মনের নদী বেশি গভীর (৮)

0
167

মনের নদী বেশি গভীর
(৮)

আজকে সারাটাদিন আমি আর ফারাহ দুইজন একসাথে অফিসে বসে কাজ করেছি। আমি আমার মতো চোখ কান বন্ধ করে কাজ করে গিয়েছি আর ফারাহ কাজ করেছে ফারাহর মতো। আমাদের দুইজনের কোনো কথাবার্তা হয়নি বললেই চলে। দুপুরে আমার হাতের কাজগুলো সব গুছিয়ে ফেলার পর হঠাৎ মনেহলো কী যেন একটা গড়বড় আছে। যত কাজই থাকুক না কেন, ফারাহ তো চুপ করে থাকার মেয়ে না। কিছুক্ষন পরপর নতুন নতুন প্রজেক্টের আইডিয়ার কথা না বললে ওর কোনো কাজ নাকি আগায় না। আমি আমার চেয়ার থেকে উঠে ফারাহকে বললাম,
– চা খাবে? আমি আমার জন্য বানাতে যাচ্ছি।
ফারাহ শুধু ওর ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে কোনোরকমে কাষ্ঠ হাসি হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।
আমি চা বানিয়ে একটা বিস্কিটের বক্স নিয়ে এসে ওর পাশে বসলাম। ওর দিকে চায়ের মগটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
– ঠিক আছো ফারাহ? তোমার কি মন খারাপ?
– মন খারাপ? না তো আপা। আমি ঠিক আছি।
ফারাহ কোনোভাবেই ঠিক নেই। ওর মধ্যে সবসময় একটা অস্থিরতা কাজ করে। অস্থির হয়ে কথা বলে, অস্থির হয়ে কাজ করে, হঠাৎ করেই রেগে যায় আবার হঠাৎ করেই রাগ পড়ে গিয়ে খুশিতে ঝলমল করে উঠে। এত ঠান্ডা, চুপচাপ, ধীরস্থির ফারাহকে মনেহলো আমি চিনি না। আমি কিছু না বলে ওর পাশে বসে চুপচাপ চা খেতে থাকলাম। হঠাৎ ফারাহ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কিছু বলবেন আপা?
– নাহ, অনেক কাজ করেছি আজকে। আর কাজ করতে ভালো লাগছেনা। তুমিও তো আজকে অনেক কাজ করেছো। তোমার ফেসবুক পরকীয়া প্রজেক্টের কাজ তো মনেহয় ভালোই আগাচ্ছে।
এটা বলেই মনেহলো “ফেসবুক পরকীয়া” কথাটা বলা ঠিক হয়নি। ফারাহ এই প্রজেক্টের নাম দিয়েছে “আমাদের গল্পগুলি”। এই প্রজেক্টের ব্যাপারে সে খুবই সেনসিটিভ। এইসব নিয়ে মজা করলে বা কথায় সতর্ক না হলে মাইন্ড করে বসে। আমার কথা শুনে ও বলে উঠলো,
– ধুর আপা, এইসব প্রজেক্ট টোজেক্ট কোনো কাজে দিবে না। যার প্রেম করার সে প্রেম করবেই করবে। যে ফাঁদে পা দেবার সে ফাঁদে পা দিবেই। আমি আপনি চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে ফাঁদ দেখিয়ে দিলেও তারা সেটা দেখতে পাবেনা। ভাববে আপনি তাদের সুখ, তাদের খাঁটি ভালোবাসা সহ্য করতে পারছেন না। তাই তাদেরকে এসব বলছেন। তখন আমাদেরকেও পথের কাঁটা মনে হবে। একমাত্র ধরা খাবার পরই সবার শিক্ষা হয়, তার আগে না।
ফারাহ এখন হড়হড় করে কথা বলে যাচ্ছে। আমার মনেহলো এ তো দেখি চোরের মুখে রাম নাম। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ফারাহ এই প্রজেক্ট জপ করার পর এখন এসব কী বলছে? কিন্তু তারপরও যে ফারাহ হড়হড় করে কথা বলছে, ওর আসল ফর্মে ফিরে এসেছে, তাতে আমি একটু স্বস্তি বোধই করছি।
আমি ফারাহর দিকে বিস্কিটের টিনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
– নাও, বিস্কিট খাও। তারপর বলো কী হয়েছে। যদি বলতে চাও। আর না বলতে চাইলে কিছুক্ষন শুধু তোমার এই প্রজেক্টকে গালাগালি করে মনটা হালকা করে নিতে পারো। আমি এতে কিছু মনে করবোনা। কিন্তু মন হালকা করার পর আবার প্রজেক্টের কাজে মন দিতে হবে। আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এর জন্য কিছু ফান্ড জোগাড় করেছি।
আমার কথায় ফারাহ হেসে দিলো। বললো,
– না আপা। কাজ ঠিকঠাকই করবো। তবে এখন মনে হচ্ছে আদৌ কারো কোনো উপকার হবে কিনা। মনটা ভীষণ খারাপ।
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। ফারাহ যদি কিছু বলতে চায় তাহলে এমনিতেই বলবে। তবে নীরবতা ভাঙতে আবার বললাম,
– ওই সাদা বিস্কিটটা খেয়ে দ্যাখো। ওটা ভীষণ মজার।
ফারাহ বিস্কিটটা হাতে নিয়েই আবার কথা বলা শুরু করে দিলো। ওরা পিঠাপিঠি তিন বোন। ফারাহ সবচেয়ে বড়ো। ওর বিয়ে হয়েছে ছয়বছর হলো। কোনো ছেলেপুলে এখনো হয়নি বা নেয়নি। ওর স্বামী রাকিবের সাথে ইস্ট লন্ডনে থাকে। ওর পরের বোন সারাহও বিবাহিত এবং আড়াই বছরের একটা মেয়ে আছে। সারাহ মোহাম্মদপুরে ওর শ্বশুর বাড়িতে থাকে। আর সবচেয়ে ছোটবোন মিতির এখনো বিয়ে হয়নি। বাবা মা আর মিতি ঢাকার নিকুঞ্জতে একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকে।
ফারাহ ওর স্বভাবসুলভ আচরণে হড়হড় করে গল্প করে যাচ্ছে। আমি ভাবছি ওদের দুই বোনের নাম মিল করে রাখা, সারাহ আর ফারাহ। কিন্তু ছোট বোনের নামে মিল নেই কেন? কিন্তু ফারাহ এত তাড়াতাড়ি কথা বলছে যে কথাটা আমি জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাচ্ছিনা। আমি মনে মনে ফারাহ আর সারাহ এর সাথে মিলিয়ে নাম বের করার চেষ্টা করছি। কিন্তু একটা নামও মাথায় আসছেনা। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে ফারাহর কথায় আবার মন দিলাম।
ওদের তিন বোন একেবারে হরিহর আত্মা। ফারাহ দূরে থাকলেও ওরা একে অপরের জীবনের সবকিছু নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে। মেয়ে হবার পর থেকে সারাহ নাকি প্রায়ই বলতো ওর হাসবেন্ড হাসিব সারাহর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আগের মতো ওকে ভালোবাসে না, সময় দেয় না। এধরণের কমপ্লেইন তো অনেক মেয়েরই থাকে। ওর কথায় খুব একটা সিরিয়াস কিছু ফারাহর মনে হয়নি। সেইসময় ছোট বাচ্চা নিয়ে সারাহ হিমশিম খাচ্ছিলো। শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে এক ছাদের নিচে থাকার কমপ্লিকেশন তো আছেই। আর তার উপর হাসিবের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছিলো। সব মিলিয়ে হাসিব নিজেও অশান্তির মধ্যে ছিল। ফারাহ বোনের মন খারাপ থাকতো দেখে ওকে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকার বুদ্ধি দিয়েছিলো।এমন কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা যা ওকে আনন্দ দেয়। কিছুক্ষনের জন্য হলেও সংসার, বাচ্চা, স্বামী, শ্বশুর -শাশুড়ির বাইরে নিজের একটা জগৎ তৈরি করে দেয়। ফারাহই বোনকে ফেসবুকের দুই একটা গ্ৰুপে যুক্ত করে দিয়েছিলো। কিন্তু তারপর সেটাই ওর বোনের কাল হয়ে দাঁড়ালো। আর ওর বোনের ঘটনা থেকেই ফারাহর এই “আমাদের গল্পগুলি” প্রজেক্টের কথা মাথায় আসে।
সারাহ ছোটবেলায় গান করতো। দারুণ গানের গলা নাকি ওর। শুধু গান না, ওদের তিন বোনের মধ্যে সারাহ নাকি সবচেয়ে গুণী। ওর মধ্যে সবসময়ই শিল্প সাহিত্যবোধটা খুব প্রখর ছিল। ফারাহর বুদ্ধিতে সারাহ নতুন করে গানের চর্চা শুরু করেছিল। ফেসবুকের গ্ৰুপগুলোতে সেই গানগুলো পোস্ট করে বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছিলো। অনেকের কাছ থেকে উৎসাহ উদ্দীপনা পেয়ে ওর নিজের প্রতি একধরণের ভালোলাগা এবং আত্মবিশ্বাসের জন্ম নিয়েছিলো। এতে করে সংসারের ছোটখাটো খুঁত, স্বামীর ছোটোখাটো অবহেলা আর আগের মতো চোখে পড়তোনা। সবই ঠিকঠাক মতো চলছিল। কিন্তু সেই গ্ৰুপেই এক আবৃত্তিকারের সাথে পরিচয় হয় ওর, তার নাম আবার গুঞ্জন। সেই গুঞ্জন নাকি ব্যাচেলর এবং ফারাহর গানের ভীষণ ভক্ত। গানের প্রশংসা তো অনেকেই করেছে। কিন্তু সারাহর মনে হয়েছে তার প্রশংসাগুলো যেন একেবারেই ভিন্ন মাত্রার। অন্য রকমের গভীর আর কেমন যেন মন উদাস করা।
এরপর ধীরে ধীরে সেই মন উদাস করা স্তুতিবাক্যগুলো পোস্টের কমেন্ট থেকে ইনবক্সে জায়গা করে নেয়। একের পর এক, দিনের পর দিন চলে অবাধ এবং প্রগাঢ় সব আলাপের আনাগোনা। তারপরের ঘটনা তো সহজেই অনুমেয়। অবশেষে তারা পৌঁছে যায় একেবারে বাঁধভাঙা প্রেমের পর্যায়ে। ভিডিও চ্যাট, অসঙ্গত ছবির আদান প্রদান এমনকি অন্য ছুতোয় বাসা থেকে বেরিয়ে ঘন্টাখানেকের জন্য সেই গুঞ্জনের ফ্ল্যাটে কাটিয়ে আসা। যা যা ঘটানো যায় কোনো কিছুই বাদ পড়েনি।
তবে সেই প্রেম যে এত গভীরে পৌঁছেছে তা ফারাহ ধারণা করতে পারেনি। প্রেমের শুরুর দিকেই সারাহ বোনের সাথে সব শেয়ার করেছিলো। সারাহর ভাষ্য অনুসারে হাসিব আর ওকে ভালোবাসে না। ওর এই জীবন আর ভালো লাগছে না। পৃথিবীতে গুঞ্জনই একমাত্র মানুষ যে ওর কষ্ট বুঝতে পারে, ও জন্য কেয়ার করে, ওকে সময় দেয়, আর ওকে মন থেকে ভালোবাসে। সারাহ আর হাসিবের প্রেমের বিয়ে ছিল। কিন্তু গুঞ্জনের সাথে প্রেম হবার পর সারাহ নাকি বুঝতে পেরেছে যে সেটা আসলে কোনো প্রেমই ছিলোনা। গুঞ্জনের প্রেমের কাছে পৃথিবীর আর কোনো প্রেমই নাকি প্রেম না। গুঞ্জন সারাহকে জানিয়েছে যে ওর বাবা মা নাকি গুঞ্জনের জন্য পাত্রী খুঁজছে। কিন্তু ও পৃথিবীর আর কোনো মেয়েকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবেনা। ও সারাহ আর ওর মেয়েকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবন শুরু করতে চায়, ভালোবাসার জীবন।
ফারাহ বোনের কাছ থেকে সব শুনে গুঞ্জনের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখে। সেই গ্ৰুপে জয়েন করেও তার আবৃত্তি এবং কার্যকলাপ ফলো করে। একটু দেখেই ফারাহর লোকটাকে একেবারে লুইচ্চা টাইপের মনেহয়। সব মেয়েদের গান, নাচ, কবিতায় তার ফ্লার্টিং কমেন্ট থাকবেই। সেই কমেন্টের ভাষা যে খুব একটা উচ্চমানের তা না। এমনকি সারাহকে পাঠানো মেসেজগুলোর ভাষা দেখেও ফারাহ অবাক হয়েছে। ওর মাথায় ঢুকেনি যে সারাহর মতো রুচিশীল মেয়ে কিভাবে এইসব কথায় পটে যাচ্ছে। গুঞ্জন সারাহকে কত ভালোবাসে সেটা বুঝানোর জন্য সারাহ বোনকে নাকি কয়েকটা স্ক্রিনশট পাঠিয়েছিল। সেই মেসেজগুলোর ভাষা নাকি এইরকম,
“তুই আমার মনপাখি। তোরে আমি বুকের মধ্যে বাইন্ধা রাখমু। একবার শুধু আমার বুকে আয়। তোর দোহাই লাগে, শুধু একবার। এই বুকটা কাইট্টা তোর পায়ে উজাড় কইরা দিমু”
“তুই জানিস, আমার নাক বন্ধ। আমি কোনো কিছুর গন্ধ পাইনা। কিন্তু আমার নাক শুধু তোর শরীরের গন্ধ খুঁজে। দিবি তুই তোরে একটু শুকতে। আমি তোর গন্ধে বুদ্ হয়ে যেতে চাই”
এরকম আরো অনেক মেসেজ। ফারাহর মনেহয়েছে কী জঘন্য কথাবার্তা। ও কিছুতেই ওর বোনের সাথে এসব মিলাতে পারেনি। অবাক হয়ে জিগেশ করেছিল,
– এই অসভ্য লোক তোকে “তুই তুকারি” করছে কেন?
– “তুই” তো ভালোবাসার ডাক। সবচেয়ে আপন মানুষকে মানুষ “তুই” বলে ডাকে। কেন আমরা দুইজন দুইজন তুই বলে ডাকি না? এতে অসুবিধা কী?
ফারাহ অন্যদের পোস্টে সেই লোকের একই ধরণের কিছু কমেন্ট দেখিয়ে সারাহকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। ওদের কিছু কমন ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করেও গুঞ্জন সম্পর্কে ভালো কিছু শুনেনি ফারাহ। অনেকেই বলেছে অসভ্য, লম্পট টাইপের লোক। গ্ৰুপে মেয়ে দেখলেই নাকি তাদেরকে ত্যাক্ত বিরক্ত করা শুরু করে দেয়। ফারাহ ওর বোনকে সেগুলোও বলেছে, দেখিয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মাঝখান থেকে ফারাহর সাথে এইসব শেয়ার করা বন্ধ করে দিয়েছে।
অবশেষে নিজেকে একেবারে পতনের শেষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ধরা খেয়ে সারাহর টনক নড়ে। গুঞ্জন মাঝে মাঝে সারাহর কাছ থেকে অল্পস্বল্প টাকা চেয়ে নিতো। পরে ফেরত দিয়ে দিবে বলে। সারাহ ওর হাত খরচ, সংসার খরচের টাকা থেকে কোনোরকমে সেগুলো ম্যানেজ করতো। ধীরে ধীরে আরো বেশি বেশি টাকা দেবার জন্য গুঞ্জন সারাহকে চাপ দেওয়া শুরু করে। কিন্তু অতো টাকা তো সারাহর পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। তখন শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলিং। সারাহর পাঠানো মেসেজের স্ক্রিনশট, ছবি, ভিডিও ভাইরাল করে দেবার হুমকি। শুধু তাইনা, সেই লোকের ফ্ল্যাটেও ওদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও লুকিয়ে ধারণ করে রেখেছে সেই শয়তান লোকটা। টাকা না দিলে সেগুলো ভাইরাল করে দেবারও হুমকি দেওয়া হয়েছে। একেবারে সেইম ওল্ড স্টোরি।
আমি বুঝলাম ফারাহর মন খারাপের কারণ এখন। ফারাহ আমাকে বললো,
– আপা, সারাহ নিজে যেচে এইসব বিপদ ডেকে এনেছে। ওর শাস্তি প্রাপ্য। আমার যতই মন খারাপ হোক, আমি ঠিক করেছিলাম ওর জন্য কিছু করবো না। ও তো আমার কোনো কথা শুনেনি। কিন্তু আমার বাবা মা এখন এর মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছে। শয়তান লোকটা বাবা মাকেও মেয়ের কথা জানিয়ে হুমকি দেওয়া শুরু করেছে। আমার বাবা মেয়ের সম্মানের কথা চিন্তা করে সেই শয়তানটাকে টাকা পয়সা দিয়ে এখন নিঃস্ব হতে চলেছে। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। সেই লোক আরো টাকা চায়। আমার বাবা খুবই সাধারণ চাকরি করে অবসর নিয়েছে। আমার ছোট বোনের বিয়ে এখনো বাকি। এই সমস্যা আমাদের পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সারাহর শ্বশুরবাড়ি কিছু জানতো না। কিন্তু এর মধ্যে সারাহ আত্মহত্যার চেষ্টা করে আরো ঝামেলা বাধিয়ে ফেলেছে। এখন ওর হাজবেন্ড, শ্বশুরবাড়ির লোকরাও ওকে সন্দেহ করা শুরু করেছে।
– তোমার বাবা মা বোকার মতো ওই লোককে টাকা দিতে গেলো কেন?
– না দিলে, আমার বোনের ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলে একটা ভীষণ কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে তো। আমার বোনের সংসার ভাঙবে, ছোটবোনের বিয়ের সমস্যা হতে পারে, আমাকেও আমার পরিবারের কাছে কম ছোট হতে হবে না। আর বাবা মায়ের কথা তো বাদই দিলাম। বাবা মা ভেবেছিলো টাকা নিয়ে সে থেমে যাবে। কিন্তু এ যে এত বড়ো শয়তান তা তো বুঝেনি।
– তো, এখন কী হবে?
– আমার এক বন্ধু বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী পুলিশ, ৱ্যাবের লোকজনকে চিনে। তাকে ধরে আমি এখন ওই লোককে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করতে চাই। আমার বন্ধু আমার বোনের সাথে ডিটেইলসে কথা বলেছে। তারা গোপনীয়তা রক্ষা করে ওই লোকের বিরুদ্ধে কেসের ব্যবস্থা করতে পারবে। এমন শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করবে যে জীবনেও আর সে এই ধরণের কোনো কাজ করার সাহস পাবে না।
– হুম। দোয়া করি ফারাহ আল্লাহ তোমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিক।
– দোয়া করেন আপা। আমার বন্ধু আমাকে আশ্বাস দিয়েছে যে সে কেসের ব্যবস্থা করে দিয়ে ওর শাস্তির ব্যবস্থা করে দিবে। কিন্তু দেশের ব্যাপার তো জানেন। সব কিছুতে টাকা পয়সা ঢালতে হয়। না হলে কিছুই আগায় না। আমার বাবা তো এখন নিঃস্ব। তার পক্ষে তো আর টাকা জোগাড় করা সম্ভব না।
তারপর একটু থেমে ফারাহ আবার বলে উঠে,
– আপা, কষ্টের বিষয় কী জানেন? আমি কতবছর ধরে নিজে চাকরি করি, কত টাকা আয় করেছি কিন্তু আমার বোন, বাবা, মায়ের বিপদে তাদের কিছু সাহায্য করার মতো সাহস আর ক্ষমতা আমার নেই। আমি মেয়েদের স্বনির্ভরতা নিয়ে কাজ করি। আমি এই কাজ করার অযোগ্য। যেই মেয়ে নিজের কিছু করার যোগ্যতা নেই সেই মেয়ে অন্যদের কী পথ দেখাবে?
এই বলে ফারাহ হাউমাউ করে কাঁদা শুরু করে দিলো।
আমি তো প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম। এটা তো আরেক সমস্যা মনেহচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– অনেক টাকার ব্যাপার? তোমার কাছে টাকাটা নেই?
– আপা, আমার কী আছে. কী নেই তা তো আমি জানি না। আমাদের তো জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। আমি তো আবার হিসাব নিকাশ কম বুঝি তাই আমার বেতন সেই জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে চলে যায়। রাকিবই সব ম্যানেজ করে। ও সংসার খরচ বা আমার হাত খরচ আমাকে ক্যাশে এনে দেয়। তাতে আমার ভালোমতো চলে যায়। প্রথম প্রথম আমি সেই অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে তা জানতে চাইতাম। রাকিব এতে বিরক্ত হতো, অযথা অশান্তি হতো আমাদের। আমি তো হিসাব নিকাশ কম বুঝি, তাই মনেহয় বিরক্ত হতো ও। তাই আমি আর এইসব জানতে চাইনা। আমার হিসাব নিকাশ ভালো লাগেনা। তাই ওর উপরই সব ছেড়ে দিয়েছি।
– কী “হিসাব নিকাশ কম বুঝি”, “হিসাব নিকাশ ভালো লাগেনা” শুরু করলে? আমাদের অফিসের বাজেটের হিসাব নিকাশ তুমি বুঝতে পারো আর তুমি তোমার নিজের বেতনের হিসাব বুঝতে পারো না? এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো? যা হোক, সেই কথায় পরে আসছি। তোমার বোনের এই কেসের জন্য কত টাকা লাগবে?
– আপা বেশি না। লাখ দুয়েক হলেই আমার বন্ধু ব্যবস্থা করে দিবে বলেছে।
– তোমার এই বন্ধুতো আবার ফ্রড না?
– না আপা, আমি সব জেনে শুনেই ওর সাথে কথা বলেছি।
– দুই লাখ মানে দুই হাজার পাউনডও না। এই পরিমান পাউন্ড তোমার অ্যাকাউন্টে নেই?
– আপা, আমার হিসাবে দুই হাজার কেন? আরো অনেক টাকা আমাদের অ্যাকাউন্টে থাকার কথা। রাকিবের বেতন ঠিক কত তা আমি জানিনা কিন্তু আমার ধারণা আমাদের দুইজনের বেতনই কাছাকাছি। আমরা খুবই সাধারণভাবে থাকি। আমাদের কোনো বাচ্চা নেই। রাকিব অযথা কোনো খরচ পছন্দ করে না। সংসার খরচ, আমার হাত খরচ আর আনুষাঙ্গিক খরচ মিলে আমার হিসেবে আমাদের একজনের বেতনেই মাস চলে যায়। আরেকজনের বেতনটা তো থেকে যায়। সেখান থেকে কিছু রাকিব দেশে ওর বাবা মাকে নিয়মিত পাঠায়। কিন্তু সব না। তারপরও প্রতি মাসে বেশ কিছু জমা হবার কথা। আমার মাঝে মাঝে বাবা মাকে কিছু পাঠাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পাঠানো হয়ে উঠেনি।
– তাহলে সমস্যা কোথায়? তুমি তো সেই টাকা থেকে তোমার বাবাকে কিছু দিতেই পারো ? এটা তো তোমার উপার্জিত অর্থ। সেখান থেকে দুইহাজার পাউন্ড পাঠিয়ে দাও।
– আপা, আমার ব্যাংকে অ্যাকসেস নেই। আমি কোনোদিন সেই চেষ্টা করিওনি। এভাবেই তো আমাদের ভালো চলে যাচ্ছে। রাকিব ভালো হিসাব নিকাশ বুঝে। তাই ওর উপর সব ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি জানি আমি রাকিবের কাছে টাকা চাইলে একেবারে তুলকালাম বেঁধে যাবে।
– ফারাহ, তুমি কত বছর ধরে চাকরি করো?
– পাঁচ বছর।
– এই পাঁচ বছরে তুমি কখনও তোমার ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট চেক করোনি? যেই অ্যাকাউন্টে তোমার বেতন যায়?
– না আপা। আমি জানি আপনি আমাকে স্টুপিড ভাবছেন। কিন্তু রাকিব বলেছে যে টাকা পয়সা ওই ম্যানেজ করতে চায়, এটা ওর দায়িত্ব। এখানে দুইজন মিলে মাতব্বরি করার দরকার কী? আর এমন না যে ও আমার প্রয়োজনীয় কিছুর অভাব রেখেছে। ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও আমি মেনে নিয়েছি। ছাড় দিয়েছি। একটা সংসার মানেই তো অনেক কিছু মেনে নেওয়া, ছাড় দেওয়া। আমি যেমন ছাড় দেই, রাকিবও অনেক কিছু ছাড় দেয়। আপনার সংসারে আপনি ছাড় দেন না?
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি বললাম,
– অবশ্যই ছাড় দেই। সবাই ছাড় দেয়। যেই সংসারে ছাড় দেবার মনোভাব না থাকে সেই সংসার টিকানো তো ভারী মুশকিল। তবে ছাড় দেওয়া এক ব্যাপার আর নিজের সাধারণ সামান্য অধিকারটা খুইয়ে বসে থাকা আরেক ব্যাপার। ফারাহ, তুমি তো ভীষণ কাজের এবং বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। তুমি শিক্ষিত একটা মেয়ে। তোমার কোনো ক্লায়েন্ট তোমার কাছে এসে যদি বলে যে সে তার কষ্টার্জিত অর্থ থেকে নিজের কোনো দরকারে কোনোদিন কিছু ব্যয় করতে পারে না তখন তাকে তুমি কী বলবে? তুমিই চিন্তা করে বের করো। আমার এখানে কিছু বলার নেই।
ফারাহ মাথা নিচু করে বসে কেঁদে যাচ্ছে। আমি বললাম,
– চিন্তা করোনা। আল্লাহ নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবে। আমি আপাতত তোমাকে দুই হাজার পাউন্ড লোন দিতে পারবো। তুমি সেটা দিয়ে তোমার বোনের আগে ব্যবস্থা করো। তারপর মনটা একটু শান্ত হয়ে এলে নিজের দিকেও একটু মন দাও।
তারপর পরিবেশ হালকা করার জন্য বললাম,
– নিজের দিকে মন দেওয়া মানে কিন্তু ফেসবুকে মন দেওয়া না। নিজের দিকে মন দেবার প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে আমার লোন পরিশোধ করা। তোমার উপার্জিত অর্থ থেকে তোমার লোন পরিশোধ করা। তাড়াহুড়ার কিছু নেই কিন্তু আমি জানি তুমি পারবে।
(চলবে)

আমিনা তাবাস্সুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here