মনের_ক্যানভাসে-১১

0
231

#মনের_ক্যানভাসে-১১
#লাবিবা_আল_তাসফি
____________________

ঋতু বদলের মত করেই যেন হঠাৎ করে বদলে গেল আমার জীবন। কোনো আগমনী বার্তা ছাড়াই আগমন ঘটলো আদনানের। সুউচ্চ সুদর্শন পুরুষটি হঠাৎ করেই একদিন আমার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াল। আমি তখন দোকান থেকে এক হালি ডিম কিনে বাসায় ফিরছিলাম। পরনে আমার বাসায় পড়ার জামা কাপড়। যার ওড়না এক রঙের, পাজামা অন্য রঙের এবং জামাও ভিন্ন। আদনানকে দেখে অবাক হওয়ার চাইতে লজ্জাটা বেশি পেয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতিতে লজ্জা পাওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সেদিন দুপুরে সে আমাদের বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করলো। বাবার সাথে আড্ডা দিলো। মাহিনের সাথেও বেশ ভাব জমেছে। তবে এর মাঝে ভুল করেও একবার আমি তার সামনে যাইনি। রান্নাঘরে থেকেই মাকে হাতে হাতে সাহায্য করেছি। বিকেল হতেই আদনান চলে গেলো। যাওয়ার পূর্বে আমার কথা মাহিনকে জিগ্যেস করেছিলো হয়তো। তবে আমার দেখা না পেয়ে হয়তো বেচারার মনক্ষুন্ন হয়েছিলো। তবে তার এই সামান্য কয়েক ঘন্টার উপস্থিতি আমার পরিবারকে যেন সম্মোহন করে ফেলেছিলো। মাহিনতো এখন আদনানকে ছাড়া কিছু বোঝেনা বল্লেই চলে। ওর কথার শুরু আর শেষে থাকে আদনানের নাম।

দুদিন পর ও বাড়ি থেকে লোক আসলো বিয়ের ডেট দিতে। আমি চেয়েছিলাম আদনানকে বলে বিয়ের ডেটটা পিছাতে। কিন্তু সেই সুযোগটা আমি পাইনি। আদনান ইচ্ছা করেই আমার সাথের সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। রোজ মা কে কল করে খোঁজ খবর নিলেও আমার সাথে তার আর কথা হয়নি। বিয়ের ডেট দেওয়া হয়েছে এ মাসের শেষ এ। ইতিমধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের অধিকাংশকেই নেমন্তন্ন পাঠানোর কাজ কমপ্লিট। আমার ঘরের বাহিরে যাওয়া বন্ধ হলো। বিয়ের আগে নাকি মেয়েদের ঘনঘন ঘরের বাহিরে যেতে নেই। দিন কাটছে আমার ফেসবুক, ইউটিউব আর উপন্যাসের মাঝে। ঘরের কাজ থেকেও মিলেছে ছুটি। এখন কাজ করলে হাতের নক নষ্ট হয়ে যাবে। বিয়ের আগে মেয়েকে পারফেক্ট বানানো চাই। এর মাঝেঘটলো আরো এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। বাবা আমাকে অবাক করে দিয়ে বাজার থেকে প্যাকেট প্যাকেট বিউটি প্রডাক্ট কিনে এনেছেন। সাথে ফ্রেশিয়ালের সকল ক্রিম। আমি অবাকের পর অবাক হতে থাকলাম। যেই মা আমি সামান্য লিপস্টিক দিলে চিৎকার করে বলতো,’এত সাজগোজ করার কি আছে?’ সেই মা আমাকে রুটিন করে ফ্রেশিয়াল করার জন্য তাগাদ দিতে লাগলো। আমি কেবল নিরব দর্শকের ন্যায় সব দেখে যেতে লাগলাম। এ জগত সত্যিই বৈচিত্র্যময়। সাথে এ জগতের মানুষ ও।
___________

‘তুমি কি এখনো রেগে আছ?’

রাশেদ দেখলো মিতুর চোখে পানি। তার খারাপ লাগলো। মেয়েটাকে কি একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলছে সে?

‘কেন করেছিলে সেদিন ওমন?’

মিতু নাক টানলো। কন্ঠে অভিমান নিয়ে বলল,

‘এতদিন পর মনে পড়লো সে কথা? আমিতো ভেবেছিলাম কখনো জানতেই চাইবে না।’

রাশেদ উত্তর দিলো না। মিতু আবারো নাক টানলো। নিজে থেকেই বলল,

‘সেদিন আমি রিকশা করে আসছিলাম। পথে কিছু ছেলে রিকশা আটকায়। আমাকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছে। আর…’

‘আর কি?’

‘আর বলেছে আমি সস্তা মেয়ে। আমার মতো মেয়েকে কখনোই তুমি তোমার ঘরের বউ করবে না।’

‘আর কি বলেছে ওরা?’

মিতু দেখলো রাশেদের চেহারার রং পালটে গেছে। চোখে কেমন হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। ও রাশেদকে আর রাগাতে চাইলো না। তাই মিথ্যা বলল।

‘উহু। আর কিছু না। আমার খুব খারাপ লেগেছিল তাই তোমায় দেখেই জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমি জনাতাম না এমন কিছু হবে।’

‘ওদের দেখলে তুমি চিনতে পারবে?’

মিতু মাথা উপর নিচ করে হ্যা জানালো। রাশেদ মিতুর হাত টেনে দরজার দিকে পা বাড়ালো। মিতু দ্রুত হাত ছাড়িয়ে পেছন থেকে রাশেদকে আকড়ে ধরলো।

‘আজ না। তুমি এখন রেগে আছ। রাগ কোনো কিছুর সমাধান করতে পারে না। শান্ত হও। আমরা অন্য কোনোদিন ওদেরকে ওদের শাস্তি দিব।’

রাশেদ চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। রাগে তার শরীর এখনো কাঁপছে। সে কখনোই কোনো মেয়েকে অসম্মান করেনি। আর না কেউ করলে সে সহ্য করতে পারে।

__________

রাকিবের একটা বেসরকারি কম্পানিতে চাকরি হয়েছে। স্যালারি খুব বেশি না হলেও দিন চালানোর মতো। সমস্যা হলো তার অফিস নারায়ণগঞ্জ জেলায়। সামনের মাসেই জয়েনিং ডেট। এখন থেকেই প্রিপারেশন নিতে হবে। থাকা খাওয়ার ও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। রাশেদ তার এক বন্ধুর মাধ্যমেম্যাসে থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।

ছোট ভাইয়ের চাকরি হয়ে গেছে অথচ বড় ভাই বেকার। বউ নিয়ে বাপের কাঁধে চেপে খাচ্ছে। এমন ধরনের কথা লোকমুখে শুনে মিতুর মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেল। রুমে ঢুকতেই মিতুর চুপসানো মুখ নজরে এলো রাশেদের। এভাবে মুখ চুপসে বসে থাকার মেয়ে না মিতু। এগিয়ে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইতেই বিষন্ন মুখে মিতু উত্তর দিলো,

‘আমার স্বামী কাজ করেনা। বাপের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে। লোকমুখে এমন কথা শুনতে হচ্ছে।’

মিতুর মুখে এমন কথা শুনে রাশেদ উত্তর দিতে পারলো না। লোকে যা চোখে দেখছে সেটাইতো বলবে স্বাভাবিক।

‘রাশেদ?’

‘হুম।’

‘আমার এমন কথা শুনতে খুব খারাপ লাগে। লোকে আমায় দেখলে কেমন বাঁকা চোখে তাকায়।’

মিতুর চোখ ছলছল করছে। সে সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে।

‘আমাকে কারিগরি শিক্ষার ক্লাসে ভর্তি করে দিবে? হাতের কাজ শিখবো। হাতের কাজ করেও অনেক টাকা কামানো যায়।’

রাশেদের নিজেকে অসহায় লাগলো। এতটা অসহায় নিজেকে এর আগে কখনো মনে হয়নি। কাঁপা কন্ঠে সে মিতুকে বলল,

‘তোমাকে কিচ্ছু করতে হবেনা আমি থাকতে।’

____________

পার্কের বেঞ্চিতে বসে বাদাম চিবুচ্ছি। আদনান দক্ষ হাতে একে একে বাদাম ছুলে আমার হাতে দিচ্ছে। লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম আতটাও খারাপ না কিন্তু। কেবল একটু বেশরম এই আর কি।

‘মিস। আমি কিন্তু লজ্জা পাচ্ছি। আপনি আমাকে নিয়ে মনে মনে খারাপ কিছু চিন্তা করছেন না তো?’

আমি ছোট ছোট চোখ করে তাকালাম।

‘আপনাকে নিয়ে ভাবতে আমায় বয়ে গেছে।’

‘সে তো অবশ্যই। আপনার তাকানোর ভঙ্গিতেই বুঝা যাচ্ছে।’

চোরা চোখে আদনানের দিকে তাকালাম। লোকটা একটু বেশিই বুঝে ফেলে। এত কেন বুঝতে হবে?

‘আজ সারাদিন কি পার্কে কাটানোর প্লান করেছেন? আমার কিন্তু ক্ষুদা পেয়েছে।’

আদনানের কথায় আমার টনক নড়লো। এই এক স্থানে বিগত দু ঘন্টা জাবত বসে আছি। এখন অনুভব করলাম আমি মাজা নাড়াতে পারছি না। অবশ হয়ে আছে সবটা। করুণ চোখে আদনানের দিকে তাকালাম। আমি তাকাতেই সে সবটা বুঝে নিলো যেন।

‘আপনি চাইলে আমি আপনাকে কোলে তুলে নিতে পারি। কোলে উঠতে কোনো সমস্যা নেই তো?’

আমি তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালাম। এই লোকের বিশ্বাস নেই। দেখা গেল এই মানুষ ভর্তি পার্কে সে আমায় সত্যি কোলে তুলে নিয়েছে। লজ্জাল তো ছিটেফোঁটা ও তার মাঝে নেই। আমাকে এভাবে উঠতে দেখে আদনান চাপা হাসলো। খাটাশ কোথাকার!

এই প্রথম কোনো ছেলের সাথে একান্তে লান্স করতে রেস্টুরেন্টে এসেছে। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা ভয়ের সংমিশ্রণ অনুভব হচ্ছে। ভয় বলতে কোনো উফ মোমেন্টের শিকার হওয়ার ভয়। টেবিলে খাবার আসতেই আদনান খুব সুন্দর করে খাবার সার্ভ করলো। আমি হঠাৎ তাকে প্রশ্ন করলাম,

‘আপনার বয়স কত?’

‘হুহ?’

আমি এধরনের প্রশ্ন করতে পারি সেটা হয়তো আদনান কল্পনা করেনি। তাই প্রশ্ন করায় চমকে গেছে। আমি তাকে আবারো সেম প্রশ্ন করলাম।

‘আপনার বয়স কত?’

‘ওহ। ১৯৯৪ আমার বার্থ ইয়ার।’

‘এমাআআ। আপনিতো দেখছি বুড়ো।’

আদনান সরু চোখে তাকালো। অবশ্য তাকে দেখে কে বলবে বুড়ো? এইযে আশপাশ থেকে সকলে আড় চোখে তাকেই দেখছে। সুনেছি ক্যালিফোর্নিয়া থাকাকালীন ভার্সিটিতে তার নাম ডাক ছিল বেশ। নজর কাড়ার মতো সৌন্দর্য আছে তার। তাতে আমার কি? সৌন্দর্য ধুয়ে কি পানি খাব? আমিতো তাই বলে বুড়োকে ইয়াং বলতে পারি না হুহ।

‘মিতালি?’

‘শুনছি।’

‘আ’ম জাস্ট ২৯।’

‘হ্যা তো?’

মুখে খাবার তুলে নিতে নিতে দায়ছাড়া ভাবে উত্তর দিলাম। দেখলাম আদনান খাওয়া রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘তোমারকি সত্যিই মনে হয় আমি বুড়ো? বা এমন যে তোমার সাথে আমার যায়না?’

‘অবশ্যই। আ’ম জাস্ট ২১। আমি বিয়ে করলে হায়েস্ট হলে ২৫ বছরের কোনো যুবককে। ২৯ একটু বেশি হয়ে যায়!’

দেখলাম আদনানের মুখ চুপসে একটুখানি হয়ে গেছে। হেহে ব্যাটা বেশ জব্দ হয়েছে। আমার সাথে লাগতে আসলে এভাবেই টাইট দিবো হুহ।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here