মন শুধু মন ছুঁয়েছে,পর্ব_১৬
জান্নাতুল নাঈমা
সারারাত বেঘোরে ঘুমিয়েছে স্নিগ্ধ। নিদ্রাহীন কেটেছে আরোহীর। দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে গুটিশুটি হয়ে বসে সারারাত চোখের জল ফেলেছে সে।
একদিকে মা কে হারানোর তীব্র যন্ত্রণা, অন্যদিকে এতো সব অভাবনীয় ঘটনা কিছু ঢুকছে না তাঁর মাথায়।
আরোহী এবার চোখের জল মুছে ফোন খুঁজতে লাগলো।বিছানার এক পাশে ফোন দেখতে পেয়েই দ্রুত ফোন নিয়ে বেলকুনিতে চলে গেলো।
আশিকের নাম্বারে ডায়াল করতেই সাথে সাথে রিসিভ হলো। প্রথমে আশিক চিনতে না পারলেও কান্নার আওয়াজ শুনতেই বললো-“আরোহী”??
আরোহী কান্নার বেগ কমিয়ে ফুঁপাতে ফুঁপাতে সব খুলে বললো। আশিকও হকচকিয়ে গেলো কথাটা শুনে। কাঁপা গলায় বললো- “আরোহী তুমি কোন চিন্তা করো না আমি বাবার সাথে কথা বলে তোমাকে ফোন দিচ্ছি”
.
পাশের বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি এসেছে স্নিগ্ধর বউ দেখতে। রূপালি দরজায় ঠকঠক করতে করতে বললো –
— ও ভাবি দরজা খোলেন। আপনেরে দেখবার আইছে তারাতারি নিচে আহেন।
আরোহী বাথরুম থেকে বেরিয়ে স্নিগ্ধর দিকে মলিন চোখে তাকালো। নিজের মায়ের ছবি স্নিগ্ধর ওয়ালেটে দেখে মনের ভিতর অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এ মূহুর্তে সে মাথা গরম করতে চায় না, ঠান্ডা মাথায় সব কিছু বুঝতে চায় শুনতে চায়। তাঁর কেমন যেনো মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে তাঁর। সত্যি ভুল নাকি ঠিক তাঁর উত্তর শুধুমাএ স্নিগ্ধ আর মালাই দিতে পারবে। এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
.
হালকা গোলাপি রঙের সুতির মধ্যে গোল রাউন্ড পড়া, মাথায় হালকা গোলাপি রঙের ওড়না দিয়ে বউদের মতোই ঘোমটা দেওয়া যা বরাবরই থাকে।
নিচে নামতেই বিবিন বললো-
— এই তো নাত বউ এসেছে,,, এদিকে আসো নাত বউ।
আরোহী বিবিনের কাছে যেতেই বিবিন তাঁকে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে সকলের সাথে পরিচিত করালো।
আরোহী মৃদু হেসে সকলকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলো।সকলেই সালাম ফিরিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো। কেমন করে যেনো চেয়ে দেখছে তাঁরা।
পাড়াপ্রতিবেশিদের এই এক বাজে স্বভাব পাড়ায় কারো ঘরে নতুন বউ এলে তাঁকে পছন্দ হলে তো মহা প্রশংসা শুরু করে দেয়। আর যদি পছন্দ না হয় বউয়ের খুট ধরার জন্য ওঠে পড়ে লাগে।
এ মূহুর্তে আরোহীকে নিয়ে তাদের বড় সমস্যা হলো আরোহীর গায়ের রং স্নিগ্ধর তুলনায় বেশীই ময়লা।
একজন তো বলেই ফেললো –
— ইশ অমন রাজপুত্রের মতো ছেলেটার কিনা শেষে এমন বউ জুটলো। তা মেয়ে কি দিয়ে বশ করলে এমন সোনার টুকরা ছেলেটারে??
আরোহীর এসবে জায় আসে না। প্রথমত সে স্নিগ্ধর বউ হিসেবে নিজেকে স্বীকার করে না,দ্বিতীয়ত সে স্নিগ্ধর থেকে কালো তাঁর সাথে স্নিগ্ধ কে জায় না সেটা সে মনে প্রানে বিশ্বাস করে। যে জিনিসটা সে নিজে বিশ্বাস করে সে জিনিসটা অন্য কেউ বললে খারাপ লাগার প্রশ্নই ওঠে না। যদি সে বিশ্ব সুন্দরী হতো আর সামনের মহিলারা তাঁকে নিয়ে এমন মন্তব্য করতো তাহলে সে অবশ্যই প্রতিবাদ করতো “আপনাদের চোখ কি ঘাড়ে নিয়ে আসছেন”??নাকি চোখে কালো চশমা পড়ে আসছেন??কিন্তু এ মূহুর্তে আরোহীর কোন ভাবান্তর হলো না। সে সভ্যতা বজায় রেখে চুপচাপ বিবিনের পাশে বসে রইলো।
.
মহিলাটার কথায় তাঁর পাশের জন চিমটি কাটলো। কারন সামনে বিবিনও রয়েছে বিবিন কি জিনিস তাঁরা খুব ভালো করেই জানে।
বিবিন বললো-
— তা মাজেদার মাও ধলা বিলাই হইয়া লাভ কি যদি এমন রাজপুত্রের মতো পোলাই কপালে না জুটে।
শুনলাম তোমার মেয়ে মাজেদার জামাই নাকি ইয়াবাসহ ধরা খাইছে। তা বলিহারি অমন সুন্দরী মাইয়াটার জন্য অমন খচ্চর মার্কা জামাই ধইরা আনলা।
সামনে বসে থাকা চারজনই স্থির হয়ে গেলো। মাজেদার মায়ের মুখটাও হলো দেখার মতো। বিবিন আবারো বললো-
— “নদীর পানি ঘোলা ভালো জাতের মেয়ে কালো ভালো” তোমার মেয়েটা যদি মেট্রিক পাশ করার পর নানীর দেশে যেয়ে পুরুষ মানুষের সাথে এক ঘরে ধরা না পড়তো তাহলে এর থেকে ভালো জামাই পাইতা। কি আর করার বলো মেয়ের এমন রেকর্ড শুনে তো রাজপুত্র ছুটে আসবো না। সোনার টুকরাও জুটবে না তামাই শেষ সম্বল।
আরোহী বড় বড় করে বিবিনের দিকে তাকালো। বিবিন মুচকি হেসে বললো-
— নাত বউ নাস্তা পানির ব্যবস্থা করো অতিথি আপ্যায়ন করতে হবে তো,,,
আরোহী কিছু না বলে চুপচাপ ওঠে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। মাজেদার মায়ের মুখটা শুকিয়ে গেছে। সে চলে যাওয়ার জন্য সবে নিজেকে প্রস্তুত করছে তখনি বিবিন গলা খাকারি দিয়ে বললো-
— কারো বাড়িতে অতিথি হিসেবে আসলে অতিথির ন্যায় আচরণ করাই উচিত। তাঁর বাড়ির কোন সদস্যকে খোঁচা দিয়ে কথা বলা বা তাঁর খারাপ লাগতে পারে এমন আচরন করা উচিত নয়। গায়ের রং শুধু নাতবউ এর ই চাপা না আমারো তাই আমাকে নিয়েও এমন ভাবনা অবশ্যই মনে লালন করছো তোমরা???অন্যকে কিছু বলার আগে একবার নিজেদের অবস্থান ভেবে নিবে।
চারজনই জোর পূর্বক হেসে বললো –
— না না কি যে বলেন। আসলে মাজেদার মা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে ক্ষমা করবেন ভাবী। বউ তো খুব সুন্দর বেশ লম্বা,লম্বা চুল হরিনীর মতো চোখ বেশ বেশ।
বিবিন হোহো করে হাসতে লাগলো।
সকলে ওঠে পড়তে নিতেই বিবিন কথার ছলে পটিয়ে নাস্তা করে যেতে বললেন আর জোর গলায় বললো-
— আরোহী তারাতারি নাস্তা পানি নিয়ে আসোতো।
আরোহীতো রান্নাঘর থেকে ড্রয়িং রুমের অবস্থা দেখে বেশ অবাক হলো। বির বির করে বললো -মহিলাটা বেশ আজব “এক গালে কিলায় আরেক গালে খিলায়”
সোনালি শুনে বললো-
— হ ভাবি হাচা কইছেন এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষই এমন। কিন্তু তাগোর মনটা খুব ভালা।
.
আরোহীর ফোনটা সমানে বেজে যাচ্ছে। আরো দুবার রিং হয়ে কেটে গেলো। স্নিগ্ধ ওঠে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সবে বেরিয়েছে মাএ। পোশাক পড়ে নিয়ে নিজের ফোন খুঁজতে যেতেই আরোহীর ফোন চোখে পড়লো। মুচকি হেসে ফোনটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে লাগলো কয়েকটা মিসড কল দেখে নাম্বার চেক দিলো। অচেনা নাম্বার তাই ভ্রু কুঁচকে নাম্বার টা দেখছে।
.
এদিকে আশিক সমানে আরোহীকে ফোন দিয়েও যখন পেলো না তখন একটা মেসেজ করলো।
সাথে সাথে মেসেজটা আরোহীর ফোনে এসে গেলো।
আর মেসেজটা দেখলো স্নিগ্ধ।
.
Arohi tumi snighdhor wallet e fobor sobi dekheso hoyto sobita snighdho tumar mayer khun er por niyese amon aro koto ki niyese allah jane. Tumi seshob e matha na ghamea malak uddhar korar cheshta koro r amar kase fire asho.
.
শেষ লাইনটায় যেনো স্নিগ্ধর পায়ের রক্ত মাথায় ওঠে গেলো। রাগে চোখ,মুখ লাল বর্ন ধারন করলো।
এই মূহুর্তে আশিককে পেলে যেনো খুন করে ফেলতো একদম। পরোক্ষনেই ভাবলো-“এই আশিক মালার জন্য এতো উতলা কেনো?? যতোটা না আরোহীর জন্য তাঁর থেকে বেশী মালার জন্য। একসাথে দু মেয়েকে চায় নাকি?? শালা ভদ্র শয়তান তোকে একবার সামনে পাই উল্টো করে ঝুলিয়ে রাম দা দিয়ে বলি দিবো”।
চুল গুলো আঙুলের ফাঁকে নিয়ে পিছন দিকে চেপে ধরলো। পরোক্ষনেই চমকে ওঠে দ্রুত কাবার্ড থেকে তাঁর পুরোনো ওয়ালেট টা খুজতে লাগলো। কিন্তু পেলো না “তাঁর মানে আরোহীর হাতে পড়েছে।ওহ গড এই মেয়েটাকে এখন সামলাবো কি করে??
নাহ সামলানোর কি আছে ও আমায় কোন প্রশ্ন না করে ঐ আশিকের সাথে যোগাযোগ করেছে মেনি বিড়াল টাকে ফোন দিয়েছে। বিড়ালটাও মাছের গন্ধ পেয়ে মেও মেও করতে শুরু করে দিয়েছে। তোর জিহবা আমি টেনে যদি বের না করেছি,,,
হনহন করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো স্নিগ্ধ।
.
নিচে গিয়ে ইমরান, রিনির চক্করে পড়ে আর কিছু করতে পারলো না। ব্রেকফাস্ট করে উপরে চলে এলো।আরোহীও নিচের ঝামেলা সেরে উপরে চলে গেলো। স্নিগ্ধ কে একঝাঁক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যেই রুমে পা বাড়িয়েছে অমনি স্নিগ্ধ খপ করে হাতে টান দিয়ে পিছন দিক করে মুচড়ে ধরলো।
কাঁধে থুতনি রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো –
— বার বার নিষেধ করা সত্তেও আশিক কে কেনো ফোন দিয়েছো আরোহী??তোমার সমস্যার একমাএ সমাধান আমি আর তুমি ঐ আশিকের কাছে সমাধান খুঁজতে যাচ্ছো?? আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেছিলাম।
আরোহী ব্যাথায়, রাগে এক ঝ্যাংটা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে চিৎকার করে বললো-
— আমার সব সমস্যার মূল আপনি। আর আমি আপনার কথা শুনতে বাঁধ্য নই।
স্নিগ্ধর কলার চেপে ধরে বললো –
— আমার মায়ের ছবি আপনার ওয়ালেটে কি করে স্নিগ্ধ??বলুন কি করে এলো??
স্নিগ্ধ আরোহীর হাত ছাড়িয়ে আবারো পিছন থেকে হাত চেপে ধরলো রাগি গলায় বললো-
— এই প্রশ্নটা তুমি আমায় না করে অন্য একটা ছেলেকে কেনো জানালে হোয়াই। এতো ইম্পরট্যান্টস ওকে দেওয়ার মানে কি আরোহী??
— ইম্পরট্যান্টস মানুষ দের ইম্পরট্যান্টস তো দেবোই।
ছাড়ুন আমায় লাগছে আমার ছাড়ুন।
লাগছে কথাটা শুনতেই ছেড়ে দিলো স্নিগ্ধ। আরোহী জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললো-
— এক মূহুর্তেও জন্যও আমি আপনাকে নির্দোষ ভেবে ভুল করেছিলাম। আপনার মতোন মানুষ নির্দোষ হতেই পারে না।
স্নিগ্ধ রেগে গিয়ে আরোহীর দু কাধে চেপে ধরে নিজের খুব কাছে নিয়ে বললো-
— হ্যাঁ আমি দোষি নির্দোষ ঐ আশিক তাই তো??
আরোহী চোখে চোখ রেখে কড়া গলায় বললো-
— হ্যাঁ আশিক নির্দোষ কারন ও আপনার মতো রহস্যময় নয়। ও আপনার মতো জোর জবরদস্তি করে না। ও আপনার মতো আমার বোনের থেকেও প্রিয় কাউকে লুকিয়ে রাখেনি। সর্বোপরি ও আমার মায়ের হত্যাকারী নয়।
স্নিগ্ধ এবার দ্বিগুণ ক্ষেপে গেলো৷ আরোহীর মুখে অন্য কোন ছেলের প্রশংসা আরোহীর মনে অন্য কাউকে নিয়ে এতো আত্মবিশ্বাস তাঁর অন্তরে যেনো আগুন ধরিয়ে দিলো।
কাঁধ ছেড়ে আরোহীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো।
হিরহির করে টানতে টানতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
আরোহী আতঙ্কিত হয়ে বললো-
— একি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ছাড়ুন আমায়, ছাড়ুন বলছি।
স্নিগ্ধ পিছন ঘুরে আরোহীর চোখে চোখ রেখে বললো-
— ভয় নেই স্বামীর ঘর ছাড়া হবে না। তোমাদের মতো মেয়েরা না বড্ড আজব টাইপের হয়। এই বলছো স্বামী হিসেবে মানি না, এই বলছো চলে যাবো চলে যাবো আবার এই এখুনি ভয় পাচ্ছো শশুড় ঘর ছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়। স্বামী হারানোর ভয়,,,
বাঁকা হেসে আবারো পা বাড়ালো স্নিগ্ধ। আরোহী তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলো স্নিগ্ধ আরোহীকে টানতে টানতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো।
.
চলবে……