মন গহীনে,পর্ব_৩
সামান্তা সিমি
কলেজের সামনে গাড়ি থামতেই আমি নেমে পড়লাম।উনার দিকে ফিরেও তাকাই নি।আমাকে যে খারাপ মেয়ে মনে করে তাঁর সাথে চোখ মেলানোর কোনো ইচ্ছাই নেই আমার।
ভেতরে ঢুকব এমন সময় তুষার ভাইয়া ডেকে উঠলেন।
” নীল! ছুটির পর এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করিস।বাসায় পৌঁছে দেব আমি।”
কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলাম।
‘
‘
ক্লাস শেষ করে গেইট দিয়ে বের হচ্ছি।তুষার ভাইয়ার হোয়াইট কালারের গাড়িটা কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিন তো নিতে আসে না।তাহলে আজ এত আদিক্ষ্যেতা দেখানোর কারণ কি?আমি তো ঠিক করেছি আর কখনোই তুষার ভাইয়ার গাড়ি দিয়ে আসা-যাওয়া করব না।যাক ভালোই হয়েছে উনি এখনো এসে পৌঁছান নি।। আমি এখন নিজেই বাসায় ফিরে যাব।
চারদিকে আরো একবার নজর বুলিয়ে হাঁটা দিলাম।কিছুটা রাস্তা গিয়ে রিকশা নিয়ে নিব।আজকে গরমও পরেছে খুব বেশি।সূর্যের তাপে আধা সিদ্ধ হয়ে বাসায় ফিরতে হবে।ঠান্ডা কিছু খেতে পারল বেশ লাগত।কিন্তু এখন টাকা খরচ করা যাবে না।ইদানীং আমি খুব হিসেব করে চলি।আমার লক্ষ্য একটা দামি মোবাইল কেনা।কিনেই ছাড়ব আমি।হাতখরচের জন্য বাবা তো অনেক টাকাই দেয়।তবে আমি বেশি প্রয়োজন ছাড়া খরচ করি না।
রিকশাওয়ালা মামা’র সাথে ভাড়া ঠিক করছি তখনই একটা প্রাইভেট কার খুব স্পিডে আমার পাশে এসে থামল।আমি ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলাম।গাড়ি দেখেই বুঝে ফেলেছি এটা তুষার ভাইয়ার। দেখেও না দেখার ভান করে রিকশাওয়ালাকে বললাম,
” আমি রিকশায় উঠলে হুড টা তুলে দিবেন।আর একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেবেন।”
তখনই তুষার ভাইয়া নেমে আসলেন গাড়ি থেকে।দাঁত কটমট করে বলে উঠলেন,
” সাহস তো কম না তোর! আমার কথা অমান্য করিস?মেসেজে কি বলেছিলাম আমি?”
এহ্! কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।একশবার অমান্য করব আমি।উনি কেনো আমার উপর এত অধিকার খাটাতে আসে তা আজও বুঝলাম না।কিসের ভিত্তিতে এমন করে?সে তো আর আমার আপন ফুফাতো ভাই নয়।তাহলে?
সব হয়েছে মা বাবা’র জন্য। তাঁদের আশকারা পেয়েই তো উনি এত বাড় বেরেছে।আমাকে বাদ দিয়ে উনাকে এত আদর না করলেই হয়।এই নিয়ে আমি কিছু বলতে গেলে এক দফা বকা খেয়ে আসি।মা একটু বেশি করে।তুষার ভাইয়াকে যেন দুচোখে হারায়।হুহ্!
আমি দম নিয়ে বললাম,
” অন্যদিন তো ছুটির পর নিতে আসেন না।তাহলে আজ কেনো? এমনিতেও আমি আর আপনার গাড়িতে উঠতে চাই না।কোনোদিনও না।”
” রাস্তার মধ্যে সিনক্রিয়েট করিস না নীল।যা গাড়িতে গিয়ে বস।”
তুষার ভাইয়ার কথা আমি ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলাম।উনার গাড়ি দিয়ে যাব না আমি।ঠাডা পরুক ওই গাড়িতে।
রিকশায় উঠতে যাব ওমনি তুষার ভাইয়া আমার হাত চেপে ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন।
” আরে হাত ছাড়ুন! যাব না আপনার সাথে।আমি একাই যেতে পারব।”
আমার চিল্লানো একটাও গায়ে মাখলেন না তিনি।গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দরজা লক করে দিলেন।আজ আমি অসহায় বলে আমার উপর এত জুলুম,এত অবিচার।ঠিক আছে সময় আমারও আসবে।তখন দেখে নিব।
তুষার ভাইয়া গাড়িতে উঠতেই আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।গাড়ি চলতে লাগল।
কিছুদূর যেতেই ব্রেক কষলেন উনি।বাইরে তাকিয়ে দেখি একটা লেকের পাড়ে গাড়ি থেমে আছে।বাসায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে আমায় কোথায় নিয়ে এল?
আমি কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না।একটু পর নাকে একটা পরিচিত মিষ্টি গন্ধ আসতেই আমার চোখ আপনাআপনি তুষার ভাইয়ার দিকে ঘুরে গেল।উনি তিনটা কোন আইসক্রিম হাতে নিয়ে বসে আছেন। চোখে চোখ পরতেই বললেন,
” খাবি?”
আমি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম এগুলোতে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।সকালে কতগুলো কথা শুনিয়েছে আমায় আর এখন কত ঢং!উনার আইসক্রিম উনিই গিলুক। যদিও আইসক্রিমের ঘ্রাণটা সহ্য হচ্ছে না আমার।মন তো বলছে ছোঁ মেরে একটা নিয়ে নেই।কোণ আইসক্রিম আমার ফেভারিট।
” তুই না খেলে আমার জন্যই ভালো।যা গরম পরেছে আজ।এই তিন তিনটা আইসক্রিম এখন আমার পেটে যাবে।”
বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখি তিনি অলরেডি একটা আইসক্রিমে কামড় দিয়ে ফেলেছে।আমি জানি তো ইচ্ছে করেই এমন নাটক করছে।ও আল্লাহ! আইসক্রিমের স্মেলটা তরতর করে আমার নাকেই প্রবেশ করছে মনে হয়।উনার খাওয়া দেখে তো তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে আসছে।
” আহ্! এত সুস্বাদু আইসক্রিম আমি বোধ হয় আর কখনো খাই নি রে নীল!”
আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।তড়িৎ গতিতে উনার হাত থেকে তিনটা আইসক্রিম ছিনতাই করে নিলাম।আমাকে লোভ লাগানো হচ্ছে তাই না?এবার খালি হাতে বসে থাকুক।এগুলো তো এখন আমার পেটে হজম হবে।হুহ!
” এই তুই না বললি খাবি না! তাহলে আইসক্রিম গুলো নিলি কেনো?”
উনার বলা একটা বাক্যও গায়ে মাখলাম না।জানি হয়তোবা আমাকে খাদক মনে করছে।করলে করুক!
” তুই তো দেখি আস্ত একটা রাক্ষুসী।তিনটা আইসক্রিম একাই খাবি?”
ভালোই জ্বালায় পরলাম তো।নিজেই তো প্রথমে তিনটা সেধেছিল। আর এখন উল্টো দিকে মোড় নিচ্ছে!
আমি সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় একটা আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
” আপনি এটা থেকে একটু খেয়েছেন।নিন এটা।বাকি দুইটা আমি খাব।”
” না।এটা তুই খা।আমায় ওইটা দে।”
বলেই তুষার ভাইয়া আমার অর্ধেক খাওয়া আইসক্রিমটা নিয়ে নিলেন।বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার তো! যাই হোক! বাকিগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।উনি যদি নিজেরটা খাওয়ার পর আবার আরেকটা চেয়ে বসে থাকে তখন!
গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস আসছে।আমার সামনের ছোট চুলগুলো উড়ে এসে বারবার মুখের উপর লাগছে।যতবারই সরিয়ে দিচ্ছি ততবারই যেন ওরা অবাধ্যতা প্রকাশ করছে।
হঠাৎ তুষার ভাইয়ার স্পর্শ পেতেই থেমে গেলাম।উনি হাত দিয়ে এলো চুলগুলো সুন্দর করে কানের পিছনে গুঁজে দিলেন।
উনার দিকে তাকাতেই মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন,
” তখন যে বকেছিলাম রাগ করেছিস?”
আমি উসখুস করতে লাগলাম।আইসক্রিম খাওয়ার চক্করে রাগ অভিমান তো কখন ভুলে বসে আছি।কিন্তু তুষার ভাইয়াকে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না।তাই যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বললাম,
” রাগ করব না তো কি করব?আপনি না জেনে না শুনে কথা বলবেন আমি রাগ না করে আনন্দ পাব নাকি?”
” ইন ফিউচার ভুলভাল প্রশ্ন করলে এর চেয়েও ডাবল বকা খাবি।মনে থাকে যেন।”
আমি তো পুরাই টাস্কি খেয়ে গেলাম।কোথায় ভাবলাম রাগ করেছি বলে আমায় সরি বলবে।তা না করে আগের চেয়েও সুন্দর ভাবে ঝেড়ে দিলেন।উনি কখনো মানুষ হবেন না।আজীবন বনমানুষ হয়েই থাকবেন।অসহ্যকর লোক একটা!
‘
‘
‘
বাসায় ঢুকেই দেখি ড্রয়িংরুমে সোফায় ফুপি আর মা বসে বসে গল্প করছেন।ফুপিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।বাইরের দিক থেকে তিনি খুব স্ট্রিক্ট মহিলা।নিজের ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকেই কড়া শাসনে মানুষ করেছেন।যখন শাসনের দরকার তখন চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়েছেন।আবার মিষ্টি হাসি দিয়ে তার চেয়েও দ্বিগুণ পরিমানে ভালোবেসেছেন।এরজন্যই বোধ হয় ফুপির ছেলেমেয়ে দুটো এত শিক্ষিত হয়েছে।মাঝেমধ্যে ফুপি আমার সাথে এসব নিয়ে গল্প করে।ওখান থেকেই এগুলো জানতে পেরেছি।
দৌড়ে গিয়ে ফুপিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
” আই মিসড্ ইউ সো মাচ ফুপি।একদিন তোমাকে না দেখলে আমার কেমন কেমন যেন লাগে।”
ফুপি হেসে বললেন,
” এই দূরে যা! তুই মাত্রই বাইরে থেকে আসলি।গায়ে অনেক ধুলো-বালি।জলদি গোসল করে আয়।”
” না ফুপি!এখন আমি কিছুক্ষণ এসির নিচে বসে থাকব।তারপর গোসল।”
ফুপি ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
” এগুলো ভাল অভ্যাস নয় নীলাশা! বাইরে থেকে এসে প্রথমেই নিজেকে ফ্রেশ করে নিতে হয়।আজ কিন্তু তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছি।খেতে চাইলে তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়।আমি অপেক্ষা করছি তোর জন্য। ”
” সত্যি ফুপি? আজ তো দুপুরের লাঞ্চ একদম জমে যাবে। নো টেনশন।মাত্র দশ মিনিট।এরমধ্যেই তোমার বান্দা তোমার সামনে হাজির হয়ে যাবে।”
দৌড়ে চলে এলাম রুমে।এখান থেকেই শুনতে পাচ্ছি মা আর ফুপি আমার কথা শুনে হাসাহাসি করছে।
ফুপির হাতের মুরগির রোস্ট জাস্ট অসাধারণ! যতবারই খাই মন ভরে না যেন।তাই যেদিন ফুপি এই আইটেম টা রান্না করে সেদিনই ফুপি আমাকে তাঁদের বাসায় নিয়ে যায়।
চটপট গোসল সেরে ফুপির সাথে চলে গেলাম।
‘
‘
‘
লাঞ্চ শেষে ফুপিদের ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি।বাসায় তুষার ভাইয়া, তুষ্টি আপু কেউই নেই।ভাইয়া না থাকলে আমি বাঁচি।কিন্তু তুষ্টি আপু বাসায় না থাকলে একটুও ভালো লাগে না।পরীক্ষার কারণে ইদানীং আপু একটু ব্যস্ত।
টিভি অফ করে উঠে দাঁড়ালাম।ফুপি নিজের রুমে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। আমাকে বলেছিল ঘুমাতে কিন্তু দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই আমার।কি করে সময় কাটাব এখন? ফুপি জেগে থাকলে বাসায় চলে যেতাম। দরজা খোলা রেখে তো আর যাওয়া যাবে না।আমি এ রুম সে রুম ঘুরতে লাগলাম।ফুপিদের বাসাটা খুবই সুন্দর। সব জিনিস পরিপাটি করে সাজানো।
তুষার ভাইয়ার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটা জিনিস আমার মনযোগ কেড়ে নিল।ডেস্কটপ কম্পিউটারের পাশে একটা নীল ডায়রি।মূলত এটার কারণেই রুমে ঢুকতে বাধ্য হলাম।
হাতে নিয়ে আরও অবাক হয়ে গেলাম।কি সুন্দর ডায়রি!এটা ভাইয়ার রুমে ঠিক মানাচ্ছে না।কখনো তো শুনিনি উনি গল্প কবিতা লেখে।কি আছে এই ডায়েরির ভেতর?
কৌতুহল দমাতে না পেরে নীল কালার মলাট টা উল্টিয়ে দিলাম।
‘ তোমার খোলা চুলের মাদকতায়
ঝড় বয়ে যায় এই হৃদয়ে!
তোমার উজ্জ্বল চোখের চাহনি
এলোমেলো করে আমায়।’
ডায়রিতে লেখা এই চারটা লাইন পড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম।এগুলো তো তুষার ভাইয়ার হাতের লেখা।কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন লাইনগুলো?
আরে আমিও না ভুলে যাই ভাইয়ার তো প্রেমিকা আছে।সেই মেয়েকে ভেবেই লিখেছে হয়তো।বাহ্! তুষার ভাই তো দেখি সাচ্চা প্রেমিক হয়ে গেছে।
” তুই আমার রুমে কি করছিস?”
হঠাৎ ভাইয়ার আওয়াজ পেতেই ভয় পেয়ে গেলাম।হাত ফসকে ডায়রিটা নিচে পরে গেল।হায় হায়! নীলাশা তৈরি হও বকা খাওয়ার জন্য।উনি কখন আসলো আমি তো টেরই পেলাম না।সব দোষ এই নীল ডায়রিটার।
চলবে………..