মন গহীনে,পর্ব_১

0
4432

মন গহীনে,পর্ব_১
সামান্তা সিমি

বিকেলের স্তিমিত আলোয় ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। এই সময়টা আমার খুব ভালো লাগে।সূর্যাস্তের সৌন্দর্য দেখার মধ্যে একধরনের আকর্ষণ অনুভব করি।আমি যদি কবি হতে পারতাম তাহলে প্রতিদিন ছাদে বসে কবিতা লিখে হাজারো পাতা ভর্তি করে ফেলতাম। কিন্তু আফসোস আমি তা পারি না।শুধু যে এটাই পারি না তা নয়। অকর্মার ঢেকি নামে যে বাগধারাটা আছে সেটা আমার সাথে পরিপূর্ণ ভাবে মিলে যায়।কিন্তু এসব নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।কারণ আমি বাবা-মা’য়ের একমাত্র মেয়ে নীলাশা।পুরো নাম নীলাশা জান্নাত।এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি।

হঠাৎ পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদের দিকে তাকাতেই মন আনন্দে নেচে উঠল।আমার ক্রাশ ইয়াসির ভাইয়া ফোনে কথা বলছে আর ছাদের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে হেঁটে চলেছে।নীল কালার শার্টে কি সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে।ইস!
পড়ালেখার সূত্রে উনি চীন থাকেন।তাই সবসময় দেখা পাওয়া যায় না।ভ্যাকেশনে যখন এখানে আসে তখনই হুটহাট ছাদে দেখা যায়।আজ কার মুখ দর্শন করে ঘুম থেকে উঠেছিলাম মনে করতে পারছি না।আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না ইয়াসির ভাইয়া আমার সামনে রয়েছে।দিনদুনিয়া ভুলে আমি রেলিঙের সাথে ঘেঁষে তাঁকে দেখার চেষ্টা করছি।
ঠিক তখনই কেউ আমাকে সামনে ঘুরিয়ে গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারল।আচমকা এমন হওয়ায় আমি ব্যালেন্স রাখতে না পেরে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে থাপ্পড়ের চোটে ঘাড় থেকে মাথাটা খুলেই পরে গেছে।চোখ তুলে সামনের মানুষটাকে দেখা মাত্রই আমার অবস্থা প্যারালাইজড্ রোগীর মত হয়ে গেল।মুখ দিয়ে অটোমেটিকলি বেরিয়ে এল,

” তুষার ভাইয়া!”

” থাপড়ে তোর দাঁত ফেলে দেব আমি।ওই ছাদের দিকে তাকিয়ে কি করছিলি?”

তুষার ভাইয়ার গর্জন শুনে আমার মর-মর অবস্থা। উনি কি সব দেখে ফেলেছে!নিশ্চয়ই দেখেছে।উনার রক্তাক্ত চোখের চাহনি তাঁর প্রমাণ।
ইয়াসির ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তেই দেখি সে হা করে আমদেরই দেখছেন।দেখাটাই স্বাভাবিক। তুষার ভাইয়া পুরো ছাদ কাঁপিয়ে যে ধমক দিয়েছেন তা এক মাইল দূর থেকেও শোনা যাবে।

” কিরে কথা বন্ধ কেনো?উত্তর দে।”

আমি মুখ অন্ধকার করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।কি পোড়া কপাল আমার।একেই বলে গোদের উপর বিষফোঁড়া। ক্রাশের সামনে এভাবে অপমানিত হব এটা ভাবিনি কখনো।তুষার ভাইয়া’র এই সময়েই ছাদে আসার দরকার ছিল?
মিনমিন করে বললাম,

” আমি তো ছাদে হাঁটতে এসেছি।আপনি যা ভাবছেন তা নয়।”

” আমি কি ভাবছি সেটা তো তোকে বলিনি।তাহলে জানলি কিভাবে?

ভাইয়া’র কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।এক লাইন বাড়িয়ে বলার কি দরকার ছিল!আস্ত একটা গাধা আমি।
তখনই ইয়াসির ভাইয়ার গলা শুনতে পেলাম।

” কি ব্যাপার তুষার ভাই।কিছু হয়েছে?”

আমি ভয়ে ভয়ে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি যদি আসল কাহিনি বলে দেয় তাহলে আমি এক্ষুনি ছাদ থেকে লাফিয়ে পরব।

” কিছু না ইয়াসির।”

তুষার ভাইয়া আমাকে হাত টেনে অন্য পাশে নিয়ে গেলেন।চোখ রাঙিয়ে বললেন,

” তোকে যদি আমি আর কখনো ছাদে দেখি সেদিনই পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব।যা বাসায় যা!”

লজ্জায় অপমানে আমার কান্না এসে যাচ্ছে। দিনে দিনে তুষার ভাইয়া আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে।আমার সব ব্যাপারে উনি কেনো কথা বলবে!পান থেকে চুন খসলেই মারতে চলে আসে।ইন্টারে পড়া কোনো মেয়ের গায়ে হাত তোলা শোভা পায়?এর আগেও অনেকবার উনার হাতের চড় খেয়েছি।এভাবে মার খেতে থাকলে কিছুদিন পর দেখা যাবে আমার গাল দুটো ঝুলে পরেছে।কি বিশ্রি অবস্থা।মাঝে মাঝে মন চায় কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেই।কিন্তু হায়! সেই সাহস আমার হয়নি কখনো।আর জন্মে হবেও না।



সন্ধ্যায় টেবিলে বসে পড়ছি আর ভাবছি এখন থেকে ইয়াসির ভাইয়ার সাথে যদি রাস্তায় দেখা হয় তাহলে চোখ তুলে তাকাতেই পারব না।ক্রাশের সামনে এমন দুর্দশা হওয়ার থেকে মরে যাওয়া ভালো।সব হয়েছে ওই তুষার ভাইয়া’র জন্য। আটাশ বছরের অমানুষটা আঠারো বছরের একটা পিচ্চি মেয়ের সাথে সবসময় এমন রূঢ় আচরণ কেনো করবে!অসহ্য অসহ্য।
কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম।
হাতে গরম গরম সিঙ্গারা ভর্তি প্লেট নিয়ে মা রুমে ঢুকল।

” ওয়াও মা! এতগুলো সিঙ্গারা আমার জন্য? জলদি দাও।জিভে পানি এসে যাচ্ছে!”

আমার আনন্দকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মা বলে উঠল,

” এগুলো তোর জন্য নয়।তুই পরে খাবি।আগে তুষারকে দিয়ে আয়।ছেলেটা আমার হাতের সিঙ্গারা খেতে খুব পছন্দ করে।”

” আমাকে বলে লাভ নেই মা।তুমিই দিয়ে আসো।”

” সবসময় এমন ত্যাড়ামি করিস কেনো তুই?আমি খেয়াল করেছি তুষারের নাম শুনলেই তোর চেহারার নকশা পাল্টে যায়।এত অপছন্দ করিস কেনো ওকে?”

এই যে শুরু হয়ে গেল মা’য়ের বকুনি। আমি ছাড়া বাকি সবাই মা’য়ের কাছে ভালো।আমি নাকি তুষার ভাইয়াকে অপছন্দ করি!হাহ্!
ওই লোকই তো আমাকে দু চোখে দেখতে পারে না।যখনই দেখা হয় ধমক আর চোখ রাঙানো।

” শুনো মা! তোমার ধারণা ভুল।আমি কেনো শুধু শুধু উনাকে অপছন্দ করব।বরং উনিই আমাকে সহ্য করতে পারে না।সবসময় বকা দেয়।”

” যারা পড়ালেখায় গাধা তাঁদেরকে সবাই বকা দেয়।এটা নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই।”

” মা! তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে! একটা মাত্র মেয়ে তোমার! সবাই কি পড়ালেখায় ভালো হয়?”

” বুঝলাম।এখন তাড়াতাড়ি যা।সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো!”

মা রুম থেকে চলে গেল।
পড়ালেখা নিয়ে ডেইলি ডেইলি বকা শুনে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।আমার বইয়ের পড়া পড়তে ভালো লাগে না।তবে গল্পের বই,উপন্যাস পড়ার প্রতি আকর্ষণ বেশি।আর এগুলো নিয়েই মা’য়ের বকুনি খাই।

গায়ে উড়না জড়িয়ে প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।আমরা থাকি চার তলায় আর তুষার ভাইয়া’রা থাকেন পাঁচ তলায়।উনি আমার দুঃসম্পর্কের ফুপির ছেলে।তবে কাছাকাছি থাকায় তাঁদের সাথে আমাদের বেশ ভালো সম্পর্ক।প্রতিদিন বিভিন্ন কারণে একে অপরের বাসায় আসা-যাওয়া লেগেই থাকে।মাত্র তিনবছর হলো আমরা এই ফ্ল্যাটে উঠেছি।এর আগে তাদের চিনতামই না।প্রথম প্রথম তুষার ভাইয়া আমার সাথে ভালো করে কথা বললেও কিছুদিন পর থেকেই পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।আমাকে দেখলেই উনি কেমন যেন মুখ কালো করে ফেলেন।কারণে -অকারণে বকা দেওয়া,ধমক দেওয়া তো আছেই।

বেল টিপতেই তুষ্টি আপু দরজা খুলল।উনি তুষার ভাইয়ার’র ছোট বোন।আপুকে দেখা মাত্রই মনটা ভালো হয়ে গেল।তাঁর মত মিষ্টি মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি।আপু এবার মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।আপু খুব পড়োয়া ছাত্রী।তবে তুষার ভাইয়া আরো ব্রিলিয়ান্ট।স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি সব জায়গাতেই মুটামুটি টপে ছিলেন।ভাইয়ার পড়া দু’বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে।উনি এখন ফুপার অফিসেই বসেন।কয়েকমাস পর ফুপা ছেলের হাতে দায়িত্ব দিয়ে ঘরে বসে আয়েশ করবেন।আব্বু থেকে শুনেছি ভাইয়া নাকি দেশের বাইরে যেতে চাইছিলেন।সব ব্যবস্থা প্রায় হয়ে গেছিল।কিন্তু উনার বাবা-মা কেউই রাজি ছিলেন না। তাই আর যাওয়া হয় নি।

ভেতরে ঢুকতেই আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” ফুপি কি বাসায় নেই আপু?”

” না’রে।আম্মু একটু শপিংয়ে গেছে।তুই কি ভাইয়ার জন্য সিঙ্গারা এনেছিস?তাহলে তাড়াতাড়ি দিয়ে আয়।ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার খাবে না।আমার না কাল থেকে পরীক্ষা শুরু।টেনশনে মাথা ঘুরছে।নাহলে তোর সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতাম বনু।”

আমি কিছু বলার আগেই আপু নিজের রুমে চলে গেলেন।উফ্!
তুষার ভাইয়ার রুমে যেতে আমার একটুও ভালো লাগে না।ওখানে গেলে মনে হয় চারদিকে অক্সিজেনের অভাব।শ্বাস নিতে কষ্ট হয় আমার।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম ভাইয়ার রুমের দিকে।ফুপিদের ফ্ল্যাটটা বেশ বড়সড়। ভেতরে অনেকগুলো রুম। প্রত্যকেটা জিনিস একদম ঝকঝকে তকতকে।
আমাদের ফ্ল্যাটটাও সুন্দর তবে এত বড় নয়।
রুমের সামনে যেতেই দেখি ভাইয়া কার সাথে যেন ফোনে হেসে হেসে কথা বলছে।আমি তৎক্ষনাৎ দরজার বাইরে কোনায় লুকিয়ে পরলাম।ফোনে কি বলছে সেটা শোনার চেষ্টা করলাম কিন্তু শোনা যাচ্ছে না।এত আস্তে কথা বলে কেন?আমাকে ধমক দেওয়ার সময় তো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে।
আমি আগে থেকেই সন্দেহ করেছিলাম ভাইয়ার প্রেমিকা আছে।থাকবে না কেনো।এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে তার উপর এত শিক্ষিত।

” লুকিয়ে লুকিয়ে কারো কথা শোনার মত বদভ্যাস তোর আছে সেটা জানতাম না।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে চমকে উঠলাম।আমি যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি তা তিনি খেয়াল করেছে।কিন্তু আমি তো একটুও বুঝতে পারলাম না।উনার তো দেখি জহুরির চোখ।
কোনো উত্তর না দিয়ে উনার সামনে প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে পরলাম।

” মা আপনার জন্য পাঠিয়েছে। ”

উনি ফোন টিপতে টিপতে বললেন,
” ওই টেবিলটার উপর রেখে দে।”

আমি মুখ কালো করে ফেললাম।এত কষ্ট করে নিয়ে এসেছি আর উনি একটা ধন্যবাদও দিল না।আজব লোক তো!

” আচ্ছা ভাইয়া! আপনি আমার সাথে একটু সুন্দর করে কথা বললে কি হয়! এমন মনে হয় যেন আমাকে দেখলেই আপনার মুখে রাজ্যের বিরক্তি এসে ভীড় করে।আর একটু হাসি-খুশি থাকতে পারেন না?জানেন তো হাসলে মন মেজাজ দুটোই ভালো থাকে”

তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
” তোর মত পিচ্চি এখন আমাকে জ্ঞান দিবে আর আমি সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনবো? যা বেরিয়ে যা এখান থেকে।বিকেলের ঘটনা কিন্তু এখনো ভুলিনি।শাস্তি তোলা থাকল।”

” ভাইয়া আপনি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছেন।একটা সামান্য ঘটনা’কে টেনে টেনে এত লম্বা করছেন কেনো?”

তুষার ভাইয়া হাতের ফোন বেডে ছুড়ে ফেলে আমার দিকে তেড়ে আসলেন।

” সামান্য ঘটনা?আমাকে তুই শেখাচ্ছিস কোনটা সামান্য আর কোনটা অসামান্য? নিজের জিনিসের প্রতি খেয়াল রাখতে একবিন্দুও ছাড় দিব না আমি।আর তুই যেরকম উড়ো উড়ো করছিস তাতে কিন্তু খুব পস্তাবি। সাবধান হো।ফারদিন তুষার’কে চিনতে এখনো অনেক সময় লাগবে তোর।”

ভাইয়া কি বলছে এগুলো? আমি তো এর অর্থোদ্ধার করতে পারছি না।আমাকে সাবধান হতে বলছে কেনো?আর নিজের জিনিসের প্রতি সবারই খেয়াল থাকে।এটা এত ঘটা করে আমাকে বলার কি দরকার।

” দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?যা এখন।”

আমি দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম।ভাবছি উনি এখনো বিকেলের কাহিনি নিয়ে পরে আছেন।খুব ভয় করছে।যদি মা’য়ের কানে এই খবর যায় তাহলে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে।এই তুষার নামক যন্ত্রণা তো আমার জীবন তেজপাতা করে ছাড়বে।উনার জন্য কি নিজের ক্রাশকেও দেখতে পারব না?নিজে তো ঠিকই প্রেম করে তাহলে আমার বেলায় এত খুঁত ধরতে আসে কেনো!আর আমি তো প্রেমও করিনি।শুধুমাত্র ক্রাশকে দেখার জন্য আকুপাকু করি।তাতেই উনি বাগড়া দিতে চলে আসেন।স্বার্থপর লোক একটা!

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here