মনের_ক্যানভাসে-০২

0
414

#মনের_ক্যানভাসে-০২
#লাবিবা_আল_তাসফি

কারো সাথে বেড শেয়ার করাটা আমার একদমই পছন্দ নয়। কিন্তু মিতু আপু আছে। কিছু করার নেই তার সাথেতো বেড শেয়ার করতেই হবে। ইতিমধ্যে মিতু আপুর লুতুপুতু প্রেমালাপ শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। মন চাচ্ছে এক ছুটে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পালিয়ে যাবটা কোথায়। তাই ভাবলাম আজও আকাশ দেখতে দেখতের রাতটা পার করে দিবো। আমার রুমের জানালা থেকে দূরের আকাশটা স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। আমি রোজ রাতে সেখানে বসে চাঁদ তারাদের সাথে গল্পের আসর বসাই। অনেক কথা হয় আমাদের। হয় মিষ্টি জোছনা স্নান। চাঁদের জোছনা গায়ে মাখতে মাখতে চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি কতশত তার হিসাব নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। এক মগ চা নিয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে জানালার পাশে বসে গেলাম। মিতু আপুর সাথে যে আমার খুব খারাপ সম্পর্ক তা কিন্তু নয়। তার সাথে আমার কোনোরূপ শত্রুতা নেই। ছোট থেকেই আপুর সাথে আমার একটা বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু তার এই রাশেদ ভাইয়ের সাথে লুতুপুতু প্রেমটাই আমার পছন্দ না। একদমই না।
____________

সেদিনের পর থেকে সপ্তাহ খানেক রাশেদ ভাইয়ের কোনোরূপ দেখা মিললো না আমাদের বাড়িতে। আমার বেশ খারাপ লাগলো। মিতু আপুও পরদিন চলে গিয়েছিল। আমার জীবন আবার আগের মতো করেই চলতে লাগলো। তবে এবার রাশেদ ভাইকে ছাড়া সবটা কেমন পানসে লাগছে।
কেটে গেলো আরো কিছুদিন। একদিন সকালে মা পিঠা বানিয়ে কিছু পিঠা দিলো রাশেদ ভাইদের বাসায় দিয়ে আসার জন্য। মা খুব সুন্দর পিঠা বানায়। বরিশালের মেয়ে কিনা! আমিও এ সুযোগকে কোনোভাবেই হাত ছাড়া করলাম না। এই সুযোগে রাশেদ ভাইয়ের সাথেও সবটা মিটমাট করে নেওয়া যাবে। রাশেদ ভাই আমার খুব অপছন্দের একটা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তবুও তার সাথে কথা না বলে বেশিদিন থাকা প্রায় ইম্পসিবল। এইযে রাশেদ ভাই এখন আর আমাকে বিরক্ত করছে না এতেও প্রচন্ড রকম বিরক্ত আমি। আমি আর কথা না বাড়িয়ে সুন্দর করে ওড়না গায়ে জড়িয়ে পিঠার বক্স হাতে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের বাড়ির পর একটা গলি পেরিয়েই রাশেদ ভাইদের বাড়ি। বাড়িটা বেশ বড়। কাকা খুব সখ করে বানিয়েছেন। বাড়িতে ঢুকতেই ছোট্ট ফুলের বাগান। বাগানটা রাশেদ ভাইয়ের ব্যক্তিগত। এই বাগানের গাছের একটা পাতা ছোয়ার অনুমতিও নেই কারো। বছর দুয়েক আগে আমি একটা ফুল ছিঁড়ে কানে গুজেছিলাম তাই এক ঘন্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। কত করে মিনতি করেছিলাম মাফ করে দিতে কিন্তু ঐ জংলি মানুষটার মনে একটুও দয়া হলোনা। কাকিমাও অনুরোধ করেছিল কিন্তু তাকেও ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে মানুষটা আমার একটু বেশিই অপছন্দের। এমন নির্দয় মানুষকে পছন্দের তালিকায় ফেলা অসম্ভব।

বসার ঘরে ঢুকতেই রাশেদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি সোফায় পা তুলে বসে ফোনে ভিডিও গেম খেলছিলেন। সামনে টিভিতে রান্নার শো চলছে। সিরিয়াসলি? রাশেদ ভাইয়ের কি রান্না করার সখ জাগলো নাকি। তাকে বিরক্ত করার এমন সুন্দর টপিক ঘরে ঢুকতেই পেয়ে যাব বুঝতে পারিনি। আমি খুব খুশি মনে তার পাশের সোফায় বসে পড়লাম। একটু শব্দ করে কেশে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলাম। কিন্তু সে জেন পাত্তাই দিল না। কোনো ব্যাপার না আমি অন্যভাবে চেষ্টা করে দেখবো। হাতে থাকা পিঠার বাটিটা রাশেদ ভাইয়ের মুখের সামনে ধরলাম। সে বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে নিলো। পরপর আমার হাত থেকে বাটিটা কেড়ে নিয়ে পাশে রেখে দিয়ে আবারো ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার এবার ভিষণ রাগ হতে লাগলো। এত ঢং আসে কোথা থেকে লোকটার। তবুও রাগ সংযত করে হাসি মুখে বললাম,’বিয়ের পর রান্নার দায়িত্বটা কি আপনি নিবেন?’

রাশেদ ভাই কেমন করে যেন তাকালো। শান্ত, স্থির সে দৃষ্টি। বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো যেন। সে দৃষ্টি থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিতেই বুঝলাম আমার বলা কথার ধরণ ভুল ছিলো। রাশেদ ভাইও ততক্ষণে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েছেন। আমার বলা কথাটাকে সুধরানোর জন্য মুখ খুলতে নিব তার পূর্বেই রাশেদ ভাইয়ের ত্যাড়া কথায় মুখ বন্ধ হয়ে গেল।

‘বিয়ের পর? আমিতো তোকে বিয়ে করবোনা। তোকে আর বিয়ে? ইম্পসিবল। আবার কিনা রান্নার দায়িত্বটাও আমি নিব! জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিস আজকাল মিনি। ভালো কোনো ডাক্তার দেখা। তোর কাউন্সিলিং দরকার। টাকার চিন্তা করিস না। যা লাগবে আমাকে বলিস। ‘

একাধারে এতগুলো কথা বলে তবে থামলো রাশেদ ভাই। আর আমি? আমিতো তখন রাগে অপমানে জর্জরিত। কান থেকে ইতিমধ্যে গরম ধোঁয়া ছঙটতে শুরু করেছে। লোকটা কি ভাবে নিজেকে? প্রিন্স? প্রেসিডেন্ট? হাহ! এমন আধপাগল মানুষকে আমি কেন বিয়ে করতে চাইবো? দেশে কি স্বাভাবিক মস্তিষ্ক সম্পন্ন ছেলের অভাব পড়েছে? আর পাগল কিনা আমায় বলছে আমার কাউন্সিলিং দরকার! অপমান বোধ হলো ভিষণ। এতক্ষণ ধরে রাখা রাগটা এবার বেরিয়ে আসতে চাইছে তীব্র ভাবে। রাগকে দমিয়ে রাখতে না পেরে ঝাঁঝালো কন্ঠে বল উঠলাম,’ আপনার কাউন্সিলিং দরকার রাশেদ ভাই। সর্বদা দু লাইন বেশি না বুঝে কম বুঝতে সমস্যা কোথায় আপনার? আপনাকে বিয়ে করার জন্যতো মরে যাচ্ছি আমি। আসেন বাঁচান আমাকে। অসহ্যকর লোক কোথাকার।’

ইতিমধ্যে আমাদের চিৎকারে ঘর থেকে কাকা কাকিমা বের হয়ে এসেছেন। আমাকে দেখে কাকিমা মিষ্টি হেসে বলল,’কি হয়েছে মা? এই পাজি ছেলেটা আবার বিরক্ত করছে তোকে?’

কাকিমা রাশেদ ভাইকে চোখ গরম দিয়ে আমাকে সাথে করে তার রুমে নিয়ে গেল। আমাকে তার রুমে বসতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যেতেই আমি রুম থেকে বের হয়ে রাশেদ ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম চুপিচুপি। এই মানুষটাকে আজ একটা চরম শিক্ষা দিতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কাবার্ড খুলে তার গুছিয়ে রাখা সব কাপর এলোমেলো করে রেখে আবারো কাবার্ড বন্ধ করে রাখলাম। হিহি এর থেকে বেশি আর কিছুর দরকার নেই। আর যাই হোক কুচকানো জামাকাপড় রাশেদভাই কখনো পড়বে না। পোশাকের ব্যাপারে সে বেশ রুচিশীল। লোকটার ড্রেস সেন্স ও অসাধারণ। যাই পড়ে তাতেই অসাধারণ লাগে। তাকে এই অসাধারণ লাগার ব্যাপারটাও আমার ঠিক পছন্দ নয়। এসব ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বের হতে নিতেই নজর পড়লো টেবিলে রাখা লাল মলাটের ডায়রিটার দিকে। মুহূর্তেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। না চাইতেই যেন অনেক মূল্যবান কিছু পেয়ে গেলাম। এই ডায়েরিটা পড়ার তীব্র ইচ্ছা আমার বহুদিনের। কিন্তু রাশেদ ভাইয়ের জন্য কখনো সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই ডায়েরির পাতায় কোন মূল্যবান সম্পদ সে গোচ্ছিত রেখেছে তা আমার জানা নেই। আমি কেবল জানি এই ডায়েরির ভাঁজে তার অনেক মূল্যবান কিছু রয়েছে। সেই অজানা মূল্যবান সম্পদ নিজ চোখে দেখে নিজেকে ধন্য করার তীব্র বাসনা নিয়ে ডায়েরিটা হাতে তুলতেই কোথা থেকে রাশেদ ভাই এসে ছো মেরে নিয়ে নিল সেটা। হোয়াট এ টাইমিং ম্যান!

‘কারো ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়া কোনো সভ্য মানুষের কাজ বলে আমার মনে হয় না।’

শীতল কন্ঠে বলা কথাটা আমায় হিম করে দিল। রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণ লাল হয়ে উঠেছে। আমার ভয় হলো। এমন আচরন তো আগে কখনো করেনি সে। তবে আজ কেন? খুব বেশি রেগে গেল কি? মানুষটারতো আবার ভিষণ রাগ। এই মুহূর্তে দুটো থাপ্পর গালে পড়লেও অবাক হব না। ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে নিলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম গালে তীব্র আঘাতের। এক দুই তিন করে পুরো পাঁচ মিনিট কেটে যাওয়ার পরও যখন কোনো কিছু অনুভব হলোনা তখন এক চোখ মেলে রাশেদ ভাইয়ের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতেই দেখলাম তিনি কাবার্ড খুলে মুখ শক্ত করে আমার দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে তার রাগের পরিমান। পারলে হয়তো ঐ চোখ দিয়েই আমায় ছাই করে দিতেন। হাহ! ভাগ্য বুঝি একেই বলে!

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here