মন বদল,প্রথম অংশ
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
দিনটা শনিবার। আষাঢ় মাস। সকাল থেকে বিষম বৃষ্টি। রাস্তায় হাঁটু পানি জল। যাতায়াত ব্যবস্থা ভয়াবহ। এমন ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পাত্রের সাথে দেখা করতে যেতে হলো আমায়। রিকশা আর ছাতার বদৌলতে মাথাটা বেঁচে গেলেও রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই শাড়ি ভিজে একাকার। কাজল ল্যাপ্টে গিয়েছে। টিপটাও বোধহয় সরে গিয়েছে খানিক। ঠিক করা দরকার। আমি পার্স হাতরে দেখলাম, আয়না জাতীয় কোনো বস্তু পার্সে নেই। মহা বিপদ। ছাতাটা গুটিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ভিজে যাওয়া শাড়ির কুচি ঝাড়তে ঝাড়তে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। ‘ফাস্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্য বেস্ট ইম্প্রেশন’ প্রবাদটা মনে করে ভয়ানক মন খারাপও লাগছে। এমন ভেজা শাড়ি, ল্যাপ্টানো কাজলে দাঁড়িয়ে থাকা আমি মনে মনে প্রার্থনা করছি, পাত্র সাহেব যেন ভীষণ গোবেচারা ধরনের হয়। স্মার্ট কোনো ছেলের সামনে পড়লেই শেষ! মান সম্মান ধ্বংস। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক পড়ল,
‘ এক্সকিউজ মি? মিস.রোদেলা?’
আবারও মন খারাপ হয়ে গেল আমার। যে লোকের কন্ঠ এতো সুমিষ্ট, স্মার্ট সে দেখতে নিশ্চয় গোবেচারা ধরনের হবে না? আমি অসহায় মুখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। রেস্টুরেন্টের এক কোণায় ছোট্ট একটা টেবিল দখল করে বসে আছেন তিনি। আমি তাকাতেই মিষ্টি করে হাসলেন। প্রায় সাথে সাথেই টুপ করে একটা ডিম্পল দেখা দিল ডান গালে। আমার তৃতীয়বারের মতো মন খারাপ হয়ে গেল। লোকটি দেখতে ভয়াবহ স্মার্ট। এমন স্মার্ট ছেলের সাথে এই ন্যাতন্যাতে সাজে বসাও যেন পাপ। মহাপাপ। আমি আকাশসম অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে গেলাম। নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করে মৃদু হাসলাম। শালীন কন্ঠে বললাম,
‘ আপনিই দেখা করতে এসেছেন? সরি, আমি ঠিক চিনতে পারিনি।’
ভদ্রলোক বোধহয় স্বল্পভাষী। তিনি খুব একটা কথা এগোলেন না। ছোট্ট করে বললেন,
‘ ইট’স ওকে।’
আমার আবারও মন খারাপ হয়ে গেল। লোকটি কী স্মার্টলি উত্তর দিচ্ছে। তার স্মার্টনেসের তুলনায় আমার ব্যক্তিত্ব কী খুব নড়বড়ে লাগছে? লাগতে পারে। আমার এই মুহূর্তে মানুষের মন পড়ার অসাধারণ ক্ষমতাটা পেয়ে যেতে ইচ্ছে করল। ভদ্রলোকের কাছে আমার ফার্স্ট ইম্প্রেশন কেমন হতে পারে তা জানার জন্য ছোট্ট মনটা কেমন ছটফট করতে লাগল। আমি নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করলাম। ভদ্রলোক গম্ভীর, ভরাট কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
‘ কী খাবেন? কিছু অর্ডার করুন।’
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম,
‘ না। না। কিছু খাব না৷ ইট’স ওকে।’
কথাটা বলে ফেলেই নিজেকে হাজারখানিক গালি দিয়ে ফেললাম আমি। কী দরকার ছিল এতো কথা বলার? নো থ্যাংক্স, বললেই তো এনাফ! আমার মন খারাপ ভাবটা বেড়ে গেল। নিজেকে কেমন হ্যাংলা মনে হতে লাগল। নিজের এই বেশি কথা বলা রোগটির প্রতি ভয়াবহ বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকালাম। ভদ্রলোক বললেন,
‘ এভাবে তো বসে থাকা যায় না। কফি অর্ডার করা যেতে পারে? কথা বলতে সুবিধা হবে।’
তৃতীয় ব্লান্ডারটা এবারই করে বসলাম আমি। ফট করে বলে ফেললাম,
‘ আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি না। মায়ের কথা রাখতেই দেখা করতে আসা নয়তো…. ‘
কথাটা বলে ফেলে বুঝলাম, এভাবে হুট করে কথাটা বলা উচিত হয়নি। সময় বুঝে, ধীরে সুস্থে বলা উচিত ছিল। আমি অসহায় চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। ভদ্রলোক রাগ করলেন না। বিরক্ত হলেন কী-না সেও বুঝা গেল না। শান্ত চোখে চেয়ে বললেন,
‘ আচ্ছা। কফি খেতে খেতে কথা বলি?’
আমি উত্তর দিলাম না। আমার হীনমন্যতা বাড়তে লাগল। নিজেকে কেমন ঠুনকো, আনস্মার্ট মনে হতে লাগল। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কোন অলক্ষুণে সময়ে এখানে আসতে রাজি হয়েছিলাম সেই ভেবে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। হুট করে বলে ফেললাম বিয়ে করব না। লোকটি যে আমায় বিয়ে করার জন্য নাচছে এমন নিশ্চয়তায় বা কে দিয়েছে, শুনি? নিশ্চয় লোকটি আমার গেঁয়োপনায় মনে মনে হাসছে? কৌতূক করছে? ভদ্রলোক শান্তভাবে কফি অর্ডার করলেন। কফি আসার আগপর্যন্ত কোনোরকম কথা বললেন না। চুপচাপ ফোন ঘাটলেন। কফিতে চুমুক দিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
‘ স্পেসিফিক আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন না নাকি বিয়েই করতে চাইছেন না, রোদেলা? প্রশ্নটা ব্যক্তিগত হয়ে যাওয়ায় দুঃখিত। বিয়ে বিষয়টিই ব্যক্তিগত। আনফরচুনেটলি আপনার ব্যক্তিগত বিষয়টির সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছি। তাই প্রশ্নটা করতেই হচ্ছে। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ।’
ভদ্রলোকের কথার ধরন সুন্দর। আমি মুগ্ধ হলাম। গোছালো বুলির মানুষের সামনে অগোছালো হয়ে পড়তে হয়। কথায় তাল হারাতে হয়। অপ্রস্তুত হতে হয়। আমি তার সবই হলাম। ভেতরের মনটা জড়তা আর অস্বস্তিতে অন্ধকার হয়ে এলেও বাইরে ডাট বজায় রেখে বললাম,
‘ স্পেসিফিক কাউকে নয়। আমি আসলে বিয়েই করতে চাইছি না।’
লোকটি শান্ত চোখে চেয়ে আছেন। কফিতে চুমুক দিয়ে কপাল কুঁচকালেন। কৌতূহল নিয়ে বললেন,
‘ কেন? কৌতূহল দমন করতে পারছি না, দুঃখিত।’
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে হাসলাম।
‘ ইটস ওকে। আমি আসলে ভালোবাসা, সম্পর্ক এসবে বিশ্বাসী নই। আই মিন, ম্যান এন্ড উইমেন রিলেশনশিপ।’
ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর হালকা কেশে বললেন,
‘ আই নো ইট সাউন্ডস উইয়ার্ড বাট আপনি কী ছেলেদের সঙ্গ পছন্দ করেন না? আমি সরি আসলে কথাটা ঠিক ধরতে পারছি না।’
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। ব্যস্ত হয়ে বললাম,
‘ না না। পাগল নাকি? তেমন কোনো ব্যাপার নয়। আমি অন্যান্য মেয়েদের মতোই স্বাভাবিক। শুধু ভালোবাসা অনুভূতিটিতে বিশ্বাস করি না। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। সবকিছুই একটা আকর্ষন মাত্র। সময়ের সাথে সাথে আকর্ষন পাল্টায়। আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুও পাল্টে যেতে পারে। আজ আপনার আমাকে ভালো লাগছে কাল অন্য কাউকে ভালো লাগবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? আপনার অবচেতন মনেও ঘটনাটা ঘটে যেতে পারে। যেখানে অনুভূতিরই নিশ্চয়তা নেই। সেখানে সাময়িক আকর্ষনের উপর ভিত্তি করে একটা সম্পর্কে জড়ানোর মানে কী?’
ভদ্রলোক কফিতে চুমুক দিলেন।
‘ আপনার এমন ভাবনা কী ছোট থেকেই? নাকি হঠাৎ?’
‘ ছোট থেকে নয় আবার হঠাৎ-ও নয়। তবে এর পেছনে একটা গল্প আছে। খুব সাধারণ একটি গল্প। মাঝে মাঝে খুব সাধারণ গল্পগুলোই অসাধারণ হয়ে উঠে। চিন্তা-ভাবনা পাল্টে দেওয়ার জন্য সাধারণ ঘটনাগুলোই বোধহয় বেশি দায়ী।’
‘ নিশ্চয়ই। কিছু মনে না করলে, আমি কী আপনার গল্পটা শুনতে পারি? বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এই মুহূর্তে উঠে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনিও অনেকটা ভিজে গিয়েছেন। এভাবে মুখোমুখি চুপ করে বসে থাকাও সম্ভব নয়। তার থেকে বরং গল্পটা শুনি।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভদ্রলোক আরও দু’কাপ কফি অর্ডার করলেন। বাইরে ঝমঝমে বৃষ্টি। রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেয়ালটা ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটায়। শব্দহীন বৃষ্টি দেখতে দেখতে কাহিনীগুলো ভেসে উঠল একের পর এক। আমি আনমনা কন্ঠে বললাম,
‘ সেদিনও বৃষ্টি ছিল। রাস্তায় এক হাঁটু জল। কলেজে সেদিন ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা। আমি রাস্তার পাশে উঁচু ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। এমন আষাঢ় ভাঙা বৃষ্টিতে রিকশা পাওয়া দুষ্কর। এমন সময় ছোট্ট একটা ছেলে এসে দাঁড়াল পাশে। বৃষ্টিতে জবজবে ছেলেটি তার থেকেও ভেজা জবজবে এক চিরকুট এগিয়ে দিল আমায়। আমি অবাক হয়ে চাইতেই পাশের গলির দিকে ইশারা করে বলল, ”ওই ভাইয়াটা দিয়েছে।” আমি গলির দিকে চাইলাম। গলির মোড়ে কালো ছাতায় মুখ ঢাকা এক ছেলেকে দেখতে পেলাম। মোড়ের বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকায় চোখে পড়ল শুধু গুটিয়ে রাখা চেইক শার্টের হাতা আর মোটা বেল্টের ঘড়ি। আমি কাঁধ আর মাথা দিয়ে ছাতাটা চেপে ধরে ভেজা জবজবে চিরকুটটা খোলার চেষ্টা করলাম। চিরকুটটা মাঝপথেই ছিঁড়ে একাকার হলো। সেই ভিজে যাওয়া, ছেঁড়া চিরকুট খুঁটিয়ে দুটো লাইন পেলাম মাত্র, ‘ তুমি রৌদ্রজ্বল দুপুর, আমি কুয়াশাময় সন্ধ্যে। তবুও চাই দেখাটা হোক, কোনো এক বৃষ্টিস্নান লগ্নে।’ আমি বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। তখন কিশোরী ছিলাম। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করেছিল ঠিক, তবে গুরুত্ব পায়নি। আমি ভীষণ ইগোইস্টিক একটা মেয়ে। পছন্দ হওয়া ব্যাপারটা মুখ ফুটে বলা বা প্রকাশ করাটা আমার ধাতে নেই। সে যায় হোক, সেই ভেজা চিরকুটটা রাস্তায় জমে থাকা জলেই ভাসিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন। এই ছোট্ট স্মৃতিটুকু বৃষ্টিভেজা রাস্তাটিতে ফেলে রেখেই রিকশা নিয়ে ছুটেছিলাম গন্তব্যে।’
ভদ্রলোক কৌতূহল নিয়ে বললেন,
‘ কী হলো তারপর? ইট’স আ লাভ স্টোরি?’
আমি হাসলাম। কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম,
‘ তার জন্য আমি একটা মুগ্ধতা ছিলাম। এমন হাজারও মুগ্ধতার সাক্ষর সে দেখিয়েছিল আমায়। তারপর একদিন হঠাৎ চিরকুট ছেড়ে বিশাল এক চিঠি দিল সে। তখনও তার মুখ দেখিনি আমি। শুধু নামটা জানতাম। কী ভীষণ সুন্দর একটা নাম!’
‘ নামটা কী ছিল?’
‘ তার নামটা আপনাকে বলব না ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। নামটা গোপন থাক। কাহিনীটা বরং শুনুন।’
ভদ্রলোক হেসে মাথা নাড়লেন। আমি কথা এগুলাম,
‘ ভীষণ সুন্দর চিঠি লিখতে জানত সে। ভীষণ গোছানো তার লেখার হাত। আমি তার প্রেমে পড়েছি ভাববেন না। প্রেমে পড়িনি কিন্তু কিছু একটা ছিল। সে আমাকে অসাধারণ এক প্রেমপত্র লিখে পাঠাল। আমি উত্তরে তাকে পাঠালাম মাত্র দুটো বাক্য, ” ছোটবোনের প্রতি এই ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ ভাইয়া। এতো সুন্দর চিঠি উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।”
ভদ্রলোক আকাশসম অবাক হয়ে বললেন,
‘ ভাইয়া? প্রেমপত্রের বিপরীতে ভাইয়া? মাই গড!’
আমি খিলখিল করে হেসে উঠে বললাম,
‘ মজা করেছিলাম তার সাথে। বান্ধবীরা এমন উত্তরে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। সে ভীষণ ভঙ্গ হৃদয় নিয়ে বলেছিল, ” শেষমেশ ভাইয়া ডাকলে? ভাই ডেকে আহত করার চেয়ে বাবা ডেকে নিহত করে দিতে।”
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বলল,
‘ ভীষণ করুণ কাহিনি। গল্প এগুলো কীভাবে? প্রেমে টেমে পড়ে গিয়েছিলেন কোনোভাবে?’
ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে শুরু হওয়া আমাদের আলাপনে এবার স্বাভাবিকতা এলো। ভীষণ পরিচিতদের মতো বললাম,
‘ গল্পের মোড়টা এসেছিল আকস্মিক। হঠাৎ একদিন ছাদে যেতেই পাশের ছাদ থেকে কাগজ ছুঁড়ে মারা হলো। আমি দেখেও দেখলাম না। পাশের ছাদে কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিয়ে নিচে নেমে গেলাম। দ্বিতীয় এবং তৃতীয়দিনও একই ঘটনা ঘটল। আমি তৃতীয় দিন পাথরে বাঁধা চিরকুটটা তুলে নিলাম। তাতে লেখা, ‘চিরকুটের জবাব কী আসবে না?’ আমি সেই চিরকুটের উল্টো পাশে লাল ইটের টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে লিখলাম, ” কী চাই?’ চতুর্থ দিন আরেকটা চিরকুট পাওয়া গেল। সেখানে লেখা, ‘আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? কখনও কৌতূহল জাগে না?’ আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ‘না। আমার কৌতূহলের মাত্রা সীমিত।’ ”
এটুকু বলে থামলাম। ভদ্রলোক হেসে বললেন,
‘ সত্যিই দেখতে ইচ্ছে করেনি কখনও? একজন মানুষ নিরন্তর আপনাতে মুগ্ধতা প্রকাশ করছে। তাকে দেখতে ইচ্ছে না করাটা অস্বাভাবিক।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ সত্যিই দেখতে ইচ্ছে হয়নি। বা বলতে পারেন, আমি তাকে নিয়ে অতটুকু ভাবিইনি। যতটুকু ভাবলে একটা মানুষকে দেখতে ইচ্ছে করতে পারে ততটা ভাবনা সে তৈরি করতে পারেনি। তখন মনে হয়েছিল, এমনটাই স্বাভাবিক। তার মুগ্ধ হওয়াটা বা নিজেকে নিয়ে একটা রহস্য তৈরি করে আমাকে মুগ্ধ করার চেষ্টাটাই স্বাভাবিক।’
‘ আচ্ছা? তারপর? এখনও না দেখায় রয়ে গিয়েছে সে?’
আমি উদাস কন্ঠে বললাম,
‘ নাহ। দেখেছিলাম। পরেরদিন চিরকুট আসার পর ছাদে স্বয়ং এসে দাঁড়িয়েছিল সে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়েছে। এই মানুষ আর সেই মানুষ এক নয়। দুজন ভিন্ন। আবার একও হতে পারে। আমি অতটা মাথা ঘামাইনি তখন। সে দেখতে কেমন সেও ঠিকঠাক মনে নেই আমার।’
‘ যে এতোটা গুরুত্বহীন ছিল তার জন্য আস্ত একটা ভাবনা কীভাবে পাল্টে গেল আপনার?’
আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর বললাম,
‘ ওইযে বললাম, খুব সাধারণ ঘটনাগুলোই মাঝে মাঝে খুব বেশি অসাধারণ হয়ে উঠে। তখন কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিচ্ছি মাত্র। কলেজে যাওয়া-আসার পথে এবং ক্যাম্পাসেও প্রেম প্রস্তাব জুটতো অহরহ। এসব ডিস্টার্বেন্স থেকে বাঁচতেই এবং অন্যকে ধোঁয়াশায় রাখার প্রচন্ড বাজে অভ্যাসটাকে হাওয়া দিতেই সবাইকে জানিয়েছিলাম আমার খুব কাছের কেউ আছে। যাকে আমি ভালোবাসি। চারপাশের সবাই যেন বিশ্বাস করে তাই বিশ্বাসযোগ্য কিছু গল্পও ফেঁদে বসেছিলাম। আমার বান্ধবী আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে কিছু ফেইক ম্যাসেজের স্ক্রিনশট দেখিয়েছিল তাদের। তখন ব্যাপারটাকে নেহাৎই ফ্যান্টাসি হিসেবে দেখছিলাম আমরা। মজা পাচ্ছিলাম। আর সেই আনন্দ-মজার ঘটনা নিয়েই খুব গোপনে, খুব নীরবে সাধারণ কাহিনীটা হয়ে উঠল অসাধারণ। কেউ বুঝল না। কেউ জানল না। শুধু আমার ভাবনাটা পাল্টে গেল। আমি ভাবতে বাধ্য হলাম।’
ভদ্রলোক আগ্রহ নিয়ে চেয়ে রইলেন আমার মুখে। বৃষ্টি কমে এসেছে। কাপে ফুরিয়ে এসেছে কফি। আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে চাইলাম। শেষ হয়ে আসা কফি কাপে চুমুক দিয়ে সাধারণ ঘটনার অসাধারণ হয়ে উঠার গল্প বলতে মন দিলাম,
‘ দিনটা ছিল শীতকাল। হঠাৎ একদিন চিঠি এলো। চিঠিতে প্রচন্ড হতাশা আর ক্ষোভ। পুরো চিঠিতে একটাই বাক্য। তুমি কেন মিথ্যে বললে? তোমার প্রেমিক আছে?তবে আমায় কেন বলোনি? আগে বললে অনুভূতির মালাগুলো এভাবে ছিঁড়তে পারত না রোদপাখি।’
চলবে….