মন গহীনে,পর্ব_২২

0
2118

মন গহীনে,পর্ব_২২
সামান্তা সিমি

কেটে গেছে আরো কয়েকটা দিন।সকালে পূর্বদিকে সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ে।আবার নিয়ম মেনে বিকেলে সেই সূর্য হেলে পড়ে পশ্চিম পাড়ে। ঠিক এমনই নিয়ম মেনে আমার ছোট্ট মনটাও প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণায় ভুগছে।এ যন্ত্রণা কেউ দেখতে পায় না।কাউকে বুঝানো যায় না।বাইরে থেকে হাসিখুশি থেকে ভেতরে তা চেপে রাখতে হয়।আমি অসহ্য হয়ে গেছি।তুষার ভাইয়ার সেদিনের ব্যবহারের কথাটা মনে পড়লেই চোখের কোণে পানি জমে উঠে।
এরপর আরো কয়েকদিন উনি বাবাকে কল করেছিলেন।তখন আমি আশেপাশেও থাকিনি।কি দরকার?উনি আমার সাথে কথা বলতে চায় না তাহলে আমি কেনো আগ্রহ দেখাবো?
মা বলেছিল উনি নাকি আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে।কি করি,বাইরে কোথাও যাই কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি উনার ব্যপারে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।মনে জমে আছে অভিমানের স্তূপ।উনি কবে ফিরবেন সেটা নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।পনেরদিন পর আসুক আর একমাস পর আসুক তাতে আমার কি!একবছর পর আসলেও আমি খোঁজ নেব না।

যতই নিজেকে এটা সেটা বলে বুঝাই অবাধ্য মনটাকে মানাতে পারি না।ঘুরেফিরে সেই উনার কাছেই ফিরে যায়।নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।মাঝেমধ্যে কিছু অদ্ভুত কর্মকান্ডও করে বেড়াচ্ছি। যেমন,
গতকাল পানি খাওয়ার জন্য গ্লাসে পানি ঢালছি।গ্লাস ভর্তি হয়ে পানি উপচে পড়ছে অথচ আমার খেয়াল নেই।পুরো টেবিল ভেসে যাওয়ার পর হুঁশ আসলো।মা এসে কিছুক্ষণ বকাঝকা করেছে।
সন্ধ্যায় বাবাকে চা বানিয়ে দিলাম।কাপে একচুমুক দিয়ে বাবার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।জিজ্ঞেস করলাম,

” চা কি ভালো হয়নি বাবা?খাচ্ছো না কেনো?”

চায়ের কাপ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাবা হেসে বলল,
” ভালো হয়েছে কিন্তু লবণটা মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছে।”

এই কথা শুনে লজ্জায় আমার মাথাকাটা গেল।নিশ্চয়ই মনের ভুলে চিনির বদলে লবণ দিয়ে বসে আছি।ইস! বাবা এখন ভাববে তাঁর মেয়ে এখনো এক কাপ চা বানাতে অক্ষম।নিজের উপর রাগ হচ্ছিল খুব।

রাতে বালিশে মাথা রাখতেই মন খারাপেরা দল বেঁধে হানা দিল।আমি খেয়াল করেছি দিনের বেলাটা যেমনই কাটে,রাতের অন্ধকারে যন্ত্রণা গুলো যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়।মন বলছে তুষার ভাইয়া বিদেশ থেকে তাঁর নতুন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আসবে।হয়তোবা বিয়েও করে ফেলতে পারে।যদি এমনই হয় তাহলে ওই ডায়রী আমি আগুনে পোড়াব।
নানা আজগুবি কথা ভাবতে ভাবতে চোখের কোনা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তপ্ত দীর্ঘশ্বাস!একসময় চোখে ঘুম জড়িয়ে আসল।

.

মুখের উপর রোদের তীব্র রশ্মি অনুভব হতেই বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে ফেললাম।ঘুমের কারণে চোখ খোলার শক্তি পাচ্ছি না।তবে মেজাজ প্রচন্ড গরম হচ্ছে। আজ মা’য়ের কি হলো!কোনোদিন তো এমন করে না।নিশ্চয়ই জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়েছে।অসহ্য!
চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম,

” পর্দা লাগাও মা!রোদের কারণে গরম লাগছে আমার।”

কোনো সাড়াশব্দ নেই।পাশ ফিরে রোদ থেকে বাঁচার জন্য চেপে গেলাম।এবার তো মনে হচ্ছে রোদের তেজ আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
লাফ দিয়ে উঠে বললাম,

” ধ্যাত্! কেউ আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না নাকি।আমি যে ঘুমাচ্ছি এটা কারোর সহ্য হচ্ছে না তাই না?আমি থাকব না এই বাসায়!আজকেই বেরিয়ে……”

সামনের মানুষটাকে দেখে থেমে যেতে হলো আমার।আমি কি ভুলভাল কিছু দেখছি নাকি?বোধ হয় স্বপ্নে আছি এখনো।
দুইদিকে মাথাটা ভালো করে ঝাঁকিয়ে চোখ কচলে নিলাম।আবারো একই দৃশ্য! তারমানে এটা সত্যি!
তুষার ভাইয়া আমার পড়ার টেবিলের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে আরামসে বসে আছেন।গায়ের অ্যাশ কালারের শার্টটা বিভিন্ন জায়গায় কুঁচকে আছে।মাথার চুলগুলোও সামান্য এলোমেলো। উনার হাতে মোবাইল।দেখে মনে হচ্ছে গেইম খেলায় ব্যস্ত।
আমি অবাক হয়ে দেখছি উনাকে।কিন্তু উনি জানপ্রাণ দিয়ে গেইম খেলে যাচ্ছেন। এই সাতসকালে উনার আগমন আমায় অবাকের সপ্তম চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।

তুষার ভাইয়া মাথা তুলে একপলক আমাকে দেখে আবার মোবাইলে মনযোগ দিলেন।আমি এখনো কিছুই বলছি না।উনি এবার মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন।

” তুই শান্তিতে থাকলে তো সবার আগে আমার সহ্য হয় না।তাই আমিই নিজের হাতে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়েছি।”

আমি কোনো উত্তর দিচ্ছি না।অপলক তাকিয়ে আছি উনার শান্ত গভীর দুটো চোখের দিকে।
তুষার ভাইয়া আবার বললেন,

” চুপ মেরে আছিস কেনো?একটু আগে কি বলছিলি?এই বাসায় থাকবি না তাই তো?সমস্যা নেই।বিয়ের জন্য তৈরি হ।তোকে খুব তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে মামা মামীকে টেনশনমুক্ত করব।বিয়ের জন্য কেমন পাত্র চাই বল।আমার হাতে বর্তমানে একটা সুপাত্র আছে।ছেলেটার সবই ঠিক আছে।শুধু মাথায় টাক।এটা কোনো ব্যাপার না।বিয়ে হলো মনের মিল।মনের মিলের কাছে টাকফাক কিছু না। ”

আমি টের পাচ্ছি আমার চোখ ছলছল করে উঠছে।নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। যে মানুষটাকে এতদিন ভেবে নির্ঘুম রাত পার করেছি,যে মানুষটা আমার ছোট্ট সাজানো দুনিয়ায় অনায়াসে প্রবেশ করে আমাকে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে সেই মানুষটা এই মুহূর্তে আমার সামনে বসে কি সতেজ মনে ইয়ার্কি করে চলেছে।ঠিক যেমন আগে করতেন।
হঠাৎ করেই ডায়রীর গুটিকয়েক লাইন আমার মনে পড়ে গেল।

‘ বিশ্বাস কর আর পারছি না এভাবে থাকতে।একতরফা ভালোবাসতে গিয়ে ক্লান্ত আমি।আমার পাগলাটে মন তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে আছে।তুই হবি কি আমার?’

নিজেকে সামলাতে পারলাম না আর।তুষার ভাইয়ার প্রতি যত অভিমান জমে ছিল,যত রাগ জমে ছিল সব ভুলে গিয়ে উনাকে দুইহাতে শক্ত জড়িয়ে ধরলাম।উনার অগোছালো শার্টটাকে খামচে ধরে আরো অগোছালো করে দিচ্ছি। একহাতে শার্ট অন্যহাতে এলোমেলো চুলগুলোকে আঁকড়ে ধরলাম।না চাইতেও চোখ দিয়ে নোনা জল বের হয়ে গেল।ফুঁপিয়ে কান্না করছি আমি।

তুষার ভাইয়া কোনো রেসপন্স করছেন না।আমি এমন কিছু করব তা বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবেনি।না ভাবলে না ভাবুক।আমিও আর পারছি না উনাকে ছাড়া থাকতে।আমিও চাই উনাকে ভালোবাসতে।উনি আমাকে যতটা ভালোবাসে তারচেয়ে তিনগুন ভালোবাসতে চাই আমি।

কিছুক্ষণ পর পিঠে উনার হাতের আলতো স্পর্শ পেলাম।মনে হচ্ছে ধরতে গিয়েও ধরছেন না আমায়। ভাঙা গলায় বলে উঠলেন,

” নীল..!”

আমি আরো শক্ত করে উনাকে চেপে ধরলাম।মন চাইছে উনার বুকের ভেতর ঢুকে যেতে।যেখানে শুধু আমার বসবাস।

” আপনি খুব খারাপ তুষার ভাইয়া।পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ আপনি!আপনাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কি পেয়েছেন আপনি?ডায়রী লিখে পাতা ভর্তি করে আপনি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন তাই না?এতই যদি ভালোবাসেন তাহলে সেদিন আমার সাথে এমন ব্যবহার কেন করলেন?খুব কষ্ট পেয়েছি আমি।খুব!”

” নীল…তুই ডায়রী..”

” হ্যাঁ আমি ডায়রী পড়ে ফেলেছি।একবার নয় হাজারবার।আপনার বিখ্যাত ডায়রী আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।মাছকে পানি থেকে ডাঙায় আনলে যেমন ছটফট করে আমার তেমন অবস্থা হয়েছে।নানা উদ্ভট কাজ করে বেরিয়েছি।সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী।”

এবার তুষার ভাইয়া আমাকে সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন।মুখে হাসি ফুটে উঠল আমার।মনের ভেতর ভালোলাগার প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে।
আমার অবিন্যস্ত চুলে হাত বুলিয়ে তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,

” তুই ঘুম থেকে উঠার এক ঘন্টা আগে বাসায় এসে পৌঁছেছি।জামাকাপড় চেঞ্জ পর্যন্ত করিনি দেখ্।তোকে দেখার জন্য আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছিলাম না।তাই ছুটে এসেছি।কিন্তু তুই আমার জন্য এত বড় সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করে রেখেছিস তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।ভালোবাসি নীল।খুব ভালোবাসি তোকে।”

তুষার ভাইয়া আমার মাথায় চুমু খেলেন।উনার ঘাড়ে আমার মাথাটা আরেকটু চেপে বললাম,

” ভালোবাসা একসেপ্টেড মিস্টার তুষার!আমিও কিন্তু সারপ্রাইজড হয়েছি।ঘুম থেকে উঠে আপনাকে দেখে শকড হয়ে গেছিলাম।”

তুষার ভাইয়া আরো নিবিড়ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।আমিও পরম শান্তিতে উনার ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে আছি।ভালো লাগছে এভাবে থাকতে।উনার শরীর থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা স্মেল আসছে।

হঠাৎ করে মা’য়ের কথা মনে পড়তেই উনাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বসলাম।আমি তো দিনদুনিয়া ভুল মেরে বসে আছি।মা তো যেকোনো সময় রুমে চলে আসতো পারত।হায় আল্লাহ!জোর বাঁচা বেঁচে গেছি।
তুষার ভাইয়া রাগ দেখিয়ে বললেন,

” দূরে গেলি কেনো?কাছে আয়।আমার আরো কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।”

” এহ্! ভুলে গেছেন যে এটা আমার বাসা?যে কোনো সময় মা এসে যাবে।যদি এই অবস্থায় দেখত তাহলে কি ভয়ানক কান্ড হত ভাবতে পারছেন?”

” না ভাবতে পারছি না।কারণ মামী জানে এখন তাঁর মেয়ে এবং হবু জামাইয়ের কথোপকথন চলছে।”

” মানে?”

” মানে কিছু না।”

” বলুন!এত রহস্য নিয়ে কথা বলবেন না।আর সবার প্রথমে আমি এটা জানতে চাই আপনি কেনো সেদিন আমার সাথে ওরকম ব্যবহার করেছিলেন। ”

তুষার ভাইয়া মস্ত একটা হাই তুলে বললেন,
” আমি ভীষণ টায়ার্ড।তোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মুড নেই আমার।শোন আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।একটা ধুমধাড়াক্কা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য। ”

আমার মনে এই মুহূর্তে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে মা সবটা জানে।হায় হায়! এত ঘটনা কবে ঘটনা কবে ঘটল?এই লোক তলে তলে আরো কি অঘটন ঘটিয়ে রেখেছে কে জানে।
তুষার ভাইয়া উঠে দাঁড়াতেই আমি বললাম,

” শুনুন! আমি ভোরবেলা স্বপ্ন দেখেছি আপনি বিদেশ থেকে কোনো মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফুপিকে বলছেন যে মেয়েটা আপনার বিবাহিত বউ।যেহেতু স্বপ্নটা ভোরের দিকে দেখেছি তাই আমার মনে সন্দেহ হচ্ছে আপনি সত্যিই কাউকে নিয়ে এসেছেন নাকি?জলদি বলেন।আমি আপনাকে আর ওই মেয়েকে কুচিকুচি করে কেটে পাশের ডোবায় ফেলে দিয়ে আসব হুম।”

আমার লম্বা বক্তৃতা শুনে তুষার ভাইয়ার কোনো ভাবান্তর হলো না।উনি চোখ ছোট ছোট করে দেখছেন আমায়।উনার এমন চেহারা দেখে আমি হেসে ফেললাম।
তুষার ভাইয়া মুচকি হেসে আমার নাক টেনে বললেন,

” খুব কথা শিখেছিস তাই না?আসছি।”

উনি চলে গেলেন।আমি ঠোঁট টিপে নিজের মনেই হাসছি।আহ্! কি সুখ সুখ লাগছে।দুহাতে মুখ ঢেকে আবার সটান হয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here