মন গহীনে,পর্ব_৫

0
2578

মন গহীনে,পর্ব_৫
সামান্তা সিমি

পড়ার টেবিলে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছি। বাবা মা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে।পুরো বাসায় পিনপতন নীরবতা। কিছুই ভাল লাগছে না আমার।সেই সময় তুষার ভাইয়ার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা কল্পনা করলেই ভয় ধরে যায়।এখনো পর্যন্ত উনার সাথে দেখা হয় নি।দেখা হলে চড় থাপ্পড় দুয়েকটা খেতে হবে।আর উনি যদি মা’য়ের কাছে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা শব্দও প্রকাশ করে তাহলে মা আমায় কচু কাটা করবে।আমার জননীর কাছে পৃথিবীর সবকিছু শেয়ার করলেও ছেলে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কখনো কথা হয় না।মা এগুলো পছন্দ করেন না।
যাই হোক।আমার এখন একটাই কাজ।ভাইয়ার সাথে দেখা হলে সোজা উনার পায়ে পড়ে যাব।অনুরোধ করব যেন মা’য়ের কাছে কিচ্ছু না বলে।বিনিময়ে ভাইয়ার জিম করা শক্ত হাতের কয়েকটা চড় খেতেও রাজি আছি।আর আজকের ঘটনায় তো আমার কোনো দোষ ছিল না।আমি কি ইয়াসির ভাইয়ার সাথে নিজে থেকে কথা বলেছি?এমন সাহস আমার কোনোদিনও হয় নি।ভবিষ্যতেও হবে না।কিন্তু এত ব্যাখ্যা তুষার ভাইয়াকে কে বুঝাতে যাবে।উনি বুঝার পাত্র নন।সবার আগে আমার দোষ উনার চোখের সামনে কিলবিল করবে।দোষ না থাকলেও বলবে আমারই দোষ।

ঘড়িতে প্রায় এগারোটার উপর বাজে।ঘুমে চোখ ঢুলুমুলু।আজ আর পড়া হবে না।
বই বন্ধ করে বিছানায় যেতেই কলিংবেল বেজে উঠল।শুনশান নীরবতার মাঝে টিংটং শব্দে হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলাম।কার কি দরকার পড়ল এত রাতে?উফ্!

রুম থেকেই শুনতে পেলাম মা দরজা খুলেছে।কোনো মেয়েলি গলার আওয়াজ পাচ্ছি। কে হতে পারে?
বিছানা থেকে উঠতে নিব এমন সময় মা’য়ের সাথে তুষ্টি আপু রুমে ঢুকলেন।
মা আমাকে নির্দেশ দিলেন,

” আজ তুষ্টির সাথে গিয়ে ঘুমা।মেয়েটা তোকে নিতে এসেছে।”

” হঠাৎ? ”

আপু মুচকি হেসে বললেন,

” বা রে! এমন ভাবে বলছিস যেন এর আগে আমার সাথে ঘুমাস নি?পরীক্ষার মাঝে কয়েকদিন গ্যাপ পেয়েছি।জানিস তো এ কয়েকদিন পড়তে পড়তে আমি আধমরা হয়ে গেছিলাম।আমার মাথায় ভূত চেপেছিল যে আমি মেডিকেলে পড়তে গেছি।জীবন তেজপাতা হয়ে যাচ্ছে রে!আর যাই কর কখনো মেডিকেল পড়তে যাস না বোন!

” সেকি! তখন তো মেডিকেল পড়ার জন্য উন্মাদের মত হয়ে গেছিলে তুমি।আর এখন উল্টো সুর গাইছো!বেশি বেশি না পড়লে মানুষের চিকিৎসা করবে কিভাবে?”

আমার কথা শুনে মা বলল,
” থাক হয়েছে।তোমার আর ভাষণ দিতে হবে না।মনে হচ্ছে পড়তে পড়তে বিদ্যাসাগর হয়ে গেছো।”

” মা..ভুল বললে।মেয়েরা বিদ্যাসাগর কিভাবে হবে।মেয়েরা হবে বিদ্যাসাগরী।”

তুষ্টি আপু খিলখিল করে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ রাগি চোখে তাকিয়ে হাসি চাপতে না পেরে মা ও হেসে দিলেন।
আপু আমার মাথায় চাটি মেরে বলল,

” বেশি দুষ্টু তুই।আচ্ছা চল আমাদের বাসায়।আজ দুইবোন গল্প করতে করতে ঘুমাব।খুব মজা হবে।”

আপু আর আমি চলে এলাম পাঁচ তলায়।আপুর রুমটা আমার খুব পছন্দের। আনাচে কানাচে বারবি ডল,টেডি বিয়ার রাখা।ছোটবেলার সব পুতুল আপু যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে।আর আমার ছোটবেলার পুতুল, খেলনা এতদিনে বোধ হয় মাটির গভীরে আটকে আছে।খুব অগোছালো আমি।নিজের রুমে ঢুকলে মাঝেমধ্যে নিজেই চিনতে পারি না এটা মানুষের রুম নাকি কোনো গৃহপালিত পশু-পাখির আবাসস্থল।

আজ আপু ল্যাপটপে মুভি দেখার প্ল্যান করেছে।আহ্! ভাবতেই কত আনন্দ লাগছে।কিন্তু এত খুশির মাঝেও মনের কোনায় তুষার ভাইয়ার ভয় ঘাপটি মেরে আছে।এখনো পর্যন্ত উনার সম্মুখীন হয়নি।কোথায় আছে কে জানে।

” নীলাশা যা তো ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আয়।না ডাকলে পরে বলবে ওঁকে ছাড়া আমরা মজা মাস্তি করে ফেলেছি।ভাইয়া রুমেই আছে।তুই যা।আমি ততক্ষণে সিলেক্ট করি কোন মুভিটা দেখা যায়।”

আপুর কথা শুনে আমার আনন্দ মুহূর্তেই কাঁচের মত ভেঙে খানখান হয়ে গেল।ওহ্ খোদা! সাহায্য করো আমায়।

” কিরে যা তাড়াতাড়ি। দৌড়ে যাবি দৌড়ে আসবি।”

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।প্রবাদ বাক্যটা অক্ষরে অক্ষরে আমার সাথে মিলে যাচ্ছে। অবশ্য আমি তো এখন বাঘের গুহাতেই আছি।শুধু বাঘের মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষা।
এক পা দুই পা ফেলতে ফেলতে তুষার ভাইয়ার রুমের সামনে চলে আসলাম।রুম পুরো অন্ধকার।ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দও আসছে না।ফুপা ফুপি হয়তোবা অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।প্রায় সব রুমেরই লাইট অফ।কিন্তু তুষার ভাইয়াও কি ঘুমিয়ে গেলেন নাকি।সাত পাঁচ না ভেবে ঢুকে গেলাম রুমের ভেতর।

” ভাইয়া আপনি কি ভেতরে আছেন?”

কোনো আওয়াজ নেই। এবার তো ভুতের ভয় আমাকে জেঁকে ধরেছে।তুষার ভাইয়ার রুমটা এমনিতেও অন্যান্য রুমগুলো থেকে বেশ প্রশস্ত।লাইটের অভাবে এটা এখন বড় কোনো হলরুমের মত লাগছে।ভয়ের চোটে অজ্ঞান না হয়ে যাই।তারচেয়ে ভালো অতিসত্বর এই অন্ধকার কুঠুরি থেকে নির্গমন করি।বাপরেহ্!

বের হতে যাব এমন সময় কেউ একজন শক্ত হাতে পেছন থেকে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরল।
চিৎকার দিতে গিয়ে দেখি গলার স্বর কন্ঠনালিতেই ঠেকে গেছে।শেষ আমি শেষ।অবশেষে আমি ভুতের খপ্পরেরই পড়লাম।
আমি যখন ভয়ে ঠকঠক করে কাপছি তখনই তুষার ভাইয়ার ভারী কন্ঠস্বর কানে বাজল।

” ভয় পেয়েছিস?আরো ভয় পা।ভয়ে পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যা।ভয় পেয়ে অজ্ঞান না হলে আমার হাতের থাপ্পড় খেয়ে সিউর অজ্ঞান হবি।খাবি থাপ্পড়? ”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনতে পেয়েই অনেকটা স্বস্তি পেলাম।মন থেকে ভুতের ভয় কেটে গেছে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পরল বাস্তবের ভুতটাই তো আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে যে এক্ষণি থাপ্পড় দেওয়ার কথা বলল।
উনার থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম,

” বিশ্বাস করুন ভাইয়া আমি কিছু করিনি।ইয়াসির ভাইয়া নিজে থেকে কথা বলতে এসেছিল আমার সাথে।আপনি তো সবটা দেখেছেন উপর থেকে।তাহলে কেনো ধমকাচ্ছেন আমায়?”

” নিজে কেনো কথা বলতে আসলো?বিগত তিন বছর ধরে এই এলাকায় আছিস।কখনো কথা বলেছে তোর সাথে?তাহলে আজ কেনো আসলো?কি উদ্দেশ্য ছিল ছেলেটার?নাকি তুই কোনো ইশারা করেছিস।সত্যি করে বল আমায়।”

বাজ পড়ল আমার মাথায়। সেই আঘাতে আমার মাথার ভেতরের যন্ত্র গুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।তুষার ভাইয়া এসব কি বলছে।যে কাজটা আমি করিই নি সেই কাজের অপবাদ দিচ্ছে আমায়।বাজে লোক একটা! যা মন চায় বলবে আর আমি সেটা দাঁতে দাঁত ঘষে সহ্য করব নাকি?

” ছাড়ুন আমায়! আপনি এত খারাপ তা জানলে এই রুমে আমি পা ও ফেলতাম না।সবসময় আপনি আমার সাথে এমন করেন।কিসের এত শত্রুতা আমার সাথে?

কথাগুলো বলতে বলতে আমার গলা প্রায় ভারী হয়ে আসলো।প্রাণপণে চেষ্টা করছি উনার হাতের বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়ার।কিন্তু দানবটার সাথে শক্তিতে হেরে যাচ্ছি।
এবার তিনি কিছুটা নরম গলায় বললেন,

” কাঁদছিস?প্লিজ কাঁদিস না।রাগ উঠে গেছিল মাথায়।”

” হ্যাঁ রাগ উঠেছে আর আপনার যা মুখে আসবে তাই বলে দিবেন?সত্যি মিথ্যা যাচাই করে দেখবেন না?একবার ভাববেন না যে যাকে কথাগুলো বলছেন সে কতটা কষ্ট পেতে পারে?”

তুষার ভাইয়া হাত কিছুটা আলগা করতেই আমি এক ঝটকায় উনার থেকে দূরে সরে আসলাম।রাগ উঠেছে মাথায় তাই আমাকে এসব বলবে! বুলেট মারি উনার ওই রাগে।ধ্যত্! মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল আমার।
যেরকম পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করেছিলাম তারচেয়ে দ্বিগুন গতিতে বের হয়ে গেলাম।পেছন থেকে তুষার ভাইয়া আকুল আবেদনে নীল নীল বলে ডাকছে।আমি ফিরেও তাকাই নি।
আপুর রুমে ঢুকতেই দেখি আপু বেশ আয়োজন করে মুভি দেখার ব্যবস্থা করেছে।বেডের উপর ল্যাপটপ রেখে সোফায় বসে আছে।পাশেই ছোট ছোট তিনটা প্লেটে ভ্যানিলা আইসক্রিম।
আমাকে দেখেই আপু চেঁচিয়ে উঠলেন,

” এই তোকে কখন পাঠিয়েছি। এত দেরি করলি কেনো।তোদের জন্য বসে থাকতে থাকতে বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি।ওই মহারাজ কোথায়?”

হায় হায়! আমি তো ভাইয়াকে আসল কথা না বলেই চলে এসেছি।দ্বিতীয়বার উনার রুমে যাওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।তখন রাগের চোটে কি কি বলে এসেছি সব ভুলে গেছি।

” আসলে…আপু..”

” আচ্ছা থাক।ভাইয়ার যখন মন চাইবে তখন আসবে।এখন আয় আমরা মুভি দেখি।”

আপু আর আমি বেডের উপর পা তুলে বসলাম।দুইজনের মাঝখানে ল্যাপটপ।

” আপু এটা কি ধরনের ছবি?”

” জানি না।আগে দেখিনি।নতুন রিলিজ হয়েছে বোধ হয়।”

তখনই তুষার ভাইয়ার আগমন।এসেই ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন।এমন ভং ধরছে মনে হয় যেন কিলো কিলো ওজনের আলুর বস্তা উনি বহন করে তারপর এখানে এসেছে।আমি একপলক তাকিয়ে আবার ছবি দেখায় মনযোগ দিলাম।

” আমাদের বাসায় একটা চোর এসেছে রে তুষ্টি।চোখে চোখে রাখিস কিন্তু। ”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে আপু আর আমি চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকালাম।উনি একই ভঙ্গিমায় বসে আছেন।ঠোঁটে ঝুলছে গা জ্বালানো হাসি।

” চোর কোথায় ভাইয়া।কি বলছো এসব?ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছো নাকি?”

” এই যে তোর সাথে বসে আছে।এর চেয়ে বড় চোর দুনিয়াতে দুটো খুঁজে পাবি না।”

চোখের কোনা দিয়ে ভাইয়ার দিকে চেয়ে আছি।কি আবোলতাবোল বলছেন উনি।ইচ্ছে করে পা’য়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে চাইছে এটা ভালোই বুঝতে পারছি।এই লোকের যন্ত্রণায় শান্তি নেই আমার।
চোখ গরম করে বললাম,

” কি চুরি করেছি আমি যে আমাকে চোর বলছেন?”

” তুই তো আমার সবচেয়ে বড় জিনিসটা চুরি করেছিস নীল।”

” প্রমাণ দেখান।শুধু শুধু আমার নামে আজেবাজে কথা বলবেন না তুষার ভাইয়া।”

আমার কথা শুনে ভাইয়া কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলেন।হঠাৎ বুকের বাম পাশে হাত রেখে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।
আমি কিছু বলতে নিব তখনই তুলি আপুর ঝাঁজালো কন্ঠ শোনা গেল।

” এই তোরা দুইজন থামবি?নীলাশা শোন! ভাইয়া তোর সাথে মজা করছে।তুই সিরিয়াস হোস না।আর এই যে আমার গুণধর ভাই।তুমি একটু চুপ থাকো।তোমার অর্থহীন ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে একটুও ভালো লাগছে না।যাও গিয়ে নিজের ঘরে ঘুমাও।”

” ভ্যাজর ভ্যাজর আবার কেমন শব্দ? মেডিকেল পড়ে শুধু দা-বটি,ছুড়ি-কাঁচি চালানো শিখছিস।শব্দভান্ডার একটু উন্নত কর।নাহলে তোর এই অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনে রোগী তোর কাছে আসতে চাইবে না।রোগী না আসলে তোর মেডিকেল পড়ে ডাক্তার হয়ে লাভ কি?শুধু শুধু আমার বাবা’র টাকা নষ্ট করা।এরচেয়ে ভালো বিয়ে করে সংসার কর।যা যা।”

” কি বললে তুমি ভাইয়া?এই নীলাশা শুনলি তুই !এই ভাই নামক জন্তুটা আমায় কি বলল।তুই সাক্ষী থাক।আমি কাল আম্মুকে বিচার না দিয়েছি তাহলে আমার নাম তুষ্টি নয়।তুষ্টি নাম বদলে আমি তুষ্ট রেখে দেব।”

তুষার ভাইয়া আর তুষ্টি আপুর তর্ক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।হে আল্লাহ! আমার মত নিরীহ প্রাণীটার উপর একটু দয়া করো।ওদের চেঁচামেচিতে আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। তুষার ভাইয়ার আজকে কি হয়েছে কে জানে।সবার সাথে ইচ্ছে করেই ঝগড়া লাগতে চাইছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here