মন গহীনে,পর্ব_১০,১১,১২,১৩

0
2571

মন গহীনে,পর্ব_১০,১১,১২,১৩
সামান্তা_সিমি
পর্ব_১০

সাদনান ভাইয়া উশখুশ করছেন।মনে হচ্ছে ভয়াবহ কিছু ঘোষণা করতে চলেছেন।উনার বোধ হয় কথা পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না।একটু পরপর চারদিকে নজর বুলিয়ে আমার দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন।উনার চেহারার হাল দেখে আমার নিজেরই বাঁধভাঙা হাসি আসছে।কিন্তু হাসা যাবে না।সাদনান ভাইয়া এখন একটা কিছু নিয়ে সিরিয়াস মুডে আছে।হাসা মানেই বেয়াদপি।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই সিড়ির গোড়ায় কয়েকজন মহিলার কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া গেল।এবার আমি নিজেও ছটফট করতে লাগলাম।কেউ যদি এসে দেখে আমি সাদনান ভাইয়ার সাথে একা ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলছি তাহলে তিল থেকে তাল, তাল থেকে আরো বহু কিছু বানিয়ে ফেলবে।এই ক্ষেত্রে পাশের বাসার আন্টিদের তো জবাব নেই।

সাদনান ভাইয়া অতি ব্যস্ততার সহিত বললেন,

” আচ্ছা নীলাশা তুমি আজ যাও।আমারো একটু তাড়া আছে।বায়।”

হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে ভাইয়া অপর পাশের সিড়ির দরজার দিকে চলে গেল।আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে পা চালালাম।সিড়ির কাছে আসতেই দেখি আমার ভাবনা সত্যি। মহিলাগুলো এই বিল্ডিংয়েরই।আমাকে দেখে উনারা পড়ালেখার হালচাল জিজ্ঞেস করল।কোনোরকমে উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম।আজকে জোর বাঁচা বেঁচে গেছি।

___________________________

কেটে গেল আরো কতগুলো দিন।
দুপুরে ড্রয়িংরুমে বসে ভাত খাচ্ছি আর টিভি দেখছি।আজ সকাল থেকেই বিল্ডিংয়ে বেশ হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। এর কারণটা খুঁজে পাচ্ছি না।শেষমেষ মায়ের থেকে জানতে পারলাম আজ ৩১ ডিসেম্বর। সেই উপলক্ষে ছাদে হ্যাপি নিউ ইয়ারের পার্টি আয়োজন করেছে।পড়ালেখা নিয়ে আমার দিনগুলো যে কিভাবে কাটছে তার প্রমাণ আজ হাতানাতে পেলাম।বছরের শেষ দিন আজ।অথচ আমার তারিখটাই মনে নেই।

পার্টিতে নাকি প্রধান দায়িত্বে আছে এই বিল্ডিংয়ের ছেলেপুলেরা। যেহেতু পুরো বিল্ডিংয়ে তুষার ভাইয়া এবং সাদনান ভাইয়া সব ছেলেদের থেকে সিনিয়র তাই মূলত উনারাই সবকিছুর তদারকি করছেন।
তুষার ভাইয়া তো সকালে পড়াতে এসেছিলেন।তখন তো পার্টি নিয়ে কিছু বলেন নি।এহ্! কি ঢং।
আমাকে বললে কি এমন হত।
ভাত খাওয়া শেষে মেইনডোর খুলে করিডোরে গেলাম।তখনই পাশের ফ্ল্যাটের অভির সাথে দেখা।বিচ্ছু ছেলেটা এবার সিক্সে পড়ে।আমাকে দেখতে পেয়েই বলে উঠল,

” নীলাশা আপু! আজ কিন্তু খুব জাঁকজমক একটা পার্টি হবে।সাথে হেব্বি খানাপিনা।আর অনেক বাজিও ফাটাবে। তুমি যাবে তো!”

অসহায় মুখ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।পার্টি উপলক্ষে ওদের মনে কত আনন্দ। একমাত্র আমিই বোধ হয় নিরানন্দে আছি।কবে যে পরীক্ষাটা দিয়ে মুক্ত হব।এত পড়ালেখা আর ভালো লাগছে না।একবার পরীক্ষাটা দিয়ে নেই তারপর আমি খাঁচা ভেঙে ছাড়া পাওয়া পাখির মত উড়ে বেড়াব।ভার্সিটি উঠলে তো কিছুটা স্বাধীনতা পাব।তখন তুষার ভাইয়ার ওইসব ধমক,চোখ রাঙানো কিছুই পাত্তা দিব।ভার্সিটি উঠা মানেই তো শুধু চিল আর চিল।আহা!

অভির মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললাম,
” আমার একটা রাগী স্যার আছে জানিস! পড়া না পারলে এত জোরে মারে যে তিন চারদিন পর্যন্ত ব্যথা থাকে।ওই স্যারের পড়া যদি শেষ করতে পারি তাহলেই আমি পার্টিতে যেতে পারব। নাহলে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতে হবে।তোরা বাজি ফাটাবি আর আমি জানালা দিয়ে হা করে সেই বাজির ঝলকানি দেখব।”

অভি ঠোঁট উল্টে বলল,
” তোমার স্যার তো দেখি খুবই ভয়ানক।কই আমার স্যার তো এত জোরে মারে না।খুব আদর করে আমায়।”

” সবার স্যার কি আর তোর স্যারের মত! আমার স্যারের মত নির্দয় মনের মানুষ খুব নগন্য।উনার শাসনে বইয়ের পড়া পড়তে পড়তে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ”

কথাটা বলে অভির দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার পিছনে চোখ বড় বড় করে কিছু একটা দেখছে।কিছু বুঝে উঠার আগেই সে ডেকে উঠল,

” হ্যালো তুষার ভাইয়া।!

পিছনে ফিরতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। তুষার ভাইয়া লিফট থেকে নেমে কখন যে এখানে দাঁড়িয়েছে তা আমার খেয়ালই নেই।আমি তো আশ মিটিয়ে মনের দুঃখ কষ্ট অভির সাথে শেয়ার করতে ব্যস্ত ছিলাম।

তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে অভিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” অভি তুমি এখন ঘরে যাও।রাতে ছাদে দেখা হবে।”

অভি সুড়সুড় করে চলে গেল।এদিকে ভয়ে আমি অস্থির হয়ে আছি।উনি যদি ওইসময়ের কথাগুলো শুনে থাকে তাহলে!

” তোর কি পরিমাণ সাহস! একটা বাচ্চার কাছে আমার নামে কুট কাচালি করছিস?এত শয়তানি বুদ্ধি তোর পেটে?বাচ্চাদের চোখে আমাকে ভয়ংকর বানিয়ে দিচ্ছিস!”

যা ভেবেছি তাই।তুষার ভাইয়া সব কথা শুনে নিয়েছে।মনের কষ্ট গুলোও কারো সাথে ভাগাভাগি করার অবকাশ পাব না আমি।
আর আমি ভুল কি বলেছি?
উনি ভয়ংকর এটা তো সত্যি কথা!বাচ্চাদেরও জানা উচিত তাঁরা যে সারাক্ষণ তুষার ভাই,তুষার আঙ্কেল বলে চেঁচায় তাদের সেই প্রাণপ্রিয় মানুষ আমার সাথে কি নিষ্ঠুর ব্যবহার করে।

আমাকে চুপচাপ দেখে তুষার ভাইয়া বলল,
” এখন ভেজা বেড়াল হয়ে গেছিস তাই না?মুখে কোনো রা নেই।চল ঘরে চল।দুপুর টাইমে বাইরে কি করছিস!তোকে পড়িয়ে চলে যাব।বিকেলে আমার কাজ আছে।”



পড়ার টেবিলে একে একে সব হোমওয়ার্ক তুষার ভাইয়াকে দিলাম। এখন আর উনাকে মারার চান্স দেই না।কাঠের স্কেল সামনেই পড়ে থাকে।কিন্তু উনি মারার সুযোগই পান না।কি করে মারবে! সব পড়া তো আমি কমপ্লিট করে রাখি।

পড়ানো শেষ হতেই তুষার ভাইয়া বলল,
” শোন! রাতে একা ছাদে যাবি না।মামীর সাথে যাবি।নয়ত আমি তুষ্টিকে পাঠাব।বিল্ডিংয়ের সব ছেলেরা আজ ছাদে থাকবে।তাই আগেই বলে রাখি আমি যদি উনিশ-বিশ কিছু দেখি তাহলে তোকে ঘরে এনে তালা মেরে ফেলে রাখব।আমার নজর কিন্তু তোর উপরই থাকবে।”

আমি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়লাম।
চেয়ার উঠতে যেতেই আবার বসে পড়লেন তিনি।আমার গাল টেনে বলে উঠল,

” বড্ড আদুরে তুই!”

ভাইয়ার কথা শুনে মুচকি হাসলাম।তাকিয়ে দেখি উনার ঠোঁটেও বাঁকা হাসির ঝিলিক।হাসিমুখে থাকলে উনাকে কতই না সুন্দর লাগে।
হঠাৎ করেই কেনো জানি খুব লজ্জা লাগছে।তাই মাথা নামিয়ে নিলাম।উনিও আর কিছু না বলে চলে গেল।

_______________________

রুমে থেকেই শুনতে পাচ্ছি সাউন বক্সের উচ্চ আওয়াজ যেখানে বিভিন্ন হিন্দি রিমিক্স গান বাজছে।আমার আর ঘরে বসে থাকতে মন চাইছে না।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে দশটা বাজে।বিল্ডিংয়ের সবাই মনে হয় এতক্ষণে ছাদে জটলা পাকিয়েছে। শুধুমাত্র আমিই কাঁচুমাচু মুখে একবার মায়ের কাছে যাচ্ছি আরেকবার মেইনডোরের দিকে দেখছি।মা’কে কখন থেকে খুচাচ্ছি ছাদে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মা’য়ের নাকি সাউন্ড বক্সের শব্দে মাথা ধরে যায়।এদিকে তুষ্টি আপুরও কোনো পাত্তা নেই।ধুর এবার আমি একাই চলে যাব।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তুষ্টি আপুর দেখা মিলল।আপুর গায়ে হালকা নীল কালারের থ্রি-পিস। আমি লক্ষ্য করেছি আপু যখন যা-ই পড়ুক এত মিষ্টি লাগে!ইস! আপু কত্ত কিউট।

ছাদে পৌঁছাতেই হরেকরকম লাইটের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল।চারদিকে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এতবড় ছাদ অথচ কত হিজিবিজি লাগছে।
যার কারণে শীতের রাতের ঠান্ডা কাউকেই কাবু করতে পারছে না।আনাচকানাচে বাচ্চারা যে যেভাবে পারছে গানের সাথে হাত-পা মেলানোর চেষ্টা করছে।
বাহ! কি উৎসবমুখর পরিবেশ।নিমিষেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল।
এত ভিড়ের মাঝেও একজনের দিকে ঠিকই নজর পড়েছে আমার।যার পড়নে কালো ট্রাউজার্স, গায়ে হোয়াইট টি-শার্ট, তারউপর ব্রাউন কালারের জ্যাকেট।হ্যাঁ।উনি আমাদের তুষার ভাইয়া।
ছাদে উপস্থিত সকল ছেলেপুলেদের মধ্যে উনার হাঁটার মুভমেন্ট, কথাবলার স্টাইল সবকিছু আলাদা।যার কারণে অনায়াসেই চোখটা বারবার উনার দিকে চলে যাচ্ছে। আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো একঝাঁক মেয়ের দল।ওদের চোখ অনুসরণ করে দেখি ওরা আপাতত তুষার ভাইয়াকে নিয়েই কথা বলছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।কিন্তু উনার তো সেদিকে খেয়ালও নেই।নাকি সব দেখেও না দেখার ভান করছে কে জানে।বাহ্! উনি তো দেখি রীতিমতো এই বিল্ডিংয়ের সেলিব্রিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চলবে….

মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_১১

ঘড়িতে বাজছে রাত এগারোটা ত্রিশ।সবাই উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে নতুন বছরের জন্য।
ছাদের কোলাহল দ্বিগুন হয়ে উঠেছে।আমাদের বিল্ডিংয়ের আশেপাশে আরো কয়েকটা বিল্ডিংয়েও পার্টি হচ্ছে। ওইসব ছাদেও একই দৃশ্য। মোটকথা চারদিকের হট্টগোলে মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম।
আমি আর তুষ্টি আপু ছাদের এককোনায় দুটো চেয়ারে বসে গল্প করছি।গল্পের মুখ্য বিষয় তুষার ভাইয়া এবং তুষার ভাইয়া প্রেম।
একটু আগে হঠাৎ করেই তুষ্টি আপুকে তুষার ভাইয়ার প্রেমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম।জানি না কেন হুট করে প্রশ্নটা মাথায় আসল।
তুষ্টি আপু কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,

” ভাইয়া আর আমার মধ্যে সম্পর্কটা খুব সহজ স্বাভাবিক। দুজনেই দুজনের গোপনীয় কথাবার্তা একে অপরের সাথে শেয়ার করি।সেই কারণেই ওর প্রেম নিয়ে অল্প কিছুটা জানি।তিনবছর আগে ভাইয়ার একটা মেয়ের সাথে রিলেশন ছিল।আমি সরাসরি কখনো দেখিনি।ওর মোবাইলে ছবি দেখেছি।দেখতে আহামরি কিছু ছিল না।তবে খারাপও বলা যায় না।আমি তো ভেবে নিয়েছিলাম ওই মেয়েই আমার ভাবী হবে।ওরা মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে, পার্কে মিট করত। এগুলা সব আমাকে বলত বাসায় এসে।কিন্তু হঠাৎ করেই ভাইয়া অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গেল।আর এটা আমি সহজেই উপলব্ধি করেছি।ভাইয়া ওর প্রেম সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করল।কিছু বলতে চাইত না।তাই আমিও আর জোর করতাম না।আমার যতটুকু মনে হয় ওই মেয়েটার সাথে ভাইয়ার ব্রেকআপ হয়ে গেছে।আর এখন ওর নতুন কোনো রিলেশন আছে কিনা সেটা বলতে পারি না।”

তুষ্টি আপুর কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম।
তবে অবাক হওয়ার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।মেয়েটা বোধ হয় উনার অতিমাত্রার রাগের শিকার হয়েছিল।নিশ্চয়ই তুষার ভাইয়া রাগ সামলাতে না পেরে চড় মেরে মেয়ের গাল চ্যাপ্টা বানিয়ে দিয়েছে।সেই কষ্ট অপমান সইতে না পেরে মেয়ে ব্রেকআপ করে চলে গেছে।হিহিহি।
কিন্তু ওই নীল ডায়রিটার লেখাগুলো কাকে উদ্দেশ্য করে লিখা?প্রাক্তনকে নিয়ে!
নাকি উনি আবার নতুন করে কারো সাথে রিলেশনে জড়িয়েছেন।

” এই নীলাশা! চল চল একটু সামনে এগিয়ে যাই।বাজি ফাটাবে এক্ষুনি।আমি আজ ফানুস উড়ানো দেখবই।”

তুষ্টি আপুর চিৎকারে ধ্যান ভাঙলো আমার।ঘড়ির কাঁটা কি তাহলে বারো’য়ের ঘরে উঁকি ঝুকি মারছে!

আপুর হাত ধরে আমি সামনে এগিয়ে গেলাম।
সকলের ধাক্কাধাক্কিতে বেহাল অবস্থা।
হঠাৎ আমার ডানপাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই সেদিকে তাকালাম।সেটা আর কেউ নয়।তুষার ভাইয়া।
উনি এত কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছেন যে আমি পড়েছি বিপাকে।উনি উনার দল ছেড়ে এইখানে কোন রাজকার্য করতে এসেছেন কে জানে।
দুইহাত জ্যাকেটের ভেতরে ঢুকিয়ে তুষার ভাইয়া বললেন,

” তোর গায়ে সুয়েটার কোথায়?শীত ঠান্ডা কোনোটাই লাগে না?”

আমি চটপটে গলায় উত্তর দিলাম,
” সত্যিই লাগে না ভাইয়া।আমি ঠিক আছি।”

” ঠিক তো থাকবিই।দিনে দিনে তোর গায়ের চামড়া গন্ডারের চামড়ায় রূপ নিচ্ছে সেটা তো ভুলেই গেছি।গন্ডারদের কিন্তু শীত লাগে না জানিস তো!”

” ভাইয়াআআআ! আপনি আমায় গন্ডার বললেন?”

তুষার ভাইয়া হাসিহাসি মুখ নিয়ে বলল,
” দুঃখিত।তুই গন্ডার না।তুই হলি মহিলা গন্ডার।আর এভাবে চিল্লাছিস কেনো?মাথার ঘিলু নাড়িয়ে দিবি নাকি।তুই কি জানিস তোর গলার চিৎকার শুনলে খেঁকশিয়ালির হুক্কাহুয়া ডাকের কথা মনে পড়ে।খেঁকশিয়ালির ডাক শুনেছিস কখনো?না শুনলে বল আমি ব্যবস্থা করব।”

একটা সুন্দর মুহুর্ত নষ্ট করে তুষার ভাইয়া কি শান্তি পাচ্ছে কে জানে!রাগে আমি দাঁত কিড়মিড় করছি।উনি আমাকে খেঁকশিয়ালি এবং গন্ডার নাম দুইটা উপহার দেওয়ার জন্যই এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তা ভালোই বুঝে গেছি।পাশ থেকে তুষ্টি আপু কিটকিট করে হেসে উঠছে।
বিড়বিড় করতে করতে বললাম,

” অন্তত এই মুহুর্তে আপনার ছড়াপাঁচালির ঝুলিটা বন্ধ রাখুন ভাইয়া।আমাকে নতুন বছরের আমেজটা উপভোগ করতে দিন।নিজেও করুন।”

” কি সর্বনাশ।ছড়াপাঁচালি কেমন শব্দ? তুষ্টির সাথে থাকতে থাকতে তুই তো ওকে ফলো করা শুরু করে দিয়েছিস।তোদের দুইজনের শব্দ ভান্ডার আবর্জনায় ভরা।মেরামত কর তাড়াতাড়ি। ”

বিরক্তিতে আমার সর্বাঙ্গ ছেয়ে গেল।এই লোকের মাঝেমধ্যে কি হয় বুঝি না।উদ্ভট সব কথাবার্তা।
এবার আপু ঝাঁজালো গলায় বলে উঠল,

” শব্দ নিয়ে গবেষণা করা বন্ধ করো ভাইয়া।তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো!ওই যে দেখো ছেলেগুলো হাত উঁচিয়ে ডাকছে তোমায়।”

তুষার ভাইয়া প্রতিত্তোরে আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।ফটফট শব্দে বাজি ফুটতে শুরু করল।শীতের রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশটা মুহুর্তেই বিভিন্ন রঙের আলোতে রঙিন হয়ে উঠল।
ছাদের উপস্থিত ছেলেগুলো দুইদলে ভাগ হয়ে গেছে।একদল সমানে বাজি ফাটাচ্ছে।আরেক দল জানপ্রাণ দিয়ে ফানুস উড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। পরপর তিনটা ফানুসে আগুন ধরে যাওয়ার পর চতুর্থ ফানুসটা ওঁরা আকাশে উড়াতে সক্ষম হলো।
আমি মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফানুস এবং বাজির উড়াউড়ি দেখছি।

হঠাৎই আমার ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাতে কোনো শক্ত পুরুষালি হাতের উষ্ণ স্পর্শ পেলাম।
পাশে তাকাতেই দেখি তুষার ভাইয়া অপলক আমাকে দেখছেন।উনার হাতের মুঠোর মধ্যেই আমার হাত বন্দী।হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি উনার আঙুল আমার আঙুলের খাঁজে প্রবেশ করিয়ে হাতটাকে আরো চেপে ধরলেন।আমার ঠান্ডা হাতটা উনার উষ্ণ হাতের উত্তাপটুকু যেন শুষে নিচ্ছে। মুহুর্তেই শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।বুকের বাম পাশে থাকা হৃদপিণ্ডটা অতিমাত্রায় ধুকপুক করছে।মন বলছে ভাইয়ার এই চাহনি ভিন্ন,তাঁর হাতের এই স্পর্শ ভিন্ন।কিন্তু কেনো ভিন্ন!

আমি চোখেমুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে উনার দিকে তাকাতেই কানের কাছে ফিসফিস করে উঠলেন,

” হ্যাপি নিউ ইয়ার নীল!আমার হাতের ভাঁজে তোর হাত আবদ্ধ থেকেই নতুন বছরটা শুরু হোক।”

অবুঝের মত এখনো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।প্রায়ই উনার কিছু কিছু কথার অর্থ উদ্ধার করতে পারি না আমি।তেমনভাবে এখনও পারছি না।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে তুষার ভাইয়া বললেন,

” কিরে! আমার মুখে বাড়তি একটা নাক গজিয়েছে নাকি আরো চারটা চোখ উঠেছে।এভাবে রসগোল্লার মত চোখ দিয়ে কি দেখছিস?আমাকে হ্যাপি নিউ ইয়ার বলবি না?”

আমার হাত এখনো উনার হাতের মধ্যে আটকে আছে। উনার চোখেমুখে একধরনের স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে।কোনো কিছু নিজের করে পাওয়ার আকুলতা চেহারায় ফুটে আছে।তুষার ভাইয়াকে সত্যি এখন তুষারের মত শুভ্র লাগছে।
নিজের মনের কথা শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।
আজ কি আমি এই লোকটার চোখের ভাষা পড়ে নিতে পারছি?এত ক্ষমতা আমার কিভাবে আসলো।
আচ্ছন্নের মত বললাম,

” হ্যাপি নিউ ইয়ার, তুষার ভাইয়া!”

_________________________

হরদমে বাজি ফাটানো শেষে এবার বিরিয়ানি খাওয়ার ধুম পড়ে গেল।বিরিয়ানির গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে।
যাদের অতিমাত্রায় ক্ষুধা পেয়েছে ওঁরা নিজেদের প্লেট নিয়ে ইতিমধ্যে খেতে বসে গেছে।
আমি আর আপু এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি।বিরিয়ানির গন্ধ নাকে লাগতেই আমার ক্ষিধে টা যেন লাফিয়ে উঠল।তুষার ভাইয়ার কড়া নির্দেশের জন্য এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা লাগছে।নাহলে কখন খেয়েদেয়ে বাসায় চলে যেতে পারতাম।একটু আগেই উনি এসে বলে গেছেন উনি নাকি খাবার নিয়ে আসবে।ওখানে নাকি অনেক ছেলে।
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল।ছেলে আছে তো কি হয়েছে।আমরা তো খাবার আনতে যাব।এমন তো না যে ছেলেদের সিগন্যাল দিতে যাব।লোকটা পারেও বটে।

হঠাৎই তুষ্টি আপুর ফোন বেজে উঠায় সে আমার থেকে কিছুটা দূরে চলে গেল।এবার আমি একা হয়ে গেলাম।

” তুমি এখানে কেনো নীলাশা?খাবে না?”

সাদনান ভাইয়ার আওয়াজ পেতেই চমকে উঠলাম।আপু যাওয়ার সাথে সাথেই উনি হাজির তারমানে দূর থেকে আমার উপর নজর রাখছিল!বারবার আমার সাথে কথা বলতে আসার উদ্দেশ্যটা কি সেটাই ঠাওর করতে পারছি না। ছেলেটাকে আমার এত একটা পছন্দ হচ্ছে না।তাই দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম,

” জ্বি। আপু আসলেই খাব।”

সাদনান ভাইয়া এবার বেশ স্পষ্ট ভাষায় বলতে লাগল,
” সেদিন তো ছাদে তোমাকে কথাটা বলতে পারলাম না।তাই এখন বলতে চাইছি। আজ নতুন বছরের প্রথম প্রহর।আমার মনে হয় এখনই কথাটা বলার উপযুক্ত সময়।”

খুব অস্বস্তিতে ভুগছি আমি।আপু যে গেল আর আসার নাম নেই।সাদনান ভাইয়ার কোনো কথা শুনতে আমি আগ্রহ বোধ করছি না।পেটের ভেতর ক্ষিদের চোটে আগুন জ্বলছে।কিন্তু উনাকে তো মুখের উপর বলতেও পারছি না চলে যান আমার ক্ষিদে পেয়েছে, আমি এখন খেতে যাব।

সাদনান ভাইয়া গলা খাদে নামিয়ে বলতে লাগলেন,
” আই এম ইন লাভ উইথ ইউ নীলাশা! অনেকদিন থেকেই কথাটা বলার চেষ্টা করছি।আজ বলতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।প্লিজ একসেপ্ট মাই লাভ!”

আমি মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগল।জীবনে এই প্রথম কেউ সরাসরি এভাবে প্রপোজ করে বসল।এই লোক আমাকে পছন্দ করে এটা তাহলে তুষার ভাইয়া আগে জানত।যার জন্য আমাকে বলেছিল সাদনান ভাই থেকে দূরে থাকতে।

ঠিক তখনই সাদনান ভাইয়ার পেছনে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তুষার ভাইয়ার দিকে নজর পড়ল আমার।হায় হায়! এবার নিশ্চয়ই একটা বড় ঝামেলা হতে চলেছে।আল্লাহ! সব ঝামেলা কি আমার ঘাড়ে এসেই ঠাই নেয়?
তুষার ভাইয়ার চাহনি ঠিক লাগছে না আমার।এমনভাবে দেখছেন আমাকে যেন লবণ মশলা ছাড়াই কাঁচা গিলে খাবেন।
তুষার ভাইয়া রাগী গলায় বলে উঠলেন,

” সাদনান, তোকে আমি বলেছিলাম নীলাশার আশেপাশেও থাকবি না।তুই সব জেনেও ওকে প্রপোজ করে বসে আছিস?কেনো ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিস!”

সাদনান ভাইয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
” হ্যাঁ সব জেনেও ওকে প্রপোজ করেছি আমি।ভালোবাসি ওঁকে আমি।তোর তো কোনো কিছুর অভাব নেই।টাকা, বাড়ি-গাড়ি, চেহারা সবই তো আছে।তুই চুটকি বাজালেই মেয়েরা লুটিয়ে পড়বে।তাহলে আমার আমার আর নীলশার মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কেনো দাঁড়াবি!”

” সাদনান…”

তুষার ভাইয়া সাদনান ভাইয়ার কলার চেপে ধরল।উচ্চ শব্দে সাউন্ড বক্স বাজার কারণে কেউ এপাশটায় এত খেয়াল করছে না।
ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।তাঁরা দুইজন কি নিয়ে এভাবে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ লেগে গেল আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
সাদনান ভাইয়া তুষার ভাইয়াকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না।তখনই কয়েকটা ছেলে ঘটনাটা দেখতেই ছুটে আসলো।ওরা বহুকষ্টে তুষার ভাইয়াকে ছাড়িয় আনল।দুজনেই রাগে ফুঁসছে। ছেলেগুলো সাদনান ভাইয়াকে টেনে অপর পাশে নিয়ে যেতেই তুষার ভাইয়া আমার দিকে হিংস্র চাহনি দিলেন।ভয়ে আমার কলিজা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সাদনান ভাইয়ার রাগ এবার তাহলে আমার উপর ঝাড়বেন!

কিছু বুঝে উঠার আগেই ভাইয়া আমার হাত টেনে সিড়ির দিকে নিয়ে গেলেন।এত জোরে ধরেছেন মনে হচ্ছে হাতটা এক্ষুনি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।ব্যথা সহ্য করতে না পেরে হালকা আর্তনাদ করে উঠলাম।

” হাতটা মনে হয় দু টুকরো হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া।ছাড়ুন।আমি নিজে থেকেই হাঁটতে পারব।”

আমার চিৎকার কানে তুলছেন না তিনি।তুষার ভাইয়া এখন রাগের উচ্চ সীমানায় পৌঁছে গেছেন।উনার এই রূপটাকে আমি বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছি।রাগে উনার ফর্সা চেহারাটা রক্তিম হয়ে উঠেছে।

চলবে…

মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_১২

হিড়হিড় করে টানতে টানতে তুষার ভাইয়া আমায় লিফটের ভেতর নিয়ে গেলেন।
ছাদের হিমশীতল বাতাসে এমনিতেই আমার হাত-পা গুলো ঠান্ডা হয়ে ছিল।এখন তো আরো শিথিল হয়ে গেছে।
উনি দুইহাত মুঠ করে সটান দাঁড়িয়ে আছেন।বড়সড় একটা ঢোক গিলে বললাম,

” ভাইয়া..আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেনো?প্লিজ শান্ত হন!”

ভয়াবহ দুটো জলন্ত চোখ নিয়ে ভাইয়া আমার দিকে ফিরলেন।রক্ত হিম হয়ে আসলো আমার।
উনি সর্বশক্তি দিয়ে আমার দুইকাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলেন,

” তুই কি তাহলে আমায় হাসতে বলছিস?আমার এখন হাসা উচিত ?শুনলি না ওই হ্রামি কি বলল!সে তোকে ভালোবাসে!আমার সামনে এটা বলার সাহস কোথায় পেল?বারবার না করা সত্বেও সে তোর আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে।আমাকে বলছে তৃতীয় ব্যক্তি!এরপরও তুই আমায় বলছিস শান্ত হতে!

এবার আমার অবস্থা আরো করুণ হয়ে গেল।কাঁধের হাড়গোড় বোধ হয় কটমট শব্দে ভাঙতে শুরু করেছে।কিন্তু যে করেই হোক আমার এখন ভাইয়াকে শান্ত করতে হবে।

” সাদনান ভাইয়া ভালোবাসে বলেছে তো কি হয়েছে! আমি তো আর উনার কথায় রাজি হয়ে যাই নি।তাহলে কেনো আপনি শুধু হাইপার হচ্ছেন ভাইয়া!”

তুষার ভাইয়া হাত দিয়ে আমার দুইগাল টিপে ধরলেন।আমি হতবাক হয়ে গেলাম।উনি এমন সাইকোর মত ব্যবহার কেনো করছেন!উনার রাগের চোটে আমি ব্যথায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছি তা কি তিনি বুঝতে পারছেন না!

” সে তোকে ভালোবাসি কেনো বলবে?হুম? ওর হয়ে সাফাই গাইছিস?দোষ তো তোরও কম নয়।আমি না করার পরও তুই সাদনানকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছিস।কিছুদিন আগে বিকেলে ছাদে ওর সাথে দেখা হয়েছিল।তখনও কথা বলেছিস আর আজও। কেনো এড়িয়ে যেতে পারিস নি ওকে?আমার তো মনে হয় ছেলেদের থেকে এইসব বাক্য শুনে তুই চরম মজা পাস।আনন্দ হয় তোর তাই না যার জন্য সাদনান তোকে ভালোবাসি বললেও তোর কোনো খারাপ লাগা নেই।”

তুষার ভাইয়ার এমন নিকৃষ্ট কথাগুলো আমার কানে শূলের মত বিঁধে গেল।দুটো কথার দ্বারা উনি আমায় কত নিচে নামিয়ে দিলেন!কি এমন বলেছি আমি?কেউ আমাকে ভালোবাসি বললে সেখানে আমার কি ই বা করার আছে।আমি তো আর কাউকে সেধে নিয়ে আসি না।
শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তুষার ভাইয়াকে ধাক্কা মেরে বললাম,

” আপনি একজন উন্মাদ ভাইয়া।বদ্ধ উন্মাদ।আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।এত গুলো খারাপ কথা আপনি আমাকে বলতে পারলেন?যেখানে আমি কোনো দোষই করিনি!কেনো আপনি আমাকে দুচোখে দেখতে পারেন না?আমি আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি?আজকের পর থেকে আমার চোখে আপনার অবস্থান টা কোথায় নেমে গেছে তা আপনি ভাবতেও পারবেন না।এতদিন শত বকা দিলেও,রাগ দেখালেও আপনাকে আমি সম্মানের চোখে দেখতাম।কিন্তু আজ যা করলেন এরপর তো নয়ই।”

লিফট চার তলায় পৌঁছাতেই আমি বড় বড় পা ফেলে নেমে গেলাম।তুষার ভাইয়া আমার দিকে অপরাধী চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন।থাকুক তাকিয়ে।মুখে যা আসে তা বলে দিলেই হয়ে গেল তাই না?আমাকে কি মানুষ মনে হয় না উনার?আমি ছোট বলে আমার মধ্যে কোনো খারাপ লাগা নেই?রাগ উঠলেই যা তা শুনিয়ে দেবে আর আমি চুপ করে তা হজম করে নিব সেটা হবে না।
.

ঘরে ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে মা’য়ের মুখোমুখি হয়ে গেলাম।মা বসে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলেন।আমাকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করল,

” কিরে তোদের পার্টি শেষ?গানের আওয়াজ তো এখনো শোনা যাচ্ছে। তোরা কিভাবে পারিস ঘন্টার পর ঘন্টা এত শব্দের মধ্যে বসে থাকতে।আমার তো ঘরে থেকেই মাথা ধরে গেছে।”

মা’য়ের কথার কোনো উত্তর দিলাম না।চুপচাপ জুতোগুলো সু কেবিনেটের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলাম।মা এবার বলে উঠল,

” তোর কি হয়েছে রে?মুখটা দেখতে অন্ধকার লাগছে কেনো?”

” কিছুনা মা।ঘুম পাচ্ছে। ”

” তাহলে যা শুয়ে পর।তোর বাবা অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে গেছে।আমি তো এই সিরিয়ালটা দেখার জন্য বসে আছি।তুই যা।”

রুমে এসে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।মনটা বিষিয়ে আছে।নতুন বছরের দিনেই তুষার ভাইয়া আমার সাথে এমনটা করতে পারল।কোথায় ভাবলাম হাসি-খুশি মুড নিয়ে আজ রাতটা কাটাব।কিন্তু তা আর হলো কই।তুষার ভাইয়ার বলা তিক্ত কথাগুলো মনে হতেই কান্না পাচ্ছে।

ঘুমে চোখটা লেগে এসেছিল তখনই দরজায় ঠকঠক শব্দে জেগে গেলাম।মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।উফ্! কেউ আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না নাকি যত্তসব!
দরজা খুলতেই দেখি মা রাগী চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।আজ কি সবাই আমার সাথে রাগ দেখাবে?অন্তত নতুন বছরটাতে ছাড় দেওয়া যায় না!

” এই ফাজিল মেয়ে! তুই তখন উপর থেকে খেয়ে আসিস নি!তাহলে কি করতে গেছিলি ওইখানে?তুষার ফোন করে না বললে তো জানতেই পারতাম না যে তুই না খেয়ে আছিস।জলদি ডাইনিংয়ে গিয়ে বস।ডিম ভেজে দিব। ফ্রিজে ডাল আছে।এত রাত করে অন্য কিছু বানাতে পারব না।জ্বালিয়ে মারবে এই মেয়ে আমায়!”

কথাগুলো বলতে বলতে মা কিচেনে ঢুকে গেল।আমি যে রাতে খাইনি এই কথাটাই তো আমি ভুলে গেছি।অবশ্য ভুলে যাওয়ারই কথা।পেটের খিদের থেকে মনের কষ্ট অনেক বেশি।আর আমি সেই কষ্টে আক্রান্ত এক রোগী।কিন্তু তুষার ভাইয়ার আমার জন্য এত দরদ দেখানোর কি দরকার ছিল।আমি না খেলে উনার কি আসে যায়!উনার জন্যই আমার বিরিয়ানি খাওয়া মিস হয়ে গেল।এখন আমাকে ডিম দিয়ে ভাত গিলতে হবে।

ডাইনিংয়ে খেতে বসে মাকে একটা ভয়াবহ কথা বলে বসলাম।আমি জানি এই কথাটা শুনলে মা আগুনের মত জ্বলে উঠবেন।আর হলোও তাই।
মাকে বলেছিলাম আমার জন্য নতুন টিচার ঠিক করে দিতে।কারণ আমি আর তুষার ভাইয়ার কাছে পড়তে ইচ্ছুক না।আমার এই বক্তব্য শুনে মা বলল,

” কেনো তুষারের কাছে পড়তে কি সমস্যা? ওর কাছে পড়ছিস বলেই তো মাত্র দেড়মাসের মধ্যেই এত এগিয়ে গেছিস!তুই কিসের ভিত্তিতে পড়বি না বলছিস সেটা আমি বুঝতে পারছি না।”

” মা আমি পড়ব না উনার কাছে ব্যস্! ভালো লাগে না।”

” তোমার ভালো লাগা না লাগা দিয়ে কোনো কাজ নেই আমার।তুমি ওর কাছেই পড়বে।তুষারকে পড়াতে না করলেই তুই পড়ায় ঢিল দিয়ে দিবি।তোকে কি আর চিনি না আমি।আর কত কেয়ার করে তোকে ছেলেটা।তখন খাস নি বলে ফোন করে আমায় বলল।”

মা’য়ের সাথে কথার যুদ্ধে হেরে গিয়ে মনটা আরো বিষন্ন হয়ে গেল।কেউ আমার কথার দাম দেয় না,কেউ আমার খারাপ লাগা-ভাল লাগার পাত্তা দেয় না।



পরদিন সকালে তুষার ভাইয়া যথাসময়ে পড়াতে আসলেন।আমি যন্ত্রের মত উনাকে সব হোমওয়ার্ক দিয়ে গেছি।একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকাই নি।তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম উনি আমার দিকে অপলক চেয়ে ছিলেন।কিছু একটা বলতেও গিয়েও যেন মাঝপথে আটকে যাচ্ছিলেন।কি জানি হয়তোবা আমার মনের ভুলও হতে পারে।
পড়া শেষ হতেই ভাইয়া বলে উঠলেন,

” কথা বলবি না?তাকা আমার দিকে।”

আমি তখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।
উনার চোখে চোখ মেলানোর কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
আমাকে চুপ দেখে আবার বললেন,

” নীল!”

আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম।কি করুণ গলায় ডাকছেন উনি!এভাবে ডাকলে না তাকিয়ে থাকা যায় না।তাকাবো না তাকাবো না ভেবেও হুট করেই উনার চোখে চোখ রাখলাম।
সাথে সাথেই আমি শকড্!
ভাইয়ার চেহারা কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।মনে হচ্ছে কেউ উনার শরীরের রক্ত শুষে নিয়ে উনাকে এমন সাদা বানিয়ে দিয়েছে।কি আশ্চর্য!
মাথার চুল এলোমেলো।আজ কি চিরুনি লাগাতে ভুলে গেছেন?চোখগুলোও লালচে।সারারাত না ঘুমালেই একটা মানুষকে এমন ভয়ঙ্কর দেখায়।তাহলে কি ভাইয়া রাতে ঘুমায় নি!ইস! কি মায়াবী চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
ভাবলাম একবার জিজ্ঞেস করি কাহিনী কি!কিন্তু কালকের ঘটনা মনে পড়তেই নিভে গেলাম।উনার ব্যপারে খোঁজ নেওয়া কি দরকার!
তুষার ভাইয়া নীরব মুখে উঠে চলে গেলেন।আমার একটু খারাপ লাগল।বেশি ওভারএক্টিং করে ফেলেছি কিনা কে জানে!



সারাটা সকাল একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল।কেনো জানি সব রাগ গিয়ে ওই সাদনান চামচিকা টার উপর পড়ছে।এই শয়তান ছেলেটার জন্যই এতসব ঘটে গেল।আমাকে নাকি ভালবাসে।হাহ্!একদিন না দুদিন সামনাসামনি দেখা হয়েছে আর এরমধ্যেই ভালোবেসে ফেলেছে।কয়েকদিন আগেই তো সাত তলার তিন্নি মেয়েটা বলল উনি নাকি কার সাথে প্রেম করছেন।এরমধ্যেই ব্রেকআপ হয়ে গেল আর আমাকে প্রপোজ করে বসে আছে! এদের মনে কি রেডিমেড ভালোবাসা থাকে নাকি বুঝি না!যাকেই ভালো লাগবে তাকেই ভালোবাসা বিতরণ করে বেড়ায়।উফ!সব ঝামেলা আমার মাথার উপরই কেনো ঘাপটি মেরে বসে থাকে বুঝি না।ঝামেলার আমাকে এত পছন্দ!

চলবে….

মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৩

ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁইছুঁই। গত একঘন্টা থেকে পড়ার টেবিলে বই সামনে রেখে বসে আছি।তুষার ভাইয়ার আসার কোনো নাম গন্ধ নেই।অন্যদিন তো চারটা অথবা সাড়ে চারটার দিকে চলে আসতেন।সময়ের ব্যপারে উনি খুবই সতর্ক।তবে আজ উনি আসছেন না কেনো।ভাবছি সকালে যে উনাকে সরাসরি ইগনোর করে গেছি তারজন্য বোধ হয় আর পড়াবেন না আমায়।

ধুর! আমিও যে কিসব নির্বোধ চিন্তা ভাবনা করি।এমনটা আবার হয় নাকি।
রান্নাঘর থেকে মা চেঁচাচ্ছেন তুষার ভাইয়াকে ফোন দিয়ে জেনে নিতে আজ পড়াতে আসবে কিনা।কিন্তু মা’য়ের কথা আমি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে টেনে বের করে দিচ্ছি। উনার সাথে সামনাসামনি কথা বলি না তাহলে ফোনে কেনো বলব!

আর ফোন করার প্রয়োজন পড়ে নি।পাঁচটা দশ বাজতেই তুষার ভাইয়া চলে আসলেন।
এবারও আমি সকালের মত ভাব ধরে ফেললাম।আমি ভাইয়াকে বুঝাতে চাই যে আমি উনার ব্যবহার দ্বারা কতটা কষ্ট পেয়েছি।তাই এই অভিনয়ের সূত্রপাত।
তাও একবার আড়চোখে উনাকে দেখে নিলাম।উনি মোবাইল টিপায় ব্যস্ত।ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা দেখছেন।নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু।
গায়ে ফরমাল লুক।তারমানে অফিস থেকে সোজা চলে এসেছেন।ভাইয়াকে এই ড্রেস আপে দেখতে আমার বরাবরই ভালো লাগে।উনার গায়ে হালকা বেগুনি রঙের শার্ট।ব্লেজারটা কোথায় রেখে এসেছে কে জানে!

এলোমেলো চুলগুলো কপালের উপর পড়ে আছে।ফর্সা চেহারায় অবসাদ এবং ক্লান্তির ছোঁয়া।
হঠাৎ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ফেললেন।চোখে চোখ পড়ে গেল উনার।আমি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।লুকিয়ে চুড়িয়ে দেখতে গেলে বোধ হয় এমনই হয়!আমারো যে হঠাৎ কি হলো।

তুষার ভাইয়া কৌতুকময় কন্ঠে বলে উঠল,
” তুই তো আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিস!দিলি তো নজর লাগিয়ে।দেখ আমার চেহারা কেমন শুকিয়ে গেছে।ভালো করে দেখ চোখগুলো লাল হয়ে আছে না?”

উনার ঝরঝরে কন্ঠ শুনে বেশ অবাক হলাম আমি।হঠাৎ করে উনার কি হলো!আজ সকালেও তো অপরাধবোধে ভুগছিলেন আর বিকেল হতে হতে তা গায়েব হয়ে গেল।তবে উনার চোখগুলো সত্যিই লাল হয়ে আছে।চেহারাও বিবর্ণ।

” চুপ করে আছিস কেনো?আমার দিকে যে কূটনীর নজরে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলি এতে আমার সৌন্দর্য তো একধাপ নষ্ট হয়ে গেল।সাধে কি আর বলি তোর পেটে মাথায় শয়তানি বুদ্ধির আবাসস্থল! হিংসুটে মেয়ে একটা।”

ভাইয়ার কথা শুনে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছি না।কত সাহস!আমাকে হিংসুটে বলল।
বেশ চড়া গলায় বলে উঠলাম,

” ও হ্যালো মিস্টার! নিজেকে কি সুপারস্টার ভাবেন আপনি?বস্তির ওই দাঁত উঁচুওয়ালা মুহিব নামের ছেলেটার চেহারাও আপনার থেকে ভালো। শুধু ফর্সা হলেই সুন্দর বলে না।এগুলাকে বলে ফার্মের মুরগি।কিন্তু আপনাকে তো মুরগি বলা যাবে না।আপনার জন্য ধলা বিলাই নামটা পারফেক্ট। আর কি বলছিলেন আমি নজর দেওয়াতে আপনার চেহারা শুকিয়ে গেছে,চোখ লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই আপনি রাতে না ঘুমিয়ে পুরো এলাকার পাগলা কুকুর গুলো তাড়া করে বেড়িয়েছেন। যার জন্য চোখমুখের এই হাল।খবরদার আমাকে যদি আর একটাও কথা বলেছেন ভালো হবে না কিন্তু। ”

একশ্বাসে কথা গুলো বলে তবেই দম নিলাম।নিজেকে নিয়ে প্রশংসা করতে করতে একেবারে তালগাছের মাথায় উঠে গেছে।এ কেমন মানুষ! নিজের ঢাক নিজে পেটায়।
তুষার ভাইয়া হা করে আমার দিকে চেয়ে আছেন।নিশ্চয়ই শক খেয়েছে।একদম উচিত শিক্ষা হয়েছে।

উনি ডানে বামে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলেন।তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে লাগলেন,

” তুই তো একটা ভুল কথা বললি নীল! রাতে আমি কুকুর তাড়াই না।রাতে আমি তোর যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না।চোখ বুজলেই স্বপ্ন দেখি।সেখানে তোর শানের মত সাদা সাদা চুল,হাতির দাঁতের মত বিশাল দুটো দাঁত, চোখগুলো তো গনগনে আগুনের মত জ্বলতে থাকে।আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করতে করতে আমায় আক্রমণ করতে ছুটে আসিস।ভাব একবার, এই ভয়ানক পেত্নী রূপ দেখলে ঘুম দূরে থাক আমার তো কোমায় চলে যাওয়ার কথা।কিন্তু তবুও আমি ফিট বডি নিয়ে চেয়ারে বসে আছি।”

তুষার ভাইয়ার মুখে আমার রূপের বর্ণনা শুনে শিউরে উঠলাম।এসব শোনার আগে দেয়ালে মাথা ঠুকে মরে গেলাম না কেনো!
উনার দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে বললেন,

” যাক অবশেষে তুই কথা বললি আমার সাথে।”

চমকে উঠলাম আমি।কোথায় গেল আমার অভিনয়,কোথায় গেল আমার অভিমান?
উনার কথার তালে তালে এতক্ষণ আমিও তাল দিয়ে গেছি। এখন তো নিজের উপরই রাগ লাগছে।

তুষার ভাইয়া করুণ গলায় বলে উঠলেন,
” রাগ কর যা-ই কর।প্লিজ কথা বলা বন্ধ করিস না।পাগল হয়ে যাই আমি।”

আমি সূক্ষ্ম নজরে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।উনার চোখের পর্দায় একরাশ আকুতি।উনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন না তাহলে আমি কথা না বললে উনি কেনো পাগল হবেন।ঢং!আমাকে আজেবাজে কথা শুনাবে আর আমি রাগ করেও থাকতে পারব না?


আকাশে সন্ধ্যে নামার হাতছানি।চারদিকে শীতল হাওয়া বইছে যার ফলে শরীরে হালকা কাঁপুনি উঠছে।তিন্নির সাথে ছাদে ঘুরাঘুরি করছি আমি।তিন্নি আমার এক ক্লাস জুনিয়র।বড্ড চটপটে এই মেয়েটা।আমি ছাদে আসতে চাইছিলাম না।ও জোর করে নিয়ে আসলো।তিন্নি তখন থেকে বকবক করে মাথা-কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।আমি নাকি পড়তে পড়তে শুকিয়ে যাচ্ছি।আমাকে দেখতে নাকি এখন রোগী রোগী লাগে।
এরকম অর্থহীন কথাবার্তার কোনো মানে হয়?

আমার স্বাস্থ্য শরীর নিয়ে গবেষণার টপিক শেষ হতেই সে এবার তুষার ভাইয়াকে নিয়ে শুরু করল।

” নীলাপু আমার তো জানাই ছিল না তুষার ভাইয়া এত রাগী।গতকালের ঘটনা আমি দূর থেকে খেয়াল করেছিলাম।খুব ভয় পেয়েছি আমি।জানো আপু তুষার ভাইয়া এতদিন আমার ক্রাশদের লিস্টে একদম টপে ছিল। কিন্তু এখন দশ নাম্বারে চলে গেছে।”

” তোর ক্রাশের লিস্ট এত বড়?তুই তো আমার থেকেও একধাপ এগিয়ে আছিস।ভার্সিটি যখন উঠবি তখন তো….”

ছাদের দরজা দিয়ে সাদনান ভাইয়াকে ঢুকতে দেখে আমার কথা মাঝপথে আটকে গেল।
তিন্নি আর আমি দুজনই কৌতুহল নিয়ে দেখলাম উনি এখানেই আসছেন।এই ছোকড়া আবার কি জন্য হাজির হলো কে জানে?আর জানলো কিভাবে আমরা ছাদে আছি।

সাদনান ভাইয়া শুকনো মুখে সামনে এসে বলতে লাগল,
” কালরাতের ঘটনাটার জন্য আমি খুবই লজ্জিত নীলাশা।কি বলতে কি বলে ফেলেছি।তুমি মনে কিছু নিও না।আমার তুষারের দিকটা ভেবে দেখার দরকার ছিল।সব জানার পরও আমি তোমাকে প্রপোজ করেছি যা খুবই বিশ্রি হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমি সত্যিই দুঃখিত।তুষার আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছে।জানি না কিভাবে ওর কাছে ক্ষমা চাইব।”

সাদনান ভাইয়ার ইনোসেন্ট মার্কা চেহারা দেখে আমি একটুও নরম হলাম না।বরং ঠাস করে প্রশ্ন ছুড়লাম,

” এক মিনিট!আমাকে একটা জিনিস ক্লিয়ার করুন তো!বারবার যে বলছেন ‘সব জানার পরও’ এটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।আপনি সবার প্রথমে এই তিনটা শব্দের ব্যাখ্যা দিন।”

সাদনান ভাইয়ার চেহারা আগের চেয়ে আরো দুঃখী দুঃখী হয়ে গেল।
” এটা আমি বলতে পারব না।এমনিতেই তুষার আমার উপর ক্ষেপে।তোমার কৌতূহল দমাতে গেলে আমার অবস্থা আরো করুণ হয়ে যাবে।ভালো থেকো।আমি এখন যাই।”

আমাকে দ্বিধার মধ্যে ফেলে উনি চলে গেলেন।মন চাইছে একটা ইটের টুকরো নিয়ে লোকটার মাথায় ঢিল মেরে রক্তাক্ত করে দিই।
পাশ থেকে তিন্নি বলল,
” তুষার ভাইয়ার ভয়ে সে জর্জরিত হয়ে আছে।একদম ঠিক হয়েছে।সে জানে তুষার ভাইয়ার সাথে ঝামেলা করলে ওরই বিপদ।তাই তোমার কাছে ক্ষমা টমা চেয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলল।জানো আপু সাদনান ভাইয়ার আগে কয়টা প্রেমিকা ছিল?”

” তিন্নি তুই কি থামবি?এমনিতেই মাথা হট হয়ে আছে তার উপর তোর ক্যাঁচক্যাঁচানি শুনে ছাদ থেকে লাফ দিতে ইচ্ছা করছে।উনার প্রেমিকা সম্পর্কে জানতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার।”

ধমক খেয়ে তিন্নি চুপসে গেল।আমার মাথায় শুধু সাদনান ভাইয়ার বলা তিনটে শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে।

__________________________

কেটে গেছে আরো বেশ কয়েকটা দিন।ধীরে ধীরে আমার পড়ালেখার চাপ আরো বাড়ছে।পরীক্ষা তো প্রায় এসেই গেল।মাঝেমধ্যে খুব ভয়ে থাকি।না জানি রেজাল্ট কেমন আসে।একটু উনিশ-বিশ হলেই মানুষের সামনে মুখ দেখানোর জায়গা পাব না।
আমার মা প্রত্যেকদিন একবার করে মনে করিয়ে দেয় যে রেজাল্ট যদি খারাপ আসে তাহলে ধরে বেঁধে আমাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাবে।কি ভয়াবহ কথা।মনে পড়লেই কলিজা কেঁপে উঠে।
অন্যদিকে তুষার ভাইয়া তো আছেনই।উনার কথা আর কি বলব।ডেইলি এত এত পড়া দিয়ে যায় আমি পড়তে পড়তে বেঁহুশের মত হয়ে যাই।তবে মায়ের হুমকিতেই হোক আর তুষার ভাইয়ার চাপেই হোক আমি কিন্তু হেব্বি পড়াশোনা করছি।

কিন্তু তুষার ভাইয়ার সাথে আমি এখনো অনেকটা রেগে আছি।যদিও মুখে সেটা ততটা প্রকাশ করি না।উনাকে যখনই দেখি তখনই ওইদিনের কথাগুলো মনে পড়ে যায়।তাই প্রয়োজন ছাড়া উনার সাথে কোনো বাড়তি কথা বলি না।এই ব্যপারটা তুষার ভাইয়া খুব ভালো করেই বুঝতে পারেন।
প্রথমদিকে উনি আমাকে মানানোর অনেক চেষ্টাচরিত্র করেছিলেন।একদিন তো আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যরি পর্যন্ত বলেছে।কিন্তু তবু আমার মন বিন্দুমাত্র টলে নি।মাঝেমধ্যেই আমাকে হাসানোর জন্য বিভিন্ন উদ্ভট কথা বলেন।ঝগড়া লেগে আমাকে রাগিয়ে দেওয়ারও সুযোগ খুঁজেন।কিন্তু আমি তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাই।যার ফলে তিনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েন।আর সেই হতাশাগ্রস্ত চেহারা দেখে আমি পৈশাচিক আনন্দ পাই।

__________________

ঘুমের মধ্যে দরজা নক করার আওয়াজ ক্ষীণভাবে কানে প্রবেশ করছে।ব্রেইন সিগন্যাল দিচ্ছে চোখ খুলার জন্য। কিন্তু ঘুমের তাড়নায় পারছি না।
হঠাৎ করেই দুমদাম শব্দ টা আরো বেড়ে গেল।ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।
বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়লাম।ইস!পায়ের হাড়গোড় যেকোনো একটা নিশ্চয়ই ভেঙেছে। চোখ কচলে পড়ার টেবিলের উপর রাখা ছোট ঘড়িটাতে তাকাতেই দেখি বারটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি।
দরজা খুলে দিতেই তড়িঘড়ি করে মা রুমে ঢুকলেন।

” কখন থেকে ধাক্কা দিচ্ছি।কানে কি তুলো গুঁজে ঘুমাস?”

অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে মা’কে বললাম,
” এত রাতে আমার ঘুম নষ্ট করে জানতে এসেছো আমি কানে তুলা দেই কিনা তাই তো?তাহলে শুনো আমি তুলা দেই না।হয়েছে? এবার যাও প্লিজ।আমার কালকে ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে যাবে তো!”

” এখন ঘুমাস না।তুষ্টি এসেছে তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওর সাথে ঘুমাতে বলছে।যা তাড়াতাড়ি। ”

আমি বড় করে একটা হাই তুললাম।আপুও যে কি করে না!আগে ফোন করে বলে দিলেই তো হয়।

তুষ্টি আপুদের বাসায় ঢুকতেই আপু আমাকে ড্রয়িংরুমে মাঝে দাঁড় করিয়ে বলল,

” এখানে একটু দাঁড়া।আমি এক্ষুনি আসছি।”

এটা বলেই আপু চলে গেলেন।আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সবাই কি কাহিনী করছে এসব।আমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখছি নাকি।এমনও তো হতে পারে যে আমি এখন স্বপ্নের দেশে ঘুরাফেরা করছি।আল্লাহ্!স্বপ্ন কি এত স্পষ্ট হয়!
কিন্তু পরক্ষণেই নিজের হাতে চিমটি কাটতেই বুঝতে পারলাম না আমি বাস্তবেই আছি।

এক মিনিটের মাথায় আপু ফিরে আসলেন।কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরে বলল,

” কোনো কথা বলবি না।আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেদিকে শুধু পা চালা।”

আপুর কথামত আমি হেঁটে চলেছি রোবটের মত সোজা হয়ে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here