মন গহীনে,পর্ব_২১

0
2150

মন গহীনে,পর্ব_২১
সামান্তা সিমি

ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।নিজেকে দেখছি খুঁটিয়ে খুটিয়ে।না চাইতেও নজর চলে যাচ্ছে চিবুকের গর্তটার দিকে।এই সামান্য গর্তও যে কারো কাছে এতটা প্রিয় হয়ে দাঁড়াবে তা কি কোনোদিনও ভাবতে পেরেছিলাম?
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই লজ্জায় রাঙা হচ্ছি।কিভাবে যাব তুষার ভাইয়ার সামনে।কিভাবে উনার চোখে চোখ মেলাব।নিশ্চিত জ্ঞান হারিয়ে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।

ডায়রীর পাতা গুলো এই চারদিনে হাজারবার চষে ফেলেছি।যতবার পড়েছি ততবারই মনে হয়েছে উনি আমার সামনে বসে আছেন।স্থির চাহনিতে দেখছেন আমাকে।
এখন শুধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কবে তিনি ফিরবেন।উনি যাওয়ার পর এখনো পর্যন্ত উনার সাথে কথা হয় নি।ধুর! যদি একটা মোবাইল থাকত তাহলে কথা বলতে পারতাম।উনার গলার স্বর শুনতে খুব ইচ্ছা হয়।আমাকে পাগল বানিয়ে নিজে তো পরদেশে গিয়ে বসে আছে।
মাঝে মাঝে একলা ঘরে বসে উনার কথা ভাবতে গিয়ে আনমনেই হেসে উঠি।কখনো দুহাত দুইদিকে মেলে অনবরত ঘুরতে থাকি।আবার কখনো আয়নার সামনে বসে নিজেই নিজের সাথে বাক্যালাপ করি।এসব করতে গিয়ে সেদিন তো মা’য়ের সামনে লজ্জায়ও পড়েছি।

সেদিন বিকেলে মা ঝাড়ু দেওয়ার জন্য রুমে ঢুকতেই আমাকে হাস্যরত অবস্থায় দেখে ফেলেছে।বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পেড়েছিলাম তখন।মা কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুড়ল,

” তুই একা বসে হাসছিস যে?কি হয়েছে তোর?শরীর ঠিক আছে?”

মা’য়ের কথা শুনে মুখ কালো করে ফেলেছিলাম।সবকিছুতেই মা এই কথাটা জিজ্ঞেস করবেই করবে।দেখা যাবে পানির গ্লাস আমার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে তখন জিজ্ঞেস করবে শরীর ঠিকঠাক? আবার যদি বলি মা ভীষণ ঘুম পাচ্ছে কেনো জানি।তখনও বলবে শরীর মনে হয় ঠিক নেই।

.

রাতের বেলা ড্রয়িংরুমে বাবার সাথে বসে টিভি দেখছি।মা কিছুদূরে সোফায় মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।একটু আগে মা এবং বাবার মাঝে ছোটখাটো একটা মিষ্টি ঝগড়া হয়ে গেছে।আমার কাছে এটা মিষ্টি হলেও মা’য়ের কাছে খুবই ভয়াবহ ব্যাপার।
মা এসেছিল টিভিতে সিরিয়াল দেখতে।সেইসময় বাবাও হাজির নিউজ দেখবে বলে।ব্যস! শুরু হয়ে গেল দুইজনের তর্কাতর্কি।রুমে বসে আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছি আসল ঘটনা।এগুলো শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত।তবুও কৌতুহলের কারণে ড্রয়িংরুমে একবার উঁকি দিলাম।বাবা আমাকে দেখে বলে উঠল,

” তোমার মা’য়ের জি বাংলা, স্টার জলসা ছাড়া চলে না।এসব দেখে কি লাভ হয় তুমিই বলতো মা!এগুলো দেখলে ভালো মানুষও কূটনামী শিখে ফেলবে অচিরেই।এরচেয়ে ভালো বসে বসে নিউজ দেখা।দেশ বিদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।”

বাবার কথা শুনে মা সাথে সাথে তেতে উঠল।চোখমুখ পাকিয়ে বলল,

” তোর বাবার কথায় সায় দিবি না নীলাশা।আমাকে উনি নিউজের উপকারিতা শিখাতে আসে!তুই জানিস তোর বাবা কোন পদ্ধতিতে নিউজ দেখে?সোফায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।যখনই আমি রিমোট দিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে যাব তখনই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে।”

” দেখলে নীলাশা! আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।কেমন কূটনীতিবাজ হয়ে গেছে তোমার মা।আরে আমি আবার কখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখলাম।তোমার মা’য়েরই চোখে দেখার ভুল।”

” দেখ্ দেখ্ নীলাশা তোর বাবা ইনিয়ে বিনিয়ে আমাকে কিন্তু কানা বলছে।সরাসরি না বললেও কি আমি বুঝতে পারি না।তোর বাবা মনে করে সে ছাড়া দুনিয়ার সবাই বেকুব,সবাই অবুঝ।”

” নীলাশা সবাই অবুঝ কিনা জানি না।কিন্তু তোমার মা যে অবুঝ এটা স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই।”

তর্কাতর্কি আরো বেড়ে গেল।আমি একবার বাবার দিকে আরেকবার মা’য়ের দিকে তাকাচ্ছি। তাদের ঝগড়া দেখে খারাপ লাগছে না।কেমন বাচ্চাদের মত ঝগড়া করছে।
ঝগড়ার শেষ পর্যায়ে মা হেরে গেল।বাবা বিজয়ীর মুখে সোফায় আয়েশ করে বসেছেন নিউজ দেখার জন্য। সাথে আমাকেও বসিয়ে রেখেছেন।সেই থেকে আমিও নিউজ দেখছি।

মা’য়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি আমাকে ইশারায় কিছু দেখাচ্ছে। মা’য়ের দৃষ্টি অনুসরণ তাকিয়ে দেখি বাবা সত্যি সত্যিই সোফায় মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঝিমাচ্ছেন।আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না।মাও আমার সাথে গলা মেলাল।দুজনের হাসির আওয়াজ পেয়ে বাবা ধড়ফড় করে উঠে বসলেন।কিছু বলতে যাবে এমন সময় টেবিলে রাখা মোবাইল বেজে উঠল।স্ক্রিনে ফারদিন তুষার নামটা দেখেই আমার ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করতে লাগল।মেসেঞ্জারে ভিডিও কল দিয়েছেন উনি।
বাবা হাত বাড়িয়ে কল রিসিভ করলেন।তখনই স্ক্রিনে ভেসে উঠল উনার শক্তপোক্ত গড়নের মুখচ্ছবি। আজ কতদিন পর উনাকে নড়নচড়ন অবস্থায় দেখতে পেলাম।
তুষার ভাইয়া যাতে আমাকে দেখতে না পায় তাই আমি সোফার অপর পাশে চেপে বসলাম।তবে আমি ভালো করেই উনাকে দেখতে পাচ্ছি।
মা বাবা তুষার ভাইয়াকে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করছে।উনিও হেসে জবাব দিচ্ছেন। আমি শুধু অপলক দেখছি উনাকে।
হঠাৎ করেই তুষার ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,

” নীল কেমন আছে?সে কি কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে?”

বাবা বলল,
” এইতো নীলাশা এখানেই বসে আছে।নে কথা বল।”

বাবা আমার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন।
তুষার ভাইয়ার মুখ গম্ভীর।চোখে কাঠিন্যতা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। উনি এভাবে কেনো দেখছেন আমায়?উনি দেশের বাইরে যাওয়ার আগে কোনো কারণে আমার উপর রেগেছিলেন নাকি?

” ক..কেমন আছেন তুষার ভাইয়া? ”

তুষার ভাইয়া এখনো অদ্ভুত চোখে দেখছেন আমায়।মনে হচ্ছে যেন এই মেয়েটাকে প্রথমবার দেখছেন।
হয়তোবা আমাকে ভিডিও কলে কাজের মহিলার মত লাগছে যার জন্য আমাকে চিনতেই পারছেন না।ধুর!উনি কল দিবে জানলে আমি চুল টুল আঁচড়ে সেজেগুজে বসে থাকতাম।

” ভাইয়া আপনি…”

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তুষার ভাইয়া কল কেটে দিলেন।মুখটা চুপসে গেল আমার।কি হলো এটা?উনি কি ইচ্ছে করেই এমন করলেন?
বাবাকে মোবাইলটা ফেরত দিয়ে চলে গেলাম নিজের রুমে।মনটাই খারাপ হয়ে গেল।কিছুটা অপমানও বোধ হচ্ছে।

_______________________

বিকেলে চলে গেলাম ফুপির বাসায়।বাসায় বসে বসে বিরক্ত হওয়া ছাড়া তো আর কোনো কাজ নেই।তারচেয়ে ভালো তুষ্টি আপুর সাথে আড্ডা দেব।সুযোগ পেলে তুষার ভাইয়ার কথাও জিজ্ঞেস করে ফেলব।
রুমে ঢুকে দেখি আপু কারো সাথে ফোনে কথা বলায় মশগুল।আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মিষ্টি হাসলেন।আমাকে ফিসফিস করে বলল,

” ভাইয়া কল করেছে কথা বলবি?”

বড়সড় একটা ঢুক গিললাম।মন তো চাইছে একটাবার কথা বলতে কিন্তু উনার প্রতি অভিমান জমে আছে এক বুক।মাথা নেড়ে আপুকে বুঝিয়ে দিলাম কথা বলতে চাই না আমি।কিন্তু আপু তা গায়ে মাখল না।উল্টে বলল,

” নাও ভাইয়া..নীলাশা আমার সাথেই আছে।কথা বলো”

আপু জোর করে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন।এমন ঝামেলায় পড়তে হবে জানলে এখানে কখনোই আসতাম না।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

” হ্যালো ভাইয়া..!”

আমাকে অবাক করে দিয়ে আবারো খট করে ফোন কেটে দিলেন উনি।অসহায়ের মত আপুকে ফোনটা দিয়ে দিলাম।অপমানে কষ্টে এবার আমার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।আর যাই হোক কেউ আমাকে অবহেলা করলে সেটা আমি কিছুতেই মানতে পারি না।আর অবহেলা যদি প্রিয় মানুষটা করে থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে বললাম,

” তোমার ভাইটা আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না তুষ্টি আপু!দেখলে কিভাবে মুখের উপর ফোন কেটে দিল!এজন্যই আমি কথা বলতে চাই নি।খুবই খারাপ লোক উনি।কোনো ম্যানারস্ জানে না।”

” আরে নীল বনু তুই শুধু শুধু মন খারাপ করছিস।ভাইয়ার হয়তোবা কোনো আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেছিল।তাই..”

” হ্যাঁ আমি কথা বলার সময়ই উনাকে আর্জেন্ট কাজগুলো ডাকাডাকি করে।আসলে উনি আমার সাথে কথা বলতেই চায় না।অপছন্দ করে আমাকে।”

” প্লিজ থাম নীলাশা। তুই জানিস ভাইয়া তোকে কতটা….”

” কতটা কি?”

” বাদ দে।চল ছাদ থেকে ঘুরে আসি।এতক্ষণে রোদ পড়ে গেছে নিশ্চয়ই। একটু হাঁটাহাঁটি করা যাবে।”

ছাদে গিয়ে আপু নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা জুড়ে দিল।আমার সেগুলোতে মন নেই একফোঁটা। শুধু ভাবছি উনি আমাকে প্রত্যেক্ষভাবে এরকম ইগনোর করছেন কেনো?বিদেশে গিয়ে কি নতুন কাউকে পছন্দ হয়ে গেছে। এদিকে আমি উনার জন্য মনের ভেতর হাজারো প্রেমের অনুভূতি সাজিয়ে রেখেছি আর উনি একেকটা অবহেলা দ্বারা দূরে ঢেলে দিচ্ছেন আমায়।ডায়রীর লেখাগুলোর সাথে বাস্তবে উনার আচার ব্যবহারে কোনোই মিল পাচ্ছি না।আমি কি তাহলে উনার মোহ ছিলাম?মোহ কেটে গেছে এখন আর আমাকে ভালো লাগে না।সরাসরি যদি উনি আমাকে এমন অবহেলা করে তাহলে সেটা কোনোমতেই সহ্য করতে পারব না।এখন বুঝতে পারছি প্রথম প্রেম যতটা না খুশির উত্তেজনা নিয়ে আসে তারচেয়েও বেশি কষ্ট দেয়।কেনো উনি আমাকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করালো?নিজের ছোট্ট দুনিয়ায় আমি তো ভালই ছিলাম।সেখানে কেউ আমাকে অবহেলা করত না,কেউ কষ্ট দিত না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here