মন গহীনে,পর্ব-২৪,২৫
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৪
” সেদিন তোর অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করেই বুঝে গেছিলাম যে তুই ডায়রী পড়ে ফেলেছিস।”
তুষার ভাইয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।একটু না।অনেক বেশি। উনার কোনো কথায় বা ব্যবহারে তো ক্ষণিকের জন্যও বুঝতে পারিনি সেটা।আমি কি এত বড়ই গাধী মানব?
” আমি জানি এই মুহূর্তে তোর মনে অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে।সমস্যা নেই।আমি ধীরে ধীরে সব ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। ”
” বলুন!আমি আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না।”
তুষার ভাইয়া মৃদু হেসে কফির কাপে চুমুক দিলেন।কপালে উড়ে আসা চুলগুলোর উপর হাত চালিয়ে বলতে লাগলেন,
” যখনই বুঝতে পেরেছি তুই ডায়রী খুলেছিস তখনি আমি সাবধান হয়ে গেছি।আমি সেটা বুঝতে দেই নি তোকে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমার নীল কি কি করতে পারে।মনে মনে চেয়েছিলাম তুই তোর সবটুকু দিয়ে আমার প্রেমে পড়।এতই বেশি প্রেম জাগোক তোর মনে যে প্রতি মুহূর্তে আমার কথা ভেবে তুই উতলা হয়ে থাকিস।তোর ধ্যানে জ্ঞানে শুধু আমিই থাকতে চেয়েছি।তাই ভাবলাম তোকে কিছুটা ইগনোর করি।যাতে মিস করার ব্যাপারটা ভালোভাবে তুই অনুভব করতে পারিস। এজন্যই সেদিন তোর সাথে দেখা না করে চলে গেছিলাম।আমি চেয়েছি আমার প্রতি তোর ভালোবাসা তীব্র হোক।”
উনার কথা শুনে মুখ গোমড়া হয়ে গেল আমার।উনি ইচ্ছে করে তাহলে এমনটা করেছে।আর এদিকে আমার যে করুণ অবস্থা হয়েছিল তা তো আর জানেন না।
” বাহ্! ভালোই তো।আমাকে কষ্টে রেখে আপনি আনন্দেই ছিলেন।”
” কে বলেছে আনন্দে ছিলাম?আমি সারাক্ষণ ফুরফুরা মেজাজে থাকি বলে ভাবিস যে আমার কোনো খারাপ লাগা নেই তাই তো?তোর এই কয়েকদিনেই এমন অবস্থা আর আমি যে তিনটে বছর কাটিয়েছি। সবসময় অপেক্ষা করে থাকতাম কবে তোর মুখ থেকে ‘ভালবাসি’ শব্দটা শুনব।মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে হত তোর এই স্নিগ্ধ চেহারা একটু ছুঁয়ে দেখি,তোর চুলের শ্যাম্পুর গন্ধের মাদকতায় ডুবে যাই,তোর হাত ধরে নির্জন রাস্তায় হেঁটে বেড়াই।কিন্তু কিছুই করা হত না।মনের বাসনা গুলোকে চাপা দিয়ে রাখতাম।অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটল নীল!”
আমি মুগ্ধ হয়ে তুষার ভাইয়ার কথা শুনছিলাম।উনি থেমে যেতেই চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ফেললাম।
তুষার ভাইয়া উনার হাতের ভাঁজে আমার হাত আবদ্ধ করে বললেন,
” তোকে সারাজীবন আমার পাশে চাই।এই হাত জোড়া যেন কখনো আলাদা না হয় নীল!”
” হবে না।!”
তুষার ভাইয়া তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
.
বাসার মেইনডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।রেস্টুরেন্ট থেকে চলে এসেছি অনেকক্ষণ আগেই।তুষার ভাইয়া আমাকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে পাঁচ তলায় উঠে গেছেন।
তখন থেকে আমি এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।
কিভাবে যাব মা’য়ের সামনে!মা তো সব জানে।এতদিন তুষার ভাইয়ার কথা ভেবে যে উদ্ভট কাজগুলো করে বেড়িয়েছি তার কারণও নিশ্চয়ই মা জানত।
কি লজ্জা! কি লজ্জা!
হঠাৎ করেই দরজা খুলে গেল।মা বেরিয়ে আসলেন।আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
মা অবাক হয়ে বলল,
” কিরে এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস যে?কলিংবেল না চাপলে আমি বুঝব কি করে।দিন দিন এই মেয়ে বড় না হয়ে ছোট হচ্ছে কে জানে। আবারো দাঁড়িয়ে আছে!যা ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হ।আমি তোর ফুপির বাসায় যাচ্ছি।”
ঝটপট চলে এলাম রুমে।নিজের মা’য়ের সামনেও এখন অস্বস্তি বোধ হয়।এর চেয়ে কষ্ট আর আছে?
_______________________
ঘড়িতে সকাল দশটা।
আজ শুক্রবার হওয়ায় ব্রেকফাস্ট করার সময় বাবার সাথে ইচ্ছেমত আড্ডা দিয়ে এখন ড্রয়িংরুমে বসে মোবাইল স্ক্রল করছি।আমার নিজের ব্যক্তিগত একটা মোবাইল আছে এটা ভাবলেই কেমন বড় বড় ফিলিংস আসে।এখন তাহলে আমি আর ছোট নেই।
আজ ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুক একাউন্ট খুলেছি।ধীরে ধীরে হোয়্যাটসঅ্যাপ,ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট সবই খুলব।আমি হলাম মর্ডাণ যুগের মেয়ে।সবকিছুর সাথেই সম্পর্ক রাখতে হবে।আপাতত মনের সুখে ফেসবুক চালানো যাক।
আমার মনের সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।কেউ একজন ডোরবেল দিচ্ছে। মেজাজ খারাপ হওয়ার মত অবস্থা। একটু আরাম করে বসলাম সোফায় আর এখনই কারো আসার সময় হলো?
মনে মনে চাইছি মা এসে দরজাটা খুলুক।উৎসুক চোখে ভেতরের রুমের দিকে তাকিয়ে আছি।নাহ্ মা বের হচ্ছে না।তাই হালকা চিল্লিয়ে বললাম,
” কে যেন এসেছে মা।একটু দরজাটা খুলো না!”
রান্নাঘর থেকে মা’য়ের ঝাঁজালো গলার উত্তর আসলো,
” কেনো রে?তুই তো ড্রয়িংরুমেই বসে আছিস।উঠে গিয়ে খুলতে পারছিস না?অলস মেয়ে কোথাকার।দেখ গিয়ে তোর থেকে বয়সে ছোট তিন্নি মেয়েটা তাঁর মা’য়ের সাথে কত কাজ করে।ওর মা’য়ের কিছুই করা লাগে না।রান্না থেকে শুরু করে ঘর মোছা সব নিজের হাতে করে।আর তুই?সারাদিন এ রুম থেকে সে রুম হৈ হৈ করে ঘুরে বেড়াস।কাজের কথা বললেই মুখ অন্ধকার করে ফেলিস।আর এখন তো মোবাইল হাতে পেয়েছিস।তোকে আর পায় কে।”
মা’য়ের বকুনি শুনে আমার মাথা ঘুরতে লাগল।একি কান্ড!সামান্য দরজা খোলা নিয়ে এত বড় বক্তৃতা দেবে এটা জানলে ভুলেও বলতাম না।জীবনটাই বেদনার।
তৃতীয়বারের মত কলিংবেল বাজতে তড়িঘড়ি করে উঠে গেলাম।দরজা খুলে সামনের মানুষ গুলোকে হতভম্ব আমি।
দরজার সামনে একজন নয়।চার চারটে মানুষ দাঁড়ানো।আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ফুপি।উনার পেছনে ষাটোর্ধ্ব একজন লোক যাকে আমি আগে একবার দেখেছি।লোকটার পাশে মাঝবয়েসী এক মহিলা।সবার পেছনের মানুষটাকে দেখে চূড়ান্ত পর্যায়ের হতভম্ব আমি।ইয়াসির ভাইয়া!
ফুপি বলল,
” নীলাশা তোর মা বাসায় আছে তো?”
আমি নিচু গলায় জবাব দিলাম,
” জ্বি ফুপি।”
ফুপি এবার তাঁর দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকল।আমি শুধু দেখেই যাচ্ছি। ইয়াসির ভাইয়া উনার বাবা মা’কে নিয়ে কেনো আসলো?
ইয়াসির ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তে উনি আমার দিকে হাসি ছুড়লেন।আমিও বোকার মত একটু হাসলাম।
বহু মাস পর উনাকে দেখলাম।গায়ে ফিটফাট পোশাক।আগের থেকে বেশ সুন্দর হয়েছেন।গাল মুখ পুরো হয়েছে।স্টাইল করে চুল দাড়ি কাটা।গায়ের রঙ টাও বোধ হয় উজ্জ্বল হয়েছে।
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছি এসব হচ্ছে টা কি?
ফুপি উনাদের উদ্দেশ্য হাসিমুখ করে বলল,
” আপনারা বসুন এখানে।আমি আসছি।”
ফুপি আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ভেতরের রুমে নিয়ে যেতে লাগল।কপট ধমকের সুরে বলল,
” এসব কি শার্ট প্লালাজ্জো পড়ে ঘুরে বেড়াস হুম?যেকোনো সময় যে কেউ চলে আসতে পারে তাই না?”
ফুপির কথায় মাথা দুলালাম।যদিও কথাটা আমার পছন্দ হয় নি।আমি যেটা পড়ে কম্ফোর্ট পাই সেটাই তো পড়ব তাই না!আর আমি যেসব পোশাক পড়ি সেগুলো যথেষ্ট শালীনতার ভেতরেই থাকে।কিন্তু এখন এসব নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার সময় নয়।ওই লোকগুলো আমার বাসায় হাজির হয়েছে কেনো সেটাই জানতে হবে।
ফুপিকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি রান্নাঘরে মা’য়ের কাছে চলে গেলেন।ভালোই ঝামেলায় পড়লাম দেখি।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবনা চিন্তা করার পর রান্নাঘরে উঁকি দিলাম।আমাকে দেখে ফুপি স্নেহমাখা কন্ঠে বলল,
” তুই এই শার্ট পাল্টে সুন্দর দেখে একটা জামা পড়তো মা।ওই যে তোর একটা বেগুনি কালারের জামা আছে না?সেটা পড়।দারুণ মানায় তোকে ওই জামাটায়।”
ফুপির কথা শুনে আরেক দফায় হতভম্ব হলাম।গতকাল ছিল আমার অবাক হওয়ার দিন।আর আজ হতভম্ব হওয়ার দিন।বিনা কারণে জামা পাল্টাতে যাব কেনো।
” আমরা কোথাও যাব নাকি ফুপি?ঘুরতে যাব?নাকি কোথাও বেড়াতে যাব?”
” তুই আগে জামা চেঞ্জ করে আয় তারপর বলছি।”
মুখ কালো হয়ে গেল আমার।প্রশ্ন করার সাথে সাথে উত্তর না পেলে আমার অস্থির লাগে।
রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় একবার মা’য়ের দিকে তাকালাম।মা’য়ের কপালে চিন্তার রেখা। আসলে হচ্ছে টা কি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
রুমে এসে দরজা লক করে বেডে শুয়ে পড়লাম।কোথায় ভাবলাম আজ সারাদিন পায়ের উপর পা তুলে শুধু আয়েশ করব।সেটা মনে হয় আর সম্ভব না।প্রচন্ড অলসতা লাগছে।উঠে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করার মুড নেই এক ফোঁটাও।চুলোয় যাক সব।আমি শুয়েই থাকব।
মোবাইলে টুং করে শব্দ হতেই চোখ খুললাম।লক খুলে দেখি তুষার ভাইয়ার মেসেজ।খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম।ফুপি আসার মিনিট খানেক আগেই তো উনাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম।এরমধ্যে একসেপ্ট করে ফেলেছে আবার মেসেজও করেছে।বাহ্!
কিন্তু মেসেজ দেখে আমার খুশি ভাবটা নিমিষেই চলে গেল।উনি লিখেছেন,
” কিরে এফবি আইডিও খুলে ফেলেছিস দেখি।ঠিক আছে সমস্যা নেই। তবে প্রোফাইল পিকচার কভার পিকচারে আবার নিজের ঢং করে তোলা পিক দিবি না।মানে তোর কোনো ছবিই দিবি না।মনে থাকে যেন।”
এমন হুমকি দেওয়া মেসেজ দেখলে মন খারাপ হওয়ার কথা না?আজব লোক একটা।ভার্চুয়াল জগতে উনার সাথে এটাই প্রথম মেসেজ।সেটাও শুরু হলো হুমকি দিয়ে।ভালোই।
উনার মেসেজের উত্তরে কিছু খুঁজে না পেয়ে আমি ব্যাঙের মাথা ইমুজি দিয়ে দিলাম।?
উনি সাথে সাথেই সিন করেছেন।কি যেন টাইপ করছেন এটা বুঝা যাচ্ছে। বাহ! ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং তো!
” ব্যাঙ তোকে আমি ফ্রাই করে খাওয়াবো।আহাম্মক কোথাকার।”
এবার বেশ হাসি পেল আমার।তাই লিখলাম,
” আহাম্মক হই আর যা-ই হই আপনারই তো!”
মেসেজের পাশেই কিসিং ইমুজি দিয়ে দিলাম।?
কিছুক্ষণ চুপচাপ। উনি সিন করেছেন কিন্তু রিপ্লাই দিচ্ছেন না।প্রায় এক মিনিট পর লিখলেন,
” তোর এমন মেসেজ দেখলে আমি কাজে মন দিতে পারব না।এক্ষুনি মেসেঞ্জার থেকে বের হয়ে যা।আজ বাসায় আসি।তারপর দেখবি কিস তোকে গুলে খাওয়াব।”
কিটকিটিয়ে হেসে উঠলাম আমি।উনাকে বিরক্ত করার একটা ভালো মাধ্যম পাওয়া গেল।যখনই ইচ্ছে হবে কাজে লাগাব।
হঠাৎই দরজায় ঠকঠক শব্দে আমার হুঁশ আসলো।হায় হায়!নিশ্চয়ই ফুপি এসেছে।যদি দেখে আমি এখনো শুয়ে আছি তাহলে ভাববে আমি খুব ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে।
তাড়াতাড়ি মোবাইল রেখে ওয়ারড্রব থেকে জামা বের করে তৈরি হতে লাগলাম।
চলবে…
মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৫
ঝটপট ড্রেস চেঞ্জ করে দরজা খুলে দিলাম।ফুপি হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে পড়লেন।
আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে বললেন,
” শুধু জামা পড়লে হবে?চুলগুলো তো এলেমেলো হয়ে আছে।চিরুনি কই।দে আমায় আমিই আঁচড়ে দেই।”
ফুপির চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।এবার আমার বেশ সন্দেহ হলো।তাই দেরি না করে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” প্লিজ ফুপি আমাকে বলবে যে কেনো তুমি আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেডি করতে চাইছো?”
ফুপি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে চিরুনি খুঁজতে ব্যস্ত।মাথা তুলে বললেন,
” উনারা তোকে দেখতে এসেছে।”
বাজ পরল আমার মাথায়।সেই বাজের আঘাতে আমি পুরো জখম হয়ে গেলাম।এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
ফুপি কি বলছে এসব?উনারা কি তাহলে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছে আমায়?আর ইয়াসির ভাইয়া কিভাবে….
আমার মাথায় গন্ডগোল লেগে গেছে। ইয়াসির ভাইয়াকে কোনো একসময় ভালো লাগত আমার।জাস্ট ভালো লাগা ছিল।এমন অনেককেই তো ভালো লাগত।কিন্তু যখন আমার জীবনে তুষার ভাইয়ার ভালোবাসার আগমন ঘটে তখন তো এসব আমি ভুলে গেছি।আমার মনেই ছিল না ইয়াসির নামে কেউ আছে কিনা।আজ উনাকে দেখে মনে পড়ল একসময় উনি ক্রাশ ছিলেন।
মনের দুঃখ চেপে রাখতে না পেরে কাঁদকাঁদ হয়ে বললাম,
” তুমি পাগল হলে ফুপি?”
ফুপি ভ্রু কুঁচকে বলল,
” কি বললি?”
চেহারা আগের চেয়েও করুণ করে ফুপির দিকে তাকালাম।কিন্তু আমি তো চোখে অন্ধকার দেখছি।সবকিছু কত ভালোভাবে চলছিল। গতকাল রাতেই তো তুষার ভাইয়ার কথা চিন্তা করতে করতে মনে হাজারো সুখের পাখনা মেলে ঘুমাতে গেছিলাম।আর সকাল হতে না হতেই আমার দুর্ভাগ্যের দিন চলে আসলো।আমি কেনো একটু শান্তিতে থাকতে পারি না!
ফুপিকে হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলাম।
” ফুপি আমার এখনো বিয়ের সময় হয় নি ফুপি।তুমি কেনো উনাদের এখানে আনলে?”
” বোকা মেয়ে দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যায়?ইয়াসিরকে তো চিনিস!আমাদের পাশের বিল্ডিংয়েই বাসা।মাসকয়েক হলো বিদেশ থেকে পড়া শেষ করে দেশে ফিরল।ভালো চাকরিও পেয়ে গেছে।ছেলেটা দেখতে শুনতেও তো ভালোই।আসলে ওর মা’য়ের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক আমার।সে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল তোর কথা।আমি বলেছি মেয়ে ছোট এখনো।তো আজ সকালে হুট করেই বাসায় এসে হাজির।তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে এলাম।তুই এত টেনশন করিস না তো!বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না।শুধু দেখে চলে যাবে।”
ফুপি চলে গেলেন রুম থেকে।মুখে একরকম কথা বললেও ফুপির মনে অন্যকিছু চলছে বুঝতে পারছি।উনি হয়তোবা এই ব্যাপারটাতে নিমরাজি আছেন।একটু আগে ইয়াসির ভাইয়াকে নিয়ে যে গুনগাণ গাইলেন সেখান থেকে সব পরিষ্কার বুঝা যায়।
রাগে দুঃখে আমার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।
তখনই মাকে রুমে ঢুকতে দেখে মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো।দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরলাম মাকে।
” ফুপি এসব কি বলছে মা?উনারা নাকি আমায় দেখতে এসেছে?আমার কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না।তুমি ফুপিকে মানা করে উনাদের চলে যেতে বলো।”
” এভাবে কাউকে চলে যেতে বললে কেমন দেখায়? তোর ফুপি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়।এখন উনাকে উল্টাপাল্টা কিছু বললে উনি কষ্ট পাবেন মনে।আর তুই এত চিন্তা করছিস কেনো।মুখচোখের কি হাল বানিয়েছিস।আমি আছি তো।তোকে যা করতে বলা হচ্ছে তুই তা-ই কর।”
মা’য়ের কথা শুনে মাথায় রাগ উঠে গেল।মাকে ছেড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম।আমার অবস্থাটা কি মা বুঝতে পারছে না?আমাকে ফেলে সে পড়ে আছে ফুপিকে নিয়ে।
টলমলে চোখে বললাম,
” তুমিও তাহলে ফুপিকে সাপোর্ট করছো!তুমিও চাও যে উনারা আমাকে দেখু্ক।তুমিও চাও যে ইয়াসির ভাইয়ার সাথে বিয়ে হোক আমার তাই তো?”
” নীলাশা তুই মাথা গরম করছিস বেশি।বিয়ে করতে কে বলেছে তোকে?”
আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে বলে বসলাম,
” আমি তুষার ভাইয়াকে ভালোবাসি মা।একটু নয়।অনেকখানিই ভালোবাসি।বিয়ে করলে একমাত্র উনাকেই করব।হাজারটা ইয়াসির ভাইয়া আমার সামনে এসে দাঁড়ালেও আমি শুধু তুষার ভাইয়াকেই খুঁজব।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলাম আমি।মা’য়ের চেহারার রিয়্যাকশন দেখার জন্যও মাথা তুলছি না।জানি না হঠাৎ কি হলো আমার।মনে এত সাহস কিভাবে এসে গেল যে কথাগুলো আমি বলতে পেরেছি।এখন যা হয় হোক।সত্যি কথাটা বলতে পেরে শান্তি লাগছে মনে।
মা এগিয়ে এসে আমার পাশে বসল।মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল,
” বেশ তো!আমরা তো তোকে জোর করব না কখনো।অন্তত বিয়ের ব্যাপারে।আর ভালোবাসিস এই কথাটা এমন মুখ অন্ধকার করে বলতে হয়? ভালোবাসার কথা প্রকাশ করবি হাস্যোজ্জ্বল মুখে। অপর পাশের মানুষ টাকে কতটা ভালোবাসিস সেটা যেন তোর চোখমুখ ছাপিয়ে ফুটে উঠে।চোখের দিকে তাকালেই যেন সেই মানুষটার প্রতি অগাধ ভালোবাসার পরিমাণ স্পষ্টবুঝা যায়।তা না করে এমন শক্ত হয়ে বলছিস। আমার তো মনে হলো তুই আমাকে হুমকি দিলি! শুধু শুধু কি আর তোকে বোকা বলি?পায়ে ই যা লম্বা হয়েছিস। জ্ঞান বুদ্ধিতে এখনো ছোট।”
মা’য়ের কথা অবাক হয়ে শুনছি আমি।আজ মাকে বড্ড অচেনা লাগছে।আমার মা এত সুন্দর কথা বলতে পারে সেটা জানতাম না।
মা পুনরায় বলল,
” আমার প্রতি বিশ্বাস আছে তো?”
” আছে মা।”
” তাহলে চল।তোর ফুপির সাথে কোনোরকম রাগারাগি করিস না।হাসিমুখে কথা বলবি।উনাদের সাথেও সৌজন্য ব্যবহার করবি।”
” কিন্তু মা তুমি কি করতে চাইছো আমি সেটা বুঝতে পারছি না।প্লিজ খুলে বলো।ওই ইয়াসির ছোকরা টার সামনে সঙ সেজে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
” সঙ সেজে কেনো যাবি।খুব সিম্পল ভাবেই যাবি।”
” উফ মা তুমি আমার সাথে মজা করছো?”
কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই আমরা থেমে গেলাম।নাস্তার প্লেট হাতে ফুপি এসেছে।মুহুর্তেই আমার মলিন মুখটা আরো বিষন্ন হয়ে গেল।বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,
” নিজের ছেলের হবু বউকে অন্যকারো সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।বেঁচে থাকতে যে আরো কত কি দেখতে হবে!”
মা আমাকে আড়ালে হাতে চিমটি কাটল থেমে যাওয়ার জন্য। ফুপি বলল,
” তোমরা এখনো বসে আছো?আয় নীলাশা।এই নাস্তার প্লেটটা হাতে নে। উনারা অপেক্ষা করছেন।কিন্তু তুই এমন পাগলের মত বসে আছিস কেনো।উড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নে।”
অনিচ্ছা সত্ত্বে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলাম।এমন অসহ্যকর ঘটনা বোধ হয় আমার জীবনে আর কখনো আসেনি।
.
ফুপি আমাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেল। সেখানে বাবাকে দেখতে পেলাম ইয়াসির ভাইয়ার বাবা মা’য়ের সাথে কথা বলছে।বাবা আমাকে তাঁর পাশেই বসিয়ে দিলেন।আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে আছি।প্রচন্ড অস্বস্তিতে উড়না বারবার হাতে চেপে ধরছি।
ইয়াসির ভইয়ার মা জিজ্ঞেস করল,
” এবার কোন ক্লাসে পড়ছো মা?”
বিরক্ততে আমার সর্বমুখ ছেয়ে গেল।এখানে আসার আগে নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে এসেছে।তাহলে নতুন করে আমাকে এসব জিজ্ঞেস করার মানে কি?
মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম,
” এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি এবার।”
” খুব ভালো।এবার তো তাহলে ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার পালা।”
মনে মনে মুখ ভেংচিয়ে বললাম,
” না না এবার আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পালা।যতসব আজগুবি প্রশ্ন। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয় এটা তো সবাই জানে।সাধারণ এই কথাটা এমন সিরিয়াস মুড নিয়ে বলছে যা দেখে রীতিমতো গা জ্বলছে আমার।এখন নিশ্চয়ই বলবে ভার্সিটি উঠে যাবে তারমানে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।সেই কথা চিন্তা করেই আজ আমরা হাজির হয়েছি আমাদের খোকাকে নিয়ে।তুমি চোখ বন্ধ করে আমাদের এই প্রতিষ্ঠিত খোকাকে বিয়ে করে ফেল।”
নিজের মনের কথা শুনে দম ফাটানো হাসি আসছে।কি অদ্ভুত আমি! একটু আগেই টেনশনে আমার মর্মর অবস্থা ছিল আর এখন তাঁদের প্রশ্ন শুনে দাঁত কেলিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে।
আরো কিছুক্ষণ ছেলেমানুষী প্রশ্ন উত্তর অদলবদলের পর ইয়াসির ছোকরার বাবা বলে উঠল,
” তোমার কিছু জিজ্ঞেস করার আছে নাকি ইয়াসির।কথা বলো নীলাশার সাথে।”
আমি এবার চোখের কোনা দিয়ে ছোকরার দিকে তাকালাম।উনার মুখে লাজুক হাসি।এমন ভাব যেন উনার সাথে আমার বিয়ে পাকাপাকি হয়ে গেছে।যে ছেলেটা একসময় আমার ক্রাশ ছিল আজ সেই ছেলেটাকে দেখতে কেমন জড়ভরতের মত লাগছে।হাহাহা।
হঠাৎ করে মেইনডোর প্রচন্ড শব্দে খুলে গেল।দরজার পাশে সু কেবিনেটের উপর রাখা ফুলদানিটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়েছিল বোধ হয় ভুমিকম্প চলে এসেছে।আমি সহ ড্রয়িংরুমে উপস্থিত বাকিরাও ভয় পেয়ে গেছে।
তুষার ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন দরজা ধরে।উনার চেহারায় লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।উনি শান্ত দৃষ্টিতে একবার ড্রয়িংরুমের সকলের উপর চোখ বুলিয়ে শেষে আমার উপর থামলেন।আমি কাঁচুমাচু চেহারা নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ফেললাম।তুষার ভাইয়া হঠাৎ করে এখানে হাজির হলো কি জন্য। দেখে তো মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছেন।
আচ্ছা উনি কি কোনোভাবে খবর পেয়েছেন যে ইয়াসির ভাইয়ারা দেখতে এসেছে আমায়?তারমানে মা উনাকে সব জানিয়েছেন। এজন্যই বারবার বলছিল চিন্তা না করতে।ওয়াও! মা’য়ের মাথায় কি বুদ্ধি! যাক এখন আর কোনো দুশ্চিন্তা রইল না।আমার হিরো এসে গেছে।সে সবটা সামলে নেবে।
সকলের অলক্ষ্যে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মা’য়ের দিকে তাকালাম।মা আমার দিকে একটা মিষ্টি হাসি ছুড়ে দিল।
চলবে…