মন গহীনে,পর্ব_৪
সামান্তা সিমি
ডায়রিটা ফ্লোর থেকে তুলে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকালাম।তুষার ভাইয়ার এক হাতে ব্লেজার অন্য হাতে অফিসের ব্যাগ।সন্দেহজনক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
পিছন থেকে ডায়রিটা বের করে মেকি হেসে বললাম,
” কিছু করছি না ভাইয়া।শুধু এই ডায়রিটা একটু দেখছিলাম।”
” পারমিশন ছাড়া ডায়রিতে হাত দেওয়ার সাহস পেলি কিভাবে?”
এই যে শুরু হয়ে গেল।আমাকে যে কোন শয়তানে ধরেছিল উনার ডায়রি তে হাত দিতে গেছি।
” আচ্ছা সরি ভাইয়া।আমি সত্যি কথা বলে দিচ্ছি। আমি শুধু প্রথম পৃষ্ঠার ওই চারটা লাইন পড়েছি।তখনই আপনি এসে পরেছেন।”
তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তাই? চারটা লাইন পড়ে তাহলে কি বুঝলি?”
” বুঝেছি এটাই যে এগুলো আপনার ভালোবাসার মানুষকে ডেডিকেট করে লেখা।ঠিক বলছি তো ভাইয়া!বলুন বলুন।লাইনগুলো কিন্তু খুব সুন্দর হয়েছে। আচ্ছা আপনি কবিতা লিখলেও তো পারেন।চারদিকে একদম সাড়া পরে যাবে।”
” বাহ্! দিনে দিনে তোর মাথার বুদ্ধি খুলছে তাহলে।আমি তো ভাবতাম তোর ওই ব্রেইনে হাঁস-মুরগি’র বিষ্ঠা ছাড়া আর কিছুই নেই।”
তুষার ভাইয়ার কথা শুনে রাগে ব্রহ্মতালু গরম হয়ে উঠল।আমাকে অপমান করা ছাড়া উনি আর কিছুই পারেন না।আমি উনার এক বালতি প্রশংসা করলাম আর উনি! উনি আমায় এক ড্রাম পচানি দিলেন।সহ্য করা যায় এসব?নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে নিশ্চিত মধু মাখিয়ে কথা বলে।আর আমার সাথে কথা বলতে গেলে মনে হয় উনার মুখ দিয়ে বিষ উদগীরণ হতে থাকে।
তুষার ভাইয়া ব্লেজার রেখে ঘড়ি খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।এমন একটা ভাবভঙ্গি করছেন যেন রুমে অন্য কোনো প্রাণী নেই।
” আমি গেলাম তুষার ভাইয়া।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপমান সহ্য করতে আসিনি এখানে।”
” এই দাঁড়া! তোকে আমি যেতে বলেছি?”
দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে তাকালাম।আমাকে এখন উনার থেকে পারমিশন নিতে হবে নাকি।কি মনে করে নিজেকে?
” আপনি না বললে কি আমি যেতে পারি না?”
” না পারবি না।নিজে তো খেয়ে পেট পুরে বসে আছিস।আমি এখনো অভুক্ত। সেদিকে একটু খেয়াল দে।যা টেবিলে ভাত তরকারি সাজিয়ে রাখ।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
” মানে? আমি?”
” হ্যাঁ তুই।তোর সাথে বকবক করার এনার্জি নেই এখন।তাড়াতাড়ি যা করতে বললাম সেটা কর।”
তুষার ভাইয়া টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন।এ তো দেখি মহা বিপদ সংকটে পরলাম।বাসায় তো এক গ্লাস জলও নিজের হাতে খাই না।আর এই লোক আমাকে ভাত বেড়ে দেওয়ার কথা বলছে।
‘
‘
‘
টেবিলে ভাত বেড়ে চারদিকে পায়চারি করছি।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় চলে যাওয়া ভালো।তুষার ভাইয়া আমাকে হেনস্তা করার সুযোগ পেলে আর ছাড়তে চাইবে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে দেখা গেল।চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে আসছেন।সামনে এসেই ভেজা টাওয়ালটা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বললেন,
” যা এটা বারান্দায় মেলে দিয়ে আয়।”
তুষার ভাইয়ার কর্মকান্ডে আমি অবাকের উপর অবাক হচ্ছি।অনেকক্ষণ থেকে খেয়াল করছি তিনি আমাকে একের পর এক অর্ডার করে যাচ্ছেন।
চুপচাপ তোয়ালেটা বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে আসলাম।দরজা দিয়ে বের হতে যাব তখনই আবার তুষার ভাইয়ার রাগ মিশ্রিত কন্ঠ।
” তুই আমাকে শুধু ভাত দিলি সাথে অন্য কিছু দিলি না যে?আমি কি খালি ভাত চিবিয়ে চিবিয়ে খাব?”
” ভাইয়া আপনার চোখে কি ছানি পড়েছে?দেখতেই তো পাচ্ছেন টেবিলে তরকারি রাখা আছে।ওখান থেকে নিয়ে নিন।”
তুষার ভাইয়া মস্ত একটা হাই তুলে বললেন,
” আমি নিলে কি আর তোকে বলতাম?আর তুই এমন ছ্যাত করে উঠছিস কেনো?আমি সারাদিন অফিস থেকে খেটেখুটে আসি।তুই কি করিস?বাসায় শুধু খাস আর ঘুমাস।মাঝেমধ্যে একটু কাজটাজ তো করতে পারিস।”
” কাজ করলে নিজের বাসায় করব।আপনার হুকুম দারী পালন করব কেনো?”
” আগে পরে তো আমার হুকুমই পালন করতে হবে তোকে।তাই শুরু থেকেই অভ্যাস করে নে।”
” এহ্! বয়েই গেছে।বিনে পয়সার কাজের লোক পেয়েছেন নাকি আমায়?”
তুষার ভাইয়া উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন।সকৌতুকে বললেন,
” তুই রাজি থাকলে তোকে না হয় মাইনে দিয়েই রাখব।কি বলিস?”
দুঃখে কষ্টে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে গেলাম।মা ঠিকই বলে।আস্ত একটা বলদ আমি।কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারি না।
” কিরে তোর চেহারা শ্রাবণ মাসের মেঘের মত কালো হয়ে গেল কেনো?আচ্ছা যা বাসায় যা।তরকারি আমি নিজেই নিতে পারব।”
আমি মুখ ঝামটি মেরে বললাম,
” থাক আমিই দিচ্ছি। পরে তো ফুপির কাছে আমার নামে কুট কাচালি করবেন। আমি আপনাকে অভুক্ত রেখেই চলে গেছি।আমি কোনো কাজ পারি না ইত্যাদি ইত্যাদি। ”
বিড়বিড় করতে করতে উনার কাছে গিয়ে বোল থেকে তরকারি প্লেটে তুলে দিলাম।পরিমাণে অনেকটাই বেশি দিয়ে দিয়েছি।নাহলে পরে আবার বলবে আমি পরিবেশন করতেও জানি না।আমার সব কাজে খুঁত ধরা তো উনার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
” নিন।এবার শুরু করুন।আমি বাসায় যাচ্ছি।”
তুষার ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম।উনি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।সদ্য গোসল করে বের হওয়াতে উনার ফর্সা মুখটা আরো বেশি উজ্জ্বল লাগছে।কপালের ভেজা চুলগুলো থেকে টপটপ পানি পড়ছে।
এরকম চেহারার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।নেশা ধরে যায়।তাই চোখ নামিয়ে নিলাম।
তুষার ভাইয়া ধীর কন্ঠে বলল,
” তুই খোলা চুলে আমার সামনে আসিস না তো নীল।”
কিছুটা অবাক হলাম।খোলা চুলে থাকলেও উনার সমস্যা!
” আমার খোলা চুল আপনাকে কামড় দেয় না আঁচড় দেয় হুম?”
তুষার ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে বললেন,
” চুল খোলা থাকলে তোকে ঠাকুমা’র ঝুলির শেওড়া গাছের পেত্নী গুলোর মত লাগে। সামনে দিয়ে দুটো বড় বড় দাঁত থাকলে পেত্নী লুক একেবারে সম্পূর্ণ হয়ে যেত।হাহাহা!
তুষার ভাইয়া ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলেন।আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছি।আমার আর কত উপাধি দেবেন উনি?ছুঁচো,পেত্নী।আরো কি কি শুনা লাগে আল্লাহই জানে।
________________________
দুপুরের গনগনে রোদ মাথায় করে বাসায় ফিরছি।গেইট দিয়ে ঢুকার সময় দারোয়ান আঙ্কেলের সাথে দেখা।আসা-যাওয়ার পথে যখনই উনার সাথে দেখা হয় তখনই কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করি।
মিষ্টি হেসে বললাম,
” আজ ভীষণ গরম পরেছে তাই না আঙ্কেল? ”
উনি পান চিবাতে চিবাতে বললেন,
” হ মা! ফ্যানের নিচে বইসা থাকলেও শইল দিয়া ঘাম ঝরে।বিষ্টি নাই এক ফোঁটা। চাইরদিক খাঁ খাঁ করতাছে।”
দারোয়ান আঙ্কেল যে ভাষায় কথা বলে সেগুলো শুনতে ভালো লাগে আমার।কত সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তা।
ভেতরে ঢুকতে যাব তখনই আওয়াজ পেলাম একটা প্রাইভেট কার গেইটের সামনে থেমেছে।আমি পেছনে তাকাতেই গাড়ির জানালার গ্লাস খুলে গেল।ভেতরে ইয়াসির ভাইয়া।পাশের সিটের প্রবীণ লোকটা বোধ হয় উনার বাবা।
ইয়াসির ভাইয়াকে দেখেই আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।কেনো এমন হল সেটা জানি না।
জানালা দিয়ে মাথা বের করে ইয়াসির ভাইয়া বলল,
” দূর থেকে দেখলাম গেইট দিয়ে ঢুকছো তাই ভাবলাম একটু কথা বলে নেই।”
সৌজন্যমূলক হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
” ভা..ভালো আছেন ভাইয়া?”
” ভীষণ! তবে কিছুটা খারাপ। আমি চলে যাচ্ছি আজ।এখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট যাব। কয়েকদিন পরই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।এ কারণেই তড়িঘড়ি করে যাওয়া।ভালো থেকো নীলাশা।”
ইয়াসির ভাইয়া চলে গেলেন।আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।যতই উনাকে ভালো লাগুক সামনাসামনি কথা বলার মত দৃশ্য কখনো কল্পনা করিনি।আমার কাছে ক্রাশ মানে হলো দূর থেকে দেখার বস্তু।হিহিহি।
আনমনে হাসতে হাসতে চোখটা পাঁচতলার বারান্দায় আটকে গেল।একি! তুষার ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে!কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে রইলাম।আজকে কি উনি বাসায় তাড়াতাড়ি এসে পড়েছেন?
মস্ত বড় কেলেংকারী হয়ে গেল।ওই বারান্দাটা থেকে নিচের খোলামেলা জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যায়।তাহলে উনি নিশ্চয়ই ইয়াসির ভাইয়াকে দেখে ফেলেছে।আবারও কি থাপ্পড় খেতে হবে আমায়?
এত নিচ থেকে তুষার ভাইয়ার মুখের ভাবভঙ্গি কিছুই বুঝতে পারছি না।আল্লাহ বাঁচাও আমায়!
চলবে…