মনের নদী বেশি গভীর (১)

0
703

মনের নদী বেশি গভীর
(১)

অফিস থেকে বের হতেই মেয়েটাকে চোখে পড়লো। ঠিক মেইন এক্সিটের সামনেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদামাটা একটা সালোয়ার কামিজ পরা। কচি কলাপাতা আর সাদা রঙের সুতির চেক কামিজ। সাথে সাদা সালোয়ার আর সাদা ওড়না। লন্ডনে যে সালোয়ার কামিজ পরা মানুষ দেখা যায়না তা না। হরদম দেখা যায়। কিন্তু এই সময় ঠিক অফিসের সামনে এরকম ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে আগে কাউকে দেখিনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার দৃষ্টি মেয়েটির দিকে চলে গেলো। আমি নিশ্চিত যে মেয়েটি বাংলাদেশি। আমি বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানী, শ্রীলংকান সবার চেহারার ফারাক চট করে ধরে ফেলতে পারি। কার অপেক্ষায় মেয়েটি এখানে দাঁড়িয়ে আছে? এই ভাবতে ভাবতে আমি রাস্তায় নেমে এলাম। দ্রুত পা চালাতে হবে আমাকে। সময়মতো স্টেশনে না পৌঁছাতে পারলে ট্রেন মিস করবো। পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে গেলে বাড়িতে পৌঁছাতে দেরিতে হয়ে যাবে। আজকে আবার বাচ্চাদের বাবার জন্মদিন। বাসায় ফিরে একটু ভালোমন্দ রান্না করবো ঠিক করেছি।
এই ভাবতে ভাবতেই মনে হলো কে যেন আমার সাথে সাথে হাঁটছে। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম সেই মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। আমি তাকাতেই মনে হলো সে ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই কোনো রকমে সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠলো।
– আস্সালামুআলাইকুম আপু। আপনি কি নাফিসা আপু? নাফিসা শারমিন?
আমি একটু অবাকই হলাম। বললাম,
– হ্যাঁ, আমিই নাফিসা শারমিন। আমি কি আপনাকে চিনি?
– না আপু, আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আমি আপনার একজন বিশাল ভক্ত। ফেসবুকে আপনাকে আমি ফলো করি। আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
এই অসময়ে ভীত, বিনয়ী এবং মিষ্টি চেহারার ফেসবুক ফলোয়ার পেয়ে আমি যেন একটু আত্মশ্লাঘা অনুভব করলাম। কিন্তু তা প্রকাশ হতে দিলাম না। অবাক হয়ে বললাম,
– তাই নাকি? আমার যে এমন মিষ্টি ফলোওয়ার থাকতে পারে সেটাই আমার ধারণা ছিলোনা। আপনি কি আমার সাথে দেখা করতে এখানে এসেছেন?
– জ্বি আপু।
– কোনো দরকারে? আপনি আমার অফিস চিনলেন কেমন করে? আর আমি তো বেশিরভাগ সময় বাসা থেকেই কাজ করি। আপনি এভাবে না জানিয়ে এসে তো আমাকে নাও পেতে পারতেন।
– জানি আপু। আমি আরও কয়েকবার এসে এরকম দাঁড়িয়েছিলাম। আপনাকে পাইনি।
এবার আমি সত্যি সত্যিই ভীষণ অবাক হলাম। বললাম,
– তাই নাকি? এভাবে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে আপনি তো আমাকে ফেসবুকে একটা মেসেজ করতে পারতেন। কিসের জন্য দেখা করতে চেয়েছিলেন? আমার একটু তাড়া আছে। ট্রেন মিস করতে চাইনা।
আমরা দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিলাম। মেয়েটাকে এখন আমার খুব একটা ভালো মনেহচ্ছে না, উৎপাত মনে হচ্ছে। এভাবে যে না জানিয়ে অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, সে না জানি কী উদ্ভট আবদার করে বসতে পারে। দেখা যাবে বিশাল অংকের টাকা পয়সা চেয়ে বসবে। আমার কাছে ক্যাশ টাকা নেই। বেশি সমস্যা দেখলে ক্যাশ পয়েন্ট থেকে অল্পকিছু টাকা দিয়ে এই আপদ বিদায় করতে হবে।
আমরা ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছি। টিকেট ব্যারিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আমি মেয়েটাকে বললাম,
– কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার ট্রেন। যেতে হবে। তুমি কি কোনো কারণে দেখা করতে এসেছিলে?
নিজের অজান্তেই মেয়েটাকে তুমি বলে ফেললাম। ওকে দেখে আমার চেয়ে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। বয়সে ছোটদের আমি কেন যেন আপনি বলতে পারিনা। মেয়েটা কথা বলছে না। ভীষণ অস্থির চিত্তে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো কারণে সংকোচে কুঁকড়ে আছে। আমারও এখন অস্থির লাগছে। ট্রেন মিস করতে চাইনা। বাসায় গিয়ে রাঁধতে হবে। এই মেয়ে কথা বলবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি তাগাদা দিলাম,
– আমার ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে। তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। তোমার কিছু বলার থাকলে ফেসবুকে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারো। কেমন?
মেয়েটা মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে এখুনি কেঁদে দিবে। অনেক কষ্ট করে কান্না আটকে রেখেছে। আমার একটু মায়াই লাগলো। মেয়েটা কি কোনো বিপদে পড়ে এসেছে? করবো নাকি ট্রেন মিস? বাসায় গিয়ে রান্না করার সময় না পেলে টেক অ্যাওয়ে নিয়ে আসবো না হয়। আমি বললাম,
– তোমার নাম কী?
– নদী। আমার নাম নদী।
– বাহ্ চমৎকার নাম তো। খুবই আনকমন নাম। তুমি কি এই নামেই ফেসবুকে? খুব জরুরি কিছু না হলে তুমি আমাকে মেসেজ কোরো। আমি দেখবো। কেমন? আজ একটু তাড়া আছে।
মেয়েটা এবারো মাথা কাত করে হ্যাঁ জানালো। কিন্তু তার পরমুহূর্তেই হঠাৎ করে আমার হাত দুটো জোরে চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদা শুরু করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
– আপু, আমি আপনার কাছে উনাকে ভিক্ষা চাইছি। উনাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা। আমি জানি আপনাদের দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক আছে। আপনার কারণে উনি আমার থেকে দূরে সরে গেছে। আপনার তো অনেক কিছু আছে। আবার উনাকেও লাগবে কেন? আমার তো কিছুই নাই। উনাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা। আমি ট্রেনের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করবো। আপু, আমি আপনার কাছে ভিক্ষা চাইছি।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব। এই মেয়ে তো উম্মাদ। একেবারে বদ্ধ পাগল। কী সব আবোল তাবোল বকছে? লন্ডন ওয়াটারলু স্টেশন এই সময় মহা ব্যস্ত। কাজ শেষে ক্লান্ত মানুষদের বাড়ি ফেরার তাড়া। তারপরও অনেকেই আমাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। অদূরেই স্টেশন সিকিউরিটির লোক দাঁড়িয়ে আছে। সেই লোককে ডেকে এই আপদ ছাড়াতে হবে দেখি।
আমি একটু শক্ত হয়ে বললাম,
– কী সব আবোল তাবোল কথা বলছো? উনি টা কে? কার সাথে আমার সম্পর্ক?
মেয়েটা আমার কথা শুনে মনেহলো একটু সাহস পেলো। তাড়াতাড়ি কোনোরকমে চোখ মুছে বলে উঠলো,
– রিদওয়ান ভাই।
– রিদওয়ান ভাই টা কে?
– আপনি ভালোমতো জানেন রিদওয়ান ভাই কে। আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড। আপনারা একসাথে অনেক কাজ করেন। ছবিও পোস্ট করেন। সবাই জানে উনার সাথে আপনার সম্পর্ক আছে।
– তুমি জার্নালিষ্ট রিদওয়ান ভাইয়ের কথা বলছো?
– জ্বি।
– উনার সাথে আমার সম্পর্ক আছে? কী সম্পর্ক? কী সব যা তা কথা বলছো তুমি? উনি আমার একজন ভালো বন্ধু। তোমার কি মাথা খারাপ? তোমার সাথে উনার সম্পর্ক কী? এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে চলে যাও। না হলে আমি ওই সিকিউরিটির লোক ডেকে তোমাকে সরাচ্ছি।
মেয়েটা বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে,
– উনাকে আমি ভালোবাসি। উনি আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। সেই স্বপ্ন আমি ভেঙে যেতে দিবোনা। আপনি আমাকে দয়া করেন। উনাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।
জীবনে কোনদিন এধরণের উদ্ভট পরিস্থিতিতে আমাকে পড়তে হয়নি। কিছু একটা গড়বড় এখানে আছে। রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে এই মেয়ের সম্পর্ক কী? ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি মহলে বেশ নামকরা এবং সফল একজন জার্নালিষ্ট এই রিদওয়ান ভাই। সাংঘাতিক হ্যান্ডসাম এবং ক্যারিশমাটিক চরিত্রের মানুষ। পেশার কারণে বাংলাদেশি গণ-যোগাযোগ মাধ্যম, শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন, পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের এক পরিচিত মুখ। ব্রিটেনে বাংলাদেশি নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে তার সাংবাদিকতার কোনো জুড়ি নেই। আর বলাই বাহুল্য যে অনেক মহিলাদের হার্ট-থ্রব তিনি। কিন্তু রিদওয়ান ভাই আবার সেই পরিমান নম্র, ভদ্র এবং বিনয়ী। কাজের সুবাদে আমার তাকে বেশ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার বেশ ভালো বন্ধু, শুভাকাঙ্খী আর সাথে উপদেষ্টাও বলা যায়। আমি ভীষণ সম্মানের চোখে দেখি তাকে। বেশ পছন্দও করি। বেশ পছন্দ করি বললে ভুল হবে, একটু যেন বেশিই পছন্দ করি। তাই বলে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক? ছিঃ, এই মেয়ে কোথা থেকে এসব আবিষ্কার করছে? সাইকোপ্যাথ নাকি? একে এখুনি বিদায় করা দরকার। কিন্তু কোনো একটা কারণে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে এর কী সম্পর্ক সেটা জানার প্রবল আগ্রহ বোধ করছি। হয়তোবা কোনো সম্পর্কই নেই। এই মেয়ে সব কল্পনা করে বসে আছে। যেমন কল্পনা করেছে আমার সাথে রিদওয়ান ভাইয়ের সম্পর্ক।
কিন্তু তারপরও জানতে ইচ্ছা করছে। কোনো একটা কারণে হঠাৎ করে বুকটাও ভীষণ ভার লাগছে। আমি মাথা ঠান্ডা করে বললাম,
– তুমি বোধহয় কোনো ভুল করছো। রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মনেহয় তোমারও কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও আমি উনাকে তোমার কথা বলে দেখবো, যাতে উনি তোমার সাথে কথা বলে।
– আপনার দোহাই লাগে, আপনি উনাকে আমার কথা বলবেন না। আমি যে আপনার কাছে এসেছি সেই কথা বলবেন না। আপনি যদি বলেন তাহলে আল্লাহর কসম আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো। আপনি আমার মরার খবর পাবেন। আর সারাজীবন ধরে আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন।
আমি এবার আসলেই ঘাবড়ে গেলাম। এই মেয়ে দেখি ডেঞ্জারাস মেয়ে। একে ঘাঁটানো ঠিক হবে না। কখন কী না কী করে বসে। তারপর অযথা আমি ফেঁসে যাবো। আমার ট্রেন মিস হয়ে গেছে। আমি ঠিক করলাম, এই ঘটনা পুলিশে রিপোর্ট করে যেতে হবে। কী যে একটা বিপদে পড়া গেলো। এইজন্য সবাই বলে ফেসবুকে অপরিচিত ফ্যান-ফলোয়ার রাখতে হয় না। শুধু শুধু খাল কেটে কুমির আনা।
আমি মাথা ঠান্ডা করে বললাম,
– ঠিক আছে, আমি কাউকে কিছু বলছিনা। কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত যে তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারছি না। কারণ রিদওয়ান ভাইকে তোমার পাওয়া বা না পাওয়ার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার কোনো বোঝাপড়ার দরকার হলে তুমি বরং সরাসরি রিদওয়ান ভাই এবং উনার স্ত্রীর সাথেই কথা বোলো। আমার সাথে না। আমার এখানে কিছু করার নেই।
মেয়েটার হাবভাব যেন হঠাৎ করেই বদলে গেলো। সেই কাচুমাচু আর ভীত ভাবটা যেন হুট্ করে উধাও হয়ে গেলো। ভীষণ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে রক্তচক্ষু নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টভাবে বলে উঠলো,
– আপনি একজন মিথ্যুক। আমি সেটা প্রমান করে ছাড়বো। আমাকে নরম বলে অনেকে ভুল করে। কিন্তু আমি যা বলি আমি তা করে ছাড়ি।

(চলবে)

আমিনা তাবাস্সুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here