#মনের_ক্যানভাসে-০৭,০৮
#লাবিবা_আল_তাসফি
৭.
______________
প্রেসার কুকারে সিটি পড়েছে। গরুর মাংসের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে পুরো বাড়িতে। ঘ্রাণেই যেন অর্ধেক পেট ভরে আসছে।রাকিব গলা উঁচিয়ে মা কে ডাকলো। মাংসে পর্যাপ্ত ঝোল থাকা চাই বলে আবদার করলো। টিউশন থেকে ফেরার পথে বাজার থেকে শসা কিনে এনেছে। গরুর মাংসের সাথে শসা লেবু আর গরম গরম ভাত। আর কি চাই? রাশেদ আজ বাসায়। কিন্ত এখন পর্যন্ত রুম থেকে বের হয়নি। বুঝতে শেখার পর থেকে বড় ভাইয়ের সাথে খুব একটা মেলামেশা করা হয়ে ওঠেনি। কখনো একসাথে মাঠে খেলা হয়ে ওঠেনি। খেলনা নিয়ে দু ভাইয়ে ঝগড়া হয়নি। কেমন একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেই শৈশব থেকেই। শেষ কবে একত্রে বসে ভাত খাওয়া হয়েছে সেটাও মনে নেই রাকিবের। আজ মনে হলো ভাইয়াকে ডাকা উচিত। দু চারটা কথা হওয়া উচিত। তারপর একসাথে বসে একত্রে ভাত খাবে। বিকেল হলে ভাইয়ার বাইকে চেপে নাহয় কোথাও বেরাতে যাওয়া যাবে। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্কটা দৃঢ় হওয়া উচিত।
বৃষ্টি মাথায় করে বাসায় ফিরেছে আব্বু। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে অবস্থা। আম্মু চুলায় খিচুড়ি বসিয়েছে। বৃষ্টির সময় খিচুড়ি আর কষা মাংসের তুলনা নেই। খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে পরিবার সমেত আড্ডার ব্যবস্থা হলো। এ কদিনের সফরে যা যা ঘটছে তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে চলছে আব্বু। মাহিন খুব আগ্রহ নিয়ে আব্বুর বলা প্রত্যেকটা কথা গিলে নিচ্ছে। আড্ডার এক পর্যায়ে কথা উঠলো আমার বিয়ের। চলতে লাগলো বিস্তার আলোচনা। কথজন আত্মীয়-স্বজন আসবেই এগুলো কার্ড ছাপাতে হবে ব্লা ব্লা। এ আলোচনায় আমাকে দরকার বলে মনে হলো না। তাই চুপিসারে উঠে এলাম গল্পের আসর থেকে। এমন নয় যে আমি রাশেদ ভাইকে ভুলে গেছি। আমি কেবল মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মুখের দিকে তাকালে ভরসা পাই। মন বলে আমি পারবো। এই মানুষগুলোর জন্য হলেও আমি পিছুটান কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারবো বহুদূর। সাহস পাই মনে। কিন্তু দিনের আলো ফুরিয়ে যখন রাত নামে তখন রাতের অন্ধকারের সাথে আমার মনে না পাওয়ার বেদনারা জেগে ওঠে। গ্রাস করে নেয় আমাকে। রাতের নিস্তব্ধতা যেন যেন বারবার করে আমায় আমার ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায়। সর্বহারা আমি তখন কেবল অপেক্ষা করতে থাকি দিন হবার। একটু স্বস্থির জন্য দিনের আলোর বড্ড দরকার।
আব্বু আম্মুর তুমুল ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়ার টপিক আমি নিজে। ব্যাপারটা এমন তারা দুজন দাবি করছেন আমার প্রতি তাদের মধ্যে একজনের অধিকার বেশি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ঝগড়ার এক পর্যায়ে টপিক পাল্টে ইমোশনাল সিন শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন,,,
আম্মু–’ তোমার সংসারে এসে সখ আল্হাদ সব ত্যাগ করেছি। কখনো কোনো কিছু চেয়েছি তোমার কাছে? শাড়ি চেয়েছি নাকি গহনা? মেয়েটার বিয়ে সামনে নিজ থেকেতো একটা শাড়ি কিনে এনে দিতে পারতে। তা কি করেছো? আবার এসেছো কর্তব্য দেখাতে।’
আব্বু–’ এত কথা না বলে সোজাসাপ্টা এটা বললেই পারো যে তোমার শাড়ি চাই। বললেই কিনে দিতাম। আমার কি টাকা কম আছে নাকি।’
আম্মু কিছুটা রেগেই গেল। অপ্রিয় সত্য কথা এভাবে বলায় তীব্র ভাবে তা আত্মসম্মানকে আঘাত করলো। ক্ষিপ্ত চোখে আব্বুর দিকে তাকিয়ে কোনো কথা ছাড়া রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আজ সারাদিনে আর দরজা খুলবে বলে মনে হয়না। আমি হাসলাম। আম্মু বড্ড ছেলেমানুষী। খুব সহজ সরল সাধারণ নারী। সাধারণের মাঝে অসাধারণ একজন স্ত্রী, মা। আমাকে দেখতে পেয়ে আব্বু দুঃখী হওয়ার ভান করে বলল,
‘আজ রুমে আমার জায়গা হবে না। গেস্টরুমে থাকার মতো একটু ব্যবস্থা করে দে মা।’
আব্বুর এমন অসহায় মুখ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মাহিন। আমিও হাসলাম শব্দহীন। রেণু খালা এলে দুজন মিলে গেস্টরুম পরিষ্কার করে নিব। রেণু খালার দেখা মেলা ভার। সপ্তাহের সাত দিনের পাঁচদিনই তিনি অসুস্থ থাকেন। কাজে ফাঁকি কাকে বলে কত প্রকার কি কি সব তার জানা।
____________
সকাল দশটা বেজে পনেরো মিনিট। আকাশে সোনালি সূর্য উঠেছে। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও সেফটির জন্য একটা ছাতা সাথে নিয়েছি। লং একটা থ্রিপিস পড়ে সুন্দর করে তৈরি হয়ে নিলাম। হঠাৎ করেই খুব সাজতে ইচ্ছে হলো। বিরহে বিরহে নিজের যত্ন নিতেই ভুলে গেছি। আয়নায় তাকাতেই নিজের বিদ্ধস্ত চেহারা নজরে এলো। নিজেকে দেখে নিজেরই বড্ড মায়া হলো। দেরি না করে ঝটপট দক্ষ হাতে সুন্দর করে হালকা মেকওভার করলাম। মেকআপ এর আড়ালে লুকিয়ে গেল আমার বিরহের ঝড়ে ধ্বসে পড়া বিধ্বস্ত চেহারাটা। বাসা থেকে বের হতেই রিকশা পেয়ে গেলাম। বাড়ির পাশের চায়ের দোকানটাতে রাশেদ ভাইকে দেখলাম। এদিকেই তাকিয়ে আছে। আমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম। আগুনের আশপাশে গেলে গরম স্যাক তো লাগবেই। তাই আগুনের থেকে দূরে থাকা ভালো। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি রাশেদ ভাইকে এড়িয়ে চলার। রিকশা এসে মলের সামনে দাঁড়াতেই ভাড়া মিটিয়ে মলের ভেতর ঢুকে পড়লাম। একা একা শপিং করার মাঝে অন্যরকম তৃপ্তি আছে। এখানে নিজের পছন্দটাই বেশি প্রাধান্য পায়। থ্রিপিসের দোকানে ঢুকতেই বেশ কিছু নিউ কালেকশন নজরে এলো। সবগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেও সিলেকশনের সময় দোটানায় পড়লাম। তখনি পাশ থেকে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত বাসন্তী রঙের থ্রি পিসটি আমার দিকে এগিয়ে দিল। থ্রিপিসটি সত্যিই সুন্দর। হাতের মালিককে দেখতে ঘাড় ঘুড়াতেই পরিচিত মুখ নজরে এলো।
‘রাশেদ ভাই!’
‘অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এখান থেকেই যাচ্ছিলাম। দেখলাম এত এত জামাকাপড় দেখে হুশ হারিয়ে তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে আছিস। তাই নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এলাম।’
সে যে মিথ্যা বলছে তা একশোভাগ সত্যি। আমি আসার পথেই তাকে দেখেছি চায়ের দোকানে। এখানে নিশ্চই আমাকে ফলো করতে করতে এসেছে। আসুক তাতে আমার কি? আমি মিতালি কখনো অন্যের জিনিসে আগ্রহ দেখাইনা হুহ।
‘আপনার নাগরিক দায়িত্ব অন্যকোথাও যেয়ে পালন করেন। আমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই।’
বলেই নীল রঙের একটা থ্রি পিস প্যাক করতে দিলাম। যদিও এর থেকে বাসন্তী রঙের থ্রি পিসটা বেশি সুন্দর ছিল। কিন্তু রাশেদ ভাইকে উপেক্ষা করার এর থেকে ভালো কোনো উপায় আমি খুঁজে পেলাম না। দোকান থেকে বের হয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বুঝলাম রাশেদ ভাই আশপাশে নেই। তার অনুপস্থিতি আমার মনকে আহত করলো। তাকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও আমার মন কখনো তাকে এড়াতে পারে না। এখনো সেটাই হয়েছে। আর শপিং করতে ইচ্ছা হলো না। মল থেকে বের হতেই নজরে এলো ফুচকার দোকান। আকাশে তখন কড়া রোদ। রোদে দাড়িয়েই একসাথে দু প্লেট ফুচকা শেষ করলাম। এটা মনকে ভালো রাখার অন্যতম মাধ্যম। ফুচকা খাওয়া শেষে রিকশায় চেপে বসলাম। আজ এ শহরের প্রত্যেক অলিগলিতে বিচরণ করবো। মনের সকল আক্ষেপকে ছুড়ে ফেলবো শহরের কোনায় কোনায়।
যখন বাড়িতে ফিরলাম তখন সন্ধ্যা প্রায়। ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই চিন্তিত পরিবার পরিজন নজরে এলো। আমাকে দেখা মাত্রই মা ভিষণ রেগে গেলো। সারাদিন বাড়ির বাহিরে থাকার অপরাধে দু চারটা কটুক্তি শুনতে হলো প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। মা অবশ্য তাতে কান দিলেন না। নিন্দুকদের মুখের উপর ধুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আমি তখনো আসামির ন্যায় চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আব্বু গুরুগম্ভীর গলায় শুধালেন,
‘কোথায় ছিলে সারাদিন?’
‘রিকশা করে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। অনেকদিন বের হওয়া হয়না। ঘরে দমবন্ধ লাগছিল।’
আব্বু আর কিছু বললেন না। কেবল গম্ভীরতা বজায় রেখে বললেন,
‘রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো। তোমার আম্মু নাস্তা বানিয়ে রেখেছ তোমার জন্য।’
ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আম্মু গরম গরম পাস্তা সার্ভ করলো। এটা আমার খুব পছন্দের। আমার প্লেটে বেশি পাস্তা দেখতেই মাহিনের চিৎকার শুরু। ওর বেশিটা চাই। কিন্তু আমি কোনোভাবেই আমার পছন্দের খাবার শেয়ার করতে রাজি নই। প্লেট হাতে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। নিজের পছন্দে আর কোনো কিছুই আমি হাতছাড়া করবো না। একদমই না।
চলবে…….
#মনের_ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি
৮.
______________
খুব সুন্দর একটা ঘুম হয়েছে বহুদিন পর। কানের কাছে মোবাইলের এলার্ম বাজতেই বন্ধ চোখে হাতরে এলার্ম বন্ধ করলাম। চোখ টেনে খুলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মন চাচ্ছে আরো কিছুক্ষণ এভাবেই পরে থাকি। দরজায় ধুমধাপ ধাক্কার শব্দে না চাইতেও চোখ মেলে তাকাতে হলো। আলসে ভঙ্গিতে উঠে দরজা খুলতেই দরজার ওপারে আম্মুকে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকালাম। আজিব! এভাবে দরজার উপর হামলা করার কি আছে? সবেতো বারোটা বাজে। খুব বিরক্ত ভঙ্গিতে আম্মুকে বললাম,
‘আমার ঘুমের সাথে তোমার কি জমিজমা নিয়ে দন্দ আছে? সবসময় এভাবে আমার আর ঘুমের মাঝে ভিলেন হয়ে কেন দাড়াও বলোতো।’
তখনি ফোন থেকে এক পুরুষ কন্ঠ খুক খুক করে কেশে তার অস্তিত্বের জানান দিল। সাথে সাথে আম্মু ফোনটা আমার হাতে দিয়ে ইশারা করলেন কথা বলার জন্য। ফোন আমার হাতে দিয়ে ব্যস্ত পায়ে প্রস্তান করলেন। আমি আম্মুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন কানে ধরলাম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে আদনান বলে উঠলো,
‘আপনার আর ঘুমের মাঝে থার্ড পার্সন হয়ে আসার জন্য আশফিক বিন আদনান ভিষণ ভাবে দুঃখিত। আপনি কি তার আপনার সুন্দর হৃদয় থেকে তার ভুল ক্ষমা করতে পারবেন মিস ঘুমকুমারী?’
এটা আদনান ছিল! আমার সব কথা সে শুনে নিয়েছে! অস্বস্তি বোধ হলো। তার সাথে কিছুটা লাজুকতাও। নিজেকে সামলে কিছুটা কঠিন কন্ঠে বললাম,
‘আপনার এভাবে লুকিয়ে আমার কথা শোনা মোটেই উচিত হয়নি।’
‘এমা! লুকিয়ে কখন শুনলাম? আপনি আপনার প্রতিবেশী কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখেন তারাও আপনার বলা প্রত্যেকটা কথা শুনতে পেয়েছে। এমন উচ্চস্বরে এনাউন্স করলে আমি কেন আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ নিঃসন্দেহে শুনতে পাবে।’
আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। লোকটা আমায় অপমান করছে?
‘আপনিকি কোনোভাবে এটা বলতে চাচ্ছেন যে আমি খুব উচ্চস্বরে কথা বলি?’
‘উহু। বলতে চাচ্ছিনা। অলরেডি সেটাই বলেছি। আপনি বুঝতে একটু সময় বেশি নিয়ে ফেলেছেন।’
লোকটাকে দেখে প্রথমে খুব নর্ম ভদ্র শান্ত ছেলে মনে হলেও এখন বুঝলাম এটা মোটেই কোনো ভদ্র ছেলে না। অসভ্যের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারী গিরগিটি এই লোক। ওপরে ভালোমানুষী পোশাক পরে থাকে কিন্তু নিচে নিচে আস্ত এক অসভ্য মর্কা রূপ। নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে কোনোরকম দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘আপনি কি জানেন আপনি একটা চরম অসভ্য লোক?’
ওপাশ থেকে উচ্চ হাসির শব্দ এলো। বুঝলাম না এখানে হাসির কি বললাম। আজব! লোকটার কি মাথায়ও কোনো রকম গন্ডোগোল আছে নাকি?
‘মিস! আপনি সবকিছু বুঝতে এত টাইম নেন কেন? আমারতো মনে হচ্ছে বিয়ে পর বাচ্চা কাচ্চা হওয়ার পর আপনি আমায় প্রশ্ন করে বলবেন বাচ্চটা কিভাবে আসলো? তখন কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারবো না বলে রাখরাম। শজ্জা বলেওতো কিছু একটা আছে তাইনা?’
কান গরম হয়ে এলো। যেন গরম ধোঁয়া বের হয়ে আসতে চাইছে। কি ভয়ংকর লোক ভাবা যায়? নির্লজ্জ ও বটে। এমন বেশরম কথা বলতে একটুও মুখে বাঁধলো না? কট করে কল কেটে দিলাম। রাগে, অপমানে, লজ্জায় হাত পা ছুড়ে কাঁদতে মন চাচ্ছে। আয়নার সামনে দাড়াতেই লক্ষ করলাম আমি ব্লাস করছি। গালে লাল রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। আশ্চর্য! আমি লজ্জায় লাল নীল কেন হচ্ছি? এই অসভ্য লোকের অসভ্য কথায় লজ্জা পাওয়া মোটেই উচিত না। যেটা উচিত তা হলো রেগে যাওয়া। ভয়ংকার ভাবে রেগে যেয়ে এই মুহূর্তে ঐ বাড়িতে খবর পাঠানো উচিত যে এ বিয়েটা হচ্ছেনা। আমাদের মতো ভদ্র পরিবারের মেয়েকে এমন অসভ্য ছেলের হাতে কোনোভাবেই তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। নিজের ভাবনায় সন্তুষ্ট হলাম। মুখের ভঙ্গি সিরিয়াস করে পা বাড়ালাম মায়ের রুমে। কোনো ভাবনা ছাড়া সোজা মায়ের সামনে যেয়ে দাড়ালাম। আমাকে এভাবে দেখে বাবা মা দুজনেই আমার দিকে তাকালো। আমি একবার মনে মনে কথা সাজিয়ে নিলাম। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে ফেললাম,
‘আমি এ বিয়েটা করতে পারবো না।’
বাবা মা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আমার দিকে তাকিয়ে একসাথে প্রশ্ন করলেন,
‘কারণ?’
একসাথে বলায় প্রথমে ভরকে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলাম। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,
‘ছেলেটাকে আমার মোটেই সুবিধার ঠেকছে না। এমন একটা ছেলের সাথে আমি কোনোভাবেই সারাজীবন থাকতে পারবো না। ইম্পসিবল।’
আমার কথা শুনে বাবা মাথা নাড়ল।
‘হুম। বুঝলাম।’
আমি জানতাম আমার এ কথা কাজে লাগবে। নিজেকে নিয়ে বড্ড গর্ব হলো। ফুরফুরে মন নিয়ে বাবাকে বললাম,
‘তাহরে বিয়ে ক্যানসেল?’
‘অবশ্যই না। আদনান আমাকে আগেই বলেছে তোমার প্লান। তুমি বিয়ে না করে আইবুড়ো থাকার প্লান করেছো কি ভেবেছো এটা আমরা জানতে পারবো না? তোমার এসব ড্রামা কোনো কাজে আসবে না। আদনানের মতো একটা ছেলে হয়না। তোমার বিয়ে হবে এবং সেটা আদনানের সাথেই। এখন থেকেই প্রিপারেশন নাও। দুমাসের মাঝেই আদনান ফিরবে।’
আমি পুরোই তাজ্জব বনে গেলাম। এটা কি হলো? লাইক সিরিয়াসলি? এই লোক তার ভোলা ভাল া কথায় আমার বাবা-মা কেও ফাঁসিয়ে নিয়েছে। অসম্ভব দূরান্তর এই লোক। আর আমি? আমি কবে বললাম আইবুড়ো হয়ে থাকবো? পুরোই পাল্টিবাজ। এই লোককে আমি এমন শিক্ষা দিব সারাজীবনের মতো বিয়ে করার সখ মিটে যাবে।
_____________
বিস্কুটের বয়োম থেকে একটা বিস্কুট গালে পুরে চিবুতে চিবুতে রান্নাঘর থেকে বের হতেই মিতুকে দেখে চমকে গেল রাশেদ। এই অবেলায় এই মেয়ে এখানে কেন? কৌতুহল নিয়ে কাছে যেয়ে দাড়াতেই মিতু দৌড়ে এসে রাশেদকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কেঁদে ফেলল। এভাবে জড়িয়ে ধরায় অসস্থিতে পরলেও ছাড়িয়ে দিলো না। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বাসায় কর কেউ নেই। রাকিব সেই সকালে বেড়িয়েছে। বাবা আমজাদ খান বাজারে গেছেন। আর বাকি রইলো মা রাহেলা। তিনি হয়তো পাশের বাসায় গল্প করতে গেছেন। ফাঁকা বাড়িতে একটা ছেলে মেয়ে এভাবে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বড্ড বেমানান। রাশেদ বুদ্ধিমান ছেলে। সে জানে এমনটা কারো নজরে পড়লে তা কতটা দূর গড়াবে। একহাতে মিতুকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মিতু আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। রাশেদ মিতুকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ক্রন্দনরত মিতু কিছুই বুঝতে চাইলো না। ঠিক তখনি আগমন ঘটলো বাসার কাজের মেয়েটার। তাদেরকে এ অবস্থায় দেখা মাত্র গগনবিদারী চিৎকার করে পুরো এলাকাকে জাগিয়ে তুলল। এমতাবস্থায় মিতুর কান্নাও থেমে গেল। চোখ পিটপিট করে চাইতেই রাশেদকে ছেড়ে কিছুটা দূরে দাড়ালো। চিৎকার করার কারণ বুজতে না পেরে সে ফ্যালফ্যাল চোখে রাশেদের দিকে তাকালো। রাশেদের দৃষ্টি শীতল স্বাভাবিক। একমনে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। ইতিমধ্যে রাহেলাও চলে এসেছেন। সাথে এসেছে আরো কিছু মানুষ। রাহেলা দৌড়ে এসে রাশেদের পাশে দাঁড়ালেন। ব্যস্ত কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইলেন,
‘কি হয়েছে? চিৎকার করলো কে? কোনো অঘটন ঘটেছে বাবু? তুই এভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন?’
রাশেদ কোনো উত্তর দিলো না। কেবল শখন্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তিকালো। সে জানে এই মুহূর্তে তার কথা বলা আর না বলা সমান। এখানে তার বলা কথার থেকে দূরে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের মেয়ের কথার দাম হবে বেশি। এতক্ষণে মিতুর কাছেও সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। সবটা বুঝতেই তার চোখ ভেঙে আবারো জল বেরিয়ে আসলো। কতবড় অঘটন ঘটতে চলছে ভাবতেই মাথা নিচু করে ফেলল। রাশেদের কথা শোনা তখন তার উচিত ছিল। অশ্রুসিক্ত চোখে রাশেদের দিকে তাকাতেই তার মনে হলো রাশেদ উপর থেকে নিজেকে শক্ত খোলসে ঢেকে রাখলেও ভেতর থেকে সেও ততটাই ভয় পাচ্ছে যতটা সে নিজে পাচ্ছে। এখন কি সে একটু এগিয়ে যেয়ে রাশেদের পাশে দাঁড়াবে? মুষ্টিবদ্ধ ঐ হাতে হাত রেখে অভয় দিয়ে জানাবে এইতো আমিও আছি তোমার পাশে! আমরা একসাথে সমস্যার মোকাবেলা করবো। কোনো ভয় নেই। এইতো আমি আছি। ঠিক তোমার পাশে।
চলবে……….