মন পাজড়ে শুধু তুমি আছো?,পর্ব_৯,১০

0
1478

মন পাজড়ে শুধু তুমি আছো?,পর্ব_৯,১০
লেখিকা_মাইসারাহ_আরোহি?
পর্ব_৯

অর্থ রাগান্বিত দৃষ্টিতে আয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “আমি যাবো কি যাবো না সেটা তুমি বলার কে? কে হ‌ও তুমি আমার?”
আয়ানা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বললো,
— “বিয়ে করা বউ।”
— “মানে?” (অর্থ)
— “মানে এটাই।দেখুন বর্তমানে আপনার আমার সম্পর্কটা কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর।সবাই জানে এটা, শুধু ভেতরে ভেতরে আমরা সেটা মান্য করি না।তবে যতদিন না আমাদের মাঝে কিছু হচ্ছে ততদিন তো আমরা স্বামী-স্ত্রী। সুতরাং সেই অধিকার থেকেই বলছি আপনি পার্টিতে যেতে পারবেন না।” (আয়ানা)
— “আর যদি যাই তখন কি করবে?” (অর্থ)
— “কি করবো শুনবেন।আপনার সব কথা ভুলে গিয়ে স্ত্রীর জোর খাটাবো,আপনার গার্লফ্রেন্ড কে বিয়ে করা তখন ঘুচে যাবে। এমনিতেই উপকার করতে চাইছি সেটা তো আপনার ভালো লাগছে না।” (আয়ানা)
— “আচ্ছা বাদ দাও,বাবা-আম্মু,আপু সবাই খেয়েছে?” (অর্থ)
— “হুম খেয়েছে।” (আয়ানা)
— “আচ্ছা আমি হাত মুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে আসছি,আমার খাবারটা জয়াকে ঘরে দিয়ে যেতে বলো। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে।” (অর্থ)
— “জয়া সারাদিন কাজ করেছে এখন একটু বিশ্রাম করছে।ওকে আর বিরক্ত করবো না,আমি‌ই দিচ্ছি আপনার খাবার। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন যান।” (আয়ানা)

অর্থ আলমারি থেকে টি শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ততোক্ষণে আয়ানা অর্থের জন্য খাবার নিয়ে আসে। অর্থ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে প্লেট হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে।আয়ানা ওর পাশে বসে থেকে ওর কান্ড দেখছে। হঠাৎ অর্থ কিছু একটা মনে করে খাওয়া থামিয়ে বললো,
— “তুমি খেয়েছো?”
— “না। আপনি খেয়ে নিন,আমি পরে খাবো।” (আয়ানা)
— “তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমার খাওয়া প্রায় শেষ আর খাওয়ার পরেই তো আমি ঘুমাবো।আর আজ আমার বিছানায় শোবার কথা।সো তুমি তাড়াতাড়ি খেলে আমার বিছানাটাও তাড়াতাড়ি রেডি হবে আর আমি ঘুমাতেও পারবো।” (অর্থ)
— “একটু সেলফিশ কম করে হোন।খেয়ে দেয়ে শুতে নেই।খাওয়া শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দশপাক দেবেন। ততোক্ষণে আমার খাওয়া আর আপনার বিছানা রেডি দুটোই হয়ে যাবে।এখন অতো বকবক না করে খা‌ওয়ারটা শেষ করুন।” (আয়ানা)
অর্থ আর বেশি কথা বললো না ভদ্র ছেলের মতো সবটুকু খাবার খেয়ে নিলো।

!!
সকালে আয়ানা আর অর্থ জগিংয়ে যাবে এমন সময় অর্থি ওদের ঘরে আসে‌।অর্থিকে
দেখে আয়ানা বলে,
— “কিছু বলবে আপু?”
— “হ্যাঁ বলছি তোমরা তো রোজ জগিংয়ে যাও।তো তোমাদের সাথে আমি মেতে পারি প্লিজ?” (অর্থি)
— “পারো মানে অবশ্যই পারো।চলো একসাথে যাই।আমার-ই ভালো হলো একটা সাথী পেলাম নাহলে তো এই তোমার ভাই আস্ত একটা বিচুটি পাতা।” (আয়ানা)
— “এই মুখ সামলে কথা বলো।” (অর্থ)
— “আহ ভাই কেনো ঝগড়া করছিস? আচ্ছা চল তোরা এমনিতেই ছ’টা বাজতে চললো।” (অর্থি)
— “হুম আপু চলো।আর এই যে মিস্টার বিচুটি পাতা গাঁধার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমাদের ফলো করুন।” (আয়ানা)
অর্থ তো কিছু বলতে পারছে না তাই দাঁতে দাঁত চেপে আয়ানার পিছুপিছু গেলো।

!!
দেখতে দেখতে কেটে যায় এক মাস।আয়ানা মাত্র নিচে থেকে ব্রেকফাস্ট করে ঘরে আসলো।সবাই আগেই খেয়েছে তবে ওর খেতে দেরি হয়ে গেলো।আয়ানা ঘরে এসে দেখে অর্থ বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।আয়ানা পেছন থেকে অর্থকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “রোজ রোজ টি শার্ট কেনো পরে যান? মাঝে মাঝে তো একটু শার্ট‌ও পরতে পারেন।”
অর্থ আয়ানার কথার জবাবে বললো,
— “যাই তো প্র্যাকটিসে,আর ওখানে গিয়ে জার্সি-ই পরতে হয়।সেইজন্য টি শার্ট পরাই ভালো।আর তাছাড়া একাডেমী বাদে অন্য কোথাও গেলে শার্ট পরতাম।”
— “তাই কি? একদিন শার্ট পরে গেলে এমন কিছু হবে না। আপনি কালকে শার্ট পরে যাবেন।” (আয়ানা)
— “কেনো শার্ট পরলে বুঝি আমাকে আরো হ্যান্ডসাম লাগে?” (মুচকি হেসে অর্থ)
— “ওরেহ আমার হ্যান্ডসাম, কথা শোনো শার্ট পরলে নাকি ওনাকে হ্যান্ডসাম লাগে।হুহ কে বলেছে যে আপনি হ্যান্ডসাম?” (আয়ানা)
— “কেনো আমি হ্যান্ডসাম ন‌ই?” (ভ্রু কুঁচকে অর্থ)
— “না একদম‌ই না।” (আয়ানা)
— “তাহলে এমনি আমায় মেয়েরা এতো প্রপোজ করে? আর এমনি‌ই বলে যে আমি নাকি মোস্ট হ্যান্ডসাম বয়?” (জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে অর্থ)
— “পাম দেয় পাম।হ্যান্ডসাম মানে সুদর্শন,আর সুদর্শন কাকে বলে জানেন? সুদর্শন হচ্ছে সেই জিনিস যেটা দেখতে সুন্দর, পরিপাটি,ভদ্র।আর আপনার মাঝে তো এমন কোনো গুণ-ই নেই। চুলগুলো তো সবসময় বখাটেদের মতো খাড়াখাড়া রাখেন আর সাথে দাঁড়ি সেটাও কেমন বিচ্ছিরি,কোনো সাইজ হলো নাকি।” (আয়ানা)
— “মানলাম চুলগুলো বেশি স্পাইক করা হয়ে যায় তাই বলে তুমি আমার দাঁড়ি নিয়ে কথা বলবে? তুমি জানো সবাই আমার চাপ দাঁড়ির কত প্রশংসা করে,আর তুমি বলছো আমার দাঁড়ি বিচ্ছিরি।” (একটু মনোক্ষুণ্ন হয়ে অর্থ)

আয়ানা অর্থকে এক মিনিট পর্যবেক্ষণ করে বললো,
— “আমি খারাপ বলি নি।স্টাইলের কথা বলেছি।চাপ দাঁড়ি তো ঠিক আছে কিন্তু তার তো একটা সাইজ থাকা দরকার।মাঝেমধ্যে যে ট্রিমড করতে হয় সেটা জানেন না?”

অর্থ জবাব দেয়ার আগেই আয়ানার ফোন আসে আর ও ফোন নিয়ে একটু সাইডে চলে যায়।
— “হ্যাঁ রিয়া আপু বলো।” (আয়ানা)
— “আয়ানা আমি অনিক।আমি জানি তুমি আমার নম্বর ব্লক করেছো তাই আমি বাধ্য হয়ে রিয়া আপুর ফোন নিয়ে তোমাকে ফোন করছি।এতে রিয়া আপুর দোষ নেই আমি‌ই জোর করেছি।” (অনিক)
— “দোষ আছে কি নেই সেটা আমি পরে বুঝবো।কিন্তু তুমি কেনো আমাকে বারবার ফোন করে বিরক্ত করছো? তোমাকে তো বলেছি আমায় এভাবে বিরক্ত করবে না।কেনো এরকমটা করছো?” (আয়ানা)
— “আয়ানা তোমাকে ভালোবাসি,আমি তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই।তুমি এভাবে আমায় দূরে ঠেলে দিও না।” (অনিক)
— “উফ সেই এক কথা,আমি তোমাকে আর কতবার বলবো আমি বিবাহিত।তুমি যেটা চাইছো সেটা সম্ভব না। কেনো বুঝতে পারছো না এই সামান্য কথাটা?” (আয়ানা)
— “আমি কিছু বুঝতে চাই না আয়ানা,আমি শুধু তোমাকে চাই।হ্যাঁ শুধু তোমাকে চাই।তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না আয়ানা।” (অনিক)
— “ফোন রাখো,আর কখনো আমায় ফোন দিয়ে বিরক্ত করবে না।তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।” (আয়ানা)

অনিক অনেক জোরাজুরি করতে থাকে কিন্তু আয়ানা সেসব না শুনেই কল কেটে দেয়। আয়ানা কল কেটে পেছনে ঘুরতেই দেখে অর্থ কেমন যেনো কৌতুহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আয়ানা মাথা নাড়িয়ে বললো,
— “কি?”
— “কার সাথে কথা বললে?সেদিনের ওই ছেলেটা নাকি?” (অর্থ)
— “হুম কেনো?” (আয়ানা)
— “না কিছু না।বলছি আমার ওয়ালেট আর হ্যান্ডকারচিফ কোথায়?” (অর্থ)
— “দাঁড়ান দিচ্ছি।” (আয়ানা)
আয়ানা মানিব্যাগ আর রুমালটা এনে অর্থের হাতে দিলো।অর্থ সেগুলো নিয়ে একাডেমীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

!!
বিকেলে অর্থ বাইরে যায়।আয়ানা অর্থের আম্মু আর অর্থির জন্য চা আর কফি বানিয়ে নিয়ে ড্র‌ইংরুমে গেলো।উনারা দুজনেই টিভি দেখছিলেন,আয়ানাকে দেখে অর্থের আম্মু বেশ খুশি হলো।
— “বাহ আমার ব‌উমাটা তো খুব লক্ষী,ঠিক আমার জন্য চা করে এনেছে।ইস আমার মেয়েটা যদি এমন হতো!” (অর্থের আম্মু)
— “কেনো আম্মু আমি কি খারাপ?আমিও তো তোমাকে মাঝেমাঝে চা বানিয়ে দেই।” (অর্থি)
— “সব‌ই করিস কিন্তু আয়ানা মায়ের মতো এমন যত্ন করিস না‌। অবশ্য আমার দুই ছেলে মেয়ে দুজনেই অলস।আর তুই বড় তোর ছোটটাও তোকে দেখেই শিখেছে।” (অর্থের আম্মু)
— “এভাবে ছোট ভাইয়ের ব‌উয়ের সামনে আমার প্রেস্টিজের বারোটা বাজাচ্ছো আম্মু?” (অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে অর্থি)
মা আর মেয়ের এমন খুনসুটি দেখে আয়ানা ফিক করে হেসে দিলো।
— “না না অর্থি আপু মা তো তোমার সাথে মজা করছে।তুমি মন খারাপ করো না।” (আয়ানা)
— “আরেহ নাহ আমিও কিছু মনে করি নি।আসলে আমি আর ভাই দুজনেই খুব‌ই অলস।সবসময় বকা খেতাম আলসেমির জন্য,ইভেন এখন‌ও এর জন্য বকা খেতে হয়।” (অর্থি)
— “তা নাফিজ ভাইয়া‌ও তোমাকে আলসেমির জন্য বকা দেয় নাকি?” (আয়ানা)

নাফিজ হচ্ছে অর্থির উড বি হাজব্যান্ড।নাফিজের বাবা একটু অসুস্থ যার কারণে ওদের বিয়ে হতে দেরি হচ্ছে।তানাহলে আগেই হয়ে যেতো।
অর্থি লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ালো।

আয়ানা ওদের সাথে টিভি দেখা শেষ করে সন্ধ্যার আযান দিলে ঘরে গেলো।তারপর অজু করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলো।নামাজ পড়ে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে আয়ানা মাত্র বিছানায় এসে বসেছে ঠিক এমন সময় অর্থ আসে।অর্থকে দেখে আয়ানা বিস্মিত হয়!কারণ অর্থ নিজের হেয়ার স্টাইল,বেয়ার্ড স্টাইল দুটোই চেঞ্জ করে একটা নিউ লুক নিয়ে এসেছে। চুলগুলো এমনি সুন্দর করে একটা কাট দিয়েছে আর দাঁড়িটা হালকা ট্রিমড করেছে।যার কারণে এই নতুন লুকে অর্থকে অতিরিক্ত মাত্রায় সুদর্শন লাগছে।আয়ানা অর্থের দিকে হা করে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
— “সকালে বলেছিলাম আর এখন‌ই সব পরিবর্তন। আজকাল দেখছি মিস্টার অর্থ আমার কথা বেশ শুনছে।তবে ব্যাপারটা কেমন যেনো লাগছে এতো সহজে সব মেনে নিলো নাকি এসব আমার ভুল ধারণা।উনি হয়তো এমনি এসব করেছেন।”

অর্থ আয়ানার এমন মুখভঙ্গি দেখে একটু লজ্জা পেয়ে বললো,
— “আমি জানি আমি সুদর্শন তাই বলে এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?আমার তো লজ্জা লাগে নাকি?”
এমন কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আয়ানা চোখ সরিয়ে নিলো আর বললো,
— “আমার কি দেখার জন্য ছেলের অভাব পড়েছে যে আপনার দিকে তাকাবো? এগুলো আপনার ভুল ধারণা।আমি মোটেও আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম না।”
— “ওহ রিয়েলি।আচ্ছা তোমার পেছনে বুঝি অনেক ছেলে ঘোরে?” (অর্থ)
— “হুম ঘোরেই তো। অনেক ছেলে আছে বুঝেছেন।” (আয়ানা)
— “হুম সে যে কেমন ছেলে বোঝাই যাচ্ছে।” (অর্থ)
— “কেমন ছেলে মানে? কি বলতে চাইছেন?” (আয়ানা)
— “বলতে চাইছি এই যে তোমার পেছনে ওই টাক‌ওয়ালা,ভুড়িওয়ালা,বেটে আংকেলগুলো ছাড়া আর কেউ ঘোরে না।উনারাই তোমার জন্য পার্ফেক্ট,উনাদের সাথে তোমাকে বেশ মানাবে,বুঝেছো?” (হাসতে হাসতে অর্থ)
— “কি এত বড় অপমান?আপনাকে আমি আজকে কি যে করবো!!” (আয়ানা)

অর্থের এমন কথায় আয়ানা ভীষণ রেগে যায়।ও অর্থের দিকে তেড়ে যায় কিন্তু দুর্ভাগ্য তার আগেই স্লিপ কেটে আয়ানা অর্থের বুকে আছড়ে পড়ে।অর্থ‌ও সাথে সাথে ওকে শক্ত করে ধরে নেয়।

চলবে

#মন_পাজড়ে_শুধু_তুমি_আছো?
#লেখিকা_মাইসারাহ_আরোহি?
#পর্ব_১০

অর্থের এমন কথায় আয়ানা ভীষণ রেগে যায়।ও অর্থের দিকে তেড়ে যায় কিন্তু দুর্ভাগ্য তার আগেই স্লিপ কেটে আয়ানা অর্থের বুকে আছড়ে পড়ে।অর্থ‌ও সাথে সাথে ওকে শক্ত করে ধরে নেয়।

পরিবেশটা একদম নীরব,শুধু দুজনের হৃদস্পন্দনের টিপটিপ শব্দ হচ্ছে।আয়ানা ভয়ে চোখ কুঁচকে বন্ধ করে আছে।ওর বুকের মধ্যে কেমন যেনো টিপটিপ শব্দ হচ্ছে,ও অর্থের শার্টের হাতা শক্ত করে খামচে ধরে আছে।অর্থের এক হাত আয়ানার কোমড়ে আর আরেক হাত আয়ানার কাঁধের উপরে। অর্থের চোখের পলক একবারের জন্যও পড়ছে না,ও শুধু অপলক দৃষ্টিতে আয়ানাকে দেখে যাচ্ছে।আয়ানার কপালের উপর ছোট ছোট চুলগুলো লেপ্টে রয়েছে,মায়াবি সুদীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট বন্ধ করা চোখ আর মুখে কিঞ্চিত ভয়ের ছাপ,বোঝাই যাচ্ছে ভয়ের কারণে ও চোখ বন্ধ করে আছে,নাকে সাদা স্টোনের নোজপিন জ্বলজ্বল করছে,গোলাপি ঠোঁট দুটো কচি কিশলয়ের মতো কাঁপছে।আয়ানার নিঃশ্বাস কেমন যেনো ভারি হয়ে আসছে।হুট করে ও এমন স্লিপ কেটে যাবে সেটা ভাবতে পারে নি।তারপরে অর্থ ওকে ধরেছে সেজন্য রক্ষা নাহলে পড়ে গেলে আরেক বিপদ হতো।কিছু সময় একইভাবে থাকার পর আয়ানার স্মরণ ঘটে,ও তৎক্ষণাৎ অর্থের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

!!
পরেরদিন সকালে,
— “আয়ানা মা তুই তো কলেজ যাবি তাই না?” (অর্থের বাবা)
— “হ্যাঁ বাবা যাবো।” (আয়ানা)
— “তাহলে অর্থ তুই এক কাজ কর।তুই তো আয়ানাদের কলেজের সামনে দিয়েই যাবি তাহলে তুই বরং আয়ানাকে একটু ড্রপ করে দিস।” (অর্থের বাবা)
— “বাবা আমি একাই যেতে পারবো।আর তাছাড়া উনার তো আজকে ম্যাচ আছে আমার জন্য দেরি হয়ে গেলে অনেক সমস্যা হবে।আমি আমার সুবিধা মতো রিকশা অথবা সিএনজি করে চলে যেতে পারবো।” (আয়ানা)
— “সে হয় না তুই তো রোজ এভাবেই যাস।আমি বলি আরেকটা গাড়ি নিয়ে যেতে তাও যাস না।তাই আজ তুই অর্থের সাথেই যাবি, অর্থ তোর কি ওকে ড্রপ করে দিতে কোনো সমস্যা আছে?” (অর্থের বাবা)
— “উফ বাবা সমস্যাটা উনার নয় সমস্যাটা আমার।আমি তো গ্রাউন্ডে যাবো। এখন আমায় যদি কলেজে নিয়ে যায় তাহলে তো সমস্যা।” (মনে মনে আয়ানা)

আয়ানা ঠিক যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো।অর্থ কোনো আপত্তি করলো না বরং ওর বাবার কথায় সায় দিয়ে বললো,
— “না আমার কোনো সমস্যা নেই।ওকে শুধু তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলো।আমি সময় নষ্ট করতে পারবো না।”
— “যা মা তুই গিয়ে চটপট তৈরি হয়ে নে।” (অর্থের বাবা)
— “কিন্তু বাবা…” (আয়ানা)
— “আর কি কিন্তু কিন্তু করছো মা, তোমার তো বাবা বললেন‌ই তুমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে রেডি হয়ে এসো।” (অর্থের আম্মু)
— “হুম মা আসছি।” (আয়ানা)

আয়ানা পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে আপেঊ।তারপর দুজনে র‌ওনা হয়।আজ অর্থ নিজেই ড্রাইভ করছে আর ওর পাশের সিটে আয়ানা বসে থেকে হাতের মাঝে ওড়না পেঁচাচ্ছে,কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা।অর্থ আড়চোখে তাকিয়ে আয়ানাকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি এতো ভাবছো?”
— “হ্যাঁ কিছু বলছিলেন?” (আয়ানা)
— “বলছি কি ভাবছো এতো?” (অর্থ)
— “না কিছু না,একটু নার্ভাস লাগছে।” (আয়ানা)
— “নার্ভাস? নার্ভাস তোমার কেনো লাগছে ওটা তো আমার লাগার কথা।আজ তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচ হবে কিন্তু আমার তো তোমার মতো অতো নার্ভাস লাগছে না।” (অর্থ)
— “না ও এমনি।আপনি এসব ভাববেন না মন দিয়ে খেলবেন, আপনার দলকে জেতাতে হবে তো!” (আয়ানা)
— “হুম আর আমি তোমাকে নিয়ে ভাবিও না।এসব ভাবার আমার টাইম নেই।” (অর্থ)

আয়ানা আর কথা বাড়ালো না।একটু পরে অর্থ আয়ানার কলেজের সামনে আয়ানাকে নামিয়ে দিয়ে স্টেডিয়ামে চলে গেলো।
— “ধুর আর ভাল্লাগে না। সম্পূর্ণ উল্টো জায়গায় এলাম আমাকে আবার অতোটা পথ যেতে হবে।অসহ্য!!” (মনে মনে আয়ানা)
আয়ানা ওখান থেকে একটা সিএনজি নিয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।

!!
শরতের মাঝামাঝি।স্বচ্ছ আকাশের রং ঘন নীল আর তার সাথে তুলোর মতো দেখতে সাদা মেঘের আনাগোনা।প্রকৃতির রূপ আজ অতীব চমৎকার।হালকা শীতল হাওয়া, মাঝেমাঝে শিউলি ফুলের সুবাস নাকে পৌঁছানো সবকিছুই অপরূপ।সকালের এমন চমৎকার আবহাওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছে আয়ানা।অর্থের বারান্দার সাথেই একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে আর সেখান থেকেই একটা মিষ্টি গন্ধ আয়ানা নাকে ভেসে আসছে।আয়ানা মুচকি হেসে গ্রিলের ফাঁকা অংশ দিয়ে হাত বের করে দেয় আর গাছ থেকে কিছু ফুল হাতে নেয়। ফুলগুলোর সৌন্দর্যের তো কোনো কথাই নেই,সাদা পাপড়ি আর তার সাথে কমলা রঙের বৃন্ত এক বাক্যে অপরুপ সুন্দর।প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে বিভোর থাকতে গিয়ে আয়ানার খেয়াল-ই নেই যে জগিংয়ে যেতে হবে।ওদিকে অর্থ ঘুম থেকে উঠে আয়ানাকে ঘরে না পেয়ে বারান্দায় আসে আর ওকে দেখতে পায়।
— “তুমি এখানে,ওহো আর আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজছি।” (সামনের চুলগুলো নাড়তে নাড়তে অর্থ)

অর্থের কন্ঠস্বর পেয়ে আয়ানার ভাবনায় ছেদ ঘটে।ও অর্থের কথার জবাবে বললো,
— “কেনো? কি দরকার আমায়?”
— “দরকার মানে জগিংয়ে যাবে না? রোজ তো আমার ঘুমের বারোটা বাজাও আজ এখানে কি করছো?” (অর্থ)
— “প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আই মিন ন্যাচারাল বিউটি বোঝেন?” (আয়ানা)
— “হুম কেনো?” (অর্থ)
— “না আপনি তো আবার নাও বুঝতে পারেন।সহজ কথা তো সহজ ভাবে বুঝেন না।যাই হোক বাদ দিন আজকে সকালের চেহারাটা অন্যরকম,বারান্দায় এসে সেটা উপলব্ধি করতে করতে আমার খেয়াল ছিলো না জগিং এ যাওয়ার কথা।তাই আজ আজ মিস হয়ে গেলো।” (আয়ানা)
— “ওহ ইটস্ ওকে।বাট এটা কোন সিজন চলছে জানো?” (অর্থ)

আয়ানা এক ধাপ সামনে এগিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “হুম,এখন চলছে ঋতুর রাণী শরৎকাল।শরতের রূপের কারণে বিভিন্ন কবি তার কবিতায় নানারকম সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন এবং এজন্য শরৎকে ঋতুর রাণী বলা হয়।”
— “কি রকম সৌন্দর্য?” (অর্থ)
— “এই যে স্বচ্ছ নীল আকাশ সাথে সাদা সাদা মেঘ,গাছে গাছে সাদা আর কমলার সংমিশ্রণে শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ, অসাধারণ এক পরিবেশ,বিলের জলে শাপলার মেলা,বিকেলে মাথার উপর সারি করে উড়ে যাওয়া বকের সারি আর পড়ন্ত বিকেলে নদীর ধারে হালকা বাতাসে দুলতে থাকা কাশফুল – এই সবকিছুই প্রকৃতির সৌন্দর্য্যকে অনন্য মাত্রা দান করে।আর এগুলোই শরতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।” (আয়ানা)
— “ওহ আই সি!!আচ্ছা এখন নদীর ধারে কাশফুল আছে তাই না?” (অর্থ)
— “হুম আছে।কিন্তু কেনো?” (আয়ানা)
— “না সেদিন বলেছিলে না তোমায় একদিন নদীর ধারে নিয়ে যেতে।আমি তো তোমাকে নিয়ে যাই নি।তাই ভাবছি আজ নিয়ে যাবো। এমনিতেই আমি এক মাসের জন্য জার্মানি যাচ্ছি,প্রিমিয়ার লিগ আছে।আর তখন ফিরে এসে তো এই সিজন পাবো না।নদীর ধারে কাশফুলগুলো‌ও থাকবে না। সেজন্য ভাবছি আজকে যাবো তাহলে নদীর সৌন্দর্য‌ও দেখা হবে আর তোমার পাওয়ানাটাও মেটানো যাবে।” (অর্থ)
— “যাক বুঝেছেন এই অনেক।” (আয়ানা)

!!
বিকেলে পাঁচটার দিকে অর্থ আয়ানাকে রেডি হ‌ওয়ার জন্য বলে।
— “তাড়াতাড়ি রেডি হবে আমি অতো সময় তোমার জন্য বসে থাকতে পারবো না।
— “হুম বেশি সময় লাগবে না আমি খুব দ্রুত‌ই রেডি হ‌ই।” (আয়ানা)
— “বাই দ্যা ওয়ে তুমি কি পরবে না মানে শর্ট জিন্স নাকি ওয়েস্টার্ন?” (অর্থ)
— “দুটোর কোনোটাই না।ওসব জিন্স টপস কিংবা ওয়েস্টার্ন ড্রেস এই আমাকে দ্বারা সম্ভব নয়,বুঝেছেন?” (আয়ানা)
— “হ্যাঁ তা তো তোমাকে দিয়ে সম্ভব‌ই না থার্ড ক্লাস মেয়ে একটা!!” (অর্থ)

আয়ানা আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না তার আগেই অর্থ নিজের জামাকাপড় নিয়ে অন্যরুমে চলে গেলো।আয়ানা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলমারি থেকে ড্রেস বের করে রেডি হতে শুরু করলো।

বিশ মিনিট পর অর্থ রুমে আসে আয়ানা তৈরি হয়েছে কি না সেটা দেখার জন্য।দরজার ভেতরে প্রবেশ করে অর্থ শুধু বললো,
— “হয়েছে তোমার?”
আর কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে অর্থ,কারণ ও শুধু এখন আয়ানাকে দর্শন করে যাচ্ছে।লাল রঙ্গের জর্জেট লং ড্রেস সাথে ছেড়ে দেওয়া চুল,চোখে হালকা করে কাজল দেওয়া,ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক দেয়া সবকিছু মিলিয়ে আয়ানাকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে।এতোটা সুন্দর
ওকে আগে কখনো লাগে নি,এমনকি বিয়ের দিনেও নয়।

অনেকক্ষণ হয়ে গেলো অর্থের মুখে কোনো কথা নেই,ওর চোখের পলক‌ও পড়ছে না। এমতাবস্থায় আয়ানা বাধ্য হয়ে অর্থের হুঁশ ফেরালো‌।
— “কোথায় হারিয়ে গেলেন? যাবেন তো নাকি।আমি তো তৈরি।” (আয়ানা)
আয়ানার কথায় অর্থ বাস্তবে ফিরে এলো এবং বললো,
— “হুম চলো।”
— “ওয়েট এক মিনিট। আপনি এভাবে যাবেন?” (আয়ানা)
— “কেনো কি হয়েছে? খারাপ লাগছে আমায়?” (অর্থ)
— “না ভালো লাগছে।তবে টি শার্ট জ্যাকেট না পরে শার্ট পরলে মে বি ভালো লাগতো।” (আয়ানা)
— “তুমি গিয়ে গাড়িতে বসো আমি চেঞ্জ করে আসছি।” (অর্থ)

আয়ানা মাথা নাড়িয়ে নিচে গিয়ে গাড়িতে বসে।দুই মিনিট পর অর্থ টি শার্ট জ্যাকেট চেঞ্জ করে হালকা আকাশি রঙের একটা শার্ট পরে আসে।আয়ানার এই কথাটা অর্থ শুনেছে এজন্য আয়ানা মনে মনে মুচকি হাসলো। অর্থ ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট লাগিয়ে ড্রাইভ করতে শুরু করলো।

পড়ন্ত বিকেল সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই। পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে রয়েছে লাল আভা আর তার সাথে প্রবাহিত হচ্ছে শীতল হাওয়া।বাতাসের সাথে নদীর ধারের কাশফুলগুলো দুলছে। এমন এক সুন্দর মুহুর্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে অর্থ আর আয়ানা।দুজনের হাতেই একটা আইসক্রিম। অর্থের জানা নেই আয়ানা কেনো এমন একটা আবহাওয়ায় আইসক্রিম খেতে চেয়েছে তবুও নিজের কথা রাখতে অর্থ দুটো আইসক্রিম নিয়েছে।তবে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে মন্দ লাগছে না।আয়ানা আজ ভীষণ খুশি,মুখে এক চিলতে হাসির রেখা আর হাতে আইসক্রিম নিয়ে নদীর ধার দিয়ে ও আস্তে আস্তে হাঁটছে।বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ে উড়ে সামনে এসে বারি খাচ্ছে তবে আয়ানার ওদিকে খেয়াল নেই ও পরিবেশটা উপভোগ করতেই ব্যস্ত আর অর্থ আইসক্রিম হাতে দাঁড়িয়ে আয়ানাকেই দেখে যাচ্ছে।

খানিকটা সময় দুজনে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলো।এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে,মাগরিবের আজান‌ও পড়ে গেছে। অর্থ আর আয়ানা দুজনে বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুতি নেয় তবে ওরা দুজনে গাড়ির কাছে আসতেই কোত্থেকে যেনো কয়েকটা মেয়ে এসে ওদের পথের সামনে দাঁড়ায় এবং একসাথে বলতে থাকে,
— “আরেহ সারহান ইন্তেহাব আপনি? ও মাই গড আই কান্ট বিলিভ দিজ যে আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।জানেন আমি আপনার ভীষণ বড় ফ্যান।আপনার প্রতিটা ম্যাচ আমি দেখেছি।আপনি ফুটবল যেমন খেলেন তেমনি আপনার স্টাইল,লুকস সবকিছুই পার্ফেক্ট।এক কথায় বলতে গেলে আমি আপনার জন্য ফিদা।”

এরপরেই আরেকজন মেয়ে বলে,
— “আমি তো তোমার ডাই হার্ড ফ্যান।তোমার নামে আমার একটা ফ্যান পেজ‌‌ও আছে।আমি সেই প্রথম থেকে তোমার প্রতি অ্যাডিক্টেড। তুমি শুধু একজন প্লেয়ার ন‌ও তুমি আমার পুরো দুনিয়া।জানো তোমাকে সামনে থেকে দেখবো সেটা কখনো ভাবি নি।আমার কাছে সব কেমন যেনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে।আমি কি তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি প্লিজ?”

অর্থ মুচকি হেসে হাত এগিয়ে দিয়ে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে। যতগুলো মেয়ে ছিল সবাই যে ভীষণ খুশি হয়েছে তা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।আয়ানা পাশে দাঁড়িয়ে শুধু দেখে যাচ্ছে, অর্থের কোনো অহংকার নেই ও হাসি মুখে সবার সাথে কথা বললো,হ্যান্ডশেক করলো,অটোগ্রাফ দিলো এবং সেলফিও তুললো।ওর মুখে কোনো বিরক্তির ছাপ নেই।আর সকল মেয়ে তো ওর প্রশংসাই করে যাচ্ছে,বোঝা যাচ্ছে ওরা সবাই অর্থের খুব বড় ফ্যান।

হঠাৎ ওদের মাঝে একটা মেয়ে আয়ানাকে অর্থের পাশে দেখে। এতোক্ষণে কারো‌ই আয়ানার দিকে নজর ছিলো না সবাই অর্থকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলো।কিন্তু এখন তারা অর্থকে জিজ্ঞেস করে,
— “আচ্ছা আপনি কিছু মনে না করলে আমরা কি জানতে পারি আপনার পাশের এই মেয়েটি কে?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here