মন শুধু মন ছুঁয়েছে,(২য় খন্ড ৫) Extra_part

0
3060

মন শুধু মন ছুঁয়েছে,(২য় খন্ড ৫) Extra_part
জান্নাতুল নাঈমা

ছাদের একপাশে দোলনায় বসে ভাইবোন চন্দ্র বিলাস করছে। রিনি ভাইয়ের কথা গুলো উৎসুক নয়নে চেয়ে শুনছে। চাঁদের আলোতে ভাইয়ের মুখে সে কি স্নিগ্ধতা মনে পড়ে গেলো ভাইয়ের জন্মের সময়ের কথাটা। ভাইয়ের জন্মের পনেরো মিনিট পরই তার মা পরোলোকগমন করেছেন।
সবাই যখন মায়ের মৃত দেহ নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো এই ছোট্ট ভাইটি তখন খিদের যন্ত্রণায় হসপিটাল কেবিনে ছোট্ট দোলনায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলো।
ভাইয়ের কান্না থামাতে আট বছরের রিনি ভাইকে কোলে নিয়ে পুরো রুম ছুটাছটি করতো।
নার্স এসে তাঁর খাবার দিলে নিজ হাতে যত্ন সহকারে খাওয়িয়ে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যখন শুইয়িয়ে দিলো তখন তাঁর ঘুমন্ত মুখটায় চেয়ে বলেছিলো,,,
“ইশ আমার ভাইটা একদম রাজকুমার হয়ে এসেছে।
চোখে মুখে স্নিগ্ধতা ছেঁয়ে আছে বাবা বলতো মা ঘুমালেও মায়ের মুখে স্নিগ্ধতা ছেঁয়ে থাকে।
এখন তাঁর মনে হচ্ছে তাঁর ভাইয়ের মুখেও মায়ের মতো সকল স্নিগ্ধতা এসে ভর করেছে”
তখন থেকেই ভাইয়ের নাম রাখে স্নিগ্ধ।
মুচকি হাসলো রিনি। স্নিগ্ধ অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে।
তাঁর প্রত্যেকটা কথায় আরোহী নামটা অবশ্যই থাকবে।
“আপ্পি আরোহীর চোখ গুলো একদম মায়ের মতো”
“আপ্পি ওর চুলগুলোও মায়ের মতো লম্বা”
“আপ্পি আরোহী রেগে যখন চোখ গরম করে ঠিক তখন আমার মনে পড়ে যায় যখন তুই রেগে যাস সেই মূহুর্তটা,তুই রেগে গেলে কপালে চুমু দিয়ে রাগ ভাঙাই আর ও রেগে গেলে ঠোঁটে” সাথে সাথে চোখ বড় বড় করে তাকালো রিনি।
স্নিগ্ধ জ্বিবে কামড় দিয়ে বললো,,,

— উপস,,,সরি আপ্পি মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো।

রিনি রাগি লুক নিয়ে চেয়ে কানে ধরে বললো,,,

— ভাই,,, এসব কি,,, এসব একদম ঠিক নয় ভাই।
সে এখনো তোমার বউ হয়নি আগে বউ করো পরে এভাবে রাগ ভাঙাও নো প্রবলেম। এরপর যদি কখনো শুনেছি ভালো হবে না কিন্তু।

স্নিগ্ধ হোহো করে হেসে ওঠলো।

— আপ্পি আরোহী কিন্তু এতে দ্বিগুণ রেগে যায়,,,

রিনি কান থেকে হাত ছাড়িয়ে বললো,,,

— তাই তো স্বাভাবিক তুমি কাজটা ঠিক করোনি স্নিগ্ধ। এরপর যেনো এমনটা না হয়।
রাগ হলে কন্ট্রোল করতে হবে আগে বউ করে নাও তারপর যতো অধিকার আছে ফলিও। এর আগে কোন প্রকার জোরজবরদস্তি চলবে না।

— না আপ্পি ওকে আমার চাই জোরজবরদস্তি বুঝিনা যেভাবেই হোক ওকে আমার চাই।

— দেখ স্নিগ্ধ রেগে যাচ্ছি আমি ওর সাথে ওসব আচরন করবিনা এতে তুই ওর কাছে ছোট হয়ে যাবি। আমি তোর ভালোর জন্য বলছি রাগ দেখিয়ে জোর দেখিয়ে ভালোবাসার মানুষ কে জয় করা যায় না ভাই। আর আমার ভাই কারো চোখে ছোট হয়ে যাক সেটা আমি চাইনা।

— ওকে ওকে রিল্যাক্স সেদিনের পর অমন টা আর করিনি নো টেনশন।

— আচ্ছা ভাই ওর সাথে আমি দেখা করতে চাই।
আর বলতে চাই আমার ভাইটা একটু রাগি কিন্তু মনটা ভীষণ ভালো। আমার ভাইটা তোমায় মন থেকে খুব করে চায়। দেখিস আমি বললে ঠিক বুঝবে সবটা। বিলিভও করবে,,,

— সিরিয়াসলি,,,

রিনি স্নিগ্ধর নাক টিপে দিয়ে বললো,,,
— ইয়েস ব্রো।
.
আরোহী ব্যাগপএ গুছিয়ে রওনা হবে এমন সময় ঝড়ের গতিতে স্নিগ্ধ বাইক থামালো তাঁর সামনে।
ভ্রু কুঁচকে জিগ্যাস করলো,,,

— আরোহী,,,কোথায় যাচ্ছো??

আরোহী স্বাভাবিক ভাবেই বললো “বাড়ি যাচ্ছি”

স্নিগ্ধও স্বাভাবিক ভাবে জিগ্যেস করলো,,,

— কতোদিন থাকবে?? তুমি যদি মাইন্ড না করো আমি তোমায় পৌঁছে দেই??

আরোহী বিরক্তি নিয়ে বললো,,,

— নো থ্যাংকস! শহড় থেকে একটা ছেলে আমাকে গ্রাম অবদি পৌঁছে দেবে এতে সমাজের চোখে অনেক ছোট হতে হবে। তা ছাড়া আমার হবু হাজব্যান্ডও বিষয় টা ভালো চোখে দেখবে না।

— হোয়াট!

বাইক থেকে এক লাফে আরোহীর সামনে চলে এলো স্নিগ্ধ। আরোহী খানিকটা হকচকিয়ে গেলো।
“এই রে কি বলতে কি বলে ফেললাম এখন কি হবে??কি করে ফেইস করবো এই মাথা খারাপ লোকটাকে??” এক ঢোক গিলে নিয়ে আমতা আমতা করে বললো,,,

— না মানে আসলে,,,

— হাউ ডেয়ার ইউ আরোহী। আমার সামনে থেকে তুমি এই কথা কিভাবে উচ্চারণ করতে পারলে।

কাঁধে চেপে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলো স্নিগ্ধ।
চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে,,,

— কোথাও যাবে না তুমি, তুমি আমার সাথে আমার বাড়ি যাবে আর হবু হাজব্যান্ড মানে কিসের হাজব্যান্ড কে হাজব্যান্ড ওর ঠিকানা দাও আমায়।
বলেই আরোহীর ব্যাগ টা কেড়ে নিলো।

আরোহী বাধ্য হয়ে বললো,,,

— দেখুন আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আগামীকাল আমার এনগেজমেন্ট। মা অপেক্ষা করছে আমার জন্য প্লিজ এসব পাগলামো বন্ধ করুন।

কথাটা বলা মাএই আরোহীর গলা চেপে ধরলো স্নিগ্ধ। যতোই সে শান্ত থাকার চেষ্টা করুক যা তাঁর পছন্দ নয় তা ঘটলে আর শান্ত থাকতে পারেনা।
তারওপর যাকে মন প্রান দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছে তাঁকে হারানোর কথা শুনলে মাথাটা তো এমনিই বিগরে যায়।

— এই,,, আমি বললাম না তুমি কোথাও যাবে না।
যাবো আমি তুমি কোথাও যাবে না। হবু শাশুড়ী মায়ের সাথে কথা বলতে তো যেতেই হবে আমায়।
এনগেজমেন্ট হবে তোমার কালই তবে সেটা আভিয়ান খান স্নিগ্ধর সাথে মাইন্ড ইট।

গলা থেকে হাত ছাড়তেই আরোহী কয়েকদফা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বললো,,,

— মেরে ফেলবেন নাকি আমায়??

কথাটা এমন ভাবে বললো যে স্নিগ্ধর রাগ টা হাওয়া হয়ে গেলো চোখ মুখ নরম হয়ে এলো তাঁর,,,
শান্ত গলায় বললো,,,

— অন্যকাউকে হবু বর বলেছো মেরে যে পুঁতে ফেলেনি সেটা তোমার ভাগ্য।

আরোহী রাগ না দেখিয়ে নরম গলায় বললো,,,

— প্লিজ যেতে দিন আমায়। আপনি কাল যেতে চাইলে যেতে পারেন আমার মা কে যদি ম্যানেজ করতে পারেন আমি চোখ বন্ধ করে আপনাকে বিয়ে করে নিবো প্রমিস।

স্নিগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো সিরিয়াস,,,

আরোহী বললো,,,

— পাক্কা,,,

স্নিগ্ধ সন্দেহী দৃষ্টি তে চেয়ে বললো,,,

— ওকে ফাইন বাট আজকে তুমি কোথাও যাবেনা।
মা কে যা হোক একটা বুঝিয়ে দেবে, কাল আটটার দিকে তুমি বের হবে আকাশ আর শ্রেয়া সাথে থাকবে নো টেনশন। আর আমি যাবো তোমার আগে সব ম্যানেজ করে রাখবো বিয়ে আমি তোমায়ই করবো এট এনি কস্ট,,,

আরোহী ঘাবড়ে গেলো প্রথমে মজা নিলেও এখন বুঝতে পারছে স্নিগ্ধ সিরিয়াস বলছে,,,
“এই ছেলে সুবিধার না কথার সাথে কথা না পড়লে ডিপজলের মতো থ্রেট করবে” আল্লাহ জানে মা কি বলবে।
.
স্নিগ্ধ মানুষ টার মাথায় যে কি পরিমান ব্যামো আছে,
মাথার স্ক্রু কয়টা যে ঢিলা তাই ভেবে পাচ্ছে না আরোহী হোস্টেলের চারদিকে বিশজনের মতো গার্ড রেখে গেছে। ফোন করে বলেছে,,,

— জান ভয় পেওনা তোমায় আমি বিশ্বাস করিনা।
আমাকে বিয়ে করার ভয়ে আবার আজি গিয়ে কোন হ্যাবলাকান্ত কে বিয়ে করে নিতে পারো তাই আমি এই ব্যবস্থা করে রাখলাম ডোন্ট মাইন্ড।
মা কে গিয়ে ফেইস করবো দেন তোমায় গ্রামে আসতে দিবো ওকে সোনা এখন রাখি।
.
আরোহী ভেবে পায় না লোকটা তাঁর মা কে এতো তারাতারি এমন স্বাভাবিক ভাবে মা বলে কি করে ডাকছে,,,তুরিনের কাছে শুনেছিলাম ওনার জন্মের সময়ই ওনার মা মারা গেছেন তাহলে কি মা মানুষ দের প্রতি ওনার অনেক আবেগ লুকিয়ে আছে??
তাই কি আমার মা কেও আপন করে নিয়েছে??
ওনি কি সত্যি তাহলে আমায় ভালোবাসে??
কি হবে কাল?? মা কি ওনার প্রস্তাবে রাজি হবে??
মা কি আশিক কে রিজেক্ট করে দেবে??
যদি মা রাজি হয়ে যায় কি হবে??আমি কি ওনাকে মেনে নেবো?? না নেওয়ার তো স্ট্রং কোন কারনও নেই বরং মেনে নেওয়ার হাজারটা কারন আছে।
পরোক্ষনেই চমকে ওঠলো আরোহী,,,
নাহ মা কোনদিন মেনে নেবে না ওনাকে।
যে ভুলের জন্য নিজের সারাটা জীবন নষ্ট হয়ে গেছে সেই একি ভুল নিজের মেয়ের সাথে কখনোই করবে না।
কেনো রাজি হলাম ওনার কথায়,,, খারাপ কিছু হবে না তো??
.
নানারকম চিন্তা মাথায় নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো আরোহী,,,
কিন্তু সে কি জানে কালকের একটা দিনেই তাঁর জবনের মোড় টাই পালটে যাবে। নতুন করে জন্ম হবে আবারো,,, ভালোবাসার নতুন এক রূপের শাক্ষি হবে সে,,, সত্যি কি ভালোবাসা নাকি অন্য কিছু??
.
স্নিগ্ধর মুখে সবটা শুনে আরোহীর মা আমেনা বেগম সোজা না করে দিলেন। কিন্তু না করার যৌক্তিক কোন কারন সে বলতে পারলো না। শুধু এটুকুই বললো,,,

— আমি আমার জীবনে বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়েছি। ভালোবাসার মিথ্যাজালে ফেঁসে নিজের জীবনটা নষ্ট করেছি। পিতৃহীন এক সন্তান কে বহু কষ্টে মানুষ করেছি। আমি চাইনা আমার মেয়ের পরিণতিও আমার মতো হোক।

কথাটা বলা মাএই স্নিগ্ধ এমন একটা কাজ করে বসলো যা দেখে আমেনা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন।
বিস্ময় চোখে নিচের দিকে তাকালেন।
এটা তাঁর ধারনার বাইরে ছিলো,,,সত্যি কি এই ছেলেটা তাঁর মেয়েকে এতোটাই ভালোবাসে??
তাঁর কি এই ছেলেটাকে গ্রহন করা উচিত??
“দুনিয়াতে সবাইতো মুখোশধারী হয় না”
“সবাই তো বিশ্বাসঘাতকতা করে না”
“ভালোবাসার নামে সবাইতো ছলনা করেনা”
হয়তো এই ছেলেটা সত্যি ভালোবাসে তাঁর মেয়েকে।

আমেনা বেগম থমকে গেলেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার এসব কিছু দেখে বুকটা কেঁপে ওঠেছে।
শুধু তাঁর নয় যারা স্নিগ্ধ কে চেনে জানে এমন সকল মানুষই স্নিগ্ধর এই রূপ দেখলে কেঁপে ওঠতো। একটা মেয়েকে কতোটা ভালোবাসলে একটা ছেলে এতোটা নিচু হতে পারে।
ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু হয়তো কখনো লেখা হয়নি। আভিয়ান খান স্নিগ্ধ, শ্রেয়ান খানের একমাএ পুএর এই রূপ দেখলে যে কেউ অবাক হবে শুধু অবাক নয় হয়তো তাঁরা ভুলে যাবে এতোবছরের দেখে আসা সেই স্নিগ্ধ কে।
.
আমেনা বেগম নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বললেন,,,

— সম্ভব নয় বাবা তুমি ফিরে যাও।
.
জানালা দিয়ে ওঁকি দিয়ে সব ঘটনা দেখে এবং সব কথা শুনে চলেছে মালা। শহড় থেকে এতো সুন্দর ছেলে মানুষ এসেছে যা দেখে সে খুব খুশি সে যদি কথা বলতে পারতো পাড়ার সকলকে ডেকে ডেকে দেখাতো “দেখে যাও তোমরা দেখে যাও আমার আরোহী আপুর হিরো এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
আমার দুলাভাই একদম নায়কদের মতো দেখতে হুমহ,,, চোখ দুটো ভিজে এলো মালার সে তো কথা বলতে পারেনা জন্মগত বোবা সে। তিনবছর বয়স থেকে আমেনা বেগম আর আরোহী তাকে লালন পালন করছে,,,বাবা-মা মারা যাওয়ার পর মেয়েটা কে সকলেই ফেলনা করে রেখেছিলো।
সেই ফেলনা জিনিস কেই ঘরে তুলে নিয়েছিলেন আমেনা বেগম। মেয়ের মতো করে মানুষ করছে তাঁকে।
.
আমাদের আশে পাশে এমন অনেক জিনিসই ফেলনা হিসেবে গন্য হয় যেগুলো আমরা একটু পরখ করে যত্ন নিয়ে দেখলে মহামূল্যবান জিনিসও পেয়ে যাই।
মালা কে সবাই অবহেলা করে ফেলনা করতে চাইলেও আরোহী আর আমেনা তাঁকে ফেলনা করে রাখেনি নিজ পরিবারের সদস্যর মতোই তাঁকে মানুষ করেছে তাঁরা।
দুনিয়া তে যেমন সবাই তাঁর খারাপ কাজের জন্য কর্মফল ভোগ করে তেমন ভালো কাজের বিনিময়েও মহান আল্লাহ তায়ালা দিয়ে দেয় বিশাল রহমত।

চলবে…..
মালা চরিএটা এই গল্পের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন সবাই।
হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here