মনের নদী বেশি গভীর
(১৩)
আজকে সেই টেলিভিশন চ্যানেলের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। যেহেতু আমাদের স্টল সাজানোর ব্যাপার আছে তাই আমরা সবাই একটু আগে চলে এসেছি। আসলেই একেবারে প্রাইম স্পটে বিশাল জায়গা জুড়ে আমাদের স্টলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন রিদওয়ান ভাই। বিশাল এক ভেন্যুতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রাজকীয় স্টেইজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হল জুড়ে বসার ব্যবস্থা, আর তার চারধারে মেলার মতো বিভিন্ন স্টল। অপরপ্রান্তের আরেকটা হলে আবার বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এসবের আয়োজন করা হয়েছে। আর এতকিছুর মধ্যেও ভেন্যুতে ঢুকতেই সবার প্রথমে আমাদের স্টলটাই চোখে পড়ে।
এত বড়ো জায়গা তারপরও মানুষে গিজগিজ করছে। লন্ডনের সব বাংলাদেশিরা মনেহয় এখানে হাজির হয়েছে আজ। শুধু লন্ডনের না, দূর দূরান্ত থেকেও অনেক বাংলাদেশিরা এসে জড়ো হয়েছে। তিল পরিমান জায়গা মনেহয় নাই। চারিদিকে হৈচৈ, গান-বাজনা, কেনা বেচা, হুড়োহুড়ি সব মিলিয়ে বেশ একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। আমাদের স্টলের আমরা সবাই জামদানি শাড়ি পরেছি। কোন রং পরা হবে এই নিয়ে টানা তিনচারদিন তর্ক বিতর্কের সবাই এক রঙের শাড়ির আশা ছেড়ে দিয়ে যে কোনো রঙের জামদানি শাড়িতে সেটেল করেছে। আমি পরেছি ভীষণ হালকা হলুদ রঙের একটা জামদানি। হলুদের উপর হলুদ সুতার কাজ করা। মোটেও চোখে লাগে এরকম হলুদ না। কিন্তু এতেই আমাকে দেখে আশফাক বলেছে যে একেবারে হলুদিয়া পাখি সেজে আছো দেখি তুমি। এটা কি কমপ্লিমেন্ট না কটাক্ষ ঠিক বুঝিনি। এরপর থেকে বেশি কড়া হলুদ শাড়ি পরেছি মনে করে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। আশফাক সাধারণত এইধরণের আয়োজনে যোগ দেয়না। কিন্তু আজকে আমার সাথে এসেছে। আমি স্টল থেকে দেখতে পাচ্ছি ও একটু দাঁড়িয়ে হেসে হেসে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে গল্প করছে। যাবার আগে আমাকে আবার বলে গিয়েছে যে যাই তোমার প্রাণের রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলে আসি। আশফাক জীবনে ভুলেও কোনোদিন “তোমার প্রাণের” বিশেষণ ছাড়া আমার সামনে রিদওয়ান ভাই নামটা উচ্চারণ করেনি। এত হিংসুটে লোকটা। আমার হঠাৎ মনেহলো, মজা করেই হোক আর যা করেই হোক, আশফাক যখন এরকম ভাবছে তখন নদীর আর কী দোষ দিবো।
নদীর সাথে রিদওয়ান ভাইয়ের কী হয়েছে ব্যাপারটা আমার কাছে খুব একটা স্পষ্ট না। নদীর মেসেজগুলো থেকে যতটুকু বুঝেছি যে একসময় রিদওয়ান ভাই বদলে যেতে থাকে। আগে তো শত ব্যস্ততার মাঝেও সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত, কারণে অকারণে নদীর খোঁজ খবর নিতে থাকতো। সারাটা দিনই চলতো …. নদী, নদী, নদী, নদী …. । তার এত অস্থিরতা, আকুলতা দেখে নদী নিজেই ঘাবড়ে যেত, ভয় পেয়ে যেত। ওর মনে হতো এত সুখ কি ওর সইবে? নদী প্রায়ই রিদওয়ান ভাইকে বলতো যে সারাটাদিন ওর এত খোঁজ খবর নেবার প্রয়োজন নেই। তিনি যাতে মন দিয়ে কাজ করে, তার সংসারে কোনো অযত্ন না হয়, তার স্ত্রী – সন্তানদের যাতে অবহেলা না হয়, সেই দিকে নজর দিতে বলতো। কিন্তু রিদওয়ান ভাই কি নদীর কথা শোনে নাকি। তার চলতেই থাকতো …. নদী, নদী, নদী, নদী ….। তার কাছে নদী ছিল একদিকে আর সারা বিশ্বভ্রমান্ড আরেক দিকে। তার নাকি অনেক শখ ছিল যে নদীর সাথে তার একজন সন্তান হবে। বিশেষ করে যখন জানতে পেরেছে যে নদীকে ফরিদ সাহেব একবার জোর করে অ্যাবোরশোন করিয়েছিলো তখন থেকেই বলে গিয়েছে নদী শুধু রিদওয়ান ভাইয়ের সন্তানের মা হবে। নদীকে শুধু স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েই তার মন ভরেনি। তিনি নদীকে তার সন্তানের মায়ের আসনেও বসাতে চায়। নদী শুধু শুনে যেত। শুনতো আর আশা নিরাশার দোলাচলে ঘুরে বেড়াতো। নদীর তো মা হবার জন্য মনটা হাঁসফাঁস করে। আর রিদওয়ান ভাইয়ের সন্তানের মা, সেটা তো স্বপ্নের মতো। কিন্তু এভাবে গোপন জীবনে কি এটা আদৌ সম্ভব ? রিদওয়ান ভাইয়ের এইরকম আবেগী কথা শুনে দুই একবার নদী রিদওয়ান ভাইকে বলেছিলোও, আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলেন। অনেক অনেক দূরে, যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবেনা। তারপর আপনি যা চাইবেন তাই হবে। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে নদী আর রাজি হয়নি।
রিদওয়ান ভাই অবশ্য নদীর জন্য জীবন দিয়ে দিলেও নদীকে এই জীবন থেকে বের করার কোনো চেষ্টা করেনি। আর নদীকে দূরে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, কোনো একটা কারণে তিনি নিজেই নদীর থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। ধীরে ধীরে সকালের খবর দুপুরে, দুপুরের খবর নিতে নিতে রাত হয়ে যেত। কাজের চাপে তার নাস্তানাবুদ অবস্থা হওয়া শুরু হলো। শুধু কাজের চাপই না সংসারের চাপ, স্ত্রীর চাপ সব রাতারাতি বেড়ে গেলো। এত চাপে পড়ে এরপর প্রায় দিনই নদীর খবর নেবার সময় করে উঠতে পারতেন না তিনি। তবে যখন একটু সময় পেতেন তখন নদীকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন যে নদীর কথামতো তিনি মন দিয়ে কাজ করতে চান, সংসারের কোনো অযত্ন করতে চান না, স্ত্রী – সন্তানদের অবহেলা করতে চান না। যেই কথাগুলো দুইবছর ধরে নদীই তোতাপাখির মতো বলে গিয়ে কোনো কাজে দেয়নি, ঠিক সেই কথাগুলোই হঠাৎ নদীর কাল হয়ে দাঁড়ালো। নদীর কথা শুনেই যেন আজ রিদওয়ান ভাই নদীকে ভুলতে বসেছে। এমন ভাব যে এখানে রিদওয়ান ভাইয়ের কোনো হাত নেই।
নদী বোকা হতে পারে, খারাপ হতে পারে কিন্তু এইটুকু বোঝার ওর ক্ষমতা ছিল যে নদীর কথামতো তিনি হঠাৎ কাজ আর সংসারে মন দেবার জন্য দূরে সরে যাচ্ছে না। যদি তাই হতো তাহলে সংসার আর কাজ করেও এতদিন ধরে নদীকে এত সময় কেমন করে দিলেন তিনি? এইসব চিন্তা করে সারাটাদিন নদীর মনের মধ্যে চলতো অশান্তি। আর সাথে সারাটাদিন রিদওয়ান ভাই যোগাযোগ করবে সেই প্রতীক্ষা। তবে প্রতীক্ষায়ই সার। না প্রতীক্ষার কোনো অবসান ঘটে আর না অশান্তির কোনো শেষ। রাতারাতি যেই রিদওয়ান ভাইয়ের কারণে জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কানায় কানায় ভরে উঠেছিল, সেই মুহূর্তগুলো যেন বিষিয়ে উঠেছিল। কী হতে পারে? কেন এমন হলো? নদী কি কোনো ভুল করেছে?
রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে নদীর সংযোগের একমাত্র মাধ্যম, তার খবরাখবর পাবার একমাত্র মাধ্যম তখন ফেসবুক। পাগলের মতো নদী তখন সেই শূন্য মুহূর্তগুলো, অশান্তির মুহূর্তগুলো ফেসবুকে তাকে তন্নতন্ন করে ফলো করে কাটিয়ে দিতো। এতে করে অশান্তি কমা তো দূরের কথা, বরং বহুগুণে বেড়ে যেত। কোথায় কাজ, কোথায় সংসার, কোথায় ব্যস্ততা? রিদওয়ান ভাই তো মহানন্দে দিনাতিপাত করছে। সকালে আমার সাথে ফুর্তি করছে, দুপুরে লেখিকা মাহবুবা নাসরিনের সাথে ফ্লার্ট করছে তো বিকালে অমুকের সাথে সেলফি তুলছে তো রাতে তমুকের ঢঙের ছবির নিচে স্বরচিত কবিতা পোস্ট করছে। এত কিছুর সময় পাচ্ছে তিনি, শুধু নদীর জন্যই রাতারাতি সময়ের অভাব? এইসব দেখে নদীর একেবারে মাথা খারাপ হবার জোগাড়।
মেয়ে মানুষের মন বড়োই জটিল। নদীর চেয়েও গভীর, নদীর চেয়েও আঁকাবাঁকা। কখন কিভাবে কোন পথে বেঁকে যাবে যে তা হয়তোবা নিজেরই জানা নেই। যেই নদী রিদওয়ান ভাইয়ের প্রেমে বিনাবাক্যব্যয়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে রাজি ছিলো, মনের দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও শুধু রিদওয়ান ভাইয়ের খাতিরে সব গোপনীয়তা খুশি মনে মেনে নিয়েছিল, নিজের জীবন, সম্মান সব দিয়ে রিদওয়ান ভাইয়ের মান-সম্মান রক্ষা করতে এক পায়ে রাজি ছিল, সেই প্রেমে যখন ফাঁকি ধরা পড়লো তখন রাগে, দুঃখে, কষ্টে সেই নদীর মনটাই সন্দেহ আর প্রতিসহিংসায় বিষিয়ে উঠেছিল।
নদী নিজে থেকেই রিদওয়ান ভাইকে জিজ্ঞেস করা শুরু করেছিল,
– নাফিসা শারমিনের সাথে আপনার সম্পর্ক কী? আপনি তো অনেক ব্যস্ত কিন্তু সে তো দেখি সারাদিন আপনাকে নিয়ে পোস্ট দেয়?
– নাফিসা শারমিন? ধুর তার কথা আর বলোনা। আমার জন্য একেবারে পাগল। আমি ঠিকই বুঝতে পারি কিন্তু একটুও পাত্তা দেই না। শুধু কাজের জন্য তাকে একটু সহ্য করে যেতে হয় আর কী।
– আর লেখিকা মাহবুবা নাসরিন? তার লেখার বুঝি আপনি ভক্ত? আপনাদের মনেহয় অনেক খাতির। ফেসবুকে সবসময় দেখি।
– আরে না। তার লেখা তো পড়ার অযোগ্য। অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট ছাড়া কিছু নাই। সেও আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমাকে বইটই পাঠিয়ে হুলস্তুল করে ফেলে। আমি তো ওইসব বই ধরেও দেখিনা।
নদী আরো কয়েকজনের কথা জিজ্ঞেস করে। একই ধরণের উত্তর। সবাই তার জন্য পাগল, সবাই তার জন্য উতলা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি সাধু সন্ন্যাসীর মতো মানুষ। কাউকে কষ্ট দিতে চাননা দেখে কিছু বলেন না। কিন্তু আর কারও প্রতি তার আকর্ষণ তো নাইই বরং ভীষণ অনিহা। তার সব আকর্ষণ নদীর প্রতি। কিন্তু এভাবে লুকিয়ে সম্পর্ক রাখা তো অন্যায়, অনৈতিক। তার স্ত্রীর প্রতি তো অবিচার করা হচ্ছে । তাছাড়া তার স্ত্রী অবুঝ প্রকৃতির মানুষ। এইসব বুঝতে পারবে না। জেনে গেলে তার মন ভেঙে যাবে। কিন্তু নদী তো অবুঝ না। নদী পৃথিবীর সেরা নারী। সৃষ্টিকর্তা যাকে শুধু সবচেয়ে সুন্দর আকৃতিতে তৈরি করেননি, সবচেয়ে সুন্দর এবং সহনশীল মন দিয়ে তৈরি করেছেন। একমাত্র নদীই রিদওয়ান ভাইয়ের অপারগতা বুঝতে পারবে।
নদী রিদওয়ান ভাইয়ের অপারগতা বুঝেছিলো কিনা জানিনা, কিন্তু ও যা বোঝার সেটাই বুঝেছে। এবং যা বুঝেছে তা অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছে। দীর্ঘ দুইবছর দিন রাত একটা মানুষের সাথে কথা বলার পর সেই মানুষ সম্পর্কে তো কিছু ধারণা করা যায়। নদীর ধারণা হয়েছে যে একমাত্র কারণে রিদওয়ান ভাই নদীর থেকে দূরে সরে যেতে পারে তা হলো আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়ানো। আরেকজনের সাথে প্রেমে মজে থাকলেই, আরেকজনকে নদীর থেকে সহজে নিবিড়ভাবে কাছে পেলেই, নদীকে এভাবে ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব। আর দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে ওর বদ্ধমূল ধারনা হয়েছে অনেকের সাথেই হালকা পাতলা সম্পর্ক থাকলেও আমার সাথে তিনি প্রেম করা শুরু করেছেন। আর সেকারণেই এভাবে নদীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
ফারাহর এই “আমাদের গল্পগুলি” প্রজেক্ট শুরু হবার পর থেকে দুইটা ব্যাপার আমার কাছে একেবারে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। একটা হলো যে এই ধরণের গোপন প্রেম কখনো গোপন থাকেনা। যতই চালাক কেউ হোক না কেন, যতই গোপনীয়তা পালন করা হোক না কেন, এক সময় না এক সময় তা প্রকাশ পাবেই পাবে। এই যে রিদওয়ান ভাই গোপনে প্রেম করেছে, তিনি কি স্বপ্নেও কোনোদিন কল্পনা করেছে যে অজ্ঞাতনামা, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, বন্দিনী নদীর সাথেকার গোপন প্রেম এই আমার সামনে চলে আসবে? না কি এখনো তার কোনো ধারণা আছে?
আর দ্বিতীয় ব্যাপার হলো গিয়ে যে এধরণের গোপন প্রেমে সাময়িক আনন্দ থাকতে পারে কিন্তু এতে কোনো শান্তি নেই। এই যে নদী, তাকে না হয় অন্যায় ভাবেই প্রেমের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সে তো গোপনে প্রেম করেছে। আর এর ফল স্বরূপ কী হলো? তার দুঃখের জীবনটা আরো বিষিয়ে উঠলো। নয়ন আর ফরিদ সাহেব তো ওর সাথে একেবারে নির্লজ্জের মতো সোজা সাপ্টা প্রতারণা করেছে। তাদের প্রতি তো নদীর তিল পরিমান অনুভূতি বা ভালোবাসা নেই। তাদের প্রতারণা তাই মনেহয় সহ্য করা যায়। কিন্তু যাকে সব দিয়ে ভালোবেসেছে নদী, তার প্রতারণা জীবনভর বয়ে বেড়ানোর শক্তি কি ওর আছে? ও তো আজ উদ্ভ্রান্ত হয়ে আছে।
স্টলে এইমাত্র রিতা আপা এসে পৌছালো। তিনি আজ একাই এসেছে। দেলোয়ার ভাই আসেনি। মেয়েরা সবাই দুলাভাই আসেনি দেখে অস্থির হয়ে গেলো। রিতা আপা কিছু জবাব দিলেন না। শুধু আমার সাথে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলেন। সেই দৃষ্টির মানে হলো “তোমার সাথে কথা আছে”। রিতা আপার সাথে আর সেসময় কথা বলা হলোনা। কেননা ঠিক সেই সময় লেখিকা মাহবুবা নাসরিন আমার সাথে দেখা করার জন্য হাজির হয়ে গেলো। তিনি যে এখানে থাকবেন সেটা আমি আগেই জানতাম। এখানে বইয়েরও একটা বিশাল স্টল আছে। ইতিমধ্যে ফেসবুকে তার কিছু লেখা পড়ে সেগুলোতে কমেন্ট করে আমি তার সাথে ভালোই পরিচিত হয়ে গিয়েছি। আজকে আগে থেকেই আমাদের দেখা করার পরিকল্পনা।
এসেই মাহবুবা নাসরিন আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো যেন আমরা কতদিনের পরিচিত। তার সাথে অল্প কিছু কথা বলতেই খেয়াল করলাম রিদওয়ান ভাই আমাদের এদিকেই এগিয়ে আসছে। মাহবুবা নাসরিন কি জানেন যে রিদওয়ান ভাই তার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন? নিশ্চয়ই জানেন না। তা না হলে তিনি এভাবে সব দাঁত কেলিয়ে রিদওয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতেন না।
রিদোয়ান ভাই এসেই আমার আর মাহবুবা নাসরিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
– সেই দূর থেকে দেখতে পেলাম যে দুই নক্ষত্র একসাথে। তাই চারিদিকটা কেমন আলোকিত হয়ে আছে। পতঙ্গ যেমন আলোর টানে এগিয়ে যায়, আমিও তেমনি আপনাদের পানে ছুটে এলাম।
রিদওয়ান ভাই এই বলে আমাদের দিকে তাকিয়ে মদির হাসি ছুড়ে দিলেন। সেই হাসিতে কোনো ফাঁকি নেই। আমাদের দুইজনকে দেখে যে তিনি খুশি হয়েছেন তা তার হাসিতে স্পষ্ট। কীভাবে বিশ্বাস করবো যে তিনি কাজের জন্য আমাকে কোনোরকমে আমাকে সহ্য করে যান? আমি তার কথার জবাব না দিয়ে স্টলের কাজে মন দিলাম। মাহবুবা নাসরিনই জবাব দিলেন,
– আপনি পতঙ্গের মতো ছুটে এলেন? আর আমি দেখলাম কেতাদুরস্ত জেমস বন্ড ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
এই শুনে রিদওয়ান ভাই আরো খুশি হয়ে গেলেন। তবে এখানে এভাবে কথাবলা খুবই কষ্টের। গান বাজনা, চিৎকার চেঁচামেচির কারণে সবাইকে মোটামুটি চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে। কথা বলে সুবিধা না করতে পেরে মাহবুবা নাসরিন বলে উঠলো,
– চলেন আমরা সেলফি তুলি।
এই বলে তার মোবাইল বের করে এক হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে আমাকে আর রিদওয়ান ভাইকে ফ্রেমে জয়েন করতে বললো। এমনি সময় হলে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে সেলফি তুলতাম। কিন্তু আমার আর রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে ছবি তোলার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। আমি বললাম,
– আমার সেলফি একদম ভালো হয়না। আপনারা দুইজন দাঁড়ান, আমি বরং ছবি তুলে দেই।
রিদওয়ান ভাই বলে উঠলেন,
– ব্যাপার কী? নাফিসা আবার কবে থেকে সেলফি তুলতে অপারগ? নাকি আজকে আশফাক ভাইয়ের সাথে এসেছেন দেখে পর পুরুষের সাথে ছবি তোলা মানা?
আমার এই কথা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। আশফাক আমাকে আড়ালে “প্রাণের রিদওয়ান ভাই” বললে কী হবে, ও আমার দেখা সবচেয়ে ওপেন মাইন্ডেড পুরুষ। অন্তত এই মুহূর্তে আমার সেটাই মনে হচ্ছে। আমি দূরে আশফাককে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে এদিকে আসতে বললাম। আশফাক আসা মাত্রই বলে উঠলাম,
– আমাদের একটা ছবি তুলে দাও তো প্লিজ। সেলফি ভালো আসছেনা।
এই বলে আমি মাহবুবা নাসরিন আর রিদওয়ান ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালাম। আমার এখন আর কিছুই ভালো লাগছেনা। কেন যে এভাবে সবকিছুতে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে জড়িয়ে গেলাম। লোকটাকে এখন অসহ্য লাগছে। অথচ এতদিন কী প্রচন্ড এক মুগ্ধতার বলয়ের মধ্যে আটকে ছিলাম। ভেবেই আমার অবাক লাগছে।
আশফাক ছবি তুলে দেবার পর তার সাথে মাহবুবা নাসরিনের পরিচয় করিয়ে দিলাম। তাদের দুইজনের আবার অনেক পরিচিত মানুষ কমন পড়েছে। মাহবুবা নাসরিনের সাথে আশফাক বইয়ের স্টল দেখতে চলে গেলো। ঠিক এই সময় রিদওয়ান ভাইয়ের স্ত্রী সোমা ভাবি আমাদের স্টলে এসে হাজির। তার সাথেও আমার ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় আছে কিন্তু সামনা সামনি এই প্রথম দেখা। সোমা ভাবীর সাথে সুন্দর করে রিদওয়ান ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমি ভালোকরে সোমা ভাবীকে দেখে দিলাম। পরনে সাধারণ একটা হালকা খয়েরি জমিন আর লালপাড়ের তাঁতের শাড়ি। মুখে খুবই সামান্য প্রসাধন। অনাড়ম্বর এবং সাধারণ একটা মুখ। আরো অনাড়ম্বর এবং সাধারণ তার সাজ। রিদওয়ান ভাইয়ের আকর্ষণীয় আর গ্ল্যামারাস লুকের কাছে তাকে বেশ সাদামাটাই মনে হতে পারে। তবে একটু ভালো করে খেয়াল করলে তার চোখ মুখে এক ধরণের স্নিগ্ধতা আছে। এক ধরণের ঔজ্জ্বল্য। শুনেছি দারুন মেধাবী মহিলা তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ফিজিক্সে পড়াশুনা করেছেন। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের এনলিস্টেড রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ছিলেন। দারুন নাচও জানেন । ইউনিভার্সিটি জীবনে নাকি চারিদিক মাতিয়ে রাখতেন। সেই তুলনায় বলা যায় সব ছেড়েছুড়ে তিনি এখন মোটামুটি নিভৃতচারী জীবন যাপন করেন। একটা সেকেন্ডারি স্কুলের ফিজিক্সের শিক্ষকতা করেন। ফেসবুকে খুব একটা অ্যাকটিভ না দেখে তার সম্পর্কে আমার খুব একটা জানা হয়নি। এই যে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে আমার এত দহরম মহরম কিন্তু ভাবীর কথা খুব একটা শোনা হয়নি বা শোনার প্রয়োজনবোধ করিনি।
কিন্তু হঠাৎ করেই আজ তার সম্পর্কে জানার ভীষণ আগ্রহ বোধ করছি। তিনি কি তার স্বামীর দ্বৈত জীবন সম্পর্কে অবগত? তার স্বামী কি এক নদীর সাথেই প্রেম করেছে নাকি নদীর কথাই ঠিক। তিনি এখন নদীকে ছেড়ে আরেক গোপন প্রেমে মজে আছে?
বাকিটা সময় আমি সোমা ভাবীর সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম। মেয়েরা সবাই স্টল ভালোই চালিয়ে নিচ্ছে। আর রিতা আপা তো আছেই। সাথে রিদওয়ান ভাইও আমাদের স্টলে বাড়তি আকর্ষণ যুক্ত করেছে। দলে দলে মহিলারা এসে স্বনামধন্য সাংবাদিক, নারী জাতির পথ প্রদর্শক, সুদর্শন, ভীষণ মিষ্টভাষী রিদওয়ানের ভাইয়ের কাছ থেকে আমাদের কাজ সম্পর্কে জেনে নিচ্ছে।
টানা আট ঘন্টা সোমা ভাবীর সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম আমি। তার শিক্ষকতার গল্প, সংসারের গল্প, রিদওয়ান ভাইয়ের গল্প, দুই ছেলের গল্প। আমার কাজ, আমার পরিবারের গল্প। নাহ, সাধারণ সব গল্প। এর থেকে ধারণা করার কোনো উপায় নেই যে তার রিদওয়ান ভাইয়কে নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে কি নাই। রিদওয়ান ভাই সম্পর্কে কিছু জানে কি জানে না।
দরকার কী আমার ধারণা করার? লাভ কী আমার জেনে? আমি নিজে থেকে কি তাকে কিছু জানাতে যাবো? রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে তিনি তো মনেহয় সুখেই আছে? কী দরকার আরেকজনের সংসারে ফাঁটল ধরানোর? আর নদীই তো তা চায়না। নদী তো এখনো রিদওয়ান ভাইয়ের প্রেমে অন্ধ। সেই প্রেম ফিরে পাবার আশায়ই আমার সাথে ও যোগাযোগ করেছে। কিন্তু রিদওয়ান ভাইয়ের কোনো ক্ষতি, অসম্মান সে হতে দিতে চায়না। অদ্ভুত মানুষের মন। অদ্ভুত এই প্রেমের অনুভূতি।
তবে এই সব ঘটনায় আমার বড়ো শিক্ষা হয়েছে, আমার ভীষণ উপকার হয়েছে। আমি যেই ফাঁপা মুগ্ধতার বলয়ে আটকে ছিলাম, যেই বলয় আমাকে ভীষণভাবে টানতো, তা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। এটাই আমার বিশাল পাওনা।
স্টেইজে কে যেন ভীষণ চমৎকার করে রবীন্দ্রসংগীত গাইছে,
“আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভ’রে।”
আমি খেয়াল করলাম পেছনের দিকের একটা চেয়ারে বসে আশফাক মন্ত্রমুগ্ধের মতো গান শুনছে। আমার হঠাৎ করেই ইচ্ছা হলো ওর পাশে বসে গানটা শোনার।
“না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহাদানেরই যোগ্য ক’রে
অতি-ইচ্ছার সংকট হতে বাঁচায়ে মোরে।
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।”
(চলবে)
আমিনা তাবাস্সুম