মন গহীনে,পর্ব_৩০ (শেষ পর্ব)

0
4711

মন গহীনে,পর্ব_৩০ (শেষ পর্ব)
সামান্তা সিমি

মিষ্টি একটা আওয়াজ খুব ক্ষীণ হয়ে কানে বাজছে আমার।ঘুমের রেশ অর্ধেক কেটে গেল।কিন্তু চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না।মন বলছে উঠে গিয়ে দেখি এত মধুর আওয়াজ কোত্থেকে আসছে।
মনের কথায় সায় দিয়ে উঠে পড়লাম।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি মাত্র সাড়ে ছটা বাজে।আওয়াজের উৎস ধরে বারান্দায় যেতে নজর পড়ল একটা চড়ুই পাখি গ্রিলে বসে আপনমনে ডেকে চলেছে।চড়ুই পাখির ডাক কি এত সুন্দর! খুবই সাধারণ ডাক যেটা আমরা সবসময় শুনি।তাহলে আজ কেনো এত মধুর লাগছে আমার কাছে!
পা টিপে টিপে পাখিটাকে ছুয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম।কিন্তু আমার চেষ্টা বৃথা।কারো উপস্থিতি টের পেতেই পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় বসল।এই পাখিটা আজ সকলের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে তার সকাল শুরু করবে মনে হয়।

বারান্দার এককোনায় টবে লাগানো ছোট্ট গাছটার উপর চোখ পড়ল আমার।মুহুর্তেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল।একটা সাদা ফকফকে ফুল ফুটে আছে।শুভ্র রঙের পাপড়িগুলো চারদিকে মেলে আছে। এই টগর গাছটা কিনে এনেছিলাম প্রায় পনেরদিন হবে।এরমধ্যেই ফুল প্রস্ফুটিত হয়েছে। সকাল সকাল এমন চমক দেখব ভাবতেই পারিনি।

রুমে এসে এগিয়ে গেলাম ওয়ারড্রবের দিকে।ড্রয়ার টান দিতেই দশ বারোটা শপিং ব্যাগ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে সবচেয়ে বড় ব্যাগটা বের করে আনলাম।ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো ডার্ক রেড কালারের গর্জিয়াস একটা লেহেঙ্গা।হ্যাঁ আমার বিয়ের লেহেঙ্গা এটা!পরম ভালোবাসায় লেহেঙ্গাটার উপর হাত বুলিয়ে দিলাম।

গতকালই বিয়ের কেনাকাটার জন্য বের হয়েছিলাম।দুই পরিবার একসাথেই শপিংয়ে গেছিলাম।কিন্তু তুষার ভাইয়া সেখানে অনুপস্থিত ছিল।উনি নাকি কোন কাজে শহরের বাইরে গেছেন।আমার একটু রাগ হয়েছিল।কোথায় ভাবলাম আমার বিয়ের লেহেঙ্গা উনার পছন্দে কিনব!তা আর হলো কই?তবে উনার পাঞ্জাবি টা আমার পছন্দে কেনা।
কাল রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে গেছিল।প্রচুর টায়ার্ড থাকার কারণে কোনোরকমে ডিনার করে ঘুমে তলিয়ে গেছিলাম।শাড়ি, লেহেঙ্গা, গয়না কোনোটাই খুলে দেখা হয়নি।তাই এবার সবগুলো ব্যাগ বের করে বিছানায় রাখলাম।অন্য কেউ ঘুম থেকে উঠার আগেই সব ভালোভাবে চেক করে নেয়া যাক।যদি আবার কোনোটা বাকি থেকে যায়!

নিজের আনন্দ এবং উত্তেজনা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি।এত জলদি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না বলে একটু মন খারাপ হয়েছিল।কিন্তু যখন তুষার ভাইয়ার সাথে আমার আংটি বদলের অনুষ্ঠানটা হল এরপর থেকেই আমার মনে রঙিন হাওয়া বইতে লাগল।আমার বিয়ে এই কথাটা মনে পড়তেই আনন্দে অভিভূত হয়ে যাই আমি।
তুষার ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে! বিয়ের পর ছোট্ট একটা সংসার হবে আমাদের।একজন ভালো স্ত্রী হতে পারব তো?আমার ফুপির ভালো বউমা হতে পারব তো?এসব অনেক চিন্তায় আজকাল বুদ হয়ে থাকি।বেশ ভালো লাগে যখন এগুলো ভাবতে বসি।একটা মেয়ের জীবনে তাঁর বিয়ে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন থাকে।এই কথাটা এখন খুব সত্যি মনে হয় নিজের কাছে।

.

নানা জল্পনা কল্পনার পর ঠিক হলো ফুপিরা বিয়ে উপলক্ষে গ্রামে যাবেন না।যা করার এখানেই করবেন।তুষার ভাইয়ার কাজিনরা নাকি গ্রামে যেতে চাইছেন না।তাই বাবা মা সিদ্ধান্ত নিল যেহেতু ফুপিরা এখানেই আয়োজন করবেন তাহলে আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাব।এখানে আমাদের ফ্ল্যাটও অত বড় নয়।মানুষের গঞ্জনা হবে বেশি।তাই গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই সাপোর্ট করল।

বিয়ের আর মাত্র অল্প কিছুদিন বাকি!আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে বসে আছি। সকাল আটটার মধ্যেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব।ওখানে আমাদের রিলেটিভ অনেকেই ইতিমধ্যেই উপস্থিত হয়ে আছেন।মা আমাকে বিগত একঘন্টা ধরে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে।সব শাড়ি গয়না ঠিকমত নিয়েছি কিনা,কোনোকিছু বাকি রয়েছে কিনা আরো কত কিছু।আমি দুইদিন আগে থেকেই সব গুজগাছ করে রেখেছি।তবুও মা অনবরত হুশিয়ার করে যাচ্ছে।
সব পুটলা পুটলি টেনে হিঁচড়ে বাইরে আনার পর বাবা দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলেন।দরজার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি এই বাসা থেকে এখন বেরিয়ে যাচ্ছি আমার মা বাবার মেয়ে হয়ে কিন্তু যখন আবার ফিরব তখন শুধু তাঁদের মেয়ে নয়,আমার জীবনের সাথে জুড়ে যাবে আরো গুটিকয়েক আপনজন!

মা বলল,
” তোর বাবা নিচে যাক।আমরা পাঁচতলায় একবার দেখা করে আসি।”

” না মা।আমি যাব না।উনাদের বাসায় বোধ হয় গেস্টরা হাজির হয়ে গেছে।আমার লজ্জা লাগে।”

” গেস্ট এখনো তেমন একটা আসেনি।চল্।”

অগত্যা মা’য়ের পিছু পিছু চলে গেলাম।
মেইনডোর খোলাই ছিল।ড্রয়িংরুমের সোফায় দুটো ছেলে এবং তিনটে আমার বয়সী মেয়ে বসে আছে।ওরা বোধ হয় হাস্যরসাত্মক কিছু নিয়ে কথা বলছিল।আমাদের দেখতে পেয়ে হাসি থামিয়ে দিল।ওদের একজনকেও আমি চিনি না।মনে হয় তুষার ভাইয়ার কাজিন।
মা চলে গেলেন ফুপির সাথে দেখা করতে। হঠাৎ কোথা থেকে তুষ্টি আপু বের হয়ে আমাকে টানতে টানতে তুষার ভাইয়ার রুমে নিয়ে গেলেন।আমি কিছু বলার সুযোগই পেলাম না।তুষার ভাইয়া কাবার্ডে কি যেন খুঁজছিলেন।আমাদের আওয়াজ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালেন।
তুষ্টি আপু হাসতে হাসতে বলল,

” তোমার কথামত ভাবীকে এনেছি।”

এটা বলে আপু চলে গেল।আমি কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।তুষার ভাইয়া আমার সামনে এসে কিছুটা ঝুঁকে বললেন,

” বিয়ের আমেজে আমার কথা ভুলেই গেছিস তাই না?না কল,না মেসেজ!আমি ফোন দিলেও তোকে পাই না।! দেখা সাক্ষাৎও নেই।এত ব্যস্ত?”

আমি দুইহাতে উড়নার কোণা মুঠ করে ধরে আছি।উনি ভুল কিছু বলেননি।আর এটাও সত্যি যে আমি বিভিন্ন কারণে খুব ব্যস্ত ছিলাম।বিশেষ করে কেনাকাটা নিয়ে।এ পর্যন্ত কয়বার যে শপিং মল যেতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
আমতাআমতা করে বললাম,

” আসলে ভাইয়া কেনাকাটা নিয়ে একটু….”

তুষার ভাইয়া হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।আমার হাত-পা অসার হয়ে আসতে চাইছে।উনার শরীর থেকে আসা পারফিউমের সুগন্ধে আমি মাতাল হয়ে যাচ্ছি। খুব দুর্বল লাগছে নিজেকে।
আমার চুলের গভীরে মুখ গুঁজে উনি বললেন,

” এ কয়েকটা দিন খুব মিস করব তোকে।আমাকে ডেইলি কল দিবি কিন্তু। আর শোন বউ সাজার সময় কোনো ফাঁকফোকর যেন না থাকে।আমার বউকে আমি রানীর মত দেখতে চাই।মনে থাকবে?”

তৃপ্তির সহিত হেসে উনার পিঠে হাত রাখলাম।
” যো হুকুম মহারাজ।”

তুষার ভাইয়ার হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় হলো।তখনই শুনতে পেলাম মা ডাকছে আমায়।তুষার ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিয়ে সামনের চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বললেন,

” যা।মামী ডাকছে।”

.

পাক্কা তিন ঘন্টা জার্নি করার পর পৌঁছে গেলাম গ্রামের বাড়ি।বরাবরই আমার গ্রামের প্রকৃতি বেশ ভালো লাগে।শহরে থাকার সুবাদে যদিও গ্রামে আসা যাওয়া খুম কম।

সারা রাস্তা জার্নি করার কারণে শরীরে নেতিয়ে ছিল।কিন্তু যখন সবুজে ঘেরা মাঠের পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম তখন শরীর ও মনের অবসাদ দুটোই দূর হয়ে গেল।যতই ভেতরের দিকে যাচ্ছি ততই যেন মুগ্ধতা গ্রাস করছে আমায়।ভাঙাচোরা ইটের রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম। আমাদের দেখতে পেয়ে সকলে ঘিরে ধরল।চাচাত ভাইবোন যারা আছে ওঁরা ইতিমধ্যে আমার সাথে ইয়ার্কি করা শুরু করে দিয়েছে।এতগুলো মানুষের সামনে হঠাৎই এক বস্তা লজ্জা আমায় কাবু করে ফেলল।বিয়ের কনের যে কতরকমের জ্বালা।আহ্!

.

দেখতে দেখতে চলে এলো গায়ে হলুদের দিন।সন্ধ্যা হতেই বাড়ির আনাচকানাচে জ্বলে উঠল বিভিন্ন রঙের মরিচ বাতি।ঘর এবং উঠোনের পরিবেশ মানুষের কোলাহলে মুখরিত।সাউন্ড বক্সে বিভিন্ন রিমিক্স গান বাজছে। রিলেটিভ সবাই প্রায় উপস্থিত। যারা আসে নি ওঁরা বিয়েতে থাকবে।সবমিলিয়ে বিয়ে বাড়ি একদম জমজমাট!
এদিকে আমি আছি এক ঘোরের মধ্যে! মনের মধ্যে উত্তেজনারা বাসা বেঁধে আছে।শুধুমাত্র আজকের দিনটা।এরপরই তো সেজে উঠব আমি বধূবেশে।আমার বর আমায় নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি!ওই মুহুর্তটার কথা চিন্তা করতেই মনের ভেতরের আনন্দগুলো উল্কা বেগে ছুটতে থাকে।
সন্ধ্যার পরপরই পার্লারের দুটো মেয়ে আমায় সাজাতে বসে গেল।আমি শুধু স্ট্যাচু হয়ে আছি আর ওঁরা ইচ্ছেমতো মুখে আটা ময়দা মাখিয়ে চলেছে।আমাকে কি আজ পেত্নী বানিয়ে ছাড়বে নাকি কে জানে।কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।সাজানো শেষে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।কাঁচা হলুদ শাড়িতে খারাপ লাগছে না।চাচাতো বোনগুলো দল বেঁধে আমায় নিয়ে গেল উঠোনে।গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সেখানে বড়সড় একটা স্টেজ সাজানো হয়েছে।যার চারদিকে ফুলের সমারোহ এবং লাইটের ঝলকানি।ধীরে ধীরে হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে শুরু হলো অনুষ্ঠান!কাজিনগুলো জোর করে আমায় উঠোনে নাচতে নামিয়েছে।প্রথমে মানা করলেও কিছুক্ষণ পর সাউন্ড বক্সে পছন্দের গান বেজে উঠায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। নিজের বিয়ে বলি কি একটু নাচানাচি করব না?সারাক্ষণ জড়ভরতের মত বসে থাকা যায় নাকি।আবার এটাও ভাবছি যে এই নাচের ভিডিও তো তুষার ভাইয়া কোনো একসময় দেখবে।তখন লজ্জায় আমি না মাটির ভেতর ঢুকে যাই।কিন্তু আপাতত এসব বাদ।আমার বিয়েতে আমি উরাধুরা নাচব।তাতে কার কি!

__________________________

” বর এসেছে!”

এই বাক্যটা কানে যেতেই শরীরে এক অজানা শিহরণ খেলে গেল।কেনো জানি না গলা শুকিয়ে আসছে।বুকের ভেতর প্রচন্ড শব্দে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে।

আমি বসে আছি নিরিবিলি একটা রুমের ভেতর।এতক্ষণ মানুষ গিজগিজ করলেও এখন রুম সবটা ফাঁকা।সবাই চলে গেছে বরের কাছে।
আমি ধীর পায়ে উঠে এলাম ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সম্মুখে।কি অপরূপ এই বিয়ের সাজ!গায়ে ডার্ক রেড কালারের লেহেঙ্গা, হাতে-গলায় গয়নার ছড়াছড়ি। নিজের রূপে নিজেই মোহিত হয়ে যাচ্ছি। এত রূপ কোত্থেকে আসলো আমার?সবই কি ভারী মেকাপের জাদু নাকি আমার মনের খুশিগুলো সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পরে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে?

.

তিনবার উচ্চারিত ‘কবুল’ শব্দটির কতই না ক্ষমতা।এক মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে অন্যকারো জীবনের সাথে যুক্ত করে দিল।আজ থেকে সেই মানুষটার সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে গেলাম।দুজনের হাত ধরেই গড়ে উঠবে আমাদের ছোট্ট একটি ভালোবাসার দুনিয়া।সেখানে আমার আত্মার সাথে জুড়ে থাকবে সেই মানুষটি।আমার প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাসে তাঁর বিচরণ থাকবে।

কথায় বলে না যে-কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হয়! এটা জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই সত্য।যা আমি এই মুহূর্তে অনুভব করছি।নতুন জীবনে প্রবেশ করার জন্য বাবা মা’য়ের আদর ও ভালোবাসার গন্ডি পেরিয়ে চলে যেতে হচ্ছে আমায়।বিদায় নামক শব্দটাকে বরাবরই আমি কিছু কষ্টময় অনুভূতি দ্বারা ব্যাখা দিয়ে এসেছি।নিজের ক্ষেত্রে এখন তা সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে।
বাবা মা’য়ের চোখে পানি দেখে নিজেকে সামলানো খুব দায় হয়ে পড়ল।বাবা দুহাতে জড়িয়ে আমাকে কাঁদতে মানা করছে।তুষার ভাইয়ার হাতের মাঝে আমার হাত রেখে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে আমি তাঁদেরকে ঝাপসা চোখে দেখে যাচ্ছি।
একসময় গাড়ি চলতে শুরু করল।তারই সাথে আমার কান্না উপচে আসছে।পাশ থেকে তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,

” আর যদি এক ফোঁটাও চোখের পানি পড়ে তাহলে তোকে আমি গাড়ির ছাদে বসিয়ে নিয়ে যাব।”

মুহূর্তেই আমার কান্না থেমে গেল।কান্নার জায়গায় স্থান করে নিল হতভম্ব ভাব।নতুন বউকে কেউ এই কথা বলতে পারে সেটা তো আমার ধারণায় ছিল না।উনি কি আমার মনের কষ্টটা বুঝতে পারছেন না?একটু মন খারাপ হলো আমার।

” এত কাঁদার কি আছে বলতো!তোর বাপের বাড়ি হলো চারতলায় আর শ্বশুরবাড়ি হলো পাঁচতলায়।যখনই মন চাইবে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে চলে যাবি বাবা মা’কে দেখতে।সিড়ি দিয়ে যেতে দেরি হলে লিফট দিয়ে যাবি।তুই এমন ভাব করছিস যেন তোকে আমি বিয়ে করে পরদেশে নিয়ে যাচ্ছি। ”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে মনটা আরো বিষন্ন হয়ে গেল।উনি এই অবস্থাতেও মজা করে যাচ্ছেন? ভালো একটা বর জুটেছে আমার কপালে।আমি মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।তখনই হাতে আলতো স্পর্শ পেতে সেদিকে তাকালাম। তুষার ভাইয়া শক্ত করে আমার হাত ধরে আছেন।ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি ধীর কন্ঠে বললেন,

” এভাবে কাঁদিস না আর। ভালো লাগছে না তো। তোর চোখের পানি সহ্য হচ্ছে না আমার।তুই জানিস বউ সাজে তোকে কি মারাত্মক লাগছে।একদম আমার রাজ্যের রানী!”

উনার ভালবাসা মাখা কথা শুনে গলে গেলাম আমি।মাথাটা হেলিয়ে দিলাম উনার কাঁধে।উনিও আমায় একহাতে আগলে নিলেন।

_________________________

যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম চিরচেনা সেই জায়গায়।এটাই এখন থেকে আমার ঠিকানা।এরাই এখন আমার আপনজন। ফুপি আমাকে পরম আদরে বরণ করে নিলেন।এক বুক প্রশান্তি নিয়ে ঘরের ভেতর পা রাখলাম আমি।তুষার ভাইয়ার কাজিনগুলো ঘিরে আছে আমার চারদিকে।ভিড়ের মাঝে তুষ্টি আপুকেও দেখা যাচ্ছে। নিজের ভাইয়ের বিয়ে বলে তাঁর দাপট পুরো দেখার মত।একে ওকে বিভিন্ন কাজের অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে। ধমকাধমকি করছে।বেশ ভালো লাগছে এগুলো দেখতে।
হাসি ঠাট্টা শেষে ওরা আমায় তুষার ভাইয়ার রুমে নিয়ে গেল।রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম।মস্ত বড় রুমটা ফুলে ফুলে সজ্জিত হয়ে আছে।আনাচে কানাচে ছোটছোট মোমবাতি জ্বালানো। এ যেন কোনো রূপকথার রাজ্যে এসে গেছি আমি।ওঁরা আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিল।সাদা বেডকভারের উপর টকটকে লাল গোলাপের ছড়াছড়ি। গোলাপের গাঢ় গন্ধ নাকে লাগছে।
এদিকে শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে।কখন যে এসব ভারী গয়নাগুলো খুলব।লেহেঙ্গা চারদিকে সুন্দর করে ছড়িয়ে ওঁরা বেরিয়ে গেল।ছড়ানো লেহেঙ্গাটা গুটিয়ে আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।ক্লান্তির কারণে চোখে ঘুম নেমে আসছে।
হঠাৎই দরজা খোলার শব্দে ধড়ফরিয়ে উঠে বসলাম।তুষার ভাইয়া এসেছেন।এই প্রথম উনার দিকে ভালোভাবে নজর দিলাম।গোল্ডন কালারের পাঞ্জাবিতে উনি পুরো ঝলমল করছেন।ইস এই সুদর্শন ছেলেটা আমার বর।ভাবতেই কেমন প্রাউড ফিল হচ্ছে।আমার ঘুম চুটকিতেই উধাও হয়ে গেল।
তুষার ভাইয়া দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসলেন।আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে উনাকে সালাম করার জন্য নিচে ঝুঁকলাম।কিন্তু উনি বাঁধা দিয়ে আবার দাঁড় করিয়ে দিলেন।আমার চিবুকে হাত রেখে মিষ্টি হেসে বললেন,

” পায়ে হাত দেওয়া আমার পছন্দ না।”

” কিন্তু এটাই তো নিয়ম।”

” এই নিয়ম বাদ।আচ্ছা যা আমি তাহলে নতুন নিয়ম তৈরি করে দিচ্ছি তোর জন্য।”

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি?”

” জড়িয়ে ধর আমায়।”

উনার ঘোষিত নিয়মে কিছুটা লজ্জা পেলেও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম উনাকে।উনিও বুকের মাঝে আবদ্ধ করে নিলেন আমায়।মাথার একপাশে চুমু খেয়ে বললেন,

” তুই আমার বহুদিনের প্রতীক্ষার ফল।কখনো কষ্ট পেতে দেব না তোকে।নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখব।তুই শুধু আমার সাথে থাক প্লিজ।কখনো কোনো কারণে ভুল বুঝিস না আমায়।সহ্য করতে পারব না আমি।”

ছলছল চোখে মুচকি হাসলাম। উনাকে ভুল বুঝার আগে যেন ছারখার হয়ে যাই আমি।উনার কথার প্রতিত্তোরে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু বলতে পারছি না।মনের সবকিছু দলা পাকিয়ে আসছে।আমি তো গুছিয়ে কোনো কথাই প্রকাশ করতে পারি না।উনার ঘাড়ে আলতো চুমু খেয়ে বললাম,

” ভালোবাসি খুব।”

তুষার ভাইয়া আরো গভীরভাবে জড়িয়ে নিলেন আমায়।হঠাৎই আমার মনে কোনো এক গানের কিছু লাইন বিচরণ করতে লাগল,

‘তুমি যদি বলো এখনি করিব
বিষয় বাসনা বিসর্জন
দিব শ্রীচরণে বিষয়
দিব অকাতরে বিষয়
দিব তোমার লাগি বিষয়
বাসনা বিসর্জন।’
————————–

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here