছিল আমাদের প্রজেক্ট থেকে উপকৃত হওয়া একজন সার্ভিস ইউজার। অনুষ্ঠান শেষে আমি আর রিদওয়ান ভাই হাসিমুখে এই ছবিটা তুলেছিলাম। সাদিয়া আপা তুলে দিয়েছিলেন। আমার প্রোফাইল থেকে আমার ছবি নিয়ে আবার আমাকেই পাঠিয়ে থ্রেট করছে। কত বড়ো ফাজিল একটা মেয়ে।
এই মেসেজ পাবার পর থেকে কোন কিছুতেই মন দিতে পারছিনা। এই “আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু” এর প্রোফাইল লকড। তাই তার কিছুই দেখতে পারছিনা। কারো সাথে আলোচনা করা দরকার। রিদওয়ান ভাইকেও সরাসরি ব্যাপারটা জানানো দরকার। কিন্তু জানাতে গিয়েও জানাতে পারছিনা। এর কারন আমি নিজেই ঠিকমতো জানিনা। তবে আমার অবচেতন মন মনেহয় দুইটা ব্যাপার নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। প্রথমত মেয়েটা বলেছিলো রিদওয়ান ভাইকে জানালে ও আত্মহত্যা করবে। আর ওর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী হবো। কোনো কারণে এই ভয়টা ও আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও মেয়েটা বলে গেছে যে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে আমার যে সম্পর্ক আছে এটা সে প্রমান করে ছাড়বে। আমার কাছে পরিষ্কার যে মেয়েটা অপ্রকৃতিস্থ এবং ভীষণ ডেসপারেট। মানুষ যখন এরকম ডেসপারেট অবস্থায় থাকে তখন তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। সেইসময় সে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলতে পারে।
সে বানিয়ে বানিয়ে আমার নামে নানান জিনিস সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করতে পারে। আর এই সোশ্যাল মিডিয়া জগতের বন্ধু, ফ্যান, ফলোয়ার সবকিছু আজকাল আমার কাছে কপট মনেহচ্ছে। এদেরকে যা খাওয়ানো হবে এরা তাই খাবে। কী যে একটা ঝামেলায় পড়লাম। আশফাক সাথে থাকলে ওর সাথে একটু আলোচনা করা যেত। ও নিশ্চয়ই আমাকে বকা ঝকা করতো। বলতো নিজ দোষে আমি এসব ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়েছি। কিন্তু তাও তো কারো সাথে কথা বলা যেত। কিন্তু আশফাক অফিসের কাজে পাঁচদিনের জন্য ফ্রান্সে গিয়েছে। সেখানে আপাতত মহাব্যস্ত। এর মধ্যে এইসব কথা বলে ওকে বিরক্ত করা ঠিক না। কিন্তু আমার এত ভয় লাগছে যে গতকাল রাতে আমার মেয়ে রিদাকে আমার সাথে ঘুমাতে বলেছিলাম। রিদা আমার ঘরে ঘুমাচ্ছে দেখে আমার ছেলে রায়ান জেলাস হয়ে সেও গভীর রাতে লেপ তোষক নিয়ে ঘরে এসে মাটিতে বিছানা করে শুয়ে পড়ে। এত বয়স হয়েছে ছেলে মেয়ে দুইটার। কিন্তু এখনো ওরা মাকে শেয়ার করতে পারে না। তবে ওরা দুইজন ঘরে থাকায় হঠাৎ করেই ভয়টা আমার চলে যায়।
সকালে ল্যাপটপ খুলতেই দেখি ফারাহর ইমেইল। বেশ অনেকগুলো কেসস্টাডি রেডি করেছে। সবার পরিচয় গোপন করে অজ্ঞাতনামে ঘটনাগুলো আমাদের ওয়েবসাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার করার পরিকল্পনা ওর। এগুলো দেখে অন্যান্য ভুক্তভোগীরা নাকি তাদের গল্প শেয়ার করার সাহস পাবে। এতে করে সচেতনা তৈরি হবে। এইসব ঘটনা জানা থাকলে তাদের সাথেও যখন একই ধরণের ঘটনা ঘটা শুরু করবে, তখন হয়তোবা অনেকেই সহজে ফাঁদে পা দিবে না।
ফারাহ, এই প্রজেক্ট নিয়ে খুবই উত্তেজিত। ওকে ভিডিও কল করতেই দেখলাম ওর চোখমুখ কেমন ফুলে আছে। মনেহয় সারারাত এটা নিয়ে কাজ করেছে। একটুও ঘুমায় নি। আমাকে বললো,
– আপা আমাদের ইনক্লুসিভিটি এবং ফেয়ারনেসের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন হতে হবে। যাতে কেউ ভাবতে না পারে যে এখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে। এসব সব মাথায় রেখে সব ধরণের সিনারিও কাভার করার চেষ্টা করেছি। আপনি শুধু আমাদের ওয়েবসাইট আর ফেসবুক পেইজের জন্য সুন্দর করে একটা ভূমিকা লিখে দিয়েন প্লিজ।
“ফেয়ারনেস” কথাটা শুনা মাত্র আমার আবার নদীর মেসেজের কথা মনে পড়ে গেলো। ব্যাপারটা ভুলে থাকার জন্য আমি তাড়াতাড়ি কল কেটে দিয়ে ফারাহর পাঠানো ফাইল খুলে পড়তে বসলাম।
ফারাহ এই কেসস্টাডিগুলোকে “আমাদের গল্পগুলি” বলে সাজিয়েছে। ব্যাপারটা আমার চমৎকার মনেহলো। ননজাজমেন্টাল এবং ইনক্লুসিভ।
আমি কয়েকটা গল্পে চোখ বুলালাম। Skim reading যাকে বলে।
“৩৮ বছরের যুক্তরাজ্য প্রবাসী তিন সন্তানের এক মা। পেশায় তিনি গৃহিনী। ফেসবুকের এক গ্ৰুপের মাধ্যমে বাংলাদেশের এক অবিবাহিত পুরুষের সাথে পরিচয় হয়। পরিচয় বলতে পোস্টের নিচের কমেন্ট আদান প্রদান তারপর ইনবক্সে কুশলাদি বিনিময়। এভাবেই শুরু। সেই পুরুষই খুব যত্ন সহকারে, আগ্রহ সহকারে মহিলার খবরাখবর নিতো। এভাবেই বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা কখন যেন প্রণয়ে মোড় নেয়। সংসার নিয়ে হিমশিম খাওয়া ক্লান্ত সেই মহিলা এত এত ভালোবাসা, যত্ন, আবেগ আর প্রেমের বাণী অগ্রাহ্য করতে পারেনি। তারপর এক পর্যায়ে ভিডিও চ্যাট, অসঙ্গত ছবি এবং ভিডিওর আদান প্রদান চলে। বেশকিছুদিন এরকম চলার পর সেই পুরুষের ব্যবহারে পরিবর্তন দেখা যায়।
অবশেষে দেখা যায় যে সেই পুরুষ একজন ফ্রড। এরকম অনেক মহিলাদের ছবি এবং ভিডিও সংগ্রহ করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে বড়ো অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই তার কাজ। সেই টাকার জোগাড় করতে হিমশিম খাওয়া মহিলা এক পর্যায়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। মহিলা আপাতত বেঁচে আছে কিন্তু স্বামী সব জানতে পেরে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। এমনকি ছেলেমেয়েদের সাথেও যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। আমাদের সংস্থা এখন সেই মহিলাকে বিভিন্ন ধরণের সাপোর্ট দেবার চেষ্টা করছে।“
“৪৫ বছরের এক ডিভোর্সি মহিলা। ছোট ছোট দুই সন্তান নিয়ে ডিভোর্সের পর অনেক কষ্টে সৃষ্টে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফেসবুকের এক জনপ্রিয়, সুদর্শন মোটিভেশনাল স্পিকারের ভীষণ ভক্ত ছিলেন তিনি। সেই মোটিভেশনাল স্পিচগুলো থেকে তিনি অসাধারণ অনুপ্রেরণা পেতেন। নিজে থেকেই সব ভিডিওতে বড়ো বড়ো কমেন্ট করতেন। তারপর হঠাৎ করেই সেই মোটিভেশনাল স্পিকার সেই মহিলার সাথে যোগাযোগ করা শুরু করে। তাকে এত সুন্দর করে উৎসাহ উদ্দীপনা দেবার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্ব হয় এবং সেই থেকে গভীর প্রেম। বাঁধভাঙা প্রেম যাকে বলে। যেহেতু লোকটা বিবাহিত, দুজনেই ব্যাপারটা অনৈতিক মনে করে প্রথম প্রথম দূরে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু কারো পক্ষেই সম্ভব হয়না। এক পর্যায়ে সেই লোক স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে সেই মহিলাকে বিয়ে করার আশ্বাস দেয়। প্রেমের টানে বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ডে এসে সেই মহিলার সাথে দুই একবার থেকেও যায়। প্রায় টানা দুইবছর এরকম গভীর প্রেম চলার পর স্ত্রীকে ডিভোর্স দেবার পরিবর্তে সেই লোক হঠাৎ করেই দূরে সরে যেতে থাকে। দূরে যাবার কারণ জানতে চাইলে জানানো হয় যে সে কিছুতেই তার স্ত্রী এবং সন্তানদের এভাবে ফেলে দিতে পারছে না। অবশেষে এক পর্যায়ে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। কিন্তু সেই মহিলা এই সম্পর্কে ইমোশনালি এত ইনভল্ভড আর কমিটেড ছিলেন যে এই বিচ্ছেদ নিতে পারেন নি। এখন ভয়াবহ ডিপ্রেশনে ভুগছেন। সেলফ হার্ম করছেন। সন্তানদের দেখভাল ঠিকমতো করতে পারছেন না। নিজেকে এই সম্পর্কে জড়ানোর জন্য দোষারোপ করছেন। আমাদের সংস্থা তার জন্য নিয়মিত থেরাপির ব্যবস্থা করছে।“
“৪০ বছরের একজন সফল ব্যাংকার পুরুষ। স্ত্রীর সুন্দরী বান্ধবী প্রতিনিয়ত ফেসবুকে তার সাথে ফ্লাৰ্ট করতো। নিজের বান্ধবীর নামে মিষ্টি করে, কায়দা করে নানান আজেবাজে কথা বলতো। এক পর্যায়ে সেই লোকের সাথে স্ত্রীর বান্ধবীর গভীর প্রেম শুরু হয়। অফিসের পর তারা বিভিন্ন জায়গায় দেখা করে, অন্তরঙ্গ সময় কাটায়। তারপর দেখা যায় সেই মহিলা আর তার স্বামী দুইজন মিলে সেই ব্যাংকার লোককে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে। তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ভাইরাল করে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা বের করার চেষ্টা করে। স্ত্রীর কাছে সেই লোক অবশ্য সব খুলে বলে ক্ষমা চেয়েছে। তারা একসাথেই আছে এখন কিন্তু তাদের মধ্যে নাকি দূরত্ব তৈরি হয়েছে, বনিবনা হচ্ছেনা। তারা আপাতত ম্যারেজ কাউন্সিলিং করছে। তারা নিজেরাই এসবের সব ব্যবস্থা করেছে। তবে শুরুতে সেই লোকের স্ত্রী আমাদের সংস্থা থেকে কিছু পরামর্শ নিয়েছিলো।“
এইটুকু দেখেই আমি ওয়ার্ড ফাইলটা বন্ধ করে দিলাম। আর দেখতে ইচ্ছা করছে না। একটা ফান্ডিং অ্যাপ্লিকেশনের কাজ শেষ করতে হবে আজকের মধ্যে।
সেই অ্যাপ্লিকেশনের কাজ শুরু করতে গিয়েও আমি কী মনে করে যেন ফারাহর “আমাদের গল্পগুলির” ভূমিকা লিখতে বসলাম।
“প্রত্যেক মানুষের জীবনে অপূর্ণতা আছে। আছে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, সংগ্রাম, শূন্যতা। কোনো কোনো কষ্ট প্রকাশ্য, কোনো কষ্ট গোপন। কারো জীবন নিখুঁত না, সম্পূর্ণ না। কারো না। কিন্তু তারপরও জীবনের খুঁতগুলো, দুঃখগুলো, কষ্টগুলো, শূন্যতা গুলোকে অজুহাত বানিয়ে জীবনটাকে পূর্ণতা দানের মোহে আমরা নিজেদের আরো বড়ো অপূর্ণতার দিকে ঠেলে দেই। কী ভীষণ বোকা আমরা, কী ভীষণ নির্বোধ?”
এটুকু লিখেই আমার মনেহলো আমি এইসব কী উল্টাপাল্টা লিখছি? আমি কি কোনো গল্প উপন্যাস লিখছি নাকি? এটা আমাদের সংস্থা থেকে সবার জন্য একটা ভূমিকা। এখানে আমাদের সংস্থা সম্পর্কে ছোট করে কিছু একটা বলে তারপর প্রজেক্ট থেকে কীভাবে সবাই উপকৃত হতে পারে তা সম্পর্কে লিখতে হবে। এর ভাষা হতে হবে ফর্মাল। আর আমি এখানে সাহিত্য রচনা করতে বসলাম। তাড়াতাড়ি লেখাটুকু আমি ডিলিট করে দিলাম।
কিন্তু মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের পাতা থেকে লেখাগুলো ডিলিট করে দিলেও মনের পাতা থেকে কিছুই ডিলিট হলোনা। ফান্ডিং অ্যাপ্লিকশনটা শেষ করার পর এক কাপ চা হাতে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। আসলেই কি সবার জীবন অপূর্ণ? সবার জীবনে কষ্ট আছে? গোপন বা প্রকাশ্য কষ্ট? আমার জীবনের কষ্ট কী?
চোখের সামনে পাঁচ বছরের আমার ছবি ভেসে উঠলো। নানীর বাসার ড্রয়িং রুমে সব সোফার কাভার নামিয়ে তা দিয়ে ঘর বানিয়ে খেলছি। আমার সাথে আমার আমার এক খালাতো আর এক মামাতো বোন আছে। আমরা সবাই কাছাকাছি বয়সী। সাথে আছে নানী বাড়ির কাজের মেয়েটা। বারো তেরো বছরের পারুল। পারুলের কাছাকাছি বয়সী মামাদের বাসার কাজের ছেলেটাও আছে, নাম নিজাম। সোফা দিয়ে বানানো অন্ধকার ছোট ছোট খুপরি ঘরের মধ্যে সেই নিজাম ইচ্ছামতো আমার শরীরের নানান জায়গা ছুঁয়ে দিয়েছিলো। ফ্রকের নিচে হাত দিয়ে একেবারে গোপন অংশ ভালোমতো ছুঁয়ে দিতে তার একটুও বেগ পেতে হয়নি। কী বুঝেছিলাম কে জানে। কিন্তু টু শব্দটা করিনি। তাড়াতাড়ি খেলা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। অনেক জোরাজুরি করার পরও কেউ আর সেই খেলায় আমাকে নিতে পারেনি। শুধু সেই খেলা কেন, জীবনে আর কোনোদিন এরকম কোনো খেলা খেলিনি যেখানে আমাকে একা একা কোথাও লুকাতে হয়।
পাঁচ বছরের আমি থেকে হঠাৎ করেই আবার আমার বিয়ের দিনে চলে গেলাম। সবাই বলেছিলো আমার বিয়েতে আমাকে নাকি দেখতে পুতুলের মতো মনে হয়েছিল। পুতুলের মতোই তো। কেমন মনমরা হয়ে জড়ো পুত্তলির মতো বসে ছিলাম। বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক হবার পর, কার্ড ছাপিয়ে সবাইকে দাওয়াত দিয়ে ফেলার পর, দুই পরিবারের মধ্যে হঠাৎ করেই মনোমালিন্য হওয়া শুরু হয়। অযথা সব কারণে। অন্তত আমার কাছে অযথা মনে হয়েছিলো। কিন্তু বাকিদের কাছে তা ছিলো জীবনমরণ সমস্যা। সবাইকে দাওয়াত করে ফেলায় বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়। কিন্তু বিয়েতে আমার একমাত্র বড়বোন আসেনি। ছোটলোকদের সাথে সম্পর্ক করতে তার নাকি লজ্জা লাগে। আমার মা কোনোরকমে সবাইকে একবার একটু মুখ দেখিয়ে পিছে কোথায় যেন বসে ছিল। জীবনের একটা বিশাল অধ্যায় এত তেতো অনুভূতি নিয়ে শুরু করেছিলাম যে মুখের সেই তিতা ভাবটা কাটিয়ে উঠতে এক জীবন পার করে দিতে হলো।
হঠাৎ করেই ছাব্বিশ বছরের আমাকে দেখতে পেলাম। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। আমার কোলে ব্ল্যাঙ্কেটে মোড়ানো গোলাপের মতো সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে। সদ্যজন্ম নেওয়া আমার মেয়ে। সদ্যজন্ম নেওয়া কোনো বাচ্চা এত সুন্দর হতে পারে তা আমার ধারণা ছিলোনা। আমার পাশেই তিন বছরের রিদা আর রায়ান। কে আগে তাদের বোনটাকে কোলে নিবে সেই চিন্তায় তারা অস্থির। তাদের সেই ফুটফুটে ছোট বোন যে জন্মমৃত সেটা বুঝার বয়স তাদের সেসময় হয় নি।
এভাবে আমি অনবরত শৈশব, কৈশোর, যৌবন, মধ্যবয়সে ছুটে বেড়াচ্ছি। একেক সময় একেক ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। হোক না অতীত, স্মৃতির পাতায় সব একেবারে উজ্জ্বল, একেবারে স্পষ্ট। বুকটা আমার বিষন্নতায় ভরে যাচ্ছে। অকারণ চোখ বেয়ে জল পড়ছে। কিন্তু আমি জানি, এইসব ঘটনা কোনো অবাস্তব কিছু না, অসাধারণ কিছু না। এইসব ছোট ছোট দুঃখ, শূন্যতা, অপূর্ণতা সবার জীবনের অংশ। এরকম যেমন দুঃখ আছে, সেরকম আনন্দও আছে। আরেকদিন হয়তো এইরকম চায়ের কাপ হাতে বাইরে তাকিয়ে আমি পিছনের ছোট ছোট আনন্দের মাঝে ছুটে ছুটে বেড়াবো। তবে সেই আরেকদিন আজ না। আজ হলো আজ। আজ আমার দুঃখগুলো জীবন্ত, পার্থিব। আজ আমার এই দুঃখগুলোকে তুচ্ছ করার ক্ষমতা আমার নেই।
আমি ফেসবুক খুলে নিয়ে “আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু” কে রিপ্লাই করলাম।
“আমরা চোখের সামনে যা দেখি বা বুঝি বলে মনে করি, তার সবটাই কি সত্যি? তুমি নিজের জীবন দিয়ে চিন্তা করে দেখো? যাকে তুমি একেবারে সামনে থেকে দেখে নিশ্চিত হয়েছো যে সে তোমাকে ভালোবাসে, আসলেই কি সে তোমাকে ভালোবেসেছে?
আমার মনেহয় তুমি অনেক কিছু ভুল বুঝেছো। আমার সবাই ভুল বুঝি, ভুল করি। তুমি শুধু একা না, সবাই। কিন্তু ভুল করা মানেই যে সেই ভুলের মধ্যে ডুবে থাকতে হবে তা না। ভুল থেকে বেরিয়ে আসা যায়। তুমি হয়তো সেই বের হবার রাস্তা এখন দেখতে পাচ্ছনা, কিন্তু বের হয়ে আসা যায়।
তুমি যদি আমার সাথে কথা বলতে চাও তাহলে কথা বলতে পারো। কিন্তু আমাকে যদি বিশ্বাস করো তাহলেই কথা বলবে, না হলে না। আর আগেই বলে রাখছি, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। মানুষ “নদী” এর সাথে যদিও পরিচয় হয়নি, প্রকৃতি “নদী” আমার খুব প্রিয়। ভালো থেকো।”
(চলবে)

আমিনা তাবাস্সুম

মনের নদী বেশি গভীর
(৫)
কিছুদিন ধরে ফেসবুকের উপর কেমন যেন বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছে। হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই যে এর মাধ্যমে অনেক অনেক ভালো কিছু হচ্ছে। আমাদের এই সংস্থা আজকে এই পর্যায়ে এসেছে শুধুমাত্র ফেসবুকের বদৌলতে। কিন্তু এটাকে মূলত আমার কাজের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যাবহার করতে চাইলেও, কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারছিনা। কেমন যেন নেশার জালে আটকে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পরপর ফেসবুকের নিউজফীড স্ক্রল না করলে আমার শান্তি হয়না। নিউজফীড স্ক্রল করে আমি যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ, আনন্দের বা শিক্ষণীয় কিছু দেখি তা ঠিক না। অনেকসময় আমি খেয়াল করেছি যে প্রায় দশ পনেরো মিনিট ধরে স্ক্রল করার পরও মন দিয়ে আমি কিছু দেখিনি। লাগাতার একের পর এক পোস্ট এবং ছবিতে লাইক দিয়ে চলে এসেছি। অনেকসময় পোস্ট না দেখেই ওয়াও, দারুন, হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি অ্যানিভার্সারি, কংগ্রাচুলেশন, কী সুন্দর, চমৎকার এসব কমেন্ট করে গিয়েছি। কতবার যে জন্মদিনের পোস্টে হ্যাপি অ্যানিভার্সারি জানিয়েছি আর অ্যানিভার্সারির পোস্টে হ্যাপি বার্থডে – তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কেন যে এরকম করি তা আমি জানিনা। অথচ আমি যদি বুঝতে পারি যে কেউ আমার পোস্ট না দেখে, না পড়ে লাইক কমেন্ট করছে তাহলে আমার মেজাজটা তার উপর কিন্তু চড়াও হয়ে যায়। কী একটা হিপোক্রেসির মধ্যে আছি যে মাঝে মাঝে নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত ধরে যায়। তারপরও এর নেশা থেকে বের হতে পারি না। কাজের ছুতায় বার বার ফিরে আসি। নিজেকেই নিজে বুঝ দেই যে কাজের জন্য আমার বারবার ফেসবুকে ঢুকা বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি ঠিকই জানি আমি নেশার ঘোরে ফেসবুক ব্যবহার করছি। কাজের জন্য এতবার ফেসবুকে ঢুকার প্রয়োজন নেই। এভাবে নিজের সাথেই চলে নিজের একটানা দ্বন্দ্ব।
তবে কোনো কিছুর বাড়াবাড়ি নাকি ভালো না। আমার নিজেরই বাড়াবাড়ি পছন্দ না। তাই আমার যখন একটু বাড় বাড়ে তখন প্রকৃতি নিজেই আমাকে শিক্ষা দিয়ে থামিয়ে দেয়। এই আমার কপট ফেসবুক ব্যবহারের অভ্যাসে নিজেই ধরা খেয়েছি। অনেকেই দেখি আমার উপর মাইন্ড করে বসে আছে।
আজকে ভীষণ দরকারি কিছু কাজ সারার জন্য অফিসে এসেছিলাম। কাজ ঠিকমতো শুরুই করতে পারিনি এর মধ্যে রুবিনা এসে জরুরি কথা বলা শুরু করে দিলো,
– আপা, আপনার যদি পাঁচ মিনিট সময় হয় তাহলে একটু কথা বলতে চাই।
– হ্যাঁ, বলো।
– ইলা অনেক মন খারাপ করে আছে। ওর ধারণা আপনি ওকে পছন্দ করেন না বা কোনো কারণে ওর সাথে রাগ করেছেন।
ইলা আমাদের একজন ভলান্টিয়ার। প্রায় ছয় মাসের উপর হলো আমাদের সাথে কাজ করছে। রবিবার সকাল বেলাটা ও আমাদেরকে দেয়। সংসারের কাজ, দেড়বছরের বাচ্চার কাজ সামলিয়ে প্রতি উইকেন্ডে কমিট করা সহজ ব্যাপার না। খুবই ভালো মনের একটা মেয়ে। কাজও দারুণ করে। ওর ইচ্ছা বাচ্চাটা একটু ঝরঝরে হয়ে গেলেই এই লাইনে কোনো চাকরি খুঁজবে। ওর মতো মেয়েকে অপছন্দ করা বা ওর উপর রাগ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি বললাম,
– ওমা, ওর উপর রাগ করবো কেন?
– নাহ, মানে, আমাদের ফেসবুকের মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে না?
– হ্যা, তো?
– সেখানে নাকি ও একবার একটা সিরিয়াস কথা বলেছিলো, তারপর আপনি কী একটা মজার কমেন্ট করে সেটা উড়িয়ে দিয়েছেন।
রুবিনা আমাকে ইলা মেসেজে কী লিখেছিলো, আমি কী মজা করেছিলাম সব বুঝানোর চেষ্টা করলো। আমি তো কিছুই মনে করতে পারলাম না। মেসেঞ্জারে এত এত গ্ৰুপে অ্যাকটিভ থাকা সম্ভব না। তবে কিছু জায়গা আছে যেখানে মাঝে মাঝে যুক্ত না হলে খারাপ দেখায়। আমাদের এই কাজের গ্রুপটাও সেইরকম। দরকারি ব্যাপারে অবশ্য সবাই খুবই একগেজড থাকে কিন্তু অন্যান্য সময় তো চলে হাহাহিহি। সেই সময় মাঝে মাঝে আমি ঢুঁ মেরে চোখের সামনে যা দেখি সেটার উপর একটা কমেন্ট করে বেরিয়ে আসি। জীবনে কোনোদিন ইলার কোনো ব্যাপারে আমি রাগ করেছি বা মজা করেছি বলে আমি মনে করতে পারলাম না। কিন্তু ইলা নাকি এই নিয়ে ভীষণ মন খারাপ করেছে। রুবিনার কাছে কান্নাকাটিও করেছে। এখন নাকি রুবিনাকে বলেছে যে এখানে ও আর ভলান্টারি করবেনা। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত রুবিনা আমাকে জানাতে বাধ্য হলো।
এরপর সারাটাদিন চলে গেলো ইলার মান ভাঙাতে। শেষ পর্যন্ত আমরা বের করতে পারলাম যে আমি আসলে মজার কমেন্টটা করেছিলাম ইলার আগে রুবিনা আরেকটা মজার কথা বলেছিলো তার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু লিখে কথা বললে যা হয়। ব্যাপারটা আমি পরিষ্কার করে লিখেনি। অতঃপর ইলা মেয়েটা অপমানিত বোধ করে বসে ছিল আর আমার ওর মান ভাঙাতে পুরো একদিন নষ্ট হলো। আজ অফিসে কোনো কাজই করে উঠতে পারিনি।
এছাড়াও আমি লক্ষ্য করেছি যে আমার বেখেয়ালের ফেসবুক ব্যবহারের উপর অনেকের অনেক অনেক খেয়াল। মানুষজনের কাজ না থাকলে যা হয়। সেইদিন এক দাওয়াতে সোমা ভাবির সাথে কথা হচ্ছিলো। বেশ অনেক্ষন কথা হবার পর তিনি বলছিলেন যে উনার ছেলের বিয়ের ঠিক হয়েছে। আর একসপ্তাহ পরই বিয়ে। আমি তো মহা আনন্দিত বলে উঠলাম,
– ইশ, এত দারুণ খবরটা এত দেরিতে দিলেন?
তিনি বললেন,
– আমি তো ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি। দেখেন নি?
– না তো। মিস করে ফেলেছি। আসলে আজকাল নিউজফিডে এত আলতু ফালতু পোস্টে ভরা থাকে যে আসল পোস্টগুলোই চোখে পড়ে না।
সোমা ভাবি এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে বলে উঠলেন,
– জ্বি, আপনি তো এখন সেলিব্রিটি। সেলিব্রিটি মানুষদের সাথে ভাব ভালোবাসা পোস্ট নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আমরা তো ফেসবুকে সব দেখি।
আমি আর কথা বাড়াইনি। আমার মন আর মেজাজ দুইটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মন খারাপ হয়েছিল ভাবীর খোঁচা মারা কথায়। আর মেজাজ খারাপ হয়েছিল এই মনে করে যে মানুষের আর কাজ কাম নাই। অন্যের ফেসবুক কর্মকান্ড নিয়ে পড়ে থাকে সারাদিন।
এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে ল্যাপটপ গুটিয়ে অফিস থেকে বের হতে যাচ্ছি ঠিক সেসময় ফারাহ এসে জানালো যে রিদওয়ান ভাই এসেছে। যাবার আগে আমি যেন তার সাথে দেখা করে যাই।
ইতিমধ্যে রিদওয়ান ভাইকে এই প্রজেক্টের কথা বলা হয়ে গিয়েছে। প্রজেক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তিনি বেশ উৎসাহ দিয়েছেন এবং এইসব প্রচার করার ব্যাপারেও বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমি তো ভেবেছিলাম প্রজেক্টের কথা শুনে তার ভিন্ন কোনো প্রতিক্রিয়া হবে। সত্যি কথা বলতে তার প্রতিক্রিয়া দেখে আমি একটু আশাহতই হয়েছি। তাহলে কি শুধু শুধু মানুষটা সম্পর্কে ভুল ধারণা করছি?
এবার অবশ্য আমি ফারাহকেই বলেছি তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে সব কাজ সারতে। আমি এরমধ্যে বেশি ইনভল্ভড হবো না। এর প্রথম কারণ এই প্রজেক্ট ফারাহর আইডিয়া। আর এর জন্য সব খাটাখাটুনি সেই করছে। আমি চাই ওর কাজের সব ধরণের প্রচার কাজে ওই সামনে থাকুক। এতে করে ওর জব স্যাটিসফ্যাকশন বাড়বে এবং আরো আরো ভালোলাগার সাথে ও কাজ করতে পারবে। এতে আমার সংস্থারই লাভ। আর দ্বিতীয় কারণটা ব্যক্তিগত। আমি রিদওয়ান ভাইয়ের বেশি কাছাকাছি যেতে চাইনা।
ফেসবুকে “আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু” কে মেসেজ করার প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেলো। সে মেসেজ দেখে এক সপ্তাহের মতো চুপচাপ ছিল। এক সপ্তাহ পর আমার মেসেজে একটা “লাভ” রিয়্যাকশন দিয়েছে শুধু। তারপর আবার নিশ্চুপ। তারপর তিনদিন আগে হঠাৎ করে ছোট করে একটা রিপ্লাই করেছে,
“উনার কোনো অসম্মান হোক সেটা আমি চাই না। আমি উনাকে ভালোবাসি।”
এর মানে কী আমি কিছুই বুঝিনি। এর মানে কি তাদের মিল মোহাব্বত হয়ে গিয়েছে? কে জানে? আমাকে যে থ্রেট করে কোনো মেসেজ দেয় নি এতেই আমি স্বস্তি বোধ করছি। তাই ওর মেসেজেও একটা “লাভ” রিয়্যাকশন দিয়ে শেষ করে দিয়েছি।
অফিস থেকে বের হবার সময় রিদওয়ান ভাইকে সালাম দিতে গিয়ে দেখলাম একটা গোল টেবিলে ফারাহ, রুবিনা, মালিহা আর রিদওয়ান ভাই বসে কথা বলছে। রিদওয়ান ভাইকে দেখে মনে হলো তিনি দিন কে দিন হ্যান্ডসাম হচ্ছেন। এই মুহূর্তে দর্শনদারিতে তিনি জর্জ ক্লুনিকে হার মানাতে পারবে। এমনিতে তিনি চুপচাপ। খুব একটা বেশি কথা বলেন না। আমার ধারণা ছিল সাংবাদিকরা অনেক আলাপী হয়। তবে কথা না বলেও তিনি চারপাশে একটা বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়। মুগ্ধতার বলয়। যেমন এখন দেখেই বুঝা যাচ্ছে তাকে ঘিরে বসে থাকা তিন ললনা তাকে নিয়ে মুগ্ধ, তার উপস্থিতিতে বেশ আনন্দিত। তার সঙ্গ ভীষণভাবে উপভোগ করছে।
আমি সামনে গিয়ে বললাম,
– আসসালামুআলাইকুম রিদওয়ান ভাই। সব ঠিকঠাক? এখানে দেখি কঠিন মিটিং চলছে। আপনাদের বিরক্ত করবো না। বাসায় ফিরতে হবে। ভাবলাম আপনাকে সালাম দিয়ে যাই।
– সালাম। সব ঠিকঠাক না হয়ে কোনো উপায় আছে। আপনার ওয়ার্কফোর্স তো ভীষণ এফিশিয়েন্ট।
তিন মহিলাই এই প্রসংশায় খুশি হয়ে উঠলো। তাদের চোখেমুখে সেই আনন্দ জ্বলজ্বলে হয়ে ফুটে উঠলো। আমি বললাম,
– আমি জানি। সেকারণেই তো ওদের উপর সব ছেড়ে দিয়ে গায়ে হাওয়া বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারছি। ঠিক আছে, আপনারা কথা শেষ করেন। আমি এখন চলি।
এইসময় ফারাহ বলে উঠলো,
– আপা একটা নতুন আইডিয়া মাথায় এসেছে। আপনাকে বলা হয়নি। আপনি যদি পাঁচমিনিট বসতেন তাহলে একসাথে আলোচনা করে ফেলা যেত।
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
– তোমার নতুন আইডিয়ার কোনো শেষ আছে? আবার পাঁচ মিনিট পর আরেকটা আইডিয়া মাথায় আসবে। তোমরা সবাই মিলে যা ভালো মনেকরো তাই করো।
আমি এই বলে রিদওয়ান ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া বুঝার চেষ্টা করছি। তিনি কি আমাকে পাঁচ মিনিট বসে যেতে বলবে? নাহ, আমাকে আশাহত করে তিনি কিছুই বললেন না। বরং ফারাহ বলে উঠলো,
– আপা, প্লিজ পাঁচ মিনিট। আপনি জেনে রাখলে আমাদের একটু সুবিধা হবে।
অগত্যা আমি বসলাম। ফারাহ ওর মনোযোগ এরপর রিদওয়ান ভাইয়ের দিকে নিয়ে বললো,
– সোশ্যাল মিডিয়া, পত্রিকা, সচেনতামূলক অনুষ্ঠান, আলোচনা অনুষ্ঠান – এসব ছাড়াও আমরা আরেক মাধ্যমে এই ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে পারি। সেটা হলো গল্প, উপন্যাসের মাধ্যমে।
মালিহা বলে উঠলো,
– গল্প, উপন্যাস আজকাল কেউ পড়ে নাকি?
ফারাহ বললো,
– যারা পড়ার ঠিকই পড়ে। দেখো না ফেসবুকের সাহিত্যগ্ৰুপগুলো কেমন রমরমা।
মালিহা আবার বলে উঠলো,
– ধুর, এরকম অনেক গ্ৰুপে আমি গল্প পড়েছি। হিন্দি সিরিয়ালও হার মানাবে সেইসব গল্প। সেখানে অন-লাইনে রগরগে পরকীয়ার গল্প লিখলে এক কথা, কিন্তু সচেতনতার গল্প একজনও পড়বে না।
ফারাহ মালিহার কথা পাত্তা না দিয়ে সোজা রিদওয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি যুক্তরাজ্য প্রবাসী একজন লেখকের কথা চিন্তা করেছিলাম। মাহবুবা নাসরিন নাম। উনার লেখা আমি ফেসবুকে মাঝে মাঝে পড়ি। উনি যুক্তরাজ্যের পাঠকদের কাছে মোটামুটি পরিচিত আর আমার ধারণা এই ধরণের লেখা উনি ভাল লিখতে পারবে। রিদওয়ান ভাই, উনি মনেহয় আপনার ভালো বন্ধু। আপনি একটু জিজ্ঞেস করে দেখবেন নাকি?
রিদওয়ান ভাই বললো,
– মাহবুবা নাসরিন? উনি তো ফেসবুকে অ্যাডাল্ট কন্টেন্টের লেখা লিখে কিছুটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মালিহা তো বললোই, অন-লাইনে যেই ধরণের লেখা চলে সেইরকম লেখা আর কী।
আমার মনে হলো আমি এখানে শুধু শুধু বসে আছি। আমার তো বলার কিছু নেই। আমি বললাম,
– তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো। আমার ট্রেন ধরতে হবে। আমি যাই তাহলে। রিদওয়ান ভাই, আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। পরে একসময় কথা হবে।
রিদওয়ান ভাই শুধু হালকা করে মাথা নেড়ে হাসলো। আমার মনে হলো লোকটা বেশি অমায়িক। অস্বীকার করতে পারবোনা, আমি যতবার রিদওয়ান ভাইকে দেখি, ততবার মুগ্ধ হয়ে যাই।
ট্রেনে উঠার কিছুক্ষন পরই ফারাহর ফোন,
– আপা দেখলেন, রিদওয়ান ভাই কেমন সেই লেখক মাহবুবা নাসরিনকে ছোট করে কথা বলে গেলো? অথচ ফেসবুক দেখলে মনেহবে উনারা দুইজন best of friends। রিদওয়ান ভাইয়ের মতো মানুষের কাছ থেকে তো এমন আশা করিনি। আমি তো সবসময় মাহবুবা নাসরিনের লেখা পড়ি। আমার তো ভালোই লাগে। আর উনি এইধরণের কন্টেন্ট ভালো লিখবেন।
ফারাহ গড়গড় করে অনেক কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটার একটা জিনিস মাথায় এলে সেটা অন্যদের পছন্দ না হলে বা তার বিপক্ষে কিছু বললে সে কিছুতেই সেটা নিতে পারেনা। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তারপর ওকে ঠান্ডা করতে হয়। ফারাহকে থামিয়ে আমি বললাম,
– ফারাহ, ট্রেনের আওয়াজে আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিনা। আজকে অনেক কাজ করেছো। এখন বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। আগামীকাল কথা হবে ইনশাল্লাহ।
ট্রেনের বাকি পথ আমি ফেসবুকে লেখক মাহবুবা নাসরিনের প্রোফাইল ঘেঁটে প্রায় পার করে দিলাম। প্রোফাইল দেখেই পছন্দ হয়ে গেলো সেই মহিলাকে। এর কারণ মনেহয় তার সাথে আমার মিল আছে। তার প্রোফাইলও আমার ফেসবুক প্রোফাইলের মতো উন্মুক্ত। একেবারে হাটবাজার বানিয়ে রেখেছে। তবে প্রোফাইলের মিলের সাথে আরেকটা মিল খুঁজে পেলাম। সেও রিদওয়ান ভাইয়ের ভক্ত। অনেক পোস্টে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে তার অগণিত কমেন্টের আদানপ্রদান তার সাক্ষী হয়ে আছে।
এই ভাবতেই আমার হঠাৎ আবার নিজেকে হিপোক্রেট মনেহলো। এই আজ সকালেই যারা অন্যদের ফেসবুক কর্মকান্ডের উপর নজরদারি করে তাদের কথা ভেবে বিরক্ত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যে এদের কোনো কাজ কর্ম নেই তাই সারাদিন কে কী করলো তা নিয়ে পড়ে থাকে। অকারনে মাইন্ড করে আর না হয় আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্প তৈরী করে। ভেবেছিলাম আমি অনেক ভালো। মহৎ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আর এখন আমি কী করছি?
আমি ফেসবুক বন্ধ করে দিয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। কেবল সন্ধ্যা নামলো। নীল আকাশে কে যেন উজাড় করে সোনালী আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। কী যে অদ্ভুত সুন্দর, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। কিন্তু বাইরের সুন্দরের সাথে আমার মনের ভিতরের কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছিনা। আমার মনেহলো কত সহজে আমরা অপরের খারাপটা, ভুলটা দেখতে পাই। অথচ নিজের অজান্তেই নিজের ব্যাপারে আমরা অনবগত। একেই কি self-contradiction বলে? সৃষ্টিকর্তা কি আমাদের এভাবেই সৃষ্টি করেছে? কিন্তু কেন?
ট্রেন একটা স্টেশনে থেমেছে। কাকতালীয়ভাবে স্টেশনের একটা বিলবোর্ডে আমার চোখ আটকে গেলো। সেখানে লেখা,
The contradictions are what make human behavior so maddening and yet so fascinating, all at the same time.” — Joan D. Vinge
ঠিক সেই সময় মোবাইলে মেসেজের নোটিফিকেশন। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি “আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু” মেসেজ করেছে। আজকে আর ফেসবুকে ঢুকবোনা বলে ঠিক করেছি। কিন্তু নোটিফিকেশনে মেসেজটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে ছোট করে লেখা,
“আজকে উনার সাথে আপনার দেখা হয়েছে। তাই না?”
(চলবে)
আমিনা তাবাস্সুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here