মনের নদী বেশি গভীর,১৬ (শেষ পর্ব)

0
507

মনের নদী বেশি গভীর
১৬ (শেষ পর্ব)

দুনিয়ার সব মানুষ দেখি আমাকে আর রিদওয়ান ভাইকে নিয়ে নানান সন্দেহ করে বসে আছে। এই নিয়ে আমার মেজাজ খুবই খারাপ। সব দোষ এই ফেসবুকের। মানুষজন ফেসবুকের পোস্ট দেখে মনেকরে সবার জীবনের আদ্যোপান্ত সব জেনে ফেলেছে। এই দুইবছরে আমাদের সংস্থার সব ধরণের প্রচার কাজে রিদওয়ান ভাই সাথে ছিল। আর এমন কোনো প্রচারণা হয়নি যেখানে আমি দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করিনি। এখন নিজের প্রোফাইল ঘুরে দেখে নিজেরই অবাক লাগছে, নিজেরই বিরক্ত লাগছে। কিন্তু যখন মানুষ গোপনে কিছু করে তখন কি সে প্রকাশ্যে এভাবে কিছু পোস্ট করবে? বেকুব মানুষজন এই সহজ ব্যাপারটা কেন বুঝতে পারেনা বুঝলাম না।
আমি আমার প্রোফাইল থেকে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথেকার সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছি। আমার এই কর্মকান্ডে সবচেয়ে খুশি হয়েছে আশফাক। সব দাঁত কেলিয়ে আমাকে বলেছে, “ওমা, তোমার প্রাণের ফেসবুক থেকে তোমার জানের রিদওয়ান ভাইয়ের সব ছবি ডিলিট করে দিলে?”
অনন্যা রহমানকে শুরুতে অনেক হম্বি-তম্বি করতে দেখা গেলেও, পরবর্তীতে সে একেবারেই চুপসে গিয়েছিলো। দেখা গেলো রিদওয়ান ভাইয়ের মুখোশ উন্মোচন করা নিয়ে আমি তার থেকে অনেক বেশি উৎসাহী। তাকে সাংবাদিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি, ফেসবুক লাইভ করার উপদেশ দিয়েছি, এমনকি সুন্দর করে ফেসবুকের পোস্টও লিখে দিতে চেয়েছি। কিন্তু অনন্যার পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছিলাম না। আবার কিছুতে নাও করছিলো না সে। কেমন একটা দোটানার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো। আসলে যখন সে আমাদের ইমেইল করেছে ঠিক সেই সময় তার কাছে রিদওয়ান ভাইয়ের প্রেমের ফাঁকি ধরা পড়েছিল। অল্প সময়ের প্রেম হলে কী হবে, সে এতই মজে ছিলো যে হাজবেন্ডের কাছে তা প্রকাশ করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করেনি। তার ধারণা ছিল যে প্রেমিকা হিসেবে না হলেও অন্তত তাকে প্রকাশ্যে বন্ধু হিসেবে সবার কাছে পরিচয় দিবে রিদওয়ান ভাই। অথচ তাদের প্রেম গভীর হবার পর থেকে রিদওয়ান ভাই সবসময় তটস্ত থাকতো। পরিচিত কোনো মানুষের সামনে তো দূরের কথা, এমনকি অনন্যাকে বলে দিয়েছিলো যাতে সে রিদওয়ান ভাইয়ের ফেসবুক পোস্টে কোনো লাইক, কমেন্ট না করে। প্রেম হবার পর থেকে রিদওয়ান ভাইও আর অনন্যার ফেসবুকের কাছে ধারে যায়নি। যা হতো সব গোপনে। গোপনে দেখা করা, গোপনে কাছে আসা এমনকি গোপনে মেসেজ আদান প্রদান। অনন্যাকে মেসেজ করার জন্য রিদওয়ান ভাই একটা ভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা শুরু করেছিলো। তার সাংবাদিকতার জন্য একটা ফেসবুক পেইজ আছে। শুধুমাত্র সেই পেইজের ইনবক্সে অনন্যার মেসেজ পাঠানোর অনুমতি ছিল। এইসব নিয়ে অনন্যা আপত্তি জানালে রিদওয়ান ভাই বলেছিলো তার স্ত্রী নাকি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। অকারণে রিদওয়ান ভাইকে সন্দেহ করে। রিদওয়ান ভাইয়ের ফেসবুক প্রোফাইলে তার কড়া নজর আর নানান নিষেধাজ্ঞা। তাই তার পার্সোনাল অ্যাকাউন্টে কোনো ধরণের যোগাযোগ করা যাবেনা।
অথচ অনন্যার হাজবেন্ড যখন তার মতিগতি নিয়ে নানা প্রশ্ন করা শুরু করেছিলো, তখন অনন্যা সত্য কথা বলে দিয়েছে। কোনো ধরণের লুকানোর চেষ্টা করেনি। অনন্যা বেপরোয়া টাইপের মহিলা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে হাজবেন্ডের কাছে তার প্রেমের কথা জানানো মোটেও সহজ কোনো ব্যাপার ছিলোনা। ভীষণ একটা অশান্তির মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। তারপরও সে মন শক্ত করে কাজটা করেছে। অপরদিকে রিদওয়ান ভাই অনন্যার একটা সাধারণ ফেসবুক পোস্টে লাইক দিতে অক্ষম, অপারগ। নাকি তাতে তার অনীহা, অনিচ্ছা? কী ভেবেছিলো রিদওয়ান ভাই? অনন্যা রহমান ফ্যালনা, তার মতো ফ্রড? যে বাকিটা জীবন গোপনে তার সাথে প্রেম করে কাটিয়ে দিবে? এইসব ভেবে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে সেইসময় মরিয়া হয়ে আমাদের ইমেইল করেছিল অনন্যা।
এরপর রিদওয়ান ভাইয়ের সাথেকার সম্পর্কে ফাটল ধরার সাথে সাথে ওদের সংসারেও ফাটল ধরে যায়। অনন্যার হাজবেন্ড ডিভোর্সের তোড়জোড় শুরু করে দেয়, বাচ্চাদের কাষ্টডি নিয়ে কথা শুরু হয়, চলতে থাকে নানান অশান্তি। অবশেষে কোনো একটা কারণে ডিভোর্স টিভোর্স বাদ দিয়ে অনন্যার সাথেই সংসার করার সিদ্ধান্ত নেয় ওর হাজবেন্ড। হয়তোবা অনন্যার প্রতি তার ভালোবাসাটা ছিল প্রবল। তাই অনন্যাকে এত সহজে ছেড়ে যেতে পারেনি। বরং অনন্যাই সংসার থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলো। ওর হাজবেন্ডকে বলেছিলো তুমি নিশ্চয়ই আর আগের মতো আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। বিশ্বাস করতে পারবে না। ওর হাজবেন্ড নাকি বলেছিলো যে একবার সুযোগ নাহয় দিয়েই দ্যাখো। যদি না পারি তাহলে তো আমরা আলাদা হতেই পারবো।
অনন্যার ঘটনা শুনে আমার মনেহয়েছে যে কে বলেছে, নারীরা শুধু সব মেনে নিয়ে সংসার করে যায়। পুরুষরাও দেখি করে। হয়তোবা সংখ্যায় নারীদের তুলনায় অনেক কম। তাই বলে যে একেবারে নেই তা কিন্তু না। এরপর থেকে অনন্যাও কি পাল্টে যেতে থাকে? হয়তোবা। অনন্যার হাজবেন্ডই ওকে এধরণের মিডিয়ার সামনে গিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে। তার কথা যা হবার হয়ে গিয়েছে। এতে যখন ওদের স্বামী -স্ত্রীর মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়নি তখন ঢাক ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে নতুন ঝামেলা বাধানোর প্রয়োজন কী? তাছাড়া এতে করে রিদওয়ান ভাইকে নিয়ে যতটা কথা উঠবে তার চেয়ে অনেক বেশি কথা উঠবে অনন্যাকে নিয়ে। দুই সন্তানের মা, দেবতার মতো হাজবেন্ড, সবাইকে ছেড়ে নষ্ট মহিলা প্রেম করেছে।
অনন্যার হাজবেন্ডের কথায় যুক্তি আছে। তাই অনন্যা যখন দোনোমোনো করছিলো তখন তাকে আর জোর করিনি। কিছুদিন চিন্তা করার পর অবশ্য আমাকে জানিয়েছিল যে পরিচয় গোপন করে যদি রিদওয়ান ভাইয়ের কথা প্রকাশ করা যায় তাহলে সে তা করতে রাজি। এই এক রিদওয়ান ভাইকে নিয়ে আমি ইতিমধ্যে অনেক সময় নষ্ট করেছি। আমার আর এই ঝামেলা ভালো লাগছিলোনা। আমি ফারাহ আর রুবিনাকে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা দেখার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলাম।
যেদিন অনন্যা আমার অফিসে দেখা করতে এসেছিলো সেইদিনই সংস্থা থেকে রিদওয়ান ভাইকে একটা অফিশিয়াল ইমেইল পাঠানো হয়েছিলো। সেখানে বলা হয়েছিলো যে তার বিরুদ্ধে নারীঘটিত কার্যকলাপ সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে। সেকারণে আমাদের সংস্থার সবধরণের কার্যকলাপের সাথে তার সম্পৃক্ততা সাময়িকভাবে উঠিয়ে নেওয়া হলো। ইন্ডিপেন্ডেন্ট তদন্ত হবার পরই এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তদন্তের আর অবশ্য প্রয়োজন হয়নি। রিদওয়ান ভাই নিজে থেকেই আমাদের থেকে পাকাপাকি সরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে দুইবছর টানা রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে আমি কাজ করেছি, তিনি নানানভাবে আমাদের সংস্থার উপকারের জন্য কাজ করেছেন।যদিও এতে তারও উপকার হয়েছে কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই ছিল পারস্পরিক সমঝোতার মধ্যে দিয়ে। আমি অথবা আমাদের সংস্থার কোনো মেয়ে তার সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলতে পারবে না। আর আমার সাথে যেটুকু ফ্লার্ট করার চেষ্টা করেছেন তিনি আমি সেটা প্রশ্রয় দিয়েছি। তাই শুধু অফিশিয়াল ইমেইল পাঠিয়ে আমি বেশ অস্বস্তিবোধ করছিলাম। ইমেইল পাঠানোর পর তাকে আমি ফেসবুকে মেসেজ করেছিলাম।
– সালাম রিদওয়ান ভাই। খুবই দুঃখিত যে আপনাকে আমাদের সংস্থা থেকে এমন একটা ইমেইল পাঠাতে হলো। আমাদের সংস্থার প্রয়োজনে এটা করতে হলো। কিন্তু আপনি আমাদের জন্য যতটুকু করেছেন সেটা আমরা কখনো অস্বীকার করতে পারবো না।
মেসেজ দেখে তিনি বেশকিছুদিন কোনো রিপ্লাই করেন নি। এরপর হঠাৎ লিখেছিলেন,
– নাফিসা, কী হয়েছে তা আমার বিস্তারিত জানা দরকার। আপনার সাথে কি একটু দেখা করা যাবে?
– দুঃখিত রিদওয়ান ভাই। আমি আপনার সাথে দেখা করতে পারবোনা। আর বিস্তারিত জানানোরও কিছু নেই। অনন্যা রহমান নামের একজন আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমাদের এই সিদ্ধান্ত।
– অনন্যা রহমান? আপনি তাকে চেনেন? সে তো একজন স্লাট। সেই মহিলার কথায় আপনারা এরকম করতে পারেন না।
– আমার মনেহয় না সেই মহিলা একজন স্লাট। তাছাড়া সে একাই না। নদী নামের অল্প বয়সী মেয়েও আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমরা এখন তাকে সেই রেস্টুরেন্টের উপরের বন্দি জীবন থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছি।
নদী এবং অনন্যার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই রিদওয়ান ভাইকে ওদের নাম জানিয়েছি।
এরপর বহুদিন আর কোনো জবাব পাইনি রিদওয়ান ভাইয়ের কাছ থেকে।
এরমধ্যে আমরা নদীর সাথে যোগাযোগ করে ওর জন্য নানান ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। ফরিদ সাহেবের সংসার থেকে বেরিয়ে আসার ব্যবস্থা, ওর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, ওর নিজেকে চালানোর জন্য ভাতার ব্যবস্থা, পরবর্তীতে নিজেকে সাবলম্বী করে তোলার জন্য কিছু পড়াশুনা আর ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা। শুরুর দিকে এসব কোনো কিছুতেই আগ্রহী ছিলোনা নদী। ওর জীবনের তখন একটাই কষ্ট ছিল। কেন রিদওয়ান ভাই এভাবে ওর থেকে দূরে সরে গেলো? ওকে পরবর্তীতে আমি অনন্যা রহমানের ঘটনা জানাই। এরপর ও হঠাৎ করেই বদলে গেলো। নিজের জীবনটাকে ফিরে পেতে আমাদের সাহায্য নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও ফরিদ সাহেব এখনো কিছু জানেনা কিন্তু আগামী মাসেই নদীর সেই সংসার থেকে বেরিয়ে আসার কথা। শুধু তাইনা অনন্যা রহমানের সাথে রিদওয়ান ভাইয়ের সম্পর্কের কথা জানার পর নদীও নিজের পরিচয় গোপন রেখে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথেকার ওর সব গল্প প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়। ফারাহ আর রুবিনা মিলে সাংবাদিকদের সাথে অনন্যা আর নদী দুইজনের গল্প একসাথে প্রকাশের ব্যাপারে কাজ করেছে।
রিতা আপাও আজকাল তার থিয়েটার ক্লাবের পাশাপাশি আমাদের সংস্থার কাজেও অনেক সময় দিচ্ছেন। তাকে অনেক কাজে সাথে পেয়ে আমাদের ভালোই উপকার হচ্ছে। তিনি যেন রিদওয়ান ভাইয়ের অভাব পূরণ করে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে রিতা আপা লন্ডনে টেমস নদীর ধারে একটা এক বেডরুমের এপার্টমেন্টে উঠে আসে। দেলোয়ার ভাইয়ের সাথে থাকাটা তার কাছে নাকি বিষের মতো ঠেকছিলো। মন থেকে মাফ করতে পারছিলেন না তিনি। মন থেকে সন্দেহটাও দূর করতে পারছিলেন না। ভেতরে ভেতরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলেন। দেলোয়ার ভাইকে তিনি তার মনের অবস্থা প্রকাশও করেছেন। হয়তোবা দেলোয়ার ভাই আরেকটু সহানুভূতি দেখালে, আরেকটু আশ্বাস দিলে তিনি এভাবে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিতেন না। কিন্তু দেলোয়ার ভাইয়ের ছিল এক কথা। এত ছোট একটা ব্যাপারে এরকম ওভাররিঅ্যাক্ট করার কী আছে? এমন ভাব যে তিরিশ বছরের সংসার করা স্ত্রীকে ছেড়ে আরেক মহিলার সাথে প্রেম করাটা একটা তুচ্ছ ব্যাপার। এরকম হতেই পারে। এতে রিতা আপার এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে।
অবশেষে রিতা আপা কিছুদিন একা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। দেলোয়ার ভাইকে তিনি ডিভোর্স দেননি। তার সাথে যোগাযোগ আছে। কিন্তু এই দূরত্বটা রিতা আপার প্রয়োজন ছিল। একটু দূরে থেকে তিনি সময় নিয়ে দেখতে চান যে তার কী করা উচিত। কীসে তার শান্তি হবে। যদিও ইতিমধ্যে দেলোয়ার ভাই আবার কান্নাকাটি, মাফ চাওয়া চাওয়ি শুরু করে দিয়েছে। রিতা আপাকে ফিরে যাবার জন্য আবার অনুরোধ করছে। এবার দেলোয়ার ভাই আশ্বাস দিয়েছেন যে সেই সানিয়ার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই এবং সানিয়া নাকি দেলোয়ার ভাইয়ের সাথে আর সম্পর্ক রাখতে আগ্রহীও না। দেলোয়ার ভাই স্বীকার করেছেন যে তিনি রিতা আপার সাথে অন্যায় করেছেন। ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়। কিন্তু তারপরও তিনি রিতা আপাকে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার জন্য কি দেলোয়ার ভাইকে মাফ করে দিতে পারে না রিতা আপা? আমি জানি রিতা আপা মাফ করে দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। হয়তো বা মাফ করে দিবেও। কিন্তু এবার তিনি সময় নিচ্ছেন। এবার তার মনে হচ্ছে সময় নেওয়াটা ভীষণ জরুরি। কেননা তিনি জানেন time is the great healer.
শেষ পর্যন্ত গত সপ্তাহে রিদওয়ান ভাইয়ের কাহিনী ইংল্যান্ডের সব নামকরা বাংলা পত্রিকায় স্থান করে নেয়। “সাংবাদিক রিদওয়ান চৌধুরীর মুখোশ উন্মোচন”, “স্বনির্ভর নারী না পণ্য নারী – কীসের প্রতি রিদওয়ান চৌধুরীর ঝোঁক”, “নারী স্বাধীনতার আড়ালে নারী নির্যাতন” – এরকম সব হেডলাইনে চারিদিক ছেয়ে যায়। রিদওয়ান ভাইয়ের এতদিনের সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে তার শত্রু যেমন আছে, শুভাকাঙ্খীও তেমনি আছে। এরকম কয়েকজন শুভাকাঙ্খী নাকি রিদওয়ান ভাইকে আগে থেকেই ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছিলো। তিনি তাই খবর প্রকাশের আগেই পরিবার নিয়ে লন্ডন ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান।
এই খবরে ইংল্যান্ডের বাংলাদেশী সমাজ আপাতত বড়োই পুলকিত। কিছুদিন ধরে এই নিয়ে ফেসবুক সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। নানা মুনির নানা মতে চারিধার মুখরিত। অবশ্য এই সবই সাময়িক। কিছুদিন পরই সবকিছু থিতিয়ে যাবে, সবাই সব ভুলে যাবে। তবে তিলে তিলে গড়ে তোলা রিদওয়ান চৌধুরীর সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার হয়তোবা আর আগের জায়গায় ফিরে যাবেনা। আর তিলে তিলে গড়ে তোলা রিদওয়ান চৌধুরীর “অসাধারণত্বের” ইমেজও তিনি আর ফিরে পাবেনা।
তবে এই ঘটনায় বাংলাদেশী সমাজ পুলকিত হলে কী হবে, যেই দুইজনের সবচেয়ে খুশি হবার কথা, আশ্চর্যভাবে তারা খুশি হতে পারেনি। বরং উল্টা কষ্ট পেয়ে বসে আছে। অনন্যা রহমানের ভাষ্য অনুসারে এতটা বাড়াবাড়ি তো সে চায়নি, এতটা নির্মম হতে তো সে চায়নি। সাংবাদিকরা নাকি অতিরিক্ত বাড়িয়ে সব লিখেছে। এমন তো কথা ছিল না। আমরা নাকি প্রেশার দিয়ে সাংবাদিকদের সাথে তার কথা বলিয়েছি। কিন্তু শুধু রিদওয়ান ভাইয়েরই তো সব দোষ না, তার নিজেরও তো এখানে দোষ আছে।
আর নদী তো তার চেয়েও এক ডিগ্রি উপরে। নদীর মুক্তির জন্য, ভবিষ্যতের জন্য এতদিন ধরে কষ্ট করে আমরা এত ব্যবস্থা করলাম, সে এই এক রিদওয়ান ভাইয়ের খবরে সব প্রত্যাখ্যান করে বসলো। সে নাকি আর মুক্তি চায়না। বাকি জীবন এভাবেই কাটিয়ে দিতে চায়। যেই মানুষটা তার জীবনে ক্ষনিকের জন্য আনন্দ এনে দিয়েছিলো, সেই মানুষটাকে সে এভাবে অপমান করলো। ও মহাপাপী, ওর পাপের প্রায়শ্চিত্ত প্রয়োজন। কিছুতেই আর নদীকে তার এই সিদ্ধান্ত থেকে নড়ানো যাচ্ছেনা।
এইসব দেখে ফারাহ বলছে, এই জন্য কারো কোনো উপকার করতে হয়না। অনেক মহিলাদের মতিগতির কোনো ঠিক নেই। কারও প্রতি প্রেম ভাব জন্ম নিলে সেই প্রেম নিয়ে দুঃখবিলাস করেই তারা কাটিয়ে দিতে ভালোবাসে। আর ভালো কিছু তাদের ভালো লাগেনা। শুধু শুধু মাঝখান দিয়ে আমাদের পন্ডশ্রম।
আজ সকাল সকাল হঠাৎ করে রিদওয়ান ভাইয়ের কাছ থেকে আমি একটা মেসেজ পেলাম। সেখানে লেখা,
“আপনাদের মহিলাদের অনেক সুবিধা। আপনারা সব ব্যাপারে ভিকটিম প্লে করে পার পেয়ে যান। আর আমরা পুরুষরা হয়ে যাই সবসময় অপরাধী। তাই না? সব কিছু কি আসলেই এত সহজ? এত সাদা কালো? তবে সব মহিলা এক না। আমার স্ত্রী সোমাও একজন মহিলা। এখানে যদি কেউ ভিকটিম হয় তাহলে সে ভিকটিম। কিন্তু সে কিন্তু ভিকটিম প্লে করেনি। আমার হাতটা ঠিকই শক্ত করে ধরে আছে। কারণ একমাত্র সেই আমাকে জানে। সে আমার আসল রূপের সাথে পরিচিত। তাই সে আমার হাত ছাড়েনি।
যাই হোক, আপনাদের সাথে কাজ করে অনেক আনন্দ পেয়েছি। আশাকরি এইটুকু স্বীকার করবেন যে আপনাদের কাজে আমি কোনো ত্রুটি করিনি। এই যে গত দুই বছরের প্রজেক্টে যতগুলো মেয়েদের উপকার হয়েছে, তাতে কিছুটা হলেও আমার অবদান আছে। আপনারা আমাকে যতই নিচে নামানোর চেষ্টা করেন না কেন, আমি আমার কাজ নিয়ে গর্বিত। তবে এত লাঞ্চিত, এত অপমানিত হবার পরও আশ্চর্য লাগে যে আপনাদের সাথে কাজ করা সময়টা ভীষণ মিস করি। ভালো থাকবেন নাফিসা।”
এই মেসেজটা পাবার পর আমারও কেন যেন বুকটা দুমড়ে উঠেছিল। ক্ষনিকের জন্য মনে হয়েছিলো কী দরকার ছিল এসবের। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো নাকি?
আমি আশফাককে মেসেজটা দেখিয়ে বললাম,
– আমার মন খারাপ। সব কেমন যেন এক তরফা হয়ে গেলো। রিদওয়ান ভাই তো কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না?
আশফাক মহা বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো,
– উফ, তোমরা মহিলারা পারোও বটে। সব জেনে শুনে এরকম একটা লোকের সব কিছুতে এত সহজে বিগলিত হয়ে যাও কেমন করে বলতো? সে বললো যে তার স্ত্রী তাকে জানে, তাই শক্ত করে হাত ধরেছে আর সেটা তুমি বিশ্বাস করে বসে থাকলে? জিজ্ঞেস করেছো তার স্ত্রীকে যে তার কী অভিমত, সে কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে?”
তারপর আবার মজা করে বলে উঠলো,
– একটা কাজ করো। তোমার নদী আর অনন্যা রহমানকে ফুলের মালা সহ তোমার প্রাণের রিদওয়ান ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দাও। তারা গিয়ে রিদওয়ান ভাইয়ের পায়ে সেই মালা দিয়ে ক্ষমা চেয়ে দুইজনই একসাথে প্রেম করার জন্য রাজি হয়ে যাক। আর তোমার সংস্থা থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য একটা গ্র্যান্ড রিসেপশনের আয়োজনও করে ফেলো। সেই রিসেপশনে তুমি তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিও। আর তার সাথে তো শক্ত করে হাত ধরা স্ত্রী আছেই।
আশফাকের কথায় আমি না হেসে পারলাম না। বললাম,
– উফ, তুমি এত হিংসুটে একটা লোক।
আমার মনে হলো আশফাক ঠিকই বলেছে। কী অদ্ভুত এই মেয়েদের মন। সব জেনে, শুনে, বুঝেও কেমন করে সেই গহীন অন্ধকারে ডুবে থাকে।
আমি আমাদের খাবার টেবিলে আশফাকের সামনে বসে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করে যাচ্ছি। ফারাহ একটা ইউটিউবের গান শেয়ার করেছে। নতুন গান মনেহয়। গানটা শুনতে শুনতে গানের কথাগুলোর মধ্যে একেবারে ডুবে গেলাম আমি ……

আমাদের গল্পগুলো অল্প সময় ঘর পাতালো
তারপর পথ হারালো তোমায় আমায় নিয়ে
আগে যদি বুঝতো তারা
মনের নদীর তল পাবে না
বেহায়া মুখ পোড়াতো অন্য কোথাও গিয়ে
আমাদের গল্পগুলো …….

(সমাপ্তি)

আমিনা তাবাস্সুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here