মন গহীনে,পর্ব-১৫,১৬,১৭

0
1961

মন গহীনে,পর্ব-১৫,১৬,১৭
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৫

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্রেসলেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি।মানতেই হবে তুষার ভাইয়ার পছন্দ আছে।সেই বক্সটা এখনো খুলিনি।ডায়রী ছাড়া আর কি থাকতে পারে?
আমার পছন্দের জিনিস তো অনেক কিছুই আছে।কোনটা হতে পারে।

” ব্রেসলেট টা কি ভাইয়া গিফট্ করেছে?দারুণ হয়েছে তো!”

তুষ্টি আপুর আওয়াজ পেতেই ব্রেসলেট থেকে মনযোগ সরিয়ে নিলাম।এটা এত খুঁটিয়ে দেখার কিছু নেই।
তুষ্টি আপু টেবিলে বসে কি যেন লেখালেখি করছে। মুচকি হেসে বলল,

” ওই বক্সটায় কি থাকতে পারে বলতো!আমাকে তো বলেনি কিছু।কতবার বললাম একটু দেখাতে।কিন্তু দেখায় নি।উল্টে আরো আমার বেনী ধরে টান দিয়েছে।বজ্জাত ভাই একটা।আমিও দিয়েছি নখ দিয়ে আঁচড় কেটে।ওকে ঘায়েল করার জন্যই হাতের নখ বড় রাখি।এগুলো আমার অস্ত্র।”

আপুর কথা শুনে হেসে উঠলাম।কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেছে।দুই ভাইবোনের খুনসুটিময় ঝগড়া দেখতে এবং শুনতে ভীষণ ভালো লাগে।
মাথায় একটা প্রশ্ন উঁকি দিতেই আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,

” আমার জন্মদিনের কথাটা তোমরা কিভাবে মনে রেখেছো আপু? মা’র থেকে জেনেছো নাকি?”

তুষ্টি আপু মেকি হেসে বলল,
” সত্যি কথা হলো আমারও মনে ছিল না।আমি ভাইয়ার থেকে জানতে পারলাম।সারপ্রাইজের প্ল্যানটা মূলত ওরই ছিল।”

আমার কিছুটা খারাপ লাগল।উনি আমার জন্য এতকিছু করল আর আমি একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলাম না।কত্ত খারাপ আমি!না না আমি কালকেই ভাইয়াকে থ্যাংক ইউ বলব।যেভাবেই হোক।

___________________________

পরেরদিন সকালে ঘরে এসে মা’কে ওদের সারপ্রাইজের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। মা তেমন কিছুই বলল না।কিন্তু যখন গিফটের বক্সটা সামনে রাখলাম তখন মা’য়ের মনেও কৌতূহল উঁকি দিল।
তাই সময় নষ্ট না করে কাগজে মোড়ানো বক্সটা খুলে ফেললাম।
ভেতরের বস্তুগুলো দেখো আমার চক্ষু চড়কগাছ।কিটক্যাট আর ডজনখানেক কানের দুলে বাক্স ভর্তি। এতগুলো কানের দুল দেখে খুশিতে আমি পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। ছোট বড় সব সাইজের ঝুমকা।আমি আরো একবার স্বীকার করতে বাধ্য হলাম ভাইয়ার পছন্দ অসম্ভব সুন্দর!
এত ঝুমকা কবে পড়ব আমি?ডেইলি নতুন নতুন একটা পড়েও শেষ করা যাবে না।দেখে মনে হচ্ছে উনি দোকানের সব ঝুমকা নিয়ে এসেছেন।
খুশিতে গদগদ হয়ে মা’কে বললাম,

” তুষার ভাইয়া কিভাবে জানল আমার ঝুমকা পছন্দ? কিটক্যাট কত্তগুলো!আহা..আনন্দে আমার কেঁদে দিতে ইচ্ছে করছে।”

মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভ্রু কুঁচকে বলল,

” এই ডায়রীটাও দিয়েছে তোকে?”

ডায়রীর কথা মনে পড়তেই আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।ঝুমকাগুলোর একপাশে নীল সাদা সংমিশ্রণের একটি ডায়রী উঁকি মারছে।দেখে মনে হচ্ছে এটা নতুন কোনো ডায়রী।ভাইয়ার হাতে যেটা প্রায়ই দেখা যায় ওটা নয়।
মা’কে তো সব খুলে বলা যাবে না।মা আবার কি থেকে কি ভেবে বসবে।
আমতাআমতা করে বললাম,

” তাই তো দেখছি।ডায়রীও গিফট দিয়েছে।ভাইয়া কি যে করে না।আমার ডায়রীর কি দরকার।”

মা’য়ের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেল।সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
” ডায়রী দিয়েছে ভালোই তো।লেখালেখি করতে পারবি।”

মায়ের হাসির কারণ আমি বুঝতে পারলাম না।রহস্য রহস্য গন্ধ!

_____________________

শেষ পর্যন্ত ভাইয়াকে আর ধন্যবাদ জানানো হলো না।ধন্যবাদ জানানোর ব্যপারটা মাথা থেকে আউট হয়ে গেছে। পড়ালেখা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।মাঝেমধ্যে নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাই।যে মেয়ে সারাদিনে চার কি পাঁচ ঘন্টাও ভালোভাবে বইয়ের সামনে থাকত না আর সে মেয়ে এখন ঘন্টার পর ঘন্টা বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে।
এদিকে তুষার ভাইয়াও অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।এ কারণে তিনি ডেইলি আসতে পারতেন না।শেষমেষ উনি নিজেই আমার জন্য একজন টিচার ঠিক করে দিলেন।একবার অফিস আরেকবার আমাকে পড়ানো বিষয়টা আসলেই হিমশিম খাওয়ার মত।
এখন যে টিচার টা আমাকে পড়ায় তিনি ভাইয়ার বান্ধবী। উনারা নাকি ভার্সিটিতে ক্লাসমেট ছিলেন।উনাকে আমি মিহি আপু বলো ডাকি।বেশ ভালোই পড়ায়।অবশ্য আমার টিচারের তেমন প্রয়োজনও ছিল না।সব বিষয়ই মোটামুটি আয়ত্তে আছে আমার।কিন্তু তুষার ভাইয়া সেই কথা কানেও তুললেন না।টিচার না থাকলে আমি নাকি পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাদিন টিভি দেখায় গা ভাসিয়ে দেব।

.

দিন শেষে মাস পেরিয়ে আমার এইচএসসি পরীক্ষা চলে আসলো।প্রস্তুতি ভালোই।কিন্তু সকাল থেকেই মনের কোণে একটা ভয় বাসা বেঁধে আছে।কাল পরীক্ষা এই কথাটা মনে হতেই কেমন অস্থির লাগছে।
আজ বেশি কিছু পড়ব না।গতকালই সব রিভিশন দেওয়া শেষ। আজ শুধু বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে কঠিন জিনিস গুলো চোখ বুলিয়ে নিব।

সন্ধ্যা মেলাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তুষার ভাইয়া বাসায় আসলেন।এখন তো উনার তেমন দেখাই পাওয়া যায় না।উনি নাকি প্রচন্ড ব্যস্ত।তাই বাসায়ও তেমন একটা আসেন না।গত শুক্রবার এসেছিলেন।মাঝখানে উনার দেখা পাইনি।আজ মনে হয় অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন।

রুম থেকেই শুনতে পাচ্ছি মা’য়ের সাথে উনি খেজুরে আলাপ জুড়ে দিয়েছেন।এই আলাপের জন্যই আমার মা-বাবা দুজন আমাকে নিঃস্ব করে উনার বশে চলে গিয়েছে।যাই হোক।এসব প্যাঁচালো জিনিস নিয়ে চিন্তা করে এখন মাথা নষ্ট না করাই ভালো।

কিছু সময় পর ধরাম করে দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম।সেটা আর কেউ নয়।আমাদের স্নো ভাইয়া।আমার শান্ত শিষ্ট মনটা এলোমেলো করে দেওয়ার জন্যই হাজির হয়েছে কি না কে জানে।তাহলে আজকে আমি উনার গলা টিপে ধরব।তারপর ঠেলতে ঠেলতে মেইনডোর দিয়ে বাইরে নিয়ে ফেলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিব।

তুষার ভাইয়া শিষ বাজাতে বাজাতে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লেন।বসার নমুনা দেখে আমার রীতিমতো রাগ উঠে গেল।জলহস্তীর মত লাফিয়ে লাফিয়ে বসা লাগে নাকি।মুখে কিছুই বললাম না।শুধু শুধু মাথা গরম করলে নিজেরই ক্ষতি।না জানি আমার তুলতুলে বিছানা কতটা কষ্ট পেয়েছে।
তুষার ভাইয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,

” তোর চেহারা তো শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে রে নীল!শুটকি মাছের মত লাগছে দেখতে।”

আমি কিছুই বললাম না।মুখ উল্টো করে চেয়ারে বসে রইলাম।কিন্তু বসে থাকতে পারলাম না।
বিছানা থেকে ছোট একটা টেডিবিয়ার হাতে নিয়ে তুষার ভাইয়া একবার উপরে ছুড়ে আবার ক্যাচ ধরলেন।এটা দেখে আমার গা জ্বলে উঠল।এগুলো আমার প্রিয় জিনিস।কেউ হাত লাগালেই আমার শরীর রাগে রিরি করে উঠে।

” আপনি এটা নিয়ে এমন করছেন কেনো?যেখানে ছিল সেখানেই রাখুন।ছিড়ে যাবে।এগুলো কি খেলার জিনিস?আপনার এতই খেলতে ইচ্ছে করলে দোকান থেকে কিনে নিয়ে আসুন।কেনো আমার গুলোর উপর নির্যাতন করছেন।”

তুষার ভাইয়া নিজের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।আমার রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেলে।আমি সমানে চিল্লিয়ে যাচ্ছি আর উনি সমানে আমায় উপেক্ষা করছেন।খুব অপমান ফিল হচ্ছে আমার।
আমি আরো একবার জোর গলায় বললাম,

” ওটা রেখে দিন।ভাল হবে না কিন্তু। ”

তুষার ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বললেন,
” তোকে রাগাতে আমার এত ভালো লাগে।তুই নীল থেকে লাল হয়ে যাস।সেই লালের আভা ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত মুখে।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আমার মুখ লাল থেকে কালো হয়ে গেল।উনি আমাকে রাগানোর জন্যই এখানে এসেছেন তাহলে।উনার মত এত খারাপ লোক আমি আর দুটো দেখিনি। নীরব মুখে উঠতে গেলেই উনি আমাকে হাত টেনে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।

” মামী থেকে শুনলাম তুই নাকি কয়েকদিন ধরে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছিস না।তোর কি মনে হয় খাওয়া ঘুম ছেড়ে সারাদিন বসে বসে টেনশন করলেই পরীক্ষা ভালো হবে?তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেনো নীল! তুই কাল পরীক্ষা দিতে যাবি।সেখানে প্রশ্ন দেওয়া হবে তুই উত্তর লিখবি।কিন্তু এমন ভাব করছিস যেন কাল অগ্নিপরীক্ষা। তোকে জ্বলন্ত কয়লার উপর হাঁটতে বলা হবে।”

আমি কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে তুষার ভাইয়ার উজ্জ্বল চেহারার দিকে তাকালাম।আমার কাছে তো সত্যিই অগ্নিপরীক্ষা মনে হচ্ছে।
তুষার ভাইয়া এবার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলতে লাগলেন,

” শোন, পরীক্ষা নিয়ে ভয়ভীতির কারণটা হলো আমরা সবাই পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ফলাফল নিয়ে চিন্তা করি।যেটা আমাদের মনোবল নষ্ট করে দেয়।সেই চিরাচরিত নিয়ম মেনেও তুইও রেজাল্ট নিয়ে ভয় পাছিস।অথচ এখনো পরীক্ষার হলেই যাসনি।এসব দুশ্চিন্তা করতে করতে অনেকসময় প্রিপারেশন ভালো থাকলেও পরীক্ষার খাতায় ঠিকমতো লিখতে পারে না কেউ।গত কয়েকমাস পড়ালেখা করেছিস তো তাই না?তাহলেই হবে।মাথায় শুধু এটাই রাখবি আমি যেহেতু পড়েছি আমি পারব।বুঝা গেল?”

আমি উপর নিচে মাথা দুলালাম।সত্যিই তো! আমি যেহেতু পড়াশোনা করেছি তাহলে এত ভয় কীসের!আশা করি পরীক্ষা ভালোই হবে।যাক উনার কথায় কিছুটা হলেও ভরসা পেলাম।যতটা খারাপ মনে করেছিলাম ততটা খারাপ নন উনি।

তুষার ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
” বেস্ট অফ লাক আমার নীল আশা!! আজ বেশি লেট করিস না।জলদি ঘুমিয়ে যাবি।আর যদি টেনশনের কারণে ঘুম না আসে তাহলে আমাকে ইনফর্ম করিস।তোর টেনশনকে আমি ফুঁ দিয়ে দূর করে দেব।আসি এখন।”

তুষার ভাইয়া চলে যেতেই আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।এই লোকটাকে এখন কি ফুরফুরা লাগছে।কিন্তু যখন রেগে যায় তখন পুরো এটম বোম্ব।

.

পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। প্রাণপণ চেষ্টা করছি মনটাকে উৎফুল্ল রাখার।
টেনশনকে ধারেকাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছি না।কাঙ্ক্ষিত সময়ে তৈরি হয়ে বসে আছি।বাবা মা দুজনেই আমার সাথে পরীক্ষা হলে যাবেন।তাই দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম।দরজায় লক লাগাতে লাগাতে বাবা বলল,

” তোমার ফুপা ফুপি থেকে দোয়া নিয়ে আসো।পরীক্ষার দিনে গুরুজনদের থেকে দোয়া নিতে হয়।আমরা আর না যাই।নিচে অপেক্ষা করব তোমার জন্য।”

বাবার কথামতো চলে গেলাম পাঁচতলায়।মেইনডোর খোলাই ছিল।ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই তুষার ভাইয়ার সাথে দেখা।উনি ফরমাল ড্রেসে সোফায় বসে ফাইল ঘাটাঘাটি করছেন।আমাকে দেখতে পেয়েও কিছু বললেন না।
ভেতরের রুমে গিয়ে ফুপা ফুপি দুজন থেকে দোয়া নিলাম।ড্রয়িংরুমে আসতেই তুষার ভাইয়া বললেন,

” চল আমিই দিয়ে আসব।মামা মামী কি বাইরে অপেক্ষা করছে?”

আমি মাথা নাড়তেই উনি ফাইলপত্র গুছিয়ে উঠে পড়লেন।
গাড়িতে বাবা মা পেছনের সিটে আর আমি সামনের সিটে ভাইয়ার সাথে বসলাম।সারা রাস্তা উনি তেমন কোনো কথা বলেননি।শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছেন এডমিট কার্ড,কলম,পেন্সিল সব ঠিকঠাক মতো নিয়েছি কিনা।পরীক্ষার কেন্দ্রের সামনে আসতেই আমার বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল।গেইটে ঢুকার আগে বাবা মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।কয়েক পা সামনে এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি চোখ দিয়ে ভরসা দিলেন আমায়।আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে।

চলবে….

মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৬

সময় কেটে যায় খুব দ্রুত গতিতে।এক ঘন্টা,দুই ঘন্টা পার হতে হতে দিনের চব্বিশ ঘন্টা কখন যে চলে যায় তা টেরও পাওয়া যায় না।
আমার পরীক্ষাকালীন সময় গুলোও এগিয়ে গেছে চোখের পলকে।প্র্যাকটিকেলের ঝামেলাও শেষ।অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।ইন্টারের প্যারাময় জীবন আর আমাকে ভুগতে হবে না।
আজ ছিল আমার লাস্ট প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। অন্যান্য পরীক্ষাও গুলো তেমন খারাপ হয় নি।শুধু হায়ার ম্যাথ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা করছি।জানি না কি হবে।

দুপুরে বাসায় এসে লাঞ্চ করে একটা লম্বা ঘুম দিয়েছি।ঘুম ভেঙেছে পাঁচটার দিকে।বিছানায় উঠে বসতেই টের পেলাম আমার মনটা আজকে ভীষণ ভালো।ঝরঝরে লাগছে।পরীক্ষা শেষ হওয়ার খুশিতে কিনা কে জানে।বিকেলে আর বাসা থেকে কোথাও বের হয়নি।সন্ধ্যার সময়টা মা’য়ের এটা সেটা নিয়ে গল্প করতে করতেই কেটে গেল।তারপর বাবা বাসায় আসার পর আরো কতক্ষণ জমিয়ে আড্ডা দিলাম।

রাতে ডিনার শেষে নিজের রুমে এসে একটা উপন্যাসের বই নিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লাম।কতদিন বইগুলোতে হাত দেই না।
কয়েক পাতা পড়তেই হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল।আমার জন্মদিনে তুষার ভাইয়া যে ডায়রীটা দিয়েছিল সেটা তো এখনো পর্যন্ত খুলে দেখিনি।সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার মনেই নেই ডায়রীটা কোথায় রেখেছি।পড়ালেখা নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে সেটা খুলে দেখারও আগ্রহ বোধ করিনি।কিন্তু এই মুহূর্তে হঠাৎ ডায়রীর কথা মনে পড়ল কেনো!আমার ব্রেইন কি চাচ্ছে যে আমি ওটা খুলে দেখি!হয়তোবা।

তড়িঘড়ি করে পড়ার টেবিলে এলোমেলো করে রাখা বই-খাতা গুলোর মাঝে ডায়রীটা খুঁজতে লাগলাম।পেলাম না।কোথায় রেখেছি মনেই পড়ছে না।
প্রায় আধাঘন্টার মত পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললাম।
বিরক্ত হয়ে যখন বিছানায় বসলাম তখনই নজর গেল পড়ার টেবিলের লাগোয়া ড্রয়ারের দিকে।
চাবি নিয়ে তাড়াতাড়ি ড্রয়ার খুলে ফেললাম।
এইতো সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা!
আহ্! কি অবহেলিত অবস্থায় পড়েছিল এতদিন।

ডায়রীটা সযত্নে হাতে নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম।মলাট উল্টাতে নিতেই মনে পড়ে গেল ভাইয়া তো আমায় বলেছিল যেদিন উনার কথা অনেক বেশি মনে পড়বে সেদিনই যেন এটা খুলি।
কিন্তু আমি তো এখন উনাকে মিস করছি না।তাহলে?
ধুর এমন আবার হয় নাকি!উনি থাকেন পাঁচতলায় আমি থাকি চারতলায়।এত কাছাকাছি দুজন মানুষ থাকলে মিস করার ব্যপারটা কি করে তৈরি হবে।কোনোদিনও এমন হবে না।তাহলে কি আমি কোনোদিনও ডায়রীটা খুলব না?
ডায়রী যখন হাতে নিয়েছি তখন দেখেই ছাড়ব কি আছে এতে।
বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগার পর শক্ত মলাট খুলে দিলাম।সাদা পৃষ্ঠার মধ্যখানে গাঢ় করে লেখা দুটো লাইনের উপর চোখ স্থির হয়ে গেল।

‘ কি করিলে বলো পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে ‘

কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম গোটা গোটা অক্ষরে লেখা লাইনগুলোর দিকে।
ঢোক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে আমার।জিভ দিয়ে বারংবার ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করছি।
তুষার ভাইয়া এই লেখা দ্বারা কি বুঝাতে চেয়েছে আমায়?এই লাইনগুলো তো একমাত্র নিজের প্রিয় মানুষকে উৎসর্গ করে লেখা যায়।আমি কি ভাইয়ার প্রিয় মানুষ?
প্রশ্নটা নিজের মনে উঁকি দিতেই হৃৎস্পন্দন উঠানামা করতে লাগল তীব্র গতিতে।এটা কি করে হতে পারে?আমার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আরো একবার লাইনগুলোর দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে মৃদু হাত বুলিয়ে দিলাম।এগুলো কি আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

অপর পৃষ্ঠা উল্টানোর আর সাহস নেই আমার।এই দুটো লাইন আমায় উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে। কেনো আমি ডায়েরী টা খুলতে গেলাম।কেনো? কেনো?
ডায়রীটা বন্ধ করে পানির বোতল হাতে নিলাম।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।
কোনোরকমে নিজেকে শান্ত করে বারান্দার কোনায় চেয়ারটায় বসলাম।এবার একটু স্মৃতিচারণ করা যাক।বিগত দিনগুলোতে তুষার ভাইয়াকে নিয়ে আমার সাথে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হবে।

মাস কয়েক আগে ছাদে ইয়াসির ভাইয়াকে লুকিয়ে দেখার কারণে উনি আমায় সপাটে এক চড় মেরেছিলেন।এটা মনে পড়লে এখনো আমার মাথা ঘুরে উঠে। এত সামান্য কারণে চড় মারার প্রশ্নই উঠে না।কিন্তু উনি প্রশ্ন উত্তর সব ছাড়িয়ে আমাকে চড়টা মেরেছিলেন।তারপর কলেজের সামনে এক ছেলে আমাকে ডিস্টার্ব করেছিল।ছেলেটাকে আর কখনো আমার সামনে আসতে দেখিনি।তুষার ভাইয়া এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন সামনে আসার মত অবস্থায় থাকলে তবে তো আসবে।তারমানে উনি ছেলেটাকে হয়তোবা আর ডিস্টার্ব না করার জন্য হুমকি দিয়েছে বা অন্যকিছু।
এর কিছুদিন পর বিল্ডিংয়ের গেইটের পাশে ইয়াসির ভাইয়ার সাথে কথা বলতে দেখে উনি বাজেভাবে শাসিয়েছেন আমায়।তারপর থার্টি ফাস্ট নাইটের কাহিনী তো ভুলার মত নয়।সাদনান ভাইয়া আমাকে প্রপোজ করাতে উনি যথেষ্ট হম্বিতম্বি করেছেন।মোটকথা ছেলেদের থেকে দূরে রাখার জন্য উনি আমার সামনে পিছনে ধারালো এক ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।সমস্ত ঘটনাগুলো কি কোনো কিছুর ইঙ্গিত দেয়?
এত স্পষ্ট বিষয়গুলো তখন আমার খেয়াল হলো না কেনো?অবশ্য খেয়াল না হওয়ারই তো কথা।উনার প্রতি তো আমার সেরকম কোনো অনুভূতি ছিল না।যার জন্য প্রত্যেকটা ঘটনাকে আমি খুব হালকাভাবে নিয়েছি।
চোখ বন্ধ করে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিতেই তুষার ভাইয়ার ফর্সা উজ্জ্বল চেহারাটা ভেসে উঠল। যে চেহারা সবসময় প্রাণবন্ত, সদা হাস্যময় থাকে।কিন্তু যখন রাগের সম্পূর্ণ সীমানায় পৌঁছে যায় তখন সেই চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে উঠে।সেই প্রাণবন্ত রূপ মুহুর্তেই তলিয়ে যায় কোথাও।
কি করে আমি উনার সামনে যাব?আচ্ছা এমন যদি হত যে আমি কোনোদিনও ডায়রীটা খুললাম না তাহলে কি উনার এই পাগলামোর কথা আমি জানতে পারতাম?উনি কি আমাকে কখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে এসে উনার মনের অনুভূতি গুলো শোনাতেন?

হঠাৎ করে আমি যেন একজন জ্ঞানী হয়ে উঠেছি।সবকিছু বুঝতে পারছি।সবকিছু পরিষ্কার আমার কাছে।তুষার ভাইয়া আমাকে ভালোবাসেন?

উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে বারবার ঠোঁট কামড়ে ধরছি।আমি যাব না আর কখনো উনার সামনে।কক্ষনও না।উনার চোখে চোখ মেলানোর ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে আমার।

উনি তো প্রায় অনেকদিন হলো এই বাসায় পা রাখেন না।মা’য়ের থেকে শুনেছিলাম উনি কাজ নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত।খাওয়ারও নাকি টাইম পায় না।
আল্লাহ! উনি যেন কখনো এই বাসায় না আসে।উনার সামনে গেলে আমি যদি মাথা ঘুরে পড়ে যাই।

একরাশ ভালোলাগা, একদফা উত্তেজনা, একরাশ দ্বিধা যুক্ত মন নিয়ে আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।কিছুদূরেই নীল সাদা রঙের ডায়েরী টাও আমার মত হাত-পা ছেড়ে বিছানার সাথে মিশে আছে।ওটার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়।আমার এলোমেলো মন বলছে বাকি পৃষ্ঠাগুলো পড়ে ফেলি।কিন্তু শরীরে শক্তি পাচ্ছি না।তাই হাত বাড়িয়ে ডায়রীটা বেডসাইডের বক্সে রেখে দিলাম।
চোখে ঘুমের ঘ ও নেই।



পুরো রাতটা আধোঘুমে আধো জাগরণে কাটিয়ে সূর্যের মিষ্টি আলো ছড়ানো একটি নতুন সকালের সাক্ষী হলাম।কিচেনে যেতেই দেখি মা ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে।আমাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

” চেহারা এমন লাগছে কেনো?রাতে ঘুম হয়নি?”

মা’য়ের চাহনি উপেক্ষা করে আমি জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরায় মনযোগ দিলাম।মা কি জাদু জানে নাকি!এক নিমিষেই সবটা বুঝে যায়।কিন্তু মা কি আমার মনের অবস্থাটাও বুঝতে পারছে?আমার মন যে অশান্ত, ভীষণ অশান্ত!

” হয়েছে কিন্তু পরিপূর্ণভাবে হয়নি।হয়তোবা পরীক্ষা শেষ হওয়ার খুশিতে।এখন আমার কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে।ঠিক করো তাড়াতাড়ি কোথায় নিয়ে যাবা।”

আমার কথা শুনে মা কোনো জবাব দিল না।আমি আবারো বলে উঠে উঠলাম,

” এখন তো তুমি আমার কথা শুনতেই পাবে না।কানের কাছে চিল্লাচিল্লি করলেও শুনবে না।প্লিজ আমি ঘুরতে যাব।একটু মাইন্ড ফ্রেশের দরকার না?কয়েকদিন পর তো এডমিশনের জন্য আবার ধুমসে পড়া শুরু করতে হবে।”

মা নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিল,
” তোর বাবা’কে বলিস।”

মন খারাপ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।আমি জানি যেহেতু মা’য়ের ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে মত নেই তাহলে আমার কোথাও যাওয়া হবে না।
.

ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি আর পরোটা চিবুচ্ছি।বাবা একটু আগেই অফিসে চলে গেছেন।ঘুরতে যাওয়ার কথাটা ফেনিয়ে রসিয়ে বাবার সামনে উপস্থাপন করেছিলাম।বাবা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে চিন্তা না করতে।আমার খুশি আর দেখে কে।নিশ্চয়ই বাবা একটা ব্যবস্থা করবে।মা’য়ের থেকে বাবা আমাকে বেশি ভালোবাসে কিনা!
কলিংবেল বাজার শব্দে টিভি থেকে মনযোগ সরাতে হলো।দরজা খুলে সামনের মানুষটাকে দেখে থমকে গেলাম।তুষার ভাইয়া!!
আমার পেটের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল।মুখের ভেতর পরোটার আধ চিবানো টুকরোটা গিলার শক্তিও পাচ্ছি না।হাত-পা কাঁপছে অস্বাভাবিকভাবে।এমন হচ্ছে কেনো আমার!আমি কি আজ নতুন দেখছি উনাকে?

” তুই এই দুনিয়ায় আছিস?নাকি মঙ্গল গ্রহে ঠাই নিয়েছিস?”

তুষার ভাইয়ার কথায় আমার ঘোর কাটল।উনি ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ জনক চোখে তাকিয়ে আছেন।আমি সাথে সাথেই চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম।
তুষার ভাইয়া ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

” পাগল টাগল হয়ে গেছিস নাকি?এমন হাবলার মত দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”

কোনো উত্তর দিলাম না আমি।অন্যসময় হলে হয়তোবা উনার সাথে ঝগড়া লেগে বসতাম।কিন্তু আজ তা পারছি না।চুপচাপ গিয়ে সোফার এককোনায় বসে পড়লাম।
তুষার ভাইয়া আরো একবার সূক্ষ্ম নজরে আমার আপাদমস্তক দেখে ভেতরে চলে গেলেন।

চলবে…

মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৭

সোফায় বসেই দেখতে পাচ্ছি তুষার ভাইয়া ডাইনিংরুমে মা’য়ের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠেছেন।উনার একহাতে ব্লেজার অন্যহাতে ব্ল্যাক কালারের মোবাইল।গায়ে ফিটফাট পোশাক। কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই হেসে উঠছেন।আমি মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখছি।তুষার ভাইয়ার হাসিটা আজ এত টানছে কেনো আমায়?
এই প্রথম খেয়াল করলাম তুষার ভাইয়াকে চাপ দাঁড়িতে অসম্ভব সুন্দর মানায়।
হঠাৎই তুষার ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ফেললেন।ব্যস্!খাবার আটকে গেল গলায়।জোরে কেশে উঠতেই উনি ঝটপট পানির গ্লাস এনে আমাকে দিলেন।মা এসে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,

” এখনো খায় কিভাবে সেটাও শিখিস নি তাই না?খাবার তো পালিয়ে যাচ্ছে না।ধীরে সুস্থে খেলেই তো পারিস।”

কি একটা অস্বস্তিকর অবস্থা। তুষার ভাইয়াকে যখনই লুকিয়ে দেখতে যাই তখনই ধরা খেতে হয় আমায়।

” আমার মনে হচ্ছে তোর ঘুম এখনো ভাঙেনি।ঘুমের মধ্যেই হাঁটাচলা করছিস,পরোটা চিবাচ্ছিস,টিভি দেখছিস।।মামী ওর মাথায় এক জগ পানি ঢেলে দাও তো!ওর ঘুম কেটে যাবে।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে মা হাসতে লাগলেন।আমি এখনো কিছু বলছি না।ওদের দুইজনের মাঝখানে নিজেকে কেনো জানি এলিয়েন লাগছে।আমাকে একা করে মা চলে গেল।
কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে চেঁচিয়ে বলছে,

” সে আর তাঁর ঘুম!কাল রাতে নাকি ভালো ঘুম হয় নি।দেখ না চেহারার কি হাল বানিয়ে রেখেছে।নিজের প্রতি কোনো যত্ন নিতে জানে না।”

আমি সোফায় বসে উসখুস করতে লাগলাম।আমার খাওয়া ঘুম সবকিছুর ডিটেইলস্ উনার সামনে না বললে মা’য়ের শান্তি হয় না।

তুষার ভাইয়া আমার পাশে ধপ করে বসে পড়লেন।আমার কাঁপা-কাঁপি আরো বেড়ে গেল।এই মানুষটার চোখের তাকালেই কেমন যেন লাগে আর উনি তো এখন পাশে বসে আছে।আল্লাহ।

” রাতে ঘুম হয় নি কেনো?কার কথা ভাবছিলি হুম?”

উনার কথা শুনে সূক্ষ্ণ একটা রাগ উঠেছে মাথায়।যার জন্য ঘুমাতে পারিনি সেই ব্যক্তিই কারণ জিজ্ঞেস করছে।মন বলছে উনাকে সরাসরি বলে দেই যে আপনি আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছেন।জানি না আর কত রাত এভাবে পার করতে হবে আমায়।

মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললাম,
” কারো কথা না।এমনিই ঘুম আসছিল না।”

” বিকেলে রেডি থাকিস।তোকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসব।মামীকে বলে রেখেছি আমি।”

তুষার ভাইয়া সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আবার আমার দিকে ফিরলেন।আমার ডান গালে হাত ছুইয়ে বললেন,

” আসছি।বায়।”

আমার অশান্ত মনে আরো একবার ঝড় তুলে ভাইয়া চলে গেলেন।এ কেমন অনুভূতি? এ কেমন ভালোলাগা?ডায়রীর দুটো লাইন না পড়লে বোধ হয় উনার এই ছোঁয়ার মর্মোদ্ধার করতে পারতাম না।উনি কি জানেন উনার কথা না মেনে অসময়ে ডায়রী খুলে আমি কি বিপদে পড়েছি?জানলে কি করতেন উনি?

উনার ছুয়ে দেওয়া জায়গাটায় হাত বুলাতেই কেমন যেন অজানা শিহরণ জেগে উঠল মনে।জানি না কেনো আমার হাসতে ইচ্ছে করছে,ঘর কাঁপিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে,গলা ফাটিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে।যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকেই যেন ভাইয়ার সেই হাসোজ্জ্বল মুখটা দেখছি।আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি?নাকি আমার চোখের জ্যোতিতে কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে।

.

সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে তুষার ভাইয়ার সাথে রাস্তায় হাঁটছি।স্ট্রিট লাইটের নিয়ন আলো এক অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছে।এই রাস্তাটায় সন্ধ্যার পর তেমন একটা লোকজন থাকে না।গাড়ি চলাচলও কম।
তুষার ভাইয়া ফুটপাথের উপর হাঁটছে আর আমি রাস্তার কিনারায়।যার কারণে উনাকে আমার থেকে বেশ লম্বা লাগছে।আমি মুখ শুকনো করে অন্যদিকে ফিরে গেলাম। এই মুহূর্তে একদমই মানাচ্ছে না আমাদের। উনাকে লাগছে আইফেল টাওয়ার আর আমি যেন সেই টাওয়ারের গোড়ায় জন্মানো এক চারাগাছ।
ইস!আমি এসব কি চিন্তা করছি?উনি টাওয়ার হোক আর যাই হোক তাতে আমার কি!আমি কেনো এসব নিয়ে চিন্তা করব।কি লজ্জার ব্যাপার।
কারোর মনের সুপ্ত ভাবনাগুলো অন্য কেউ জানতে পারে না এই কথাটা ভেবে আরো একবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
হঠাৎই তুষার ভাইয়া হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন।সেই দেখাদেখি আমিও থেমে গেলাম।
উনি গম্ভীর গলায় বললেন,

” তুই ফুটপাথের উপর দিয়ে হাঁট।আমি ওই পাশে হাঁটছি।”

” না না।কোনো সমস্যা নেই।”

তুষার ভাইয়া বিরক্তিমাখা চেহারায় বললেন,
” সমস্যা নেই মানে?দেখছিস না হঠাৎ হঠাৎ গাড়িগুলো কেমন ছুটে আসছে!কোনো একটা গাড়ি যদি টুস করে তোকে ধাক্কা মেরে উড়িয়ে দিয়ে যায়?তখন তো পুলিশ আমাকে ধরবে।সবাই প্রচার করে বেড়াবে আমার দায়িত্বজ্ঞান হীনতার কারণে তোর এই অবস্থা হলো।সবই আমাকে বিপদে ফেলার ফন্দি তোর তাই না?আমি তো তা হতে দিব না।আয় এপাশে।”

মুচকি হেসে দেয়ালের ওপাশে চলে গেলাম।পুলিশ তো ছিল বাহানা এটা আমি ভালোই জানি।আচ্ছা উনি কি আমার ভেতরের কথাটা বুঝতে পেরে গেছে নাকি এই কাজটা দ্বারা উনি আমার প্রতি একটা ছোট্ট যত্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন!অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আমার মন ছেয়ে গেল।
তুষার ভাইয়া আঁকাবাঁকা পা ফেলে হাঁটছেন আর সামনে কোনো অপরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দেখলেই পা দিয়ে ঢিল মারছেন।ছোট ইটের টুকরোগুলোও বাদ যাচ্ছে না।আমি নিঃশব্দে উনার প্রত্যেকটা কর্মকান্ড লক্ষ্য করে যাচ্ছি।
ভাবছি উনি বরাবরই রাস্তায় এভাবে হাঁটাচলা করতেন?আগে তো কোনোদিনও খেয়াল করিনি।
তুষার ভাইয়া হাত উঁচু করে ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন,

” কোথায় যাওয়া যায় বলতো?কোনো নিরিবিলি জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছে।কি বলিস?”

” কি জানি।”

” কি জানি আবার কি।হ্যাঁ বা না যেকোনো একটা বল।তুই আজ এত অদ্ভুত ব্যবহার করছিস কেনো বলতো!কি হয়েছে তোর?কোনো কিছু নিয়ে টেনশনে আছিস?তাহলে বল আমায়। ”

মনে মনে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।অদ্ভুত ব্যবহার করার একমাত্র কারণ তো উনি নিজেই।ইচ্ছে করছে ডায়রীর কথাটা বলে দেই।কিন্তু আমি তো সেই সাহস মনে এখনো জোগায় নি।
মোড়ের ফাস্ট ফুডের দোকানটা পাড় হতেই উনি বললেন,

” চল সেই দীঘির পাড়ে যাই।অনেকদিন হলো সেখানে পা রাখিনি।”

আমি আর দ্বিরুক্তি করলাম না।এভাবে ছন্নছাড়ার মত হাঁটতে নিজেরও ভালো লাগছে না।
তুষার ভাইয়ার পিছু পিছু চলে গেলাম দীঘির পাড়।এই নিয়ে দুবার ভাইয়ার সাথে আসলাম এখানে।

দীঘির পানি শান্ত।রাস্তার পাড়ের লাইটের হলুদ আলোয় তা চিকচিক করছে।
চারদিকে ঝিরিঝিরি বাতাস।আমি গলায় স্কার্ফটা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিলাম।
আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে তুষার ভাইয়া চলে গেলেন বাদাম কিনতে।আজ বাদাম কেনার কথা বলিনি আমি।উনি নিজেই কিনতে গেছেন।

বাদামের প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে উনি টান টান হয়ে বেঞ্চে বসে পড়লেন।আমার দিকে ফিরে বাঁকা হেসে বললেন,

” তোর বাদাম এত পছন্দ তোকে বাদামওয়ালার সাথে বিয়ে দিলে কেমন হবে বলতো?বাদামওয়ালাকে বিয়ে করবি?”

আমি অদ্ভুত চোখে তাকালাম উনার দিকে।উনার চেহারা খুশিতে ঝলমল করছে যেন এরচেয়ে সুখবর আর দুনিয়াতে নেই।”

হাতের বাদামগুলো মুখে চালান করে বললাম,

” যে জিনিস আমার পছন্দ সেই জিনিসওয়ালাকে বিয়ে করতে হবে এমন কোনো কথা আছে?বাদামের পাশাপাশি আমার তো আইসক্রিমও প্রিয়।চিপস্ খেতেও ভালোবাসি।তাহলে আপনার ভাষ্যমতে একবার বাদামওয়ালাকে বিয়ে করব,আবার আইসক্রিমওয়ালাকে।তারপর আসবে চিপস্ওয়ালা।তাই তো?”

” গণ্ডমূর্খের মত কথা বললে থাবড়া খাবি।কথার কি শ্রী!বিয়ের সাধ জনমের মত মিটিয়ে দেব আমি।হাঁদারাম কোথাকার!”

” আরে আপনিই তো বললেন আমার বাদাম পছন্দ তাই বাদামওয়ালার সাথে বিয়ে দেবেন। বাদামের সূত্র ধরেই তো চিপস, আইসক্রিমের কথা উঠল।”

” বাদামের কথা তুলে ভুল করেছি আমি।পোড়া কপাল আমার!কি আর করব।এই তিন পেশার কাজগুলো আমায় শিখে নিতে হবে।কাল থেকে অফিস বিজনেস ছেড়ে রাস্তার ধারে ভ্যান নিয়ে এগুলো বিক্রি করার প্র্যাকটিস করব।আমার ভ্যানের নাম হবে ‘তুষার ভ্যারাইটিজ ভ্যান’।কি বলিস?নামপছন্দ হয়েছে?”

ভাইয়ার কথা শুনে আমার বাদাম খাওয়া মাঝপথেই থেমে গেল।টের পাচ্ছি দুইকান দিয়ে গরম ধোঁয়া শাঁ শাঁ করে নির্গত হচ্ছে। উনার দিকে চোখ ফিরে তাকানোর সামর্থ্য নেই আর।আর বসে থাকতে পারছি না।মনে হচ্ছে কোনো গনগনে তাওয়ার উপর বসে আছি আমি।
আড়চোখে চেয়ে দেখি তুষার ভাইয়ার নজর দীঘির পানির দিকে।উনি কি হাসছেন?আবছা আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে উনার ঠোঁটে মুচকি হাসি লেগে আছে।

.

হঠাৎ করেই বাতাসের বেগ বেড়ে গেল।দীঘির শান্ত পানিতে টলমল ঢেউ কেঁপে কেঁপে উঠছে।আকাশের পশ্চিম কোনা থেকে শোনা যাচ্ছে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাক।বৃষ্টি আসার পূর্ব লক্ষণ।যেই সেই বৃষ্টি নয়।আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ঝড় আসবে।আশেপাশে যে কয়েকজন মানুষ ছিল সবাই চলে গেল।কয়েকহাত দূরের বাদামওয়ালা আঙ্কেলটাও নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এ সবকিছু লক্ষ্য করে এবার তুষার ভাইয়াকে বললাম,
” চলুন।বাসায় ফিরে যাই।যেকোনো সময় বৃষ্টি এসে যাবে।”

তুষার ভাইয়া নির্লিপ্ত চেহারায় আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই বলে উঠলেন,

‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here