মন গহীনে,পর্ব_১৪

0
1889

মন গহীনে,পর্ব_১৪
সামান্তা সিমি

আপুর কথামত আমি হেঁটে চলেছি রোবটের মত সোজা হয়ে।
চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছি আপু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়।একটা দরজা খোলার শব্দ পেলাম।তারমানে কোনো একটা রুমে নিয়ে এসেছে।

” ওয়ান-টু-থ্রি! সারপ্রাইজ!

অতিমাত্রায় চিৎকার দিয়ে আপু আমার চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিলেন।এই চিৎকারে বোধ হয় মাউন্ট এভারেস্ট পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে।তাহলে আমার কানের কি হাল হবে?
পিটপিট করে চোখ খুলতেই সামনের দৃশ্যটা দেখে আমার দুই ভ্রু কুঁচকে গেল।
তুষার ভাইয়া প্রশস্ত হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।উনার পাশেই ছোট টেবিলটায় একটা গোল সাইজের কেক রাখা।সাথে খুব সুন্দর একটা কালারফুল মোমবাতি।বিছানার উপর রঙিন কাগজে মোড়া বক্স।দেখে মনে হচ্ছে গিফটের বাক্স।
দ্বিতীয়বারের মত প্রতিটা জিনিসের উপর নজর বুলিয়ে নিতেই হঠাৎ আমার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল।আজ ২০ জানুয়ারি। আমার জন্মদিন!
নিজের জন্মদিনের কথা নিজেই ভুল মেরে বসে আছি আর ওঁরা দুজন মনে রেখেছে!এত সুন্দর একটা সারপ্রাইজ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লাম।

কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকাতেই তিনি বলে উঠলেন,

” শুভ উনবিংশতম জন্মদিন নীল!

দুই পাটি দাঁত বের করে হাসলাম আমি।পাশ থেকে আপু জাপটে ধরে বলল,

” জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা বনু।সারপ্রাইজটা কেমন লেগেছে বলতো!”

” খুব ভালো লেগেছে আপু!বেস্ট ছিল এটা!”

তুষ্টি আপু হেসে বলল,
” তুই কি ভুলো মনের মেয়ে রে নীল!নিজের জন্মদিনের কথা তোর ব্রেইন তোকে মনে করিয়ে দিল না।ভারি অদ্ভুত তো!”

” এজন্য তো আমার ব্রেইনকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আপু।যদি বার্থডে’র কথা আমার মনে থাকত তাহলে সারপ্রাইজ টা এত জমজমাট হত না।এখন যে পরিমাণ খুশি লাগছে তখন এক ছটাকও লাগত না।”

আপু এবং আমার কথোপকথন তুষার ভাইয়ার সহ্য হলো না।উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,

” দুই পেঁচীর দল তোদের প্যাঁচাল শেষ হলে আমার দিকে তাকা।আর এই যে বার্থডে গার্ল! আপনার কেক কাটার অপেক্ষায় আমরা বসে বসে সারারাত পার করতে পারব না।দয়া করে কেক টা কেটে আমাদের ধন্য করুন।”

আড়চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আমি মুখ ঝামটা দিলাম।যতই সারপ্রাইজ অ্যারেঞ্জ করুক আমাকে ভুলে গেলে চলবে না যে আমি উনার সাথে রেগে আছি।

তুষ্টি আপু তাড়া দেওয়ায় আমি কেক কাটার জন্য এগিয়ে গেলাম।তুষার ভাইয়া মুচকি হেসে আমার হাতে ছুড়িটা ধরিয়ে দিলেন।
কেকের একসাইড একটু কেটে তুষ্টি আপুকে খাইয়ে দিলাম।
আপুও আমাকে এক টুকরো খাইয়ে দিয়ে বলল,

” তোর জন্য একটা গিফট আছে।দাঁড়া নিয়ে আসছি।”

আপু চলে যেতেই তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি দুই হাত বুকের সাথে ভাঁজ করে চোখ ছোট ছোট করে দেখছেন আমায়।কারণটা অবশ্য আমি জানি কিন্তু পাত্তা দিলাম না।
আরেক টুকরো কেক কেটে নিজের মুখে ঢুকিয়ে নিলাম।
এবার তুষার ভাইয়া মুখ খুললেন,

” তোর আমাকে চোখে লাগছে না?আমাকে কেক খাওয়ালি না যে?খাদকের মত নিজেই খেয়ে চলেছিস।”

আমি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিলাম,
” একটু আগেই বললেন না যে আমি বার্থডে গার্ল।তো কেক টা তো আমার জন্যই আনা হয়েছে তাই না!”

” তুই যে কতটা পাষণ্ড মানবী তা আজ বুঝতে পারলাম।এত কষ্ট করে আমি অ্যারেঞ্জ করলাম সবকিছু আর আমার সাথেই মামদোবাজি? ”

চোখ গরম করে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।আমি এত ইগনোর করার পরও উনি আমার সাথে ঝগড়া করার রাস্তা খুঁজেন। কত ধৈর্য্য উনার!
হাতের ছুড়িটা নিয়ে কেকের উপর এলোপাথাড়ি ভাবে চালিয়ে দিলাম।ছোট একপিস নিয়ে ভাইয়ার সামনে ধরতেই উনি আতঙ্ক মিশ্রিত গলায় বললেন,

” কি ডেঞ্জারাস মেয়ে তুই!আমার তো মনে হচ্ছিল তুই কেক না আমার শরীরের উপর ছুড়ি চালাচ্ছিস।”

আমি কোনো কথা বললাম না।কারণ উনার সাথে তর্কে যাওয়া মানেই বিপদ।আমি যদি ডেঞ্জারাস হই তাহলে উনি কি?ডাবল ডেঞ্জারাস।
উনার মুখে কেক তুলে দিতেই আমার আঙুলে বিরাট এক কামড় বসালেন।

” আল্লাহ! কি করলেন এটা!”

যন্ত্রণায় চিল্লিয়ে উঠলাম।
উনার কোনো ভাবান্তর নেই।মনের সুখে কেক চিবিয়ে যাচ্ছেন।
অসভ্য লোক একটা!আমি খুব ভালো করে জানি এই কাজটা উনি ইচ্ছে করেই করেছেন।আল্লাহ! এই অমানুষ টার দাঁতগুলো যেন অকালে খুলে পড়ে যায়।আমার মনের বাসনা পূরণ করে দিও তুমি।তবে উনার বউয়ের তো কপাল পুড়বে।দন্তহীন জামাই নিয়ে রাস্তায় হাঁটা চলা করবে কিভাবে। তুষার ভাইয়ার ভবিষ্যৎ বউয়ের দুদর্শার কথা চিন্তা করে একটু খারাপ লাগল।

তুষ্টি আপু রুমে ঢুকে বলল,
” নীলাশা তুই চিৎকার দিয়ে উঠলি কেনো।আরেকটু হলে তো আব্বু আম্মু জেগে যেত।”

দাঁত কটমট করে বললাম,
” তোমার ভাইকে কি বাসায় খাবার দাবার কিছু দাও না তোমরা?উনি একটু আগে আমার আঙুল খাওয়ার চেষ্টা করেছিল।কোনো রকমে আঙ্গুলটা উনার কবল থেকে রক্ষা করেছি।”

তুষ্টি আপু হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে।এদিকে তুষার ভাইয়া একের পর এক কেক মুখে ঢুকিয়ে যাচ্ছেন। আমার উত্তপ্ত চাহনি এবং নালিশ উনার ভাবভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারছে না।যেন কেকের সাথে আঙুল কামড় দেওয়া দোষের কিছু নয়।বরং স্বাভাবিক ব্যপার।অসহ্য।

” সিরিয়াসলি ভাইয়া! তুমি নীলাশার সাথে এমন বাচ্চা টাইপের দুষ্টুমি গুলো করো? যাই হোক। নীলাশা দেখ তো এই ঘড়িটা কেমন?তোর জন্য কিনেছি।”

আপুর কেনা ঘড়িটা দেখে মুগ্ধ হতে হল।পাথরের ঘড়িটা কি সুন্দর!

” দারুণ হয়েছে আপু।সত্যি খুব খুশি হয়েছি আমি।”

তুষ্টি আপু হালকা করে আমার গাল টেনে দিলেন।ইস! আপু যদি আমার আপন বড় বোন হত!
অবশ্য আপন না হয়ে ভালোই হয়েছে।পরে দেখা যেত দিনরাত দুইজন এটা সেটা নিয়ে চুলোচুলি করতাম।এমন দৃশ্য কল্পনা করতেও খুব ভয় লাগে।

চোখ জ্বালা করতেই মনে পড়ল আমি তো কাঁচা ঘুম ভেঙে এখানে এসেছি।এখন বিছানা বালিশ আমাকে চিৎকার করে ডাকছে।কোনোরকমে মাথাটা বালিশে লাগাতে পারলেই হলো।ঘুম আমি আসছি।
মস্ত একটা হাই তুলে তুষ্টি আপুকে বললাম,

” আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।চলো রুমে।”

” হ্যাঁ চল।”

আমার ঘুমের মাঝে বাম হাত ঢুকিয়ে দিলেন তুষার ভাইয়া।উনি বললেন,

” তুষ্টি তুই যা।নীল একটু পরে যাবে।”

আপু মুচকি হেসে চলে গেলেন।এমন রহস্যময় হাসি দেখে আমার খটকা লাগল।যদিও তেমন পাত্তা দিলাম না।
চেহারায় জোর করে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুষার ভাইয়াকে বললাম,
” যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। আপনি যদি কোনো উল্টোপাল্টা কথা বলে আমাকে পচানোর চিন্তা করে থাকেন তাহলে এই প্লাস্টিকের ছুড়ি আপনার গলায় বসিয়ে দিব।”

তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
” ভালোই তো সাহস বেড়েছে তোর।আমাকে মারার হুমকি দিচ্ছিস।তাও প্লাস্টিকের ছুড়ি দিয়ে?আর তোকে আমি পচাতে যাব কেনো?আমাকে কি তোর মাটিতে বাস করা ব্যাক্টেরিয়া মনে হয়?”

” আপনার কথাগুলো ব্যাক্টেরিয়াকেও হার মানায়।শুনলেই শরীরে জ্বালা ধরে।”

” তাহলে সেটা তোর সমস্যা।শরীরের চামড়ায় সমস্যা। ”

দাঁতে দাঁত ঘষে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলাম।এই লোকটা আবার আমাকে হাইপার করে দেওয়ার ফন্দি আঁটছে।তাই এখন কথার পিঠে চুপ করে থাকাই শ্রেয়।

মুখ ভার করে চলে যেতে নিলেই তুষার ভাইয়া আমার হাত টেনে ধরলেন।
কোমল স্বরে বললেন,

” আমার নীলের যে এত রাগ তা তো জানতাম না! রাগলে নীল আর নীল থাকে না।লাল হয়ে যায়।”

আমি কিছুই বললাম না।উনার উল্টো দিকে মুখ করে আছি।তখনই অনুভব করলাম উনি আমার হাতে কিছু একটা পরিয়ে দিচ্ছেন।

” বাহ্! তোর ফর্সা হাতে বেশ মানিয়েছে তো!”

বাম হাতটা সামনে আনতেই অবাক হয়ে গেলাম।পাথর বসানো চিকন একটা ব্রেসলেট। লাইটের আলোয় চিকচিক করছে।
তুষার ভাইয়া একটা মাঝারি সাইজের বক্স আমার সামনে এনে বললেন,

” এটার ভেতর তোর পছন্দের কিছু জিনিস আর একটা ডায়রি আছে।ডায়রিটা এখন খুলবি না।যেদিন আমার কথা তোর অনেক বেশি মনে পড়বে, যেদিন খুব মিস করবি সেটা যে কারণেই হোক শুধু ওইদিনই ডায়রিটা খুলবি।প্রমিস কর!”

ভাইয়ার কথা শুনে মনে মনে হাসি পেল।উনি কি পাগল নাকি।উনার কথা আমার কেনো মনে পড়বে?মনে করার মত কিছু করেছে নাকি?আর মিস করার তো প্রশ্নই উঠে না।উনি আমার থেকে শত হাত দূরে থাকলেই ভালো।

” লাগবে না আমার কোনো গিফট্।আপনার থেকে আমি কোনো গিফট্ নিব না।”

” এগুলো তোর জন্য কিনে এনেছি।তাই তুই নিতে বাধ্য। এবার এগুলো নিয়ে তুই কি করবি তোর ব্যাপার।মন চাইলে নিজের কাছে রাখতে পারিস আবার মন চাইলে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিতে পারিস।ইট ডিপেন্ডস অন ইউ।”

তুষার ভাইয়ার শক্ত গলার কন্ঠ শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।আবার যদি সেই সাইকো রূপ ধারণ করে?তাহলে আমার উপর দিয়ে আবারও তুফান ছুটবে।
বাক্সটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে তুষ্টি আপুর রুমে চলে গেলাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here