মনের মাঝে তুমি,০৬,০৭

0
768

গল্পঃ মনের মাঝে তুমি,০৬,০৭
লেখিকাঃ আয়েশা মণি

পর্বঃ ৬

সাফা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
অবশ্য, তাবিয়ার আজকের ঘটনা নিয়ে কোন অনুসূচনা নেই। কারন সে আরেকটা বয় ফ্রেন্ডের সাথে লাইন মারছে। সে জন্য কোনমতে এই বিয়েটা ভেঙে দিল সে।

সে যাইহোক মিহরাব আর তাহিয়ার জন্য ভালো হয়েছে। আল্লাহ যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন।

– মিহরাবের গাড়ি গিয়ে থামল তাদের গেইটের সামনে।
পুরো রাস্তা তাহিয়া কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। ঝড়ের বেগে তার সাথে কি ঘটে গেল সে বুঝতেও পারলোনা।

– মিহরাব বলল মিসেস, গাড়ি থেকে নামেন।
তাহিয়া মিহরাবের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল।
সে আস্তে করে গাড়ি থেকে নামল।

এতক্ষণে আহমাদ সাহেব আর আবিদা বেগম গাড়ি থেকে নেমে গেছেন। আবিদা বেগম এগিয়ে এসে তার বৌ’মার হাত ধরে বলল। মা’রে তুমি আজ আমার ঘরে আমার পুত্র বধু হয়ে এলে। অথচ আমার মনে কত স্বপ্ন ছিল। কত জাঁকজমক করে বিয়ে করিয়ে বৌ নিয়ে আসবো আমার ঘরে। কিন্তু তা তো আর হলোনা। হুট করে তোমাদের এভাবে বিয়ে হয়ে গেল। সব শ্বাশুড়িরা আগে থেকে তৈরী থাকে। আর কত আনন্দের সাথে উপহার দিয়ে বরন করে নেয়। কিন্তু আমার ভাগ্যে যেহেতু সেটা হলোনা। সেহেতু আমার একটু ভালোবাসা উপহার দিয়ে তোমাকে বরন করে নিলাম। এটা বলে আবিদা বেগম তাহিয়ার কপালে আঁলতো করে একটা চুঁমু দিলেন। তারপর হাত ধরে নিযের বৌ’মাকে ঘরে তুলে নিলেন।

– বাসায় যেতেই সবাই অবাক!
এ কাকে নিয়ে এল আবিদা বেগম?
সবার মনে প্রশ্ন। পাশের বাসার চাচিমা, দিদিমারা সবাই আবিদা বেগমকে মাছির মক ঘিরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল।

এক পর্যায়ে আবিদা বেগম বললেন, আপনারা শান্ত হন। আমি বলছি, ও আমার পুত্র বধু। আজ হুট করেই ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি কিভাবে কি হয়েছে সব পরে বলবো।

– মেহনাজ হা করে দাড়িয়ে আছে। সে কিছু বুঝতেই পারছেনা। সে এগিয়ে এসে মা’কে প্রশ্ন করলো৷
মা! আমাদের ভাবীতো অন্যজন হবার কথা ইনি কেনো?

– সব পরে বলবো। আগে আলমারি থেকে নতুন শাড়ি গহনা গুলো বের কর।

– সাফা বেগম বৌ’মাকে মিহরাবের রুমে না নিয়ে মেহনাজের রুমে নিয়ে গেলেন।

-বৌ’মা! তুমি এখানেই ফ্রেশ হয়ে শাড়ি গহনা গুলো পড়ে নাও।

– মেহনাজ!

– জ্বি মা।

– তুই তোর ভাবীকে সাজিয়ে দেতো।

– ওকে মা।

আবিদা বেগম নিযের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলেন।
তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলেন।

আজ যা হয়েছে তা কল্পনাতীত। ছেলে আর ছেলের বৌ’য়ের উপর অনেক ধকল গেছে। তাই সব নিযেকেই সামলাতে হবে। বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে আনতে হবে। তাই যা করার এখন থেকেই শুরু করি।

আবিদা বেগম তার স্বামী আহমাদ সাহেবকে বললেন, আপনি বাজারে যান। আর স্পেশাল কিছু বাজার করে নিয়ে আসুন।

– হুম যাচ্ছি।

-আর কাজের মেয়েদেকে বললেন, তোমরা সবাই কাজে লেগে যাও। তারপর তাদেরকে কয়েকটা স্পেশাল রেসেপির নাম বললেন রান্না করার জন্য।

যে যার যার কাজে মন দিল।

মিহরাব ফ্রেশ হয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করে, টি-শার্ট টা পড়ে ছাদে গেল। মনটা আজ তার বিষন্নতায় ছায়া। কি থেকে যে কি হয়ে গেল।

একটা অচেনা মেয়েকে দুম করে বিয়ে করে নিয়ে এল।
কে জানে? মেয়েটা কাউকে পছন্দ করে কিনা। অথবা কাউকে তো ভালোওবাসতে পারে। তার ব্যক্তিগত মতামত না জেনে রাগের মাথায় এভাবে বিয়ে করে আনাটা ঠিক হলোনা।

আজকের এই ডিসিশন এর জন্য না জানি সারা জীবনটা তার কষ্টে পোহাতে হয় কিনা।

খুব বড় ভুল হয়ে গেল। কিন্তু আমিই বা ঐ সময় কি করতাম? আমার জন্য মেয়েটার বদনাম হয়েছে, আমার জন্যই কি না কি জঘন্য কথা বার্তা বলছিলো তাবিয়া আর তার মা। ঐ সময় কি করে সার্থপরের মত তাকে ফেলে চলে আসতাম?

জানিনা আমি নিযেই তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে সংসার করতে পারবো কিনা। চিনিনা জানিনা তাকে। কোন ফিলিংস নেই তার প্রতি। আর তার প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে জন্মাতে এ জীবন পার হয়ে যাবে কিনা কে জানে?

এখন সবই উপর ওয়ালার হাতে। তিনিই সঠিক পথ দেখাবেন।

মিহরাব ছাদে একা দাড়িয়ে দাড়িয়ে এসব ভাবছে।

– মেহনাজ খুব যত্ন করে তার নতুন ভাবীকে সাজিয়ে দিল। তারপর বলল আরে বাহ্! তোমাকে তো অসম্ভব সুন্দর লাগছে ভাবী।

তাহিয়া লজ্জা মাখা সুরে বলল, কালো মেয়েদের আবার সুন্দর লাগে?

-ভাবী! তুমি নিযেও জানোনা তুমি কতটা সুন্দর।
শুধু গায়ের রং সাদা থাকলেই সে সুন্দর নয়।
তোমার চেহারাতে একটা মায়া মায়া ভাব আছে,
আর তোমার এই উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের মাঝে মুখের পাতলা গঠনটা দারুন মানিয়েছে।

তোমার এত সুন্দর চেহারার গঠনটা ফর্সা মুখে একদম মানাতোনা। ফ্যাকাশে লাগতো। তার থেকে এই উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের মুখেই খুব ভালো লাগছে।

দেখো ভাবী, আয়নায় একটু দেখো।
মেহনাজ তাহিয়াকে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে দিল।
তাহিয়া আয়নার দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জা পেল। দুঃখ রা যেন এক মূহুর্তের জন্য পালিয়ে গেল।
সত্যিই আজ তাকে খুব সুন্দর লাগছে।
তবে কোথায় যেন একটু অপূর্ণতা রয়ে গেছে।
কিন্তু কি? ভাবতেই…

আবিদা বেগম এসে বললেন, ওহ মনেই ছিলোনা নাকের ফুলটা দিতে। এই নে মেহনাজ। তোর ভাবীকে নাক ফুলটা পড়িয়ে দে। আমার আবার কাজ আছে আমি আসছি।

– ঠিক আছে মা।

মেহনাজ তাহিয়াকে নাক ফুলটা পরিয়ে দিল। এবার তাহিয়া বুঝতে পারল এটারই কমতি ছিলো। নাকফুল পরাতে যেন রুপ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

আজ আয়নায় দেখে তাহিয়া নিযেকেই চিনতে ভুল করছে। তার এই লুকানো চেহারা সম্পর্কে জানা ছিলোনা। দুঃখি জীবন বলে, সে কখনো সখ করে সেরকম ভাবে সেজে গুজে আয়নার সামনে দাড়ায় নি।

তবে আজ নিযের এই পরিবর্তন দেখে মনে হচ্ছে নাহ, আমি মোটেও কালো মেয়ে নই। আল্লাহ আমাকে যতটুকু দিয়েছেন তা অনেক। কিন্তু যার সাথে আমার বিয়ে হলো তার কি আমাকে পছন্দ হবে? সে তো ইচ্ছা করে এ বিয়ে করেননি। এক প্রকার বাধ্য হয়ে।
তাহলে সে কি আমাকে মেনে নিতে পারবে? তার লাল টুকটুকে চেহারার সামনে তো আমি এক মালিনি।

– এই ভাবী! কোথায় হারিয়ে গেলে? ভাইয়্যাকে ভাবছো বুঝি?

– না, ইয়ে মানে।

– হুম বুঝেছি, বুঝেছি চলো, তোমাকে তোমার রুমে পৌঁছে দেই।

মেহনাজ তাহিয়াকে নিযের রুমে নিয়ে গেল।

তাহিয়া মিহরাবের রুমে গিয়ে অবাক হলো!
অনেক সুন্দর ফুরফুরে একটা রুম। কোথাও কোন এলোমেলো নেই। খুব দামি আসবাব পত্র আর গালিচা বিছানো রয়েছে। হয়তো খুব যত্ন করা হয় নিত্যদিন এই রুমটার।

– মেহনাজ বলল, ভাবী! এভাবে হুট করে বিয়ে হওয়াতে কিচ্ছু করতে পারিনি। আমার চাচাত ভাই বোনেরা রুমটা এই একটু সাজিয়েছে। তোমার ভালো লেগেছে
তো?

তাহিয়া দরজা, জানালা, দেয়াল আর বিছানার দিকে এক নজর দেখল যে, কাচা ফুল দিয়ে অসম্ভব সুন্দর করে রুমটাকে সজ্জিত করা হয়েছে। এত অল্প সময়ে এত সুন্দর সাজানো দেখে তাহিয়ার মনটা আনন্দে ভরে উঠল।

এসব তার জীবনের পরম পাওয়া।
সে মনে মনে আল্লাহর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করলো।

কিছুক্ষণ পর আবিদা বেগম খাবার সাজিয়ে নিয়ে এল।

– নাও মা, কিছু,খেয়ে নাও। সারাটি দিন কিচ্ছু খাওনি।

– তাহিয়া শ্বাশুড়ির রিকুয়েষ্টে কিছু খাবার খেয়ে নিল।
আবিদা বেগম আবার বললেন, শুনো বৌ’মা! তুমি আমাদের বৌ’মা নও। তুমি আমাদের মেয়ে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। এটা ভেবোনা যে তোমাকে পেয়ে আমরা অসন্তুষ্ট। আমাদের কারো এ বিয়েতে আপত্তি নেই। আমাদের ছেলের উপর আমাদের ভরসা আছে। আমরা জানি সে কোন ভুল কিছু করেনি। তাছাড়া আজ ঐ তাবিয়ার মত মেয়ের কবল থেকে রেহাই পেয়ে তোমার মত একটি ধৈর্যশীল মেয়েকে পেয়ে আমরাও খুব গর্বিত।

আবিদা বেগমের মায়ের মত মমতা ভরা কথা শুনে, তাহিয়ার মন প্রশান্তিতে ভরে গেল।

– রাত ১১.৩০ মিনিট। এখনো মিহরাব ছাদেই দাড়িয়ে আছে। সে নিযের সাথে বোঝাপড়া করে চলেছে।
এতক্ষণ একা একা ভাবনার জগতে নিমজ্জিত থেকে এখন ডাটা অন করলো মিহরাব।

ডাটা অন করতেই মিহরাবের চোঁখ পড়ল একটি কবিতার দিকে। কবিতাটা লিখা তুবা জান্নাতের।

চেয়েছিলাম মনে মনে যারে,
হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম তারে।
আমি আলোক লতার মত ধীরে ধীরে।
তোমার জীবনটা রাখবো ঘিরে।
তুমি কি করে যাবে ছেড়ে?
তোমার মায়াবতী টারে?

আমার চাহনিতে যদি পড়ে তোমার চোঁখ
তোলপাড় করবে তোমার বুক।
যেখানেই যাওনা কেন তুমি
ছায়ামানবী হয়ে রব আমি।

আমি গোলাপ খোঁপায় তোমায় গুজে,
রাখবো চুলের ভাজে ভাজে।
তুমি নিরবে নয়ন বুজে,
আমায় দেখবে স্বপন, সকাল সাঁজে।

কবিতাটা পড়ে মিহরাবের মন চট করে ভালো হয়ে গেল। সে মূহুর্তের জন্য ভুলে গেল আজ যে সে বিবাহিত। তার মনে হলো কবিতাটা তার জন্যই লিখা।

তাই মিহরাব মনের অজান্তে তুবা জান্নাতের লিখা কবিতাটার উপর আলতো করে চুঁমু দিয়ে দিল।

তারপর তুবার আইডিতে সবুজ বাতি জ্বলতে দেখে খুঁশি হয়ে নক করলো। কিন্তু নক করার সাথে সাথেই তুবা জান্নাতের ডাটা অফ হয়ে গেল। মিহবারের আবার মন খারাপ হয়ে গেল। আবারো তার মনে পড়ে গেল সে আজ নব বিবাহিত। তাই মন খারাপ নিয়েই নিযের রুমের দিকে এল।

চলবে…….

গল্পঃ মনের মাঝে তুমি

লেখিকাঃ আয়েশা মণি

পর্বঃ ৭

– মিহরাব রুমে এসে দেখলো তাহিয়া ঘুমিয়ে গেছে।
তাই চাঁদরটা টেনে দিচ্ছিলো হঠাৎ তাহিয়ার দিকে চোঁখ পড়ল। মেয়েটা সেজেছে। খুব সুন্দর করে সেজেছে। অপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে। কি নিস্পাপ চেহারা। পুরো চেহারাটা জুড়ে বিশুদ্ধতা আর পবিত্রতার ছোঁয়া।
মেয়েটা এত সুন্দরী জানা ছিলোনা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের হলেও চেহারাটা সত্যিই অনেক সুন্দর।
হয়তো হুট করে বিয়েটা করেও ঠকিনি।

মিহরাব তাহিয়ার মুখের খুব কাছে গিয়ে দেখছে। তার যে মন খারাপ ছিলো সেটা সে ভুলে গেল। গালে হাত দিয়ে ভাবছে,আজ’ই সুযোগ,ইচ্ছা মত দেখে নেই। নেক্সট টাইম হয়তো এভাবে দেখা হবেনা। অথবা দেখা হলেও এতটা সুন্দর লাগবেনা। শুনেছি বিয়ের দিন নাকি মেয়েদের রুপ দ্বিগুণ বাড়ে। এটা তারই নমুনা হয়তো।

– তাহিয়াকে দেখতে দেখতে মিহরাব আড়মোড়া হয়ে গালে হাত রেখে বসেই ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের ঘোরে ঢুলে ঢুলে কখন যে তার তাহিয়ার মুখের উপর মুখ পরেছে বুঝতেই পারেনি।

সকাল বেলা দুজনেরই ঘুম এক সঙ্গে ভাঙ্গলো।
কারো গরম নিশ্বাস তাহিয়ার ঠোঁটের উপর পরাতে সে আৎকে উঠল। চোঁখ মেলে তাকাতেই মিহরাবও তাকাল। দুজনেরই লম্বা নাক দুটো ঠেকে আছে। এক ইঞ্চি উচু আর নিচুতে দু’জোড়া চোঁখ। ড্যাবড্যাব করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল।

বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মাসজিদে আজানের শব্দে দু’জনের ঘোর কাটল।
মিহরাব ভ্রু নাচিয়া জিজ্ঞেস করলো, কি দেখছো?

তাহিয়া অস্পষ্ট কন্ঠে বলল ভোরের সূর্য।

– মিহরাব তাহিয়ার কথার মানে বুঝতে পারলোনা, সে বুঝার চেষ্টাও করলোনা। তাহিয়া লজ্জামাখা সুরে বলল প্লিজ উঠুন, অযু করতে যেতে হবে তো।

মিহরাব দ্রুত উঠতে উঠতে বলল, সরী, সরী।
আসলে, ইয়ে মানে আমার ব্যাপারে বাজে কিছু ধারনা করবেন না। আমি আপনার অজান্তে রাতে কিচ্ছু করিনি। আসলে কিভাবে যে এখানে এত কাছে ঘুমিয়ে গিয়েছি বুঝতে পারিনি।

তাহিয়া চক্ষু ভরা লজ্জা নিয়ে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমে চলে গেল। মিহরাব নিযেও খুব লজ্জিত হলো। ছিইইই কাল রাতে তাহিয়াকে দেখতে দেখতে কখন যে তার পাশেই ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। কে’ জানে? মেয়েটা কি ভাবছে।

কিন্তু সে যে বলল ভোরের সূর্য, এটা মানে কি?
সে কি সূর্য নামের কাউকে ভালোবাসে?
হতেও পারে। ঘুমের ঘোর লাগানো চোঁখে হয়তো সে আমার মাঝে তাকেই দেখেছে। যা’কগে ভালোবাসতেই পারে এ যুগের মেয়ে বলে কথা। তার তো দোষ নেই। বিয়েটা কাকতালীয় ভাবে হয়েছে। তাই যে যার মত থাকতে থাকি। দেখি সামনে কি হয়। আল্লাহু আ’লাম।

– মিহরাব একা একা এত দূর পর্যন্ত ভেবে ফ্রেশ হয়ে মাসজিদে নামাজে চলে গেল। তাহিয়া নিযেও নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করল। তারপর প্রতিদিনের নিয়ম অনুযায়ী সে কিছুক্ষণ বেলকনিতে বসে সূর্য উদিত হতে দেখল। তার রুমের সেই বিশাল জানালাটার কথা মনে পড়ে চোঁখ বেয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কোনদিন হয়তো আর সেই প্রিয় জানালার পাশে বসে সূর্য স্নান করা হবে না। এখন থেকে এই বেলকনিতে বসে সূর্য স্নান করার অভ্যাস করতে হবে।
কিন্তু এটা কি আদৌ আমার শেষ ঠিকানা?
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কি এখানে থাকা হবে? মিহরাব কি আমায় স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবে? সে তো কত সুন্দর। আমিতো সুন্দর নই। তার মনে কি আমার জন্য একটু খানি জায়গা হবে?

যদি তার হৃদয়ে বিন্দু পরিমাণ জায়গাও হয়, তাহলে আমকে দাসির মত হয়ে থাকতে হলেও আমি এখানেই থাকবো। আমি রোজ আল্লাহর কাছে যেরকম একটা জীবন সঙ্গি চাইতাম মিহরাব ঠিক সেরকমই একটি ছেলে। রক্তিম বর্ন তার চেহারা। যেন সদ্য উদিত হওয়া সূর্য। আমার ভোরের সূর্য।

মিহরাবের ডাকে তাহিয়ার ভাবনাচ্ছেদ পড়ল।

– মিহরাবের হাতে দু’টো কফির মগ।
সে একটা মগ তাহিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল গুড মর্নিং।

-গুড মর্নিং।

– কফির মগে চুমুক দিয়ে মিহরাব তাহিয়াকে জিজ্ঞেস করল কেমন লাগছে নতুন সকাল?

– ভালো।

-আপনার সাথে কিছু কথা বলার আছে।

– (তাহিয়া মিহরাবের কথায় বেশ অবাক হলো! কারন মিহরাব তাহিয়াকে আপনি সমন্ধন করছে! নিযের স্ত্রীকে কেউ আপনি বলে ডাকে তাহিয়ার জানা ছিলো না) তবুও সে সহজ ভাবে বলল জ্বি বলুন।

– তুমি সূর্যকে খুব ভালোবাসো তাইনা?

– জ্বি, ভীষণ ভালোবাসি। সূর্য আমার জীবনের একাংশ। সে তার সতেজ ভালোবাসা না দিলে হয়তো আমার বেঁচে থাকতেই কষ্ট হতো।

– মিহরাব প্রশ্নটা সিরিয়াসলি করেছে। সে সূর্য নামের কোন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেছে।

– কিন্তু, তাহিয়া আকাশ থেকে উদিত হওয়া ভোরের সূর্যকে ভেবে এসব বলেছে।

দুজনের চিন্তা ভাবনাই দু’রকম।

– মিহরাব ভারী গলায় বললো, ওহ ঠিক আছে।
কথাটা বলেই সে সেখান থেকে রুমে চলে এল।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল আমার সাথে কেন এমনটা হলো? জীবনে কাউকে ভালোবাসিনি। কত মেয়েরা প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে সেসব এক্সেপ্ট করিনি। নিযেকে যতেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। শুধুমাত্র নিযের স্ত্রীকে অফুরন্ত ভালোবাসবো বলে। তার থেকে অফুরন্ত ভালোবাসা পাবো বলে। কিন্তু সে সব তো ঠিকই ছিলো। চেনা জানা কাউকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। যার সমন্ধে সব জানা থাকবে, সেও আমার মত কোনদিন প্রেম করবেনা। সব ভালোবাসা তার জীবন সঙ্গীর জন্য যত্ন করে রেখে দিবে। কিন্তু আল্লাহ তা চাইলেন না। সে আমাকে এমন একটি মেয়ের স্বামী হিসেবে স্থির করলেন, যার মনে অন্য কেউ রয়েছে। এখন কি করবো আমি? আমার জীবনে কি তাহলে আর ভালোবাসা জুটবে না? কি করেই বা জুটবে? যা হবার তাতো হয়েই গেছে। কিন্তু এতে তাহিয়ার’ও কোন দোষ নেই। সে’ই বা কি করতো? আমাকে এসব বলার পরিস্থিতিতে সে ছিলোনা। তাই বলতে পারেনি। কিন্তু বেচারি তো নিজেও তার ভালোবাসাকে হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছে।

এভাবেই মিহরাব মনে মনে স্থির করলো, তাহিয়া সূর্যের কাছে ফিরে যেতে চাইলে তাকে সে বাঁধা দেবে না। তাকে তার ভালোবাসার কাছে ফিরিয়ে দিতে মিহরাবের কোন আপত্তি নেই। নিযের স্বার্থে সে আর দু’টো মানুষকে কষ্ট দিতে পারবে না।

মিহরাবের এই ভুল ধারনাই তার আর তাহিয়ার মাঝে দূরত্ব বাড়িয়ে দিল।

নাস্তার টেবিলে বসে আবিদা বেগম তাহিয়াকে জিজ্ঞেস করল, মা’তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?

– না, মা কোন অসুবিধা নেই।

– মিহরাব! বাবা! তুই বৌ’মার সব দিকে খেয়াল রাখবি।
বৌ’মার যেন কোন কষ্ট না হয়।

– ঠিকআছে মা।

– আহমেদ সাহেব বললেন, তুমি কিসে পড় মা?

– অনার্স ফাইনাল ইয়ারে।

– ওহ তাহলেতো এবার’ই শেষ।

– জ্বি বাবা! একমাস পরেই ফাইনাল এক্সাম।

– তাহলেতো খুব ভালো। তুমি কোন কাজ করবেনা। এই একটা মাস খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া লেখা করো।
সব তোমার শ্বাশুড়ি সামলে নিবে। কি মিহরাবের আম্মু! পারবে তো?

– হ্যা অবশ্যই, আমার একটি মাত্র পুত্রবধু, তার কোন রকম কষ্ট আমি হতে দেবো না।

নাস্তা করা শেষ হলে আবিদা বেগম এক জোড়া স্বর্নের বালা নিয়ে এলেন। তারপর বললেন, দেখিতো মা তোমার হাতটা। তাহিয়া হাত বাড়িয়ে দিল, আবিদা বেগম খুব যত্নে তাহিয়ার হাতে বালা দু’টো পড়িয়ে দিয়ে তাহিয়ার হাতে চুমু দিয়ে বললেন, জানো বৌ’মা? এই বালা দুটো বিয়ের সময় আমার শ্বাশুড়ি আমাকে পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাকেও নাকি তার শ্বাশুড়ি এই হাদিয়াটা দিয়েছিলে। আজ আমার সেই দাদী শ্বাশুড়ির দেওয়া উপহারটা পরম্পরাক্রমে তোমাকে পড়িয়ে দিলাম। তুমি এই বালা দু’টোকে যত্নে রেখো। তার সাথে আমার ছেলেটাকেও যত্নে রেখো।

– তাহিয়া এত আদর ভালোবাসা আর নিতে পারছেনা।
তার মা’ মারা যাওয়ার পর আজ প্রথম তাকে কেউ এত ভালোবাসছে, তাই প্রচন্ড আবেগ প্রবন হয়ে তাহিয়া মা’য়ের মত করে শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলল আই লাভ ইউ মা।

– আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি পাগলিটা।

সোফায় বসে মিহরাব তার মা আর তাহিয়ার ভালোবাসা দেখে কেঁদে দিল। সত্যিই মেয়েটা কত সহজে তার মা-বাবাকে আপন করে ফেলেছে। তারা তাকে কত বিশ্বাস করছে, কত ভালোবাসছে। কিন্তু এসবই তো ক্ষণিকের জন্য। তাহিয়াতো ক’দিন পর সূর্যের হয়ে যাবে। আর তার ফ্যামেলীকেই এতটা ভালোবাসবে। যে ফ্যামেলীতে মেয়েটা যাবে তারা সত্যিই খুব ভালো থাকবে।

– মিহরাব এসব ভাবতে ভাবতে ডাটা অন করে ফেসবুকে প্রবেশ করতেই দেখল তার প্রিয় লেখিকা একটি ভয়েস রেকর্ড পাঠিয়েছে।

– মিহরাব অবাক হওয়ার টাইম টুকুও অপেক্ষা না করে দ্রুত সেটা প্লে করলো।

সেখানে একটা গানের রেকর্ডিং ছিলো।

– মিহরাব হেডফোন কানে দিয়ে শুনতে লাগল।

– কার মনে যে কত স্বপ্ন থাকে,
কেউ জানেনা কত আশা বুকে।
করে লুকোচুরি খেলা।
জীবন মানেই পথ চলা,
মনে মনে কথা বলা।

গানটা শুনে মিহরাবের মনটা শিতল হয়ে গেল।
অসম্ভব সুন্দর তার প্রিয় লেখিকার কন্ঠস্বর।
যেমন তার লেখায় চমক তেমনি তার কন্ঠে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here