মন গহীনে,পর্ব-১৮,১৯,২০
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৮
তুষার ভাইয়া নির্লিপ্ত চেহারায় আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই বলে উঠলেন,
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়’
মৃদু কম্পিত পুরুষালি গলার সুমিষ্ট লাইনগুলো ছন্দের মত আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল।
সম্মোহনীর মত তাকিয়ে আছি আমি।পাশে বসে থাকা সুদর্শন সুঠাম দেহের ছেলেটার চোখেও নিখুঁত চাহনি।প্রকৃতিতে ঝড় উঠতে চলেছে।আমারও মনেও যে প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের আভাস।একগাদা নাম না জানা অনুভূতির ঝড়!অদ্ভুত কিছু আবেগের ঝড়।এই সর্বনাশা ঝড় কোথায় নিয়ে ফেলবে আমায়?
অস্ফুটস্বরে বলতে চেষ্টা করলাম,
” ভাইয়া..”
আমাকে অবাক করে দিয়ে তুষার ভাইয়া গা ঝাড়া দিয়ে বসা থেকে উঠে গেলেন।বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলোর উপর হাত চালিয়ে বললেন,
” কিছু লাইন গলায় জমে ছিল এতক্ষণ। তাই মুখ দিয়ে বের করে দিলাম।কি হলো চোখ বড় বড় করে কি দেখছিস আমায়?চল বাসায় যেতে হবে।”
আমি কি কোনো স্বপ্ন দেখছিলাম? নাকি কোনো হেলুসিনেশন!একটু আগেই তো তুষার ভাইয়ার অন্য এক রূপ দেখেছি আমি।আর মুহূর্তেই উনি রঙ পাল্টে সহজ মানুষ হয়ে গেলেন?
” আবারো দাঁড়িয়ে আছিস যে?চল? তোর জন্য যদি বৃষ্টিতে ভিজা লাগে তাহলে কিন্তু খবর করে ফেলব আমি।”
তুষার ভাইয়ার ধমক খেয়ে সম্বিত ফিরে পেলাম।ততক্ষণে উনি হাঁটা শুরু করে দিয়েছে।দৌড়ে গিয়ে উনার সমান হলাম।
হঠাৎই উনি এক হাত বাড়িয়ে বললেন,
” হাতটা ধর নীল!”
চমকে উঠলাম আমি।
কিন্তু কেনো?এমন তো নয় যে এই প্রথম উনি হাত ধরছেন।তাহলে আমার ছোট হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করছে কেনো?তুষার ভাইয়া এখনো উনার হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
” ক..কেনো ভাইয়া?”
” বাতাসের যে গতি দেখতে পাচ্ছিস?বাতাস একটা ঝাপটা দিলে তোর শুকনো কাঠির মত শরীরটা উড়ে গিয়ে দীঘিতে পড়লে তখন আমি কি করব?আমাকে বিপদে ফেলার তালে থাকিস সবসময়।আমি তো আর মুভির হিরোদের মত পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে রক্ষা করতে পারব না তোকে।কারণ আমি সাঁতার জানি না।আবার চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছিস?তুই কি চোখ গোল করে থাকার রোগে আক্রান্ত হয়েছিস?”
শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে আমার হাতটা উনার শক্ত হাতের ভাঁজে গলিয়ে দিলাম।নিমিষেই উনি আঁকড়ে ধরলেন হাতটাকে।উনার ছোঁয়া পেতেই অদ্ভুত এক উত্তেজনা জেঁকে ধরল আমায়।
আমার কেনো জানি মনে হয় তুষার ভাইয়া নিজেকে একটা খোলসের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেন।কখনোসখনো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়েও আসেন না।
বড় রাস্তার মাথায় আসতেই তুষার ভাইয়া একটা রিকশা ঠিক করে ফেললেন।আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে রিকশাওয়ালা আঙ্কেল টা স্বাভাবিক ভাড়ার চেয়েও দ্বিগুণ ভাড়া চেয়ে বসলেন।কিন্তু তুষার ভাইয়া সেদিকে কোনো পাত্তাই দিলেন না।কি আজিব লোক উনি!একটু মূলামুলি করলে কি উনার প্রেস্টিজে দাগ লাগত?আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।কি দরকার?টাকা গেলে তো উনারই যাবে।
রিকশা চলতে লাগল বাতাসের থেকেও জোর গতিতে।
বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি আসতেই বড়বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল।ভাড়া মিটিয়ে তুষার ভাইয়া আমার হাত টেনে দৌড়ে গেইটের ভেতর ঢুকে গেলেন।
.
বাসায় এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিলাম।ধুলোবালিতে জামার অবস্থা খারাপ।থ্রি-পিস টা আমার পছন্দের ছিল।কিন্তু অপরিষ্কার হয়ে যাওয়াতে একটুও মন খারাপ লাগছে না কেনো জানি।
বরং যত্ন করে পানিতে ধুয়ে টান টান করে ছড়িয়ে দিলাম বারান্দায় টাঙানো নাইলনের দড়িতে।সবকিছুতেই এত ভাললাগা খুঁজে পাচ্ছি কেনো?
যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু ভালোলাগার হাতছানি।এসবকিছুর মূলে কি তুষার ভাইয়া?
দীঘির পাড়ের মুহুর্তগুলো মনে পড়তেই মনের ভেতর হাজারো রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াতে লাগল।ইস!
বিছানার কোনায় নিরিবিলিতে বসে থাকা টেডিবিয়ার টাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।নিজেকে কেনো এত সুখী মনে হচ্ছে? আচ্ছা আমি কি প্রেমে পড়ে যাচ্ছি? তুষার ভাইয়ার প্রেমে?
প্রেমে পড়ার প্রথম মুহূর্তগুলো,প্রথম অনুভূতিগুলো বুঝি এমনই হয়?প্রথম প্রেম কি জীবনে খুশির বন্যা নিয়ে আসে?আমি জানি না।কিচ্ছু জানি না।আমার শুধু খিলখিল করে হাসতে ইচ্ছে করছে।অদৃশ্য ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে করছে।বেসুরে গলায় গানের লাইনে টান দিতে ইচ্ছে করছে।
বেডসাইডের বক্সের ড্রয়ার খুলে অতি যত্নের সাথে ডায়রীটা তুলে নিলাম।উপরের মলাটে নীল আর সাদা রঙো মিলে লতাপাতার ডিজাইন আঁকা।নাকের সামনে এনে গন্ধ শুকতেই পাগল করা এক ঘ্রাণ নাকে আসলো।যদিও এই ঘ্রাণটা পরিচিত আমার কাছে।দীর্ঘদিন বই অনাদরে এককোনায় পড়ে থাকলে যেমন গন্ধ তৈরি হয় ডায়রী থেকেও সেই গন্ধ পাচ্ছি আমি।কিন্তু আজ সেই গন্ধে কেমন প্রেম প্রেম সুবাস!
তুষার ভাইয়াকে নিয়ে শত আজগুবি চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পেলাম না।ঘুম ভাঙলো মা’য়ের ডাকে।
” নীলাশা তুই না খেয়ে কেনো ঘুমিয়েছিস।উঠে পড় মা।ডাইনিং টেবিলে তোর বাবা অপেক্ষা করছে একসাথে খাবে বলে।”
আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম।ঘড়িতে বাজছে পাক্কা দশটা।প্রায় দুইঘন্টার মত ঘুমিয়েছি আমি।মা’য়ের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম।
” মা আমার কেনো জানি গান বাজিয়ে নাচতে ইচ্ছে করছে।”
আমার কথা শুনে মা হতভম্ব। মা বোধ হয় ভাবছে আমি পাগল হয়ে গেছি।সত্যিই কি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
এগুলো কি প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি নাকি প্রথম পাগল হওয়া লক্ষণ?
ভ্রুকুটি নিয়ে মা ধমকে উঠে বলল,
” নাচতে ইচ্ছে করলে ছাদে চলে যা।যতখুশি নাচ।কিন্তু তুই যে ভেজা চুল নিয়ে বিছানায় ঘুমিয়েছিলি দেখ এখন চাদরটাও ভিজে আছে।বেআক্কেলের মত কাজ না করলে তোর হয় না তাই না?”
প্রাণখোলা হাসি দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি।মা’য়ের বকাগুলোও আজ কানে মধুর ঠেকছে।
আমার পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে মা বলল,
” দেখ দেখ এতবড় মেয়ে এখনো বাচ্চাদের মত ব্যবহার করছে।তুই দিনদিন ছোট হচ্ছিস না বড় হচ্ছিস?”
মা’য়ের কথার পিঠে আমার বলতে ইচ্ছে করল আমি প্রেমে পড়েছি।খুব করে কারো প্রেমে পড়েছি।সেই প্রেম আমায় টক ঝাল মিষ্টি অনুভূতির সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ করে দিচ্ছে আমায়।
” কিরে ছাড় আমায়?ওই যে তোর বাবা ডাকছে।”
” ছাড়ব।আগে বলো আজ ভাত খাইয়ে দিবে আমায়।”
” তুই কি আসলেই ছোট হচ্ছিস?তোকে দেখে তো আমার সন্দেহ লাগছে।সকাল থেকেই কেমন অদ্ভুত ব্যবহার।তোর শরীর মন ঠিক আছে তো?”
” উফ্ মা।খাইয়ে দেওয়ার কথা বলতেই তুমি তোমার প্রশ্নের পসরা সাজিয়ে বসেছো।যাও আমি নিজেই খেতে পারব।”
মাকে ছেড়ে চলে গেলাম ডাইনিং টেবিলে। বাবা খালি প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে।আমাকে দেখে মৃদু হেসে বলল,
” আয় বোস!”
আমি চটজলদি গিয়ে পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।বাবা আমার পড়াশোনা,অ্যাডমিশন,কোচিং নিয়ে আলোচনা শুরু করল।আমি শুধু হু হা করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি।বাবার কথায় মন নেই আমার।আমার তো মন চাইছে বাবাকে বলে দিই ‘বাবা তোমার মেয়ে তো প্রেমে পড়ে বসে আছে।এখন কি হবে?’
________________________
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পরই অদ্ভুত এক ইচ্ছা জেগেছে মনে।তুষার ভাইয়াকে দেখার ইচ্ছা! উনার গলার স্বর শোনার ইচ্ছা। কিন্তু এই সাতসকালে কিভাবে যাব উনাদের বাসায়।কোনো কারণ ছাড়া তো আর যাওয়া যায় না।এখন তো উনি বাসায়ও খুব একটা আসেন না।গতকাল সকালে এসেছিল।আবার দেখা যাবে পরের সপ্তাহে আসবে।কিন্তু আমার তো এখনই ভাইয়াকে দেখতে মনটা আনচান করছে।বেশি দেরি করলে উনি আবার অফিসে চলে যাবেন।
অনেক ভেবেচিন্তে শেষমেষ একটা বুদ্ধি গেঁথে ফেললাম মাথায়।এখন শুধু প্রয়োগ করার পালা।
চেহারায় যথেষ্ট ইনোসেন্ট ভাব ফুটিয়ে মা’য়ের সামনে হাজির হলাম।মা রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ তুলে বাসনকোসন গোছাতে ব্যস্ত।
” মা আমি আজ পরোটা খাব না।আজ ব্রেকফাস্টে আমি নুডুলস খাব।”
আমার আবদার শুনে মা সরু চোখে তাকালেন।যা আমার কাছে মোটেও ভালো লাগেনি।তাই আবার দম নিয়ে বলে উঠলাম,
” আমি সিরিয়াস কিন্তু। আমি আজকে নুডুলস্ খাবোই খাব।”
” এই তুই গতপরশু তো খেলি নুডুলস।আবার আজকেই খাবি?কাল বানিয়ে দেব।এখন পরোটা খা সবজি দিয়ে।”
” না।খাব না পরোটা।”
” তাহলে নিজে বানিয়ে খা।নুডুলস বানানো সোজা।আয় দেখিয়ে দেই।”
মুখে হাসি ফুটে উঠল আমার।আমি তো জানি মা রাজি হবে।তাহলে প্রথম দিকে না না করে কেনো এই কারণটা আজও বুঝলাম না।সবার মায়েদের মধ্যেই কি এত সুন্দর একটা বৈশিষ্ট্য থাকে?
মা’য়ের সাহায্যে ঝটপট নুডুলস তৈরি হয়ে গেল।তখনই মা’কে বলে বসলাম,
” মা এতখানি নুডুলস আমি একা খাব কি করে?তুষ্টি আপুকেও দিয়ে আসি?”
মা কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলল,
” তুষ্টিকে যখন দিবি তখন তুষার বাদ যাবে কেনো?ওর জন্যও দিচ্ছি। নিয়ে যা।”
বাহ্! আমার বুদ্ধি তাহলে কাজে লেগে গেল।নিজের জন্য নিজেরই গর্ব হচ্ছে। জাতি কি জানে যে নীলাশা’র মাথায় কি পরিমাণ বুদ্ধির চাষাবাদ হয়?
চলবে…
মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৯
কলিংবেল বাজাতেই তুষ্টি আপু দরজা খুলে দিল।আমাকে দেখে কপট রেগে বলল,
” বাহ্!আজ তোর কোনদিক দিয়ে সূর্য উঠেছে?তুই তো এখন ঈদের চাঁদ হয়ে গেছিস।দেখাই পাওয়া যায় না।লাস্ট কবে বাসায় এসেছিস মনে আছে?
” মনে করার দরকার কি?আজ সূর্য পূর্ব দিকে উঠেছে আর আমি ঈদের চাঁদও হই নি।তুমি কবে আমাদের বাসায় গেছো সেটা মনে আছে কি?এখন সাইড দাও তো।প্লেট দুটো গরম হয়ে আছে।”
” এত সকালে প্লেটে করে কি এনেছিস?”
” আহ্! আপু আগে সামনে থেকে সরো না!”
আপু সরে দাঁড়াতেই ঢুকে গেলাম ভেতরে।অতি সাবধানতার সহিত পুরো ডাইনিং ড্রয়িংরুমে নজর বুলিয়ে নিলাম।সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি নেই এখানে।বোধ হয় নিজের ঘরে আছে।
নুডুলসের বাটি দেখে তুষ্টি আপু ঝাপিয়ে পড়লেন।
ফুপি এসে বলল,
” দেখ এই মেয়ে মনে হয় নুডুলস্ জীবনেও খায় নি।আরে আস্তে খা।নীল তুই যা তুষারকে প্লেটটা দিয়ে আয়।আমি চুলায় তরকারি বসিয়েছি।”
আমাকে আর পায় কে?খুশিতে না আবার কেঁদেই ফেলি।চোখেমুখে উপচে পড়া আনন্দ কোনোরকমে চেপে সরে পড়লাম ডাইনিং রুম থেকে।
তুষার ভাইয়ার রুমের দরজা খোলা।ভেতর থেকে গানের আওয়াজ আসছে।
‘তোমারো লাগিয়া তখনি,বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি- ‘
কি সুরেলা কন্ঠ উনার!রবীন্দ্র সংগীত বেশ মানিয়েছে উনার গলায়।কিন্তু আমার মুখটা চুপসে গেল।হিংসে হচ্ছে প্রচুর।তিনি ছেলে হয়েও এত চমৎকার গান গায় আর আমি?আমার গলা ফাটা বাঁশের মত ফটফট করে।কেউ একবার আমার এলিয়েন মার্কা গলায় গান শুনলে জীবনে দ্বিতীয়বার শোনার ভুল করবে না।
নিঃশব্দে ঢুকে পড়লাম তুষার ভাইয়ার রুমে। উনি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে ব্রাশ করছেন।গায়ে শুভ্র রঙের শার্ট।শার্টের হাতার বোতাম গুলো লাগানো হয়নি।গলার কাছের কয়েকটা বোতামও খোলা।অপরূপ লাগছে উনাকে দেখতে!এত রূপ এতদিন কেনো চোখে পড়েনি আমার!
আয়নার ভেতরে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুষার ভাইয়া ভ্রুকুটি নিয়ে তাকালেন।তবে পেছনে ফিরলেন না।পুনরায় নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে বললেন,
” কিরে?তুই এখানে?লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখছিস?নাকি আমার সুমিষ্ট গলার গান শুনছিস?”
আমি বিরসমুখে প্লেটটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিলাম।উনার সামনে আসা মানেই হাজারো অদ্ভুত কথা শোনা,হাজারো প্রশ্নের জবাব দেওয়া,নিজেকে নিয়ে হাজারো পচানি খাওয়া।তবে এখন সবকিছুই ভালো লাগে।কেননা এই আপাদমস্তক মানুষটাই তো আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
” আপনার গান শোনার চেয়ে কাকের কা কা শুনলে অনেক কাজে দিবে।”
” কি বললি তুই?তুই গানের কোনো মর্ম বুঝিস?স্থূল মস্তিষ্কের মানুষের দ্বারা এসব হয়না কখনো।তোর সাথে বৃথা চেঁচিয়ে লাভ নেই।প্লেটে করে কি এনেছিস দিয়ে চলে যা।”
” আমি এখানে আপনার গান শুনতে আসিনি।আপনাকে লুকিয়ে দেখতেও আসিনি।যত্তসব! আর আপনি কি হ্যা নিজের ঢাক নিজেই পেটান।কে বলেছে আপনার গলা সুমিষ্ট? ”
” আমার ঢাক তো আমি নিজেই পেটাব।আমার ব্যক্তিগত ঢাক অন্যকে দিয়ে পেটাব কেনো।আর আমার গলা অফকোর্স সুমিষ্ট। যে কেউই শুনলে প্রেমে পড়তে বাধ্য। কেনো তুই পড়িস নি?”
‘কেনো তুই পড়িস নি’ বাক্যটা ঝংকার তুলে আমার কানে প্রবেশ করল।উনি কি আমার ভেতরের না বলা সব কথা পড়ে নিয়েছেন?আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ উনি কি বুঝতে পেরেছে যে আমি ডায়রী খুলেছি?
তুষার ভাইয়া এখন শার্টের বোতাম লাগাচ্ছেন। গুনগুন করে কি যেন একটা সুর গাইছেন।কই দেখে তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তাহলে সবকিছুই কি কাকতালীয়?
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ-কুসুম কি ভাবছিস?চাউমিন কি তোর হাতের বানানো?”
তুষার ভাইয়া প্লেট হাতে খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।কি পরিপাটি লাগছে উনাকে।
শুকনো মুখে উত্তর দিলাম,
” মা হেল্প করেছে।”
” বাহ্!কাজ শিখ তাড়াতাড়ি। তোকে বিয়ে দিয়ে আমি এবং আমরা নিশ্চিন্ত হই।”
” এত জলদি আমি শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছি না।আর আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করে আপনার মাথা নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”
” আলবাত প্রয়োজন আছে।দেরিতে বিয়ে করলে কপালে জুটবে বুড়া জামাই।তখন তো চিৎকার চেঁচামেচি করে আমাদের হাড়মজ্জা জ্বালিয়ে ফেলবি।”
আমার মেজাজ ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করল।কোথায় উনাকে একপলক দেখতে আসলাম আর উনি কিনা….
উজবুক একটা।
____________________
বিকেলের হেলে পড়া সূর্য জানালা গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে।আকাশে অদ্ভুত সুন্দর সোনালি আভা।
পাখিরা দল বেঁধে নীড়ে ফেরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে।জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এই সুন্দর দৃশ্যটা উপভোগ করছি আমি! কিন্তু আমার মন বেজায় খারাপ।কারণটা নিজেও খুঁজে পাচ্ছি না।
দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম আর উঠলাম একটু আগে।তারপর থেকেই মনটা কেমন গুমোট মেরে আছে।আজকাল তো নিজের মনের হদিস নিজেই পাই না।মন যে পড়ে আছে আরেকজনের কাছে।
মা ও বাসায় নেই।কোথায় গেছে কে জানে।হয়তোবা ছাদে নয়তো ফুপির বাসায়।
ড্রয়িংরুমে যেতেই মা ঢুকল ঘরে।কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললাম,
” আমাকে একা ফেলে কোথায় যাওয়া হয়েছিল?গিয়েছো ভালো কথা।দরজা লক করে যাবে তো নাকি!”
” তাড়াহুড়ো করে চলে গেছি রে।একটু আগেই তুষার এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।হঠাৎ করেই ওদের নাকি অফিসের জরুরি কাজ পড়ে গেছে।তাই
আর্জেন্ট টিকিট কেটে চলে যাচ্ছে মালয়েশিয়া।ওকে এগিয়ে দিতেই গেছিলাম তোর ফুপির বাসায়।”
মা’য়ের কথা শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।প্রশ্নমাখা চোখে তাকিয়ে আছি মা’য়ের দিকে।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।উনি চলে গেলেন!আমাকে না বলেই চলে গেলেন?
আমার নড়নচড়ন না দেখে মা বলল,
” কি হলো তোর?এভাবে কি দেখছিস?”
” কিছু না।তুষার ভাইয়া ফিরবে কবে কিছু বলেছে? ”
” সঠিক করে কিছু বলে নি।হয়তোবা এক সপ্তাহ লাগতে পারে আবার পনেরদিন ও লাগতে পারে।”
” ও আচ্ছা। ”
হেলতে দুলতে চলে এলাম নিজের রুমে।এমনিতেই মনটা ভালো ছিল না আর এখন খারাপ লাগাটা পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে।উনি একবার আমাকে বলে গেলে কি হত?আচ্ছা মানলাম উনার অনেক জরুরি কাজ পড়ে গেছে। অনেক তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছেন।কিন্তু মাঝপথে মা’য়ের মোবাইলে একটা কল দিয়েও তো আমার সাথে কথা বলা যেত নাকি?উনার কাছে কি আমার গুরুত্ব শুধু এতটুকু?
ভীষণ একলা লাগছে।মনে হচ্ছে কি যেন নেই।কি যেন চলে গেছে আমার থেকে।চলে গেছে বহুদূরে।এক সপ্তাহ কি খুব বেশি সময়?এক সপ্তাহ কি দেখতে দেখতে কেটে যাবে না?উনি তো আবার চলে আসবেন।আবার আমাকে এটা সেটা বলে রাগানোর প্রক্রিয়ায় লেগে যাবেন।আমি কপট রাগ দেখিয়ে আবার মনে মনে হেসে উঠব।তাহলে এত মন খারাপ করার তো কিছু নেই।
.
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসলো আকাশের বুকে।টেডিবিয়ারটাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি বারান্দায়।সবকিছু এত বিষাদময় লাগছে ।আজ সকালেও তো মনে হচ্ছিল আমার জীবনটা কত রঙিন।সেখানে বিষন্নতার কোনো ছাপ নেই।আর এখন?
তুষার ভাইয়া চলে যাওয়াতে এমন হচ্ছে? আমি কি মিস করছি উনাকে?মিস করার মুহুর্তগুলো কি এরকম কষ্টের হয়?
আমি তো ভেবেছিলাম প্রথম প্রেম শুধু উপচে পড়া খুশি নিয়ে আসে।
মা’য়ের আওয়াজ পেতেই মন খারাপ ভাবটাকে দূর করে দিতে চাইলাম।
” ভর সন্ধ্যে বেলায় বারান্দায় কেনো বসে আছিস নীলাশা?”
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।মা’য়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালো লাগছে না।মা’য়ের কি এখনই বারান্দায় আসার দরকার ছিল?
” এমনি বসে আছি।তুমি যাও।ভালো লাগছে না আমার।”
” কেনো ভালো লাগছে না?শরীর খারাপ নাকি?দেখি জ্বর আছে কি না।”
মা হাত বাড়িয়ে আমার কপাল ছুঁয়ে দেখলেন।মা’য়ের সন্দেহ মিথ্যা প্রমাণিত হলো।জ্বর নেই আমার।
” শরীরের তাপমাত্রা তো ঠিকই আছে।তাহলে তোর মন খারাপ কেনো বল আমায়?কি নিয়ে আমার মেয়েটা এত দুশ্চিন্তা করছে?”
মা’য়ের স্নেহমাখা কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে।কিন্তু মনটা যেন আরো বিষন্ন হয়ে উঠছে।কোনোরকমে বলে কয়ে মা’কে রুমে পাঠিয়ে দিলাম।
পরিষ্কার আকাশে হলদে সোনালি বাঁকা চাঁদ উঁকি মারছে ধীরে ধীরে।অপলক তাকিয়ে আছি সেদিকে।আজকে চাঁদের সৌন্দর্যও ম্লান লাগছে আমার কাছে।বিগত কয়েক মাসেও বোধ হয় আমার এত অস্থির লাগে নি এখন যতটা লাগছে।পুরো একসপ্তাহ আমি কিভাবে কাটাব উনাকে না দেখে।উনি যাওয়ার কয়েকঘন্টা মধ্যেই আমার এই হাল!
আচ্ছা তুষার ভাইয়া কি জানে এই মুহূর্তে কেউ একজন তাঁর কথা ভেবে আকাশ পাতাল এক করে দিচ্ছে? উনি কি বুঝতে পারছে কারো মনে উনার জন্য অগণিত প্রেম জমা আছে?
আনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,
” প্লিজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন ভাইয়া।আমি আপনাকে মিস করছি।খুউউব!”
.
রাতে বাবা বাসায় আসার পর যথাসম্ভব হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করছি।আমার মন খারাপ টের পেলে বাবা হাজারো প্রশ্ন নিয়ে হাজির হবেন।আর এই মুহূর্তে আমি কারোর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগ্রহবোধ করছি না।
ড্রয়িংরুমে বসে বাবা যখন নিউজ দেখছিল টিভিতে তখন আমি পা টিপে টিপে চলে গেলাম বাবার মোবাইল আনতে।উদ্দেশ্য ভাইয়ার ফেসবুকের প্রোফাইল একটু ঘুরাঘুরি করা।আমি মাঝেমধ্যে বাবার মেসেঞ্জার,ফেসবুকে ঢুকি।তাও খুব কম।লাস্ট কবে মেসেঞ্জারে গিয়েছি মনে নেই।
ভাইয়ার আইডি খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না।প্রোফাইলে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ানো একটা ছবি।ক্যাপশনে লেখা-
‘ তোমার নীলে ডুবেছি শতবার
হাত বাড়িয়ে ধরবে কি আমায়?’
বাহ্ দারুণ লেখা তো!সমুদ্রের মাঝে ডুবে আবার সমুদ্রকেই হাত বাড়িয়ে ধরতে বলছে।
এই প্রথম ভাইয়ার আইডিতে ঢুকলাম। আগে তো আইডি দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি।
ভেবেছিলাম উনার প্রোফাইলের সব ছবি দেখব।কিন্তু এখন টের পাচ্ছি আমার মন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।কি এক যন্ত্রণা!কিছুই ভালো লাগছে না।বিরক্ত হয়ে ফোনটা আগের জায়গায় রেখে দিলাম।
চলবে…
মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_২০
কি করিলে বলো পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে ‘
জাদুকরী সেই লাইনদুটোর উপর আরো একবার হাত বুলিয়ে নিলাম।এ পর্যন্ত শতবার ঠোঁটে আওড়ানো হয়ে গেছে।নাকের কাছে চেপে ধরতেই পুরোনো গন্ধ টা ছুঁয়ে গেল।
তুষার ভাইয়া পাগল করে দিয়েছে আমায়।বদ্ধ পাগল যাকে বলে।নাহলে রাত দুটোর সময় কেউ না ঘুমিয়ে প্রিয় মানুষের দেওয়া ডায়রী নিয়ে বসে থাকে?রাতের আঁধারে যেন সেই পাগলামি দ্বিগুন আকার ধারণ করে।চোখ থেকে ঘুমের রেশ কেড়ে নেয়।
রুমের ভেতর ভুতুরে পরিবেশ।শুধু বিছানার পাশের টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো।অন্যসময় হলে আমি ভুতের ভয়ে কাবু হয়ে কাঁথা মুড়ে শুয়ে পড়তাম।কিন্তু আজ ভয় লাগছে না।ভূতের ভয় দূর করে দেওয়ার ক্ষমতাও কি প্রেমের আছে?প্রেমে পড়লে কি মানুষ না ঘুমিয়ে সারারাত প্রিয় মানুষটার কথা ভেবেই কাটিয়ে দেয়?প্রিয় মানুষটাকে সারাক্ষণ চোখের সামনে বসিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে?সেই মানুষটার হাত ধরে স্বপ্নের দুনিয়ায় ভাসতে ইচ্ছে করে?প্রতি মুহূর্তে তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করে দুমড়ে মুচড়ে যায়?
এজন্যই বোধ হয় বলে ‘প্রেমে পড়া বারণ।’
ডায়রীর বাকি পাতাগুলো পড়তে ইচ্ছে করছে এবং আমি পড়ব।মনে ভেতর অজস্র সাহস জুগিয়েছি আজ।আজ না পড়লে আর কখনো পড়া হবে না।
লম্বা একটা দম নিয়ে উল্টিয়ে দিলাম প্রথম পৃষ্ঠা।
” আমার নীলাশা।তোর নামটা এত অদ্ভুত কেনো বলতো!আশার আবার কোনো রঙ হয় নাকি?তাও আবার নীল রঙ!নীল রঙ হবে আকাশের,নীল রঙ হবে সমুদ্রের বুকের গভীর জলরাশির,রামধনুর সাতটি রঙের একটি হবে নীল!
কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে তোর নামের সাথেও নীল জুড়ে দেওয়া হয়েছে।সেই রঙ রাঙিয়ে দিয়েছে আমার হৃদয়।হাজারো ঘষামাজা করে সেই রঙ মুছতে পারিনি।বরং দিনকে দিন গাঢ় হয়ে চলেছে।তুই কবে এই অঘটনটা ঘটালি বলতো?
তিনবছর আগে তোর সাথে প্রথম দেখা।আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের আকাশটা কিন্তু নীলে নীলে ভরা ছিল। ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি আয়শা মামী।মামীর কাছ ঘেষে বসে আছে পনেরো কি ষোল বছরের মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে।চেহারা জড়তায় ভরপুর।আমাকে দেখে আরো কুঁকড়ে গেল।বুঝতে পেরেছিলাম অচেনা মানুষদের সামনে হয়তোবা মেয়েটা কমফোর্ট ফিল করে না।তাই মামীর সাথে হালকা দুয়েকটা কথা বলে আবার রুমে চলে গেছিলাম।
আহান মামা এবং আয়শা মামীকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম। তোকেও দেখেছিলাম অনেকবার। কিন্তু চেহারা মনে ছিল না।পরে মা থেকে জানতে পারলাম তোরা এই বিল্ডিংয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিস আর আজই গৃহপ্রবেশ।
তারপর থেকে আস্তে আস্তে তোর সাথে পরিচয় হলো।হাসি-ঠাট্টায়, খোজ মেজাজে আড্ডা চলত আমাদের।তোর জড়তা ভাবটাও কেটে যেতে লাগল।তখনো কিন্তু আমি বুঝিনি তুই নিঃশব্দে আমার মনে কতটা জায়গা নিয়ে ফেলেছিস।দিন পেরিয়ে মাস চলে গেল।তোদের বাসায় বিভিন্ন কারণে আসা যাওয়া লেগেই থাকত।তেমনভাবে তোরও চলাচল ছিল আমাদের বাসায়।একসময় টের পেলাম তোকে একটা দিন না দেখলে মনে হত নিত্যদিনের কাজের মধ্যে কি যেন একটা অসম্পূর্ণ আছে।তোর সাথে কথা বলতে ভালো লাগত,তোর দিকে অপলক চেয়ে থাকলে শান্তি পেতাম মনে।যেদিন দেখা পেতাম না সেদিন হানা দিতাম তোদের বাসায়।কখনো কারণে কখনো অকারণে।
তুই কিন্তু আহামরি কিছু না।চোখ ধাঁধানো ধবধবে ফর্সা,রক্তলাল ঠোঁট,হরিণী চোখ,কোমর অবধি চুলের অধিকারী তুই না।কিন্তু তবুুও আমি তোর মায়ায় পড়েছি।আনন্দে আটখানা হয়ে বা অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে যখন তুই চোখ গোলগোল করে তাকাস সেই তাকানোর মায়ায় পড়েছি।
তুই হাসলে মুক্তো ঝরে না।কিন্তু তোর হাসির শব্দ আমার হৃদয়ের গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।সেখানে কিন্তু তোর জন্য অগাধ প্রেম বর্ষণ হয়।
হাসলে তোর গালে টোল পড়ে না।হাসি ছাড়াই তোর চিবুকে একটা গর্ত সবসময় দেখা যায়।ভাগ্যিস তোর গালে টোল নেই।নাহলে তোর ওই টোল নামক গর্তটা দেখার জন্য আমাকে অপেক্ষা করে থাকতে হত কখন তুই প্রাণখুলে হাসবি।
মাথার চুলগুলো তো কখনো একটু যত্নসহকারে আচড়াস না।বানিয়ে রাখিস কাক পক্ষীর বাসা।তোর এমন এলোমেলো থাকাটা কিন্তু ভালো লাগে আমার কাছে।অদ্ভুত না?
ধীরে ধীরে আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম।আমি তোর সবকিছুতেই একটু বেশি খবরদারী করছি।তুই এক কদম পা ফেললেও সেখানে আমি নাক গলাই।যখন মন চায় ধমকাই আবার যখন মন চায় এটা সেটা বলে তোকে হাসানোর চেষ্টা করি,রাগানোর চেষ্টা করি।মাঝেমধ্যে মনে হত আমি কিছুটা ডমিনেটিং টাইপের হয়ে গেছি।উদাহরণ দিতে চাই না।কারণ তুই ইতিমধ্যে অনেক প্রমাণ পেয়ে গেছিস।আমি ভেবেই নিয়েছি যে তুই আমার এবং একমাত্র আমার।
সবকিছু ছাড়িয়ে একসময় অনুভব করলাম তোর প্রতি এতদিন যে মায়ায় আটকে ছিলাম সেটা ভালোবাসাতে পরিণত হয়ে গেছে।এমনও অনেক রাত কেটেছে যখন তোকে নিয়ে হাজারো কাল্পনিক দৃশ্য সাজাতে ব্যস্ত ছিলাম।সেই দৃশ্যে তুই এবং আমি একে অপরের জন্য।সেখানে আমরা পা থেকে মাথা পর্যন্ত সুখী মানুষ।
মনের অনুভূতিগুলো চাপা দিয়ে প্রিয়ার সামনে সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের এক মানুষের রূপ ধরে থাকাটা কত কষ্টের জানিস?আমি সেই কষ্টের ভুক্তভোগী। কি করব বল?এসব তোর সামনে তুলে ধরলে সেটার খুব বাজে প্রভাব পড়ত তোর উপর। হয়তোবা পড়ালেখারও অনেক ক্ষতি হত।সেসব কিছু ভেবেই দমে থাকতাম।তবুও মাঝেমাঝে মুখ ফসকে কিছু কথা বের হয়ে যেত।কখনোসখনো মনের উসকানিতে ব্রেইনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার ভালাবাসার পরিমাণ দেখতে চাইতাম।বুঝাতে চাইতাম তোকে।
বিশ্বাস কর আর পারছি না এভাবে থাকতে।একতরফা ভালোবাসতে গিয়ে ক্লান্ত আমি।আমার পাগলাটে মন তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে আছে।তুই হবি কি আমার?
আমি চাইলেই আমার মনের কথা তোর সামনে সরাসরি বলতে পারতাম।ডায়রী লিখে এত কাহিনী করার তো দরকার ছিল না।সত্যি বলতে আমার মন চাইছিল এমন এক অভিনব কাহিনী করতে।কারণ তোকে ফেইস টু ফেইস কিছু বললে আমার প্রতি তোর অবাক হওয়া ছাড়া কোনো ফিলিংস আসত না।অভ্যাসমতো চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকতিস।তাই নয় কি?
এই যে তুই এখন ডায়রীর লেখাগুলো পড়ছিস তোর ভেতরে কি চলছে?হয়তোবা অনেক ঘৃণা নয়তো আমাকে নিয়ে তোর মনে প্রেমের উদগীরণ।যেকোনো একটা তো হবেই।আমি কিন্তু কল্পনায় দ্বিতীয়টা চিন্তা করেছি।তোর চেহারার অভিব্যক্তি এখন কেমন বলতো?হাসছিস না কাঁদছিস?
ডায়রীর লেখাগুলো পড়লে তুই আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য। আমাকে ভালবাসা ছাড়া থাকতে পারবি না এটা আমার বিশ্বাস। কারণ তোর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি,আমার ভালবাসার রূপ ধারা সব কিছু নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছি।তুই ভাবিস না যে তোকে আমার মায়ায় আটকাতে বা তোকে পটানোর জন্য বিভিন্ন বই খাতা ঘেটে এগুলো লিখেছি। উহু!
প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা বাক্য মনের গহীন থেকে লিখেছি। প্রত্যেকটা অক্ষরে আমার ভালবাসা মাখানো।
ভালোবাসি তোকে নীল!আমার হয়ে যা।প্রমিস করছি নিজের সবটুকু দিয়ে তোকে আগলে রাখব।
ডায়রীটা সম্পূর্ণ পড়ার পর যখন আমার সাথে দেখা হবে তখন খুব শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরিস তো!তাহলেই সব বুঝে নিব।ভাগ্য ভালো হলে তখন আশেপাশে কেউ থাকবে না।
তুই যদি রাজি থাকিস তাহলে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলব। আমার তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে নাকি।আর বেশি দেরি করলে চুল দাড়িতে পাক ধরবে।হাহাহা।তখন তো বলবি তোর জামাই বুড়া।
তোর কি ডায়রী আরো পড়তে ইচ্ছে করছে?কিন্তু দুঃখের সহিত জানানো যাচ্ছে যে তুষারের মনের সব কথা তাঁর প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে লেখা হয়ে গেছে।তাই তুই আর কোনো লেখা খুঁজে পাবি না। যা ভাগ্ এখন! ”
.
ডায়রীটা বন্ধ করে চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে এলাম বারান্দায়। আকাশটা ভীষণ মেঘলা লাগছে।জোরালো বৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ।আবহাওয়া কেমন থম মেরে আছে।আকাশের বুক চিরে কালো মেঘের ভেলা নজরে আসছে।আচ্ছা এখন কি আকাশের মন খারাপ?বিকেলে যে আমার মনে বিষন্নতার ছায়া ছিল সেটা কি আকাশ নিজের কাছে নিয়ে গেছে?কারণ আমার মন তো এখন সাংঘাতিক ভালো।আকাশ আর আমার মধ্যে মন খারাপ জিনিসটা অদলবদল হয়ে গেছে।হবেই তো।আকাশ তো নীল।আর আমিও যে নীল আশা।মিল তো আছেই।
চলবে….