মন বদল,শেষ অংশ
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
‘ তারপর? এখানেই ভুল বোঝাবুঝির শুরু?’
আমি হাসলাম। বললাম,
‘ আমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার মতো তো কোনো সম্পর্ক ছিল না ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। তবে কিছু একটা ঘটেছিল। স্বাভাবিক সুরে রূঢ় কোনো ছন্দপতন হওয়ার মতোই কর্কশ কিছু? সে যায় হোক, তার চিঠির উত্তরে ভীষণ বিস্ময় আর বিরক্তি নিয়ে লিখেছিলাম, ” মিথ্যে কী করে বললাম? আমি তো প্রেমিক সম্বন্ধীয় কোনো আশ্বাস আপনাকে দিইনি। না দিয়েছি কোনো প্রশ্রয়। তবে অনুভূতির ভাঙচোর বা মিথ্যার দায় আমার কাঁধে কেন?’ সে উত্তরে এক লাইনের এক চিঠি পাঠাল,
”সব প্রশ্রয় কাগজ-কলমে লিখে দিতে হয় না।” আমি লিখলাম, ‘তবে তো দূর্ভাগ্য ও দীর্ঘশ্বাস।’ সে লিখল, ” দীর্ঘশ্বাস! তবে যে আমি দীর্ঘশ্বাসটাও খুঁজে পাচ্ছি না।” এভাবেই শেষ হলো আমাদের চিঠি আলাপ। এরপর কোনো চিঠি সে পাঠায়নি। কখনোই না।’
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন,
‘ গল্পটা তবে এখানেই শেষ?’
‘ না। গল্পটা এখান থেকেই শুরু। এখানেই আমার ভাবনা পরিবর্তনের সূচনা। আমাদের চিঠি আলাপ বন্ধ হওয়ার পর পরই তাকে বেমালুম ভুলে গেলাম আমি৷ হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম সামনের বিল্ডিং থেকে মৃদু গিটারের শব্দ। সপ্তাহে এক দুই বার ছাদ থেকে ভেসে আসে সেই সুর। গুরুত্ব দিব না দিব না করেও গুরুত্বটা দিয়ে ফেললাম। পাশের বিল্ডিংয়ের এক বাচ্চাকে ডেকে জিগ্যেস করতেই বলল, অমুকদা ছাদে গান গায়। নামটা উহ্য রাখছি বলে বিরক্ত হবেন না। নামটা আসলে বলতে চাইছি না।’
‘আমি বিরক্ত হচ্ছি না। আপনি বরং বাকিটা বলুন।’
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ আমি বরাবরই গান প্রেমিক মানুষ। তার গান গাওয়ার ব্যাপারটা শুনে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। সে যে গান গায় তা ঠিক জানতাম না। ধারণাও করিনি কখনও। ওহ! আপনাকে আরেকটা কথা বলা হয়নি। সে কিন্তু বিধর্মী ছিল। ধর্মে খ্রিষ্টান।’
ভদ্রলোক প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ আপনি মুসলিম জেনেও সে আপনাকে পছন্দ করত? আশ্চর্য!’
‘ হ্যাঁ, করত। অনুভূতির নাকি কোনো ধর্ম হয় না? সেই উক্তিতে বিশ্বাসী ছিল বলেই পছন্দ করত। তবে আমার কাছে বোধহয় ধর্মটাই বড় ছিল। সেজন্যই হয়ত, আরও বেশি গুরুত্বহীনভাবে দেখেছিলাম তাকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গুরুত্বহীন অনুভূতিটা পাল্টে গেল। তার গান, গিটারের শব্দে অন্যরকম একটা আকর্ষণ তৈরি হলো। সেই আকর্ষণটা ছিল লোকটিকে জানার আকর্ষণ। কিন্তু ওইযে? আমি ভীষণ ইগোইস্টিক মেয়ে। সকল আকর্ষণ ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষমতা বোধহয় ইগোইস্টিকদের থাকতে হয়। আমারও সেই ক্ষমতা ছিল ষোলকলা। আমি তাকে চোখ-নাক-মুখ- ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সবকিছু দিয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম। ছাদটা সামনা-সামনি হওয়ায় হঠাৎ হঠাৎ ছাদে বসে গান গাইতে দেখতাম তাকে। সে আমাদের ছাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে গান গাইতে বসত। কোনো কথা টথা হতো না। দেখা বলতে সেই এতটুকুই।’
এটুকু বলে থামলাম আমি। গলা শুকিয়ে এসেছে। ভদ্রলোক মনোযোগী চোখে চেয়ে আছেন। দুই ভ্রুর মাঝে মনোযোগী ভাঁজ। আমি কফি কাপটা তুলে নিলাম। পরপর দু’বার চুমুক দিয়ে বললাম,
‘ তার প্রায় দেড়বছর পর গল্পে নতুন মোড় এলো। এই দেড় বছরেও আমার প্রতি তার অনুভূতি ছিল প্রগাঢ়। সে আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করত না ঠিক। কিন্তু তার নিত্য ব্যবহার্য মানিব্যাগের এক কোণায় থাকত লুকিয়ে তোলা আমারই এক ছবি। কলেজের বন্ধুরা প্রায়ই বলত, অমুকদার মানিব্যাগে তোর ছবি টবি দেখি এখনও। ফুসকার স্টলে মাঝেমাঝেই ভৌতিকভাবে দাম চুকে যেত। সন্ধ্যায় কোচিং শেষে অসীম দূরত্ব রেখে অনুসরণ করত কোনো একজন! ভাড়া করা রিকশাচালকগুলো মাঝে মাঝেই বিনয়ে গলে গিয়ে ভাড়া নিতে অস্বীকৃতি জানাত। অসীম দূরত্বে লুকিয়ে থাকা মুগ্ধদৃষ্টিটাকে আমি উপলব্ধি করতে পারতাম। নারী মন স্বভাবতই মুগ্ধতা পছন্দ করে। সেই ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোর জন্যই আমি ছেলেটির সম্পর্কে আকর্ষণবোধ করতে লাগলাম। যে ছেলে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা পর্যন্ত করে না তার মানিব্যাগে আমার ফটো? আশ্চর্য! আমি ছোট থেকেই ঘরকুনো স্বভাবের মেয়ে। সবার কাছে অহংকারী হলেও সত্যটা হলো আমি ব্যক্তিগতভাবে খানিক অসামাজিক। এলাকার কারো সাথে তেমন একটা ভালো সম্পর্ক আমার ছিল না। চুপচাপ থাকতাম। নিজের আলাদা এক ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করতাম। সেজন্যই হয়ত এলাকার আড্ডামহলগুলোতে তার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও আমার সাথে তার দেখা-শুনা ছিল শূন্যের কোঠায়। সেই সহজাত স্বভাবটা কাটিয়ে তাকে জানার ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে পারিনি কখনও। তবে যেখানেই তাকে নিয়ে কথা উঠত, আমি কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করতাম। তাকে জানার, বুঝার চেষ্টা করতাম। আমার এই পাগলামো দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে আমি তার প্রেমে পড়েছি?’
ভদ্রলোক সহজ কন্ঠে বললেন,
‘ মনে হচ্ছে।’
‘ তবে আপনার মনে হওয়াটা একদম ভুল ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। আমি তার প্রেমে পড়িনি। তার অদ্ভুত চালচলন, অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের প্রতি আকর্ষণবোধ করেছিলাম মাত্র। তাকে আরও জানার প্রতি আকর্ষণবোধ করেছিলাম। মানুষ মাত্রই অদ্ভুত বিষয়ের প্রতি আকর্ষণবোধ করে। মানুষ তার আশেপাশে রহস্য বা অদ্ভুত কিছু পছন্দ করে না বলেই তাদের এই আকর্ষণ। আমার ক্ষেত্রেও তাই। বুঝতে পেরেছেন?’
‘ জি, বুঝলাম।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভদ্রলোকের কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে শূন্য কাপের দিকে চোখ রাখলাম। কপালে হালকা ভাঁজ পড়ল। মৃদু কন্ঠে বললাম,
‘ গল্পের মোড়টা এলো আমার এক বান্ধবীকে দিয়ে। সে যশোরের মেয়ে। আঙ্কেল এখানে বদলি হওয়ায় তারা নতুন বাসা নিয়ে উঠল আমাদেরই সামনের ফ্ল্যাটে। প্রচন্ড মিশুক একটা মেয়ে হিয়া। আমি কারো সাথেই ঘনিষ্ঠ হতে পছন্দ করি না। হঠাৎ সখ্যতা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে হিয়ার আমাকেই মনে ধরে গেল। বহু কৌশলে এক পর্যায়ে আমার সাথে সখ্যতাও গড়ে তুলল। হিয়া নির্দ্বিধায় দূর্দান্ত একটি মেয়ে। বিশ্বাসযোগ্য, গোছালো কিন্তু একটু অদ্ভুত।’
‘ অদ্ভুত কেন?’
আমি হেসে বললাম,
‘ তা আমি নিজেও জানি না। তবে ব্যাপারটা অনুভব করি। সবার বিচারবুদ্ধি এক নয়। আমার অনুভবটা সঠিক নাও হতে পারে। যায় হোক, তারসাথে সখ্যতা হওয়ার বেশ কয়েক মাস পর ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম আমরা। তখন রাত। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। হিয়া হঠাৎ বলল, “এই রোদ?সামনের বিল্ডিং-এর অমুক ছেলেটাকে চিনিস তুই?কথা হয়েছিল কখনও?” আমি কৌতুহল নিয়ে বললাম, “কেন?” সে বলল, “আমার কাছে ছেলেটাকে খুব অদ্ভুত লাগে। কেমন যেন। প্রচুর ভাব।” আমি হেসে বললাম, “তাই নাকি? আমার কাছেও একটু আধটু অদ্ভুত লাগে বৈকি। ভাব দেখায় কি-না বলতে পারছি না। তবে পার্সোনালিটি অন্যরকম। আমাকে এক সময় পছন্দ করত।” হিয়া এই ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখাল। এই নিয়ে ঘন্টাখানেক কথাবার্তাও চলল। তার কিছুদিন পরই খেয়াল করলাম হিয়ার সাথে ছেলেটার সখ্যতা তৈরি হয়েছে। চিঠি আদান-প্রদান হচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান গেয়ে হিয়ার মন ভালো করার চেষ্টা চলছে। ঠিক সেই সময়, একটা বিষয় মাথায় ঘুরতে লাগল আমার। অনুভূতিগুলো বুঝি এতো দ্রুত পাল্টে যায়? যে ছেলেকে দীর্ঘ দেড় বছর কোনো মেয়ের সাথে দেখা যায়নি। এক মাস আগে পর্যন্ত কোনো রমনীর নামের সাথে যার নাম জড়ানোর সাহস কেউ পায়নি। সেই ছেলের হঠাৎ প্রণয় উপাক্ষাণ আমায় অবাক করছিল। দেড় বছরের প্রগাঢ় অনুভূতির দ্রুত পরিবর্তনে পাল্টে যাচ্ছিল আমার ভাবনা। হয়তো আগের অনুভূতিগুলো ভালোবাসা ছিল না। কিন্তু আজকের অনুভূতিগুলো যে ভালোবাসা তারই-বা কী নিশ্চয়তা আছে? আসলেই কী ভালোবাসা বলে কিছু আছে? নাকি সবই মুগ্ধতা? হিয়াকে দেখে আমার প্রতি তার মুগ্ধতা যেমন কেটে গিয়েছে। অন্য কাউকে দেখে হিয়ার প্রতি মুগ্ধতাও যে কেটে যাবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? আমি তার অনুভূতিকে দোষ দিচ্ছি না। মানুষের মন সদা পরিবর্তনশীল। তার মনও পরিবর্তন হয়েছে। আর এইখানেই আমার প্রশ্ন। মানুষের মন সদা পরিবর্তনশীল, মুগ্ধতাও পরিবর্তনশীল। তাহলে অপরিবর্তনীয় ভালোবাসা, পরিবর্তনশীল মনে কী করে সম্ভব?’
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
‘ এমন কী হতে পারে না যে তারা শুধুই বন্ধু?’
আমি হেসে বললাম,
‘ না, পারে না। না পারার পেছনেও একটা কারণ আছে। আপনাকে একটা ঘটনা বলি। আমার এই ভাবনা তৈরি হওয়ার কিছুদিন পর মজার এক ঘটনা ঘটল। আমরা কলেজ থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ গলির মোড় থেকে ছুটে এলো এক ছেলে। আমার হাতে চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল, অমুকদা দিয়েছে। আমি হতবাক। এতোদিন পর চিঠি? আমার থেকেও বেশি হতবাক হল হিয়া। উচ্ছল মুখটা চিমসে কালো হয়ে গেল। আমি চিঠিটা খুলে দেখলাম, চিঠিটা বাস্তবিকই আমার নামে লেখা। আগে যেভাবে লেখা হতো সেভাবেই। এই চিঠির উত্তরে হিয়ার প্রতিক্রিয়া হলো ভয়াবহ। সে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। আমি নিজের দোষ খুঁজে না পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলাম। তার দিন তিনেক পর, সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছি। ছাদে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর হঠাৎ ওপাশের ছাদ থেকে ডেকে উঠল আমায়। আমি তাকালাম। চারপাশে ঝাপসা অন্ধকার। আগুন্তকের গায়ে চকচক করছে সাদা শার্ট। তিনি বললেন, ‘ সেদিনের চিঠিটা আপনাকে নিয়েই লেখা ছিল। কিন্তু দেওয়াটা উদ্দ্যেশ্য ছিল না। চিঠিটা যখন লেখা হয়েছিল তখন দেওয়া হয়নি। আগের চিঠি। সেদিন হঠাৎ ছোটবোনের হাতে পড়ায়, ফাজলামো করে আপনার হাতে পৌঁছে দিয়েছে। আপনি কিছু মনে করবেন না।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা, কিছু মনে করব না।’ তারপরের দিন থেকে আবারও শুরু হলো তাদের উচ্ছল মেলামেশা। আপনার মনে হচ্ছে না? সেই চিঠি নিয়েই তৈরি হয়েছিল একটা মান-অভিমানের গল্প? শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে এমন কিছু ঘটার সম্ভবনা নেই।’
ভদ্রলোক কিছু বললেন না। চুপ করে চেয়ে রইলেন আমার চোখে। আমি হাসলাম। বাইরে আবারও আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। আমি মৃদু হেসে বললাম,
‘ ঘটনাটা আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক এবং সাধারণ, তাই না ইঞ্জিনিয়ার সাহেব? যেন এমনই তো হবে, এমনই হওয়ার কথা! কিন্তু এই স্বাভাবিক ঘটনাটাই আমার মনে অসাধারণভাবে দাগ কেটে গেল। ভালোবাসা বলে আসলে কিছু নেই। সবই মুগ্ধতা। কেউ কেউ জীবনে একবারই মুগ্ধ হয়। কেউ-বা মুগ্ধ হয় বারবার। এজন্যই হয়তো হিয়ার সাথেও সম্পর্কটা টিকেনি তার। সে বিয়ে করতে যাচ্ছে অন্য এক বিমুগ্ধ রমণীকে। আমি তাকে দোষ দিই না। এই মন বদলের গল্পে সে নিরপরাধ। নিষ্ঠুরতম অপরাধী হলো, মুগ্ধতা। যাকে আমরা ভুল করে ভালোবাসা বলি।’
ভদ্রলোক নিষ্পলক চেয়ে রইলেন। প্রত্যুত্তর করলেন না। আমি বললাম,
‘ আমি এই মুগ্ধতাকে খুব ভয় পাই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। মাঝপথে ভালোবাসা নামক ভুলটা যদি ভেঙে যায়? মুগ্ধতা যদি স্থানান্তরিত হয় অন্য কোনো বিমুগ্ধ রমণীতে? যদি ভরসা হারায়? হঠাৎ একা হয়ে যাওয়ার চেয়ে সার্বক্ষণিক একাকিত্বই কী বেশি ভালো নয়?’
কথা শেষে পার্স হাতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বললাম,
‘ গল্পটা এখানেই শেষ। এবার আমার ফেরার পালা। আশা করি, বিয়েটা অতিশীঘ্রই ভেঙে দিবেন আপনি। আসছি।’
কথাটা বলে দুই পা এগিয়ে গিয়েও হঠাৎ থমকে গেলাম৷ পেছন ফিরে ভদ্রলোকের চোখে চোখে চাইলাম। তিনি এখনও নিষ্পলক চেয়ে আছেন। আমি এক পা এগিয়ে এসে আবারও বসে পড়লাম চেয়ারে। মাথা নিচু করে, আচমকা রুদ্ধ কন্ঠে বললাম,
‘ আপনাকে আমি একটা মিথ্যে বলেছি। তার প্রতি আমার অনুভূতি ছিল না, এই কথাটা মিথ্যে। তার প্রতি খানিকটা অনুভূতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল বলেই আমার ইগোইস্টিক মনে এতো জ্বালাপোড়া। আমি নিজের এই বোকামির প্রতি বিরক্ত, অনুতপ্ত। আমি নিজের অহংকারের কাছে পরাজিত বলেই এতো ক্ষোভ। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ক্ষোভটা আমার নিতান্তই নিজের উপর। হিয়া বা তার ওপর নয়। এ নিয়ে কোনো গোপন কষ্টও আমার নেই। কিছু থেকে থাকলে, থেকে গিয়েছে দুয়েক প্রশ্ন। ভালোবাসার উপর প্রশ্ন। ভালোবাসা বলে আসলেই কিছু থাকলে নিশ্চয় হিয়াকেও ছেড়ে দিতে পারত না সে? মিথ্যে হয়ে যেত না আশেপাশের অহরহ ভালোবাসার গল্প? সত্যটা তিক্ত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। আর সত্যটা হলো, ভালোবাসা বলে কিছু হয় না। ‘
ভদ্রলোক উত্তর না দিয়ে শান্ত কন্ঠে শুধাল,
‘ আমি আপনাকে পৌঁছে দিই?’
আমি অবাক হলাম। ভদ্রলোক আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ালেন। বিল পে করে কোটের বোতাম দুটো লাগিয়ে নিয়ে বললেন,
‘ আসুন।’
তার কন্ঠে কিছু একটা ছিল, একদম অন্যরকম কিছু। আর সেজন্যই বোধহয় বিনাবাক্য ব্যয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম আমি। বাইরে তখন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। রাস্তায় হাঁটু সমান জল। রিকশার চাকা দুটো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ভদ্রলোক একটা রিক্সা ডাকলেন। মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া বরাদ্দ করে আমার দিকে চাইলেন। বললেন,
‘ উঠুন।’
রেস্টুরেন্টের বারান্দা থেকে রিক্সা পর্যন্ত যেতেই ভিজে জবজবে হলো শরীর। ভদ্রলোক এলেন ধীরেস্থিরে। রিক্সায়, আমার পাশটিতে বসে আচমকাই এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন তিনি। রিক্সার কাগজটা গুটিয়ে, হুড ফেলে উন্মুক্ত করে দিলেন মাথার উপর থাকা মস্ত আকাশ। ঝমঝমে বৃষ্টিতে বৃষ্টিস্নাত হয়ে গেল গোটা গা। চোখের কোলে কাজল ল্যাপ্টাল। শাড়ি হয়ে গেল আঁটোসাটো। ভাসমান নৌকার মতো, সেই রিক্সা ভ্রমণটিতে ভদ্রলোক আমার দিকে চাইলেন। তার ভেজা শরীর থেকে ভেসে এলো মৃদু মাদকীয় সৌরভ। চুল বেয়ে জল গড়াচ্ছে টপটপ। ভদ্রলোক আমার হতভম্ব দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বললেন,
‘ আপাতদৃষ্টিতে ভালোবাসা খুব সহজ মিস.রোদেলা। যতটা সহজ আপনার ল্যাপ্টানো কাজল। ছলছলে স্বচ্ছ চোখ। এই বৃষ্টিভরা অক্সিজেন। কিন্তু যখনই ভালোবাসা নিয়ে ভাবতে বসবেন তখনই তা কঠোর, গম্ভীর, আনসলভড সমীকরণ। মহাবিশ্ব সমান যোগ-বিয়োগ করলেও ভালোবাসার ফলাফল কেবল এরোর, এরোর এবং এরোর। এই এরোরের সমীকরণে সূত্র প্রয়োগ করা কী কেবলই বোকামো নয়? এই আনসলভ সমীকরণে ফলাফল না খুঁজে মনের শান্তি খোঁজাটাই কী লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়? এমনটা কেন ভাবছেন না? সেই ছেলেটি আপনাকে ভালোবাসতো। শুধু আপনাকে ভালোবাসতো গোটা দু’দুটো বছর ধরে। আর কাউকে না। তারপর সে হিয়াকে আঁকড়ে ধরল, ভালোবাসতে চাইল শুধু আপনাকে ভুলার আশায়? কিন্তু তার আফসোস। হৃদয়বৃক্ষ আপনাতে বিলীন করায় ছোট্ট এক বীজ বপনের ক্ষমতায় বা তার কোথায় রইল? জায়গা পাল্টাল, মন বদলাল, চেষ্টা চলল কিন্তু বীজ বপন আর হলো না। তবে, একদিন হবে। হঠাৎ কোনো হৃদয়বৃক্ষীর ছোঁয়ায় তরতরিয়ে বেড়ে উঠবে বিশাল এক প্রণয় বৃক্ষ। এভাবে ভাবলে ভালোবাসার অঙ্কটা অনেক সহজ মনে হয় না?’
আমি উত্তর দিলাম না। নিশ্চুপ চেয়ে রইলাম তার বৃষ্টিভেজা মুখে। তিনিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন। ভিজে জবজবে আমি বাড়ি ফিরেই সাতদিনের জ্বরে পড়লাম। উথাল-পাতাল জ্বর নিয়ে ভাবতে বসলাম, ভালোবাসার কথা। সমীকরণের কথা। হিয়া ও সেই পুরুষটির প্রেম বিচ্ছেদের কথা। জ্বর উত্তপ্ত মন এবার নরম হলো। সমীকরণ ঘেঁটে ক্লান্ত হৃদয় এবার সহজ অঙ্ক কষল। সেই আষাঢ়িয়া মানবকে হঠাৎই খুব মনে ধরল। জ্বরের দু’দিনের মাথায় অচেনা এক নাম্বার থেকে কল এলো। ওপাশ থেকে আষাঢ়ের মতোই গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ আমি ইঞ্জিনিয়ারিংটা খুব পারি কিন্তু ভালোবাসা আর মুগ্ধতার সমীকরণ কষতে জানি না। শুধু জানি রোদেলা থেকে রোদ হয়। আরো একটু আদর দিলে রোদু হয়ে যায় অনায়াসে। আমার হঠাৎ মনে হচ্ছে, আপনাকে রোদু ডাকতে না পারলে আমার চলছে না। রোদুর পর আরও অসংখ্য ব্যক্তিগত নাম……আরও অসংখ্য আদর না মেশালে আমার অঙ্কটা ঠিকঠাক মিলছে না। আমার অঙ্ক মেলানোর দায়িত্বটা এবার আপনার মিস.সমীকরণ। আমি আপনাকে ছাড়ছি না। মহাকাশ সমান যোগ-বিয়োগ করলেও না।’
আমি হাসলাম। রাস্তার পাশে, ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির ঠোঁটেও হাসি ফুটল। আমার মহাকাশ সমান সমীকরণগুলো সহজ হয়ে এলো হঠাৎ। ভালোবাসার কাটা-ছেঁড়া, হিসেব নিকেশ কোথায় মেলাল? সেই সন্ধ্যেয়, খুব সন্তপর্ণে, ফিসফিস প্রণয়কাব্যে আষাঢ়িয়া পুরুষ আমার মন ছুঁলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা আস্ত এক মন বদলের গল্প!
(সমাপ্ত)