গল্পঃ মনের মাঝে তুমি,সূচনা পর্ব
লেখিকাঃ আয়েশা মণি
– রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে, তাহিয়া তাদের বাংলোর সুবিশাল জানালার পাশে বসে অপেক্ষা করে সূর্য উদিত হওয়া দেখবে বলে।
সূর্য যখন মূয়ুরের মত পেখম মেলে তার সোনালী কিরণ চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। তখন তাহিয়া সেই স্নিগ্ধ সোনালী কিরণ নিজের গায়ে মেখে রৌদ্র স্নান করে। তারপর ইশরাকের নামাজ আদায় করে নাস্তা বানাতে যায়।
সেজন্য তাকে প্রচুর বকুনি শুনতে হয়। তবুও সে প্রতিনিয়ত তার নিয়ম ঠিক রাখে। কারন এই এক ফালি রোদের আলোই যে তার বেঁচে থাকার প্রেরণা।
– তাহিয়া যখন ছোট্ট ছিল তখন মা বলতো, জানিসতো খুকি? ঐ যে রোদের ফালি দেখছিস, ও রোজ সকালে কেন জাগে জানিস? তোর সাথে খেলবে বলে। ও তোর রোজ সকালের বন্ধু। তখন থেকেই তাহিয়া তার বন্ধুকে সময় দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
সে আদৌ জানেনা, রোদের মত ঝলমল করে তার জীবনে কেউ আসবে কি না? যার চেহারাতে প্রতিদিন সূর্য উদিত হবে। আর তাহিয়া চাঁদ হয়ে তার কিরণ চুরি করবে।
তাহিয়া নাস্তা বানাচ্ছে আর এসব ভাবছে।
এ জীবনে বোধহয় তার জন্য সূর্য হয়ে কেউ আসবেনা। আসবেই বা কি করে? সে তো সুন্দর নয়। আজকাল কালো মেয়েদের কোন মূল্য নেই। সবাই সুন্দরের পাগল। তারা কি এটা জানেনা? কালো মেয়েরাও মানুষ। ওদের ভেতরেও অনুভূতি জাগে। ওরাও ভালোবাসতে জানে। আচ্ছা! একটা মানুষের সৌন্দর্যের জন্য বিশুদ্ধ একটি মন’ই যতেষ্ট নয়?
গায়ের রং সাদা থাকলেই কি সে সুন্দরী?
কে জানে? হয়তোবা তাই। আর এজন্যই হয়তো সাদা মেয়েদের এত মূল্য।
যাকগে আমি কেন এতসব ভাবছি?
আমার মাওলা আমাকে যেভাবে সৃষ্টি করে সন্তুষ্ট হয়েছেন সেভাবেই করেছেন। এটাই বা কম কি?
আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রুটি বানাতে মনোযোগ দিল তাহিয়া। ৮ টা বাজার আগেই ভাজি রুটি নিয়ে সবার সামনে হাজির করতে হবে।
বাসার সবাই ঘুম থেকে উঠে ঘুরেঘুরে ব্রাশ করছে।
এইতো ১৫ মিনিটের মধ্যেই চেচামেচি আরম্ভ হয়ে যাবে নাস্তা তৈরী হয়নি বলে।
কিন্তু এতে তাহিয়ার কিছু আসে যায়না। নিত্যদিন চেচামেচি শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।
তবুও তার সময় জ্ঞান আছে।
বাবা ৮ টা বাজলেই অফিসে চলে যান। ছোট বোন কোচিং এ চলে যায়। তাই সে খুব দ্রুত নাস্তার কাজটা সমাপ্ত করে সঠিক টাইমে তাদের সামনে নাস্তা উপস্থাপন করে। বাবা তার কাজে খুবই খুঁশি।
বোনও মাঝে মাঝে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, কিন্তু মায়ের কাছে সে অলসের ডিব্বা।
সবই কপাল, ক’জনের ভাগ্যে এরকম হয়?
তবে এটাও ভালো, আনকম জীবন যাত্রা।
তাহিয়া সব সময় সব কথা বা কাজকে ভালোর দিকে নেওয়ার চেষ্টা করে। খারাপ চিন্তা ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয়না।
ইতি মধ্যেই তাবিয়া (তাহিয়ার ছোট বোন) ডাকাডাকি আরম্ভ করে দিয়েছে।
– আপু! আপুরে? নাস্তা রেডি হয়েছে? আমার খুব খুদা পেয়েছে।
– এইতো বোন আরেকটু অপেক্ষা কর।
তাহিয়ার মা সাফা বেগম এসে তাহিয়াকে বলল,
আমার তাবিয়ার খুদা পেয়েছে আর তুই এখনো রুটি ভাজতে আরম্ভই করিসনি কখন খাবে তাবিয়া?
– এইতো মা হয়ে যাবে।
– ১০ মিনিটের মধ্যে খাবার রেডি কর। আর যদি ১০ মিনিটের মধ্যে রেডি করতে না পারিস তাহলে সব রুটি
ময়লার বালতিতে ফেলে দিস। আমরা রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেবো।
– না মা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। খাবার কে নিয়ে এরকম বলতে নেই।
– তোর কাছে আমি জ্ঞান শিখবোনা, কথা বাদ দিয়ে কাজ কর।
তাহিয়া কথা না বড়িয়ে একই সঙ্গে গ্যাসের দু’টো চুলা জ্বালিয়ে একটাতে রুটি বাজতে লাগল, আরেকটাতে সবজি ভাজতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই নাস্তা রেডি করে টেবিলের উপর রেখে আসল।
তারপর সবাই খেতে বসল, নাস্তার টেবিলে তাহিয়ার মা বলল, তাহিয়া! খেয়ে কাজে লেগে পর। আজ বাসায় পাত্র পক্ষ আসবেন তাবিয়াকে দেখতে।
– ঠিকআছে মা, আমি সব সামলে নেবো।
তুমি শুধু বলো কি কি করতে হবে?
– সাফা বেগম তাহিয়ার হাতে একটা খাবারের মেনু ধরিয়ে দিয়ে বললেন। এসব কিছু রান্না করবি। আর রুম গুলো গুছিয়ে রাখবি।
– হুম সব করে নেবো। আবার আমার বোনটাকেও তো সাজিয়ে দিতে হবে।
– সাফা বেগম বললেন না, আমার হিরের টুকরো মেয়েটাকে আমি পার্লারে নিয়ে গিয়ে সাজিয়ে আনবো।
– মারুফ সাহেব (তাহিয়ার বাবা)বললেন, তার কি দরকার? তাহিয়া বলছেতো তাবিয়াকে সাজিয়ে দিবে।
– সাফা বেগম ভ্রু কুচকে বললেন, তুমি কি বুঝবে আধুনিকতার? তাহিয়া কি সাজাতে জানে? পার্লারের মেয়েরা তাবিয়াকে এমন ভাবে সাজাবে যে, পাত্র পক্ষরা চোঁখ ফেরাতে পারবেনা।
– তোমার যা ইচ্ছা করো। কথাটা বলে খাবার শেষ করে হাত মুছে উঠে গেলেন মারুফ সাহেব।
– শুনো তাহিয়ার বাবা! আজ অফিসে যেওনা।
– হুম যাবোনা, বাসাতেই আছি।
– তাহিয়ার মা নাস্তা শেষ করে তাবিয়াকে নিয়ে পার্লারে গেলেন। তাহিয়া একাই কাজ করছে। তাকে সাহায্য করার মত কোন কাজের মেয়েও নেই এ বাড়িতে।
বাবা অবশ্য অনেক বার কাজের মেয়ে আনতে চেয়েছেন, মা বাঁধা দিয়ে বলেছে, ঘরে এত বড় মেয়ে থাকতে কোন কাজের লোক লাগবেনা। মা জানি কি বাবাকে কি যাদু টোনা করেছেন। মায়ের বিরুদ্ধে বাবা কোন দিন কোন কথা বলেনা। আজও তাই হয়েছে। ঘরে বড় মেয়ে থাকতে ভালো সমন্ধ পেয়েছে বলে ছোট মেয়েকে আগে বিয়ে দিচ্ছে। এভাবেই প্রতিদিন হাজার হাজার অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আল্লাহ এদেরকে হেদায়েত দান করুন।
তাহিয়া দ্রুত কাজ গুলো করছে।
মেয়েটা কত ধৈর্যশীল তাকে না দেখলে কেউ বুঝবেনা।
২৩ বছর বয়স তাহিয়ার। আর তাবিয়ার বয়স ১৯ বছর। তাহিয়ার তুলোনায় তাবিয়া ৪ বছরের ছোট হলেও সে দারুন ডেঞ্জারাস মেয়ে। তাহিয়াকে এক হাটে বিক্রি করে অন্য হাট থেকে কিনে নিতে পারবে।
তাহিয়া অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। আর তাবিয়া পড়ে অনার্স ফাস্ট ইয়ারে। তাবিয়া দেখতে অনেক সুন্দরী। যে কোন ছেলে তাকে দেখলেই পছন্দ করে ফেলে। এ পর্যন্ত কত ছেলের সঙ্গে রিলেশন হয়েছে, কত ব্রেকাপ হয়েছে তার কোন হিসেব নেই।
তাবিয়ার কাছে প্রেম মানে টাকা। এক হাতে আসে অন্য হাতে চলে যায়। প্রকৃত ভালোবাসার মানেটাই বুঝেনা মেয়েটা।
কিন্তু তাহিয়া, যদিও আজ পর্যন্ত কোন রিলেশনে জড়ায়নি, তবুও ভালোবাসাকে আর প্রতিটা সম্পর্ককে সম্মান করে।
তাহিয়া ছোট সময় যখন তোতলিয়ে তোতলিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতো, মা! মা! ভালোবাতা কি?
তখন মা বলতো, ভালোবাসা আল্লাহ, ভালোবাসা রাসূল, ভালোবাসা মা। আর ভালোবাসা সে, যার জন্য হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়।
বড় হওয়া অব্দি, তাহিয়া আল্লাহ, রাসূল, আর মা কেই ভালোবাসা মনে করতো। কারন তাহিয়া সেদিন ছোট্ট থাকার কারনে মায়ের শেষ কথাটা বুঝতে পারেনি।
তবে এখন বুঝে। তাই তো সে ভালোবাসাকে এত সম্মান করে।
ভালোবাসা একটি পবিত্র শব্দ। এই ভালোবাসাকে অপবিত্র করছে কিছু নোংরা মনের মানুষরা। সত্যিই তাদের নিয়ে দুঃখ হয় তাহিয়ার। যারা চোঁখ থাকতে অন্ধ।
তাহিয়া কতবার তাবিয়াকে নিষেধ করেছে এসব করা থেকে বিরত থাকতে। কিন্তু তাবিয়া তার পাল্টা জবাবে বলেছে শোন আপু! তুই দেখতে সুন্দর না। এজন্য কেউ তোর প্রেমে পড়েনা। তাই তুই এসব বুঝবিনা। শুধু শুধু আমাকে জ্ঞান দিতে আসিসনা। আমি কারো কথা শুনিনা, শুধু নিজের মনের কথা শুনি।
নামাজের সময় যখন তাহিয়া নামাজ পড়ে
তাবিয়াকে নামাজ পড়তে বললে সে এরকম বলে।
তুই নামাজ পড়তো আপু। আমার সাথে ঘেনঘেন করিসনা। ভাল্লাগেনা এত ঘেনঘেন। বলেছি তো আমি কারো কথা শুনিনা। নিজের মনের কথা শুনি। যেদিন আমার মন বলবে নামাজ পড়তে সেদিন কাউকে বলতে হবেনা, নিজেই পড়বো।
তাহিয়া বার বার বলতে বলতে এখন ক্ষান্ত হয়েছে।
এখন শুধু পরিবারের জন্য দোয়া করে। হে আল্লাহ তুমি এদেরকে হেদায়েত দান করো।
তাহিয়ার কাজ শেষ না হতেই সাফা বেগম আর তাবিয়া পার্লার থেকে চলে এল। তাবিয়াকেও সাজিয়েছে আর সে নিজেও সেজেছে।
সাফা বেগম এসে আবারো চেচামেচি শুরু করে দিলেন। কিরে? এখনো কাজ শেষ হয়নি?
– এইতো মা শেষ।
এরই মধ্যে বাসার কলিং বেল বেজে উঠল।
সাফা বেগম এসে তাহিয়াকে বললেন, সব কিছু ডাইনিং রুমে রেখে এসে তুই নিজের রুমে যা। গেস্টদের সামনে আর আসিসনা।
– ঠিকআছে মা আমি আসবোনা।
চলবে……