মন গহীনে,পর্ব_২৩

0
1882

মন গহীনে,পর্ব_২৩
সামান্তা সিমি

তুষার ভাইয়ার রুমে আমি এবং তুষ্টি আপু হাত জড়াজড়ি করে বসে আছি।দুজনের মুখেই দারুণ উত্তেজনা।ফিসফিস করে একে অপরের সাথে কথা বলছি আর তুষার ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।

কিছুক্ষণ পর খুট করে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো।আমরা দুজন সচকিত হয়ে বসলাম।তুষার ভাইয়া শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছেন।উনার গলায় সাদা টাওয়াল ঝুলানো।গায়ে খয়েরি রঙের টি-শার্ট। পরনে ব্ল্যাক ট্রাউজার্স। উনার চুল থেকে টপটপ পানি পড়ে টি-শার্ট ভিজে যাচ্ছে।
আমি আড়চোখে তাকিয়ে উনাকে দেখে নিলাম একবার।শাওয়ার নিয়ে বের হলে উনার জ্বেল্লা মনে হয় দ্বিগুন বেড়ে যায়।এত রূপ তো আমারো নেই।হুহ্!মাঝেমাঝে বড্ড হিংসা হয় আমার।
তুষার ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই নড়েচড়ে বসলাম।উনার ঠোঁটে বাকা হাসি।

তুষ্টি আপু বলল,
” আমি যা বলেছিলাম সেটা এনেছো তো ভাইয়া?আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না বের করো তাড়াতাড়ি।”

তুষার ভাইয়া এক ভ্রু উঁচু করে মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
” দূর হ ফকিন্নি।আমি নিজের কাজে ওখানে গিয়েছিলাম।তোর জিনিসপত্র আনার জন্য যাইনি।”

” ভাইয়া! না আনলে নাই।ফকিন্নি কেনো বলবা?তুমি জানো আমার কাছে বর্তমানে কত টাকা আছে?আমার সঞ্চয় সম্পর্কে তোমার ধারণাও নেই।”

” এইতো এবার লাইনে এসো বাছাধন। নিজের যখন এতই টাকা তাহলে নিজের জিনিসপত্র গুলো নিজেই কিনে নে।আমাকে বলতে আসবি না।তোর আবদার পূরণ করতে করতে আমার বাপের একাউন্ট শেষ হতে বেশিদিন লাগবে না।এইমাসেই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করব আমি।শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিজের জামাইয়ের টাকা যত ইচ্ছা খরচ কর যা।”

” আমাকে খোঁটা দিলে তুমি ভাইয়া?তোমার একটা মাত্র বোন আমি।আমার বাবার একমাত্র মেয়ে।তোমাকে অভিশাপ দিলাম আমি খুব শীঘ্রই তোমার আইফোন টা ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবে।দুঃখী মেয়ের অভিশাপ কোনোমতেই মিস হবে না।”

” আহারে! তোকে দুঃখী মনে করার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাই না আমি।সব এঙ্গেল থেকে তোকে শকুনি মনে হয়।শকুনির অভিশাপে আইফোনের কিছু হয় না এটা জানিস না?”

তুষ্টি আপু মুখ ফুলিয়ে বসে রইলেন।তাদের ঝগড়াগুলো এতক্ষণ নিঃশব্দে উপভোগ করে যাচ্ছিলাম।কিন্তু তুষ্টি আপুর জন্য বেশ খারাপ লাগছে।কিছু একটা বলতেই হবে।বোন হয়ে বোনের পাশে না দাঁড়ালে হয় নাকি?
তুষ্টি আপুকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম,

” আমার মিষ্টি আপু।ওই ভাল্লুকটার কথায় কান দিও না তো!চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই।আমরা তো এখানে স্বইচ্ছায় অপমানিত হতে আসিনি।”

তুষার ভাইয়া ঠোঁট কামড়ে বললেন,
” এই যে পিচ্চি! সাফাই গাইতে এসেছেন তাই না?আর ভাল্লুক কাকে বলছেন?এতদিন যা বলেছেন ঠিক আছে।কিন্তু এখন থেকে একটু ভেবে চিন্তে কথা বলিয়েন।”

তুষার ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারলেন।ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি।শয়তান লোক একটা।

আমাদের অবাক করে দিয়ে তুষার ভাইয়া দুটো ব্যাগ এগিয়ে দিলেন।আমরা নিচ্ছি না দেখে ভ্রু কুঁচকে ইশারা করলেন নেওয়ার জন্য। তুষ্টি আপু খপ করে কেড়ে নিল ব্যাগ গুলো।
ব্যাগ খুলে আরো অবাক হয়ে গেলাম।দুইটা নতুন ফোন!

তুষ্টি আপু আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন।
” আমি জানতাম ভাইয়া তুমি আনবে আমার জন্য। মাই সুইট ব্রাদার!আমি আমার অভিশাপ তুলে নিলাম ঠিক আছে? আম্মু দেখো..ভাইয়া আমার জন্য নতুন ফোন এনেছে। ইয়াহু..লা লা লা।”

চিল্লাতে চিল্লাতে তুষ্টি আপু রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি হা করে তাকিয়ে আছি।এক মুহূর্তের জন্য আপু যেন বাচ্চা হয়ে গেছে।

” এই যে মিস, শোনেন প্লিজ! ব্যাগ খুলে দেখেন আপনার ফোন পছন্দ হয়েছে কিনা।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আরেক দফা অবাক হলাম।আল্লাহ! আজ অবাক হতে হতে আমি না হার্টঅ্যাটাক করে ফেলি।
ভাইয়া আমার জন্য ফোন কিনে এনেছে!এটাই তাহলে ধুমধাড়াক্কা সারপ্রাইজ ছিল?আহ্! খুশিতে আমি পাগল না হয়ে যাই।
ঝটপট ব্যাগ খুলতেই চকচকে ব্ল্যাক কালারের ফোন বেরিয়ে আসলো।আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে বললাম,

” এটা আমার ফোন!থ্যাংক ইউ সো মাচ্ ভাইয়া!খুব পছন্দ হয়েছে।”

তুষার ভাইয়ার দিকে নজর পড়তে আবারো লজ্জা পেয়ে গেলাম।উনি কেমন ঘোরলাগা চোখে দেখছেন আমায়।এমনভাবে দেখার কি আছে?

” আপনি অন্যদিকে তাকান তো!আমার কেমন যেন লাগছে।”

উনি মুচকি হাসলেন।আমার গাল টেনে বললেন,
” আমার লজ্জাবতীরে!আজ আমি খুব খুশি নীল।এতটা খুশি যে কোন পদ্ধতিতে প্রকাশ করব তা খুঁজে পাচ্ছি না।ইচ্ছে করছে তোকে কোলে নিয়ে নেচে বেড়াই।সারদিন বুকের সাথে জড়িয়ে রাখি।ইচ্ছামত চুমু খাই।”

উনার কথা শুনে আমি কেশে উঠলাম।উনি কি বলছেন নিজেরই বোধ হয় খেয়াল নেই।তবে উনার আনন্দমাখা চেহারা দেখতে খুব ভালো লাগছে।আমার তুষার ভাইয়ার উপর যেন কারো নজর না লাগে!

বের হওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতে তুষার ভাইয়া আবার ডাকলেন।উনি বিছানায় বসে আছেন।কোলের উপর ল্যাপটপ।আমি সেখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলাম,

” কি?”

ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে উনি বললেন,

” কাছে আয়।তারপর বলছি।”

আমি দুইকদম সামনে এগিয়ে গেলাম।

” হয়নি।আরো কাছে আয়।”

” আরে আমার দুইটা কান আছে তো।আমি শুনতে পাই।আপনি ওখান থেকেই বলুন।”

” আমার কথার উপর দিয়ে কথা বলছিস কেনো?আমি উঠে আসলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।”

বিরক্তমুখ নিয়ে উনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গেলাম। উনি বললেন,

” এবার নিচু হ।সিক্রেট কথা।কানে কানে বলতে হবে।”

নিচের দিকে কিছুটা ঝুঁকতেই তুষার ভাইয়া হঠাৎ আমার গালে চুমু খেয়ে নিলেন।আমি তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে গেলাম।ধাক্কা সামলাতে না পেরে স্ট্যাচু হয়ে গেছি।
চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকাতে বললেন,

” এটাই সিক্রেট কথা।যা এখন ভাগ।আমার অনেক কাজ আছে।তুই সামনে থাকলে কাজে মন বসবে না।যাওয়ার সময় মাকে বলিস আমার জন্য এক কাপ কোল্ড কফি পাঠাতে।”

তুষার ভাইয়ার স্বাভাবিক কথাবার্তা শুনে আমি আরো বেকুব বনে গেলাম।উনি এমন ভাব করছেন যেন কিছুই হয় নি।গালে চুমু খাওয়া অতি সাধারণ ঘটনা।আমার কান দুটো গরম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
লজ্জায় আটখানা হয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে।

_______________________

কাঁচের দেয়াল ঘেরা রেস্টুরেন্টে তুষার ভাইয়া এবং আমি মুখোমুখি বসে আছি।আমার পাশেই তুষ্টি আপু গভীর মনযোগ দিয়ে মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছেন। সকালে নতুন মোবাইল পাওয়ার পর থেকে আপু এক মুহূর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করছেন না।রেস্টুরেন্ট এসেছি প্রায় আধাঘন্টার মত হবে।আপু এখনো মোবাইল চালিয়েই যাচ্ছেন।
আর এদিকে অস্বস্তিতে আমার প্রাণ যায় যায়।তুষার ভাইয়ার মুখোমুখি বসাতে উনি একধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনাকে চোখের ইশারায় অনেকবার বলেছি অন্যদিকে তাকাতে।আমার ইশারা পাত্তা না দিয়ে উল্টে উনি ঠোঁট কামড়ে হেসেছেন।

শেষে বাধ্য হয়ে তুষ্টি আপুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললাম,

” আপু প্লিজ এখন তো অন্তত ফোনটা রাখো।ফোনটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।বাসায় গিয়ে তো চালাতে পারবে।”

আমার কথায় কাজ হলো।তুষ্টি আপু ফোন পাশে রেখে বলল,

” আশ্চর্য ভাইয়া কিছু অর্ডার দিচ্ছো না কেনো?এখানে বসে থাকার জন্য এসেছি নাকি?”

” ওহে জরিনার মা।এমনভাবে বলছিস যেন বসে থাকতে থাকতে তুই ক্লান্ত।এতক্ষণ তো ফোনের দুনিয়ায় ডুবে ছিলি।”

“উফ্ ভাইয়া! অলওয়েজ তুমি আমাকে জরিনার মা ফরিদার মা বলে ডাকো।আজকে নতুন ফোন এনেছো বলে কিছু বললাম না।নাহলে দেখতে।”

দুই ভাইবোনের ঝগড়া আবার শুরু হয়ে গেছে।হে আল্লাহ!লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লাম আমি।
তুষার ভাইয়া তা লক্ষ্য করে বললেন,

” তুই কি খাবি নীল?”

” আমি বার্গার।”

” তুই বার্গার মানে?কবে থেকে তুই বার্গার হলি?”

” আহ হা! বলতে চাইছি আমি বার্গার খাব।”

পাশ থেকে তুষ্টি আপু বলল,
” আমার জন্য লাচ্ছি। বেশিকিছু খাব না এখন।”

তুষার ভাইয়া অর্ডার দিয়ে দিলেন।ততক্ষণে তুষ্টি আপু আবার ফোন হাতে নিয়ে ফেলেছে।আর আমি অসহায়ের মত বসে থেকে আশেপাশের লোকজন দেখছি।
তুষার ভাইয়া নিচু গলায় বললেন,

” এদিক সেদিক কি দেখছিস?আমি তো এখানে।”

চোখ পাকিয়ে তুষার ভাইয়ার দিকে তাকালাম।আমার চোখ রাঙানো উনি কিলার হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন। আড়চোখে একবার আপুকে দেখে নিলাম।সে কারো সাথে মেসেজিংয়ে ব্যস্ত।

” আজিব তো! আমি কি আপনাকে দেখার জন্য বসে আছি নাকি?”

” বসে থাকতে কে বলেছে?দৌড়াদৌড়ি কর, লাফালাফি কর।তাও আমার দিকে তাকিয়ে থাকবি শুধু।”

মুখ ঝামটা দিলাম আমি।উনার যতসব বোগাস কথাবার্তা।
খাবার আসতেই তুষ্টি আপু ঝটপট শেষ করে উঠে পড়লেন।আমি এখনো বার্গারে একটা বাইটও দেই নি।আপু ব্যাগে মোবাইল ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,

” আমি আসছি ভাইয়া।তোরা দেরি করিস না।”

আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আপু বের হয়ে গেলেন।অবাক হয়ে তুষার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

” আপু আমাদের ফেলে চলে গেল কেনো?”

” কেনো গেল বুঝিস নি?তোকে আর আমাকে একা কথা বলার জন্য সুযোগ করে দিল আর কি।”

” তারমানে আপু সবটা জানে?”

তুষার ভাইয়া আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিলেন।
” জানে।তুষ্টি জানে এবং মামী জানে।”

আমি এবার আকাশ থেকে পড়লাম।আমার অগোচরে তুষার ভাইয়া কোনো একটা তালগোল পাকিয়েছেন সেটা আমি সন্দেহ করেছিলাম।কিন্তু সন্দেহের ফলাফল এত বড় হবে তা তো ভাবিনি।

” আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন ভাইয়া?আপনি কেনো মা’কে বলতে গেলেন।আমি এখন মা’য়ের সামনে কিভাবে যাব?ও আল্লাহ! আমার কি হবে?আপনি আসলেই অনেক খারাপ ভাইয়া। ”

” আশ্চর্য তুই এমন করছিস কেনো?আগে পরে সবাই তো জানবে ব্যাপারটা।আর মামীকে আমি বলিনি।মামী নিজে থেকেই বুঝে গেছিল। আর এটাই তো স্বাভাবিক।দিনের পর দিন আমি যেভাবে তোকে নিয়ে পজিটিভ ছিলাম,যেভাবে তোর সব ব্যাপারে খবরদারী করেছি সেগুলো চোখে পড়ার মতই।মামী আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছে আমি কোনো দ্বিধা ছাড়া স্বীকার করে ফেলেছি।এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই নীল।মামী মেনে নিয়েছে।কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো বাকিদের জানানো।তুই এগুলো নিয়ে কোনো টেনশন করিস না।সবটা আমি সামলে নিব।তুই শুধু হাসবি,গাইবি আর আমাকে অনেক বেশি বেশি ভালোবাসবি।সময় আসলে আমি নিজেই ওদের সব বলে দেব।”

তুষার ভাইয়ার কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলেও মনের কোণায় একটা ভয় জমে আছে।সব ঠিকঠাক মতো হবে তো?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here