মন গহীনে,পর্ব_২

0
2950

মন গহীনে,পর্ব_২
সামান্তা সিমি

সকালে ঘুমের ঘোরে অনুভব করছি আমার মুখে ভেজা ভেজা কিছু গড়িয়ে পরছে। হাত দিয়ে ভেজা গালটা মুছে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলাম।কিন্তু এবার আরো জোর গতিতে পরতে লাগল যেন আমি খোলা ছাদের উপর শুয়ে আছি আর বৃষ্টির ফোঁটা টপাটপ আমার মুখে পতিত হচ্ছে। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম।গালে হাত দিয়ে দেখি পানি।গায়ের টি-শার্ট টাও অনেকটা ভিজে আছে।

” কিরে নীল! তুই কি আশেপাশের সবাইকে চাকর ভাবিস নাকি যে সকাল বেলা তাঁরা অন্য কাজ বাদ দিয়ে তোকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য বসে থাকবে?”

তুষার ভাইয়ার আওয়াজ শুনতেই চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল।চোখ কচলে দেখি তুষার ভাইয়া বোতল থেকে পানি নিয়ে আমার মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। মুহুর্তেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।

” এসব কি তুষার ভাইয়া! সাত সকালে কি শুরু করেছেন এগুলো?”

” চড় মেরে গাল ফাটিয়ে দেব।ঘড়ির দিকে তাকা।”

ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি সাড়ে আটটা বাজে।হায় হায়! সাড়ে নয়টার দিকে আমার একটা প্রাইভেট আছে।মাঝে মাঝে রাস্তায় জ্যাম থাকে তাই একটু আর্লি বেরিয়ে পরি।কিন্তু আজ তো মনে হচ্ছে অনেক লেট হয়ে যাবে।
তাড়াতাড়ি কাঁথা বালিশ ছুড়ে ফেলে কাবার্ড থেকে জামা নিলাম।অন্যদিকে তুষার ভাইয়া চেঁচাচ্ছেন।

” আস্তে যা নীল! পড়ে গিয়ে যদি ব্যথা পাস তাহলে কিন্তু খবর আছে তোর।”
উনার কথা পাত্তা না দিয়ে আমি ওয়াশরুমের দিকে ছুটলাম।

রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি তুষার ভাইয়া বাবা’র সাথে কথা বলছেন।উনার গায়ে ফরমাল ড্রেস।এতক্ষণ তো খেয়ালই করিনি। অবশ্য প্রতিদিনই উনাকে এই পোশাকে দেখি।কারণ সকালে অফিসে যাওয়ার সময় উনি আমায় প্রাইভেটে নামিয়ে দিয়ে যান।তারপর আমি কলেজ চলে যাই।
আর যাই হোক তুষার ভাইয়াকে সব পোশাকেই দারুণ লাগে।উনার সব জামা-কাপড় একদম হাইফাই লেভেলের।আর হবে না-ই বা কেনো।কোটিপতি বাবার হীরের টুকরো ছেলে তো।উনি দেখতেও খুব স্মার্ট।উনার হেয়ার কাটিং এবং গালের দাঁড়ির কাট টা আমার খুব ভালো লাগে।এই দুটি জিনিসের কারণে উনার সৌন্দর্য মনে হয় দ্বিগুণ উজ্জ্বল দেখায়।আমি মনে মনে প্রার্থনা করি আমারও যাতে এমন সুদর্শন একজন লাইফ পার্টনার হয়।তবে তুষার ভাইয়ার মত বদমেজাজি না হলেই চলে।প্রথম প্রথম তো আমিও তুষার ভাইয়ার উপর ক্রাশ খেয়ে বসেছিলাম।তবে এই ব্যাপারটা উনাকে ভুলেও বুঝতে দেই নি।
চোখের সামনে এত সুন্দর একজন লোক থাকলে ক্রাশ খাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই যে উনার স্বভাবের কারণে তাঁর প্রতি আমার বিরক্তির শেষ নেই।অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর উপর থেকে আমার মন উঠে গেছে।এখন তো আমার ক্রাশ ইয়াসির ভাইয়া।তবে যতই ক্রাশ খাই প্রেম করার মত বাজে ইচ্ছা আমার নেই।হিহিহি।
সমস্ত জল্পনা কল্পনা বন্ধ করে আমি মা’য়ের কাছে গেলাম।মা কিচেনে পরোটা বেলতে ব্যস্ত।

” মা! তুমি আমাকে আরো আগে ডেকে দিলে কি হত?দেখলে তো আজ দেরি হয়ে গেল।তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও।”

আমার কথা শুনে মা পরোটা বেলা থামিয়ে দিলেন।কঠোর গলায় বলতে লাগলেন,

” যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর! তোকে ডাকতে ডাকতে সকাল বেলা আমার গলা শুকিয়ে যায় আর তুই বলিস আমি ডাকিনি! দাঁড়া আজ তোর বাবা’র থেকে তোকে বকা খাওয়াব।আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠিয়ে রেখেছে একেবারে।”

মা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাত টেনে নিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমে।হায় হায়! কি থেকে কি হয়ে গেল।

” শুনেছো তোমার মেয়ের কথা?প্রতিদিন ওর থেকে আমার এই অপবাদ শোনা লাগে আমি নাকি ওঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি না।”

মা’য়ের উচ্চ স্বরের আওয়াজ শুনে বাবা এবং তুষার ভাইয়া দুজনেই কথা বন্ধ করে তাকালেন।
মা আবার বললেন,

” তুষার তুই তো আজ সামনে ছিলি।তুই বল কিছু!”

আমি একপলক তুষার ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলাম।আমাকে বকা দেওয়ার একটা ভালো সুযোগ পেয়েছে তাহলে ছাড়বে কেনো।

” মামী ওঁকে বিয়ে দিয়ে দাও!বিয়ের পর জামাইয়ের হাতের উত্তম-মাধ্যম খেয়ে দেখবে একেবারে লাইনে এসে গেছে।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে বাবা হাহা করে হেসে উঠলেন।মাও বিড়বিড় করতে করতে কিচেনের দিকে গেল।

” বিয়ে ছাড়া আর কোনো গতি নেই এই মেয়ের।বিয়ে দিলেও তো আমার জ্বালা হবে।একটা ঘরোয়া কাজ এই মেয়ে করতে পারে না।ওঁকে নিয়ে যে আমার কত দুর্দশা সইতে হবে কে জানে।”

আমি তো একদম আবুল হয়ে গেছি।যে যেভাবে পারছে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে আমায়।একটা অবলা বাচ্চার প্রতি ওঁরা কিভাবে এত কঠোর হতে পারে!

” তুই এভাবে পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আজকে কি তোর প্রাইভেট না যাওয়ার ধান্ধা? এমন কোনো প্ল্যান থাকলে সেটা ভুলে যা।জলদি নাস্তা কর।”

তুষার ভাইয়ার কাটা কাটা কথাগুলো বিষের মত লাগছে আমার।বাবার সামনেও এভাবে কথা বলছে আমার সাথে! অমানুষ ছেলে একটা! এত রুক্ষ মেজাজের ছেলেটা কি করে প্রেম করে কে জানে!কোন অভাগিনী উনার গার্লফ্রেন্ড তাঁকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।

আমি নাস্তার প্লেট নিয়ে সোফায় বাবা’র পাশে এসে বসলাম।আমার খালি পরোটা খুব পছন্দের। সকালে আমি শুধু একটা পরোটাই খাই।
তুষার ভাইয়ার দিকে নজর পরতেই দেখি তিনি একবার আমার দিকে একবার প্লেটের দিকে দেখছেন।কি ব্যপার!উনার পরোটা খেতে মন চাইছে কিনা কে জানে।

” পরোটা খাবেন তুষার ভাইয়া?”

উনি আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে ধমকে উঠলেন।
” তুই শুধু একটা পরোটা খেয়ে দুপুর পর্যন্ত থাকবি নাকি?”

” ঠিক ধরেছেন।সকালে আমি অল্প করেই খাই।”

” তাতো খাবিই।ছুঁচোর মত মানুষ ছুঁচোর মতই তো খানা খাবি।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম হওয়ার মত অবস্থা। উনি আমাকে ছুঁচো বলল?আমার বাসায় এসে আমাদের সোফায় বসে আমাকেই সরাসরি ছুঁচো বলে দিলেন!
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,

” বাবা দেখেছো তুষার ভাইয়া আমাকে ছুঁচো বলেছে।তুমি কিছু বলবা না?এই যে শুনুন।আমার পেটে যতখানি জায়গা ধরে আমি ততখানিই তো খাব নাকি।আমি তো আর আপনার মত হাতি না যে বেলায় বেলায় এত্ত এত্ত খাবার খাব!”

পাশ থেকে বাবা বললেন,
” একি মা! এসব কি বলছো?তুষার তোমার থেকে বয়সে বড়।এগুলো আর বলবে না।আর তুষার তো ভুল কিছু বলেনি।দুপুর পর্যন্ত এভাবে খালি পেটে থাকলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হবে।তোমাকে তো কত বলি।কিন্তু তুমি তো শোনার পাত্রী নও।”

চোখ পাকিয়ে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।তিনি শান্ত চোখে আমাকে দেখছেন।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার।সাথে কান্নাও আসছে।আমার ধারণা মা বাবা সবসময় উনাকে আমার থেকেও বেশি আদর করে।উনি হাজার দোষ করলেও তাঁরা স্বীকার করবে না।আমার সহজ সরল বাবা মা দুজনকে এই লোক বশ করে ফেলেছে।



রাস্তায় জ্যামের মধ্যে আটকা পড়ে আছি।ঢাকা শহরের জ্যাম যে কত বিরক্তিকর। আজ মনে হয় প্রাইভেটটা মিস যাবে।পাশে তাকিয়ে দেখি তুষার ভাইয়া একহাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে অন্য হাতে মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছেন।ইস যদি আমারও একটা মোবাইল থাকত!বাবা’কে কত রিকোয়েস্ট করেছিলাম।মা অবশ্য রাজি ছিল না।শেষমেষ কিন্তু বাবা’কে পটিয়ে ফেলেছিলাম।তারপরও কেনা হলো না।হবে কিভাবে! একটা বিরাট মাপের ভুত যদি ঘাড়ে চেপে বসে থাকে তাহলে কোনো প্ল্যান সাকসেসফুল হয় নাকি।
সেদিন মোবাইল কেনার জন্য ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম ঠিক সেই মুহুর্তে দরজার সামনে তুষার ভাই হাজির।উনাকে দেখেই আমার মন কু ডাকছিল।
অবশেষে দেখি আমি যা সন্দেহ করেছি সেটাই ঠিক। আমার সামনেই তুষার ভাইয়া বাবা’কে সুন্দর সাবলীল ভাষায় মোবাইলের অপকারিতা সম্পর্কে একটা মস্ত বড় থিওরি দাঁড় করিয়ে দিলেন।
মোবাইল হাতে পেলে নাকি আমি গোল্লায় যাব।আমি নাকি পরীক্ষায় ফেল করে বসব।ব্যস্! বাবাও উনার কথা শুনে বেঁকে বসলেন।আর মোবাইল কেনা হলো না।অভিমানে-কষ্টে সেদিন ভাত পর্যন্ত খাই নি।তবুও বাবা’কে মানাতে পারিনি।মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমি তাঁদের মেয়েই না।ওই তুষার না ফুষার নামের বনমানুষটা তাঁদের সবকিছু।

” নে এটা শেষ কর তাড়াতাড়ি। ”

তুষার ভাইয়ার ডাকে হুঁশ ফিরল আমার।তাকিয়ে দেখি উনি একটা কেকের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

” এখন কেক খাব কেনো?আমি তো পরোটা খেয়ে এসেছি।”

” তুই যে পরোটা খেয়েছিস সেটা আমি সচক্ষে দেখেছি।বেশি কথা না বলে কেকটা খা।পেছনের সিটে পানির বোতল আছে।”

আমি বিরক্ত মুখে কেক টা নিলাম।উনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে উনি ডেইলি আমাকে জোর করে গাড়িতে কিছু না কিছু খাইয়ে ছাড়বেন।সকালে বেশি কিছু খেলে আমার কেমন কেমন যেন লাগে।কিন্তু এই লোক কি আর আমার কষ্ট বুঝবে!কিছু বলতে গেলেই কেকের সাথে একদফা ধমক খেতে হবে।

কেক শেষ করে পানির বোতল হাতে নিতেই ভাইয়া বলে উঠলেন,

” সেদিন কলেজের সামনে একটা ছেলে তোকে ডিস্টার্ব করেছিল তাই না’রে নীলাশা?”

আমি আঁতকে উঠলাম।তুষার ভাইয়া এই খবর কিভাবে পেল?
চোখের কোনা দিয়ে চেয়ে দেখি উনি এখনো মোবাইল টিপছেন।দুয়েকদিন আগে কলেজ ছুটির পর একটা ছেলে বারবার আমার সাথে কথা বলতে চাইছিল।আমি ইগনোর করেছি।ছেলেটাকে দেখতে সুবিধার মনে হচ্ছিল না।কেমন গুন্ডা টাইপের।শুধু ওই একদিনই ছেলেটা’কে দেখেছি।এরপর আর কখনো ডিস্টার্ব করেনি।
কিন্তু এই কাহিনী তো আমি কাউকে বলিনি।এমনি কি মা’কেও নয়।তাহলে তুষার ভাইয়া পর্যন্ত খবরটা পৌঁছাল কি করে!

” কথা বলছিস না কেনো নীলাশা?”

তুষার ভাইয়ার মুখে নীলাশা ডাক শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।সবসময় উনি আমায় নীল বলেই ডাকে।যখন প্রচন্ড হাইপার হয়ে যায় তখনই শক্ত কন্ঠে নীলাশা বলে ডেকে উঠে। কিন্তু আমার উপর রাগ করার কারণ কি! ওই ছেলে আমাকে ডিস্টার্ব করেছে এতে আমার দোষ কোথায়?

” না ভাইয়া…মানে কথা বলার চেষ্টা করেছিল।কিন্তু বিশ্বাস করো আমি চোখ তুলেও তাকাইনি।শুধু ওই একদিনই দেখেছি ছেলেটাকে। এরপর তো আর কখনো সামনে আসে নি।”

” সামনে আসার মত অবস্থায় থাকলে তবে তো সামনে আসবে। ”

” কেনো ভাইয়া! ওই ছেলের কি হয়েছে?”

তুষার ভাইয়া চোখ লাল করে আমার দিকে তাকালেন।মাঝে মাঝে উনাকে আমার প্রচন্ড ভয় লাগে।কারণ উনি এমনিতে বকা, ধমক,ঝারি দিলেও এত সহজে হাইপার হন না।খুব কম সময়ই উনাকে বাজে ভাবে রেগে উঠতে দেখা যায়।যেমন এখন সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে।আমি কি এমন বলেছি যে এভাবে সাপের মত ফোঁস ফোঁস করছে!

” ওই ছেলের খবর জানার জন্য তো দেখি ছটফট করছিস! শোন নীলাশা! আমার সাথে কোনো ধরনের চালাকি করতে আসিস না।ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে।তুই আসলে যেরকম ভোলা ভালা সেজে থাকিস আসলে তুই তেমন না।তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি।”

আমার চোখে প্রায় কান্না আসার উপক্রম। তুষার ভাইয়া’র মনে আমাকে নিয়ে এত খারাপ ধারণা! কি করেছি আমি? কথার প্রেক্ষিতে ওই ছেলেটা সম্পর্কে একটা সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি।আর এতেই আমাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল?আজকের পর থেকে আমি আর কখনো উনার গাড়ি দিয়ে প্রাইভেট -কলেজ কোথাও যাব না।আমি তো কোনোকালেই রাজি ছিলাম না।শুধু মা আর উনার জোরাজোরিতে বাধ্য হয়েছিলাম।কিন্তু উনি আমাকে সেধে এনে এমন অপমান করবে জানলে উনার এই আজাইরা গাড়িতে পা ও রাখতাম না।
আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে কান্না কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি।তখনই টের পেলাম জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। আজ আর প্রাইভেট পড়া হলো না।

কলেজের সামনে গাড়ি থামতেই আমি নেমে পড়লাম।উনার দিকে ফিরেও তাকাই নি।আমাকে যে খারাপ মেয়ে মনে করে তাঁর সাথে চোখ মেলানোর কোনো ইচ্ছাই নেই আমার।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here