মন হারানোর বিজ্ঞাপন,পর্ব ১

0
2108

#মন হারানোর বিজ্ঞাপন,পর্ব ১
#নুজহাত_আদিবা

আমার স্বামীর অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে! আমার মাঝেমধ্যে ওনাকে দেখে এটাই মনে হয়। মনে হয় উনি আমাকে না অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসেন।

প্রথম ভাবতাম হয়তো নতুন বিয়ে হয়েছে তাই এমনটা হচ্ছে। কিন্তু পরে দেখলাম না আসলে ব্যাপারটা এমন না।

উনি অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসেন। এটা আমি নিশ্চিত। কারণ, আমি যত খারাপ কিংবা খুব ভালো একটা কাজ করলেও ভালো ব্যতীত ওনার মুখে একটা শব্দ শুনি না।

একদিন খুব শখ করে খুব যত্ন করে রান্না করলাম। ওনাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম কেমন হয়েছে শুধু বললেন ভালো। পরেরদিন রাগ করে তরকারিতে ঝাল আর লবনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলাম। সেদিন ও জিজ্ঞেস করলাম রান্না কেমন হয়েছে? উনি সেদিন ও বললেন ভালো। আমি আসলে বুঝতে পারি না উনি আমার সাথে কেন এমন করেন। খুব বেশি কথাও বলেন না। খুব চুপচাপ শান্তশিষ্ট থাকেন সব সময়। আমি কিছুতে কিছু হলেই রেগে হাইপার হয়ে যাই। কিন্তু, উনি ঠান্ডা মাথায় ভেবে কাজ করেন।আসলেই কেমন অদ্ভুত মানুষটা।
~~~~~~~~~~~~
রাতে রান্নাবান্না শেষ করে দেখি অন্বয় এখনও অফিস থেকে বাড়িতে ফেরেননি। আমি চুপ করে শাশুড়ী আম্মুর ঘরে চলে গেলাম। অন্বয়ের কোনো ভাই বোন নেই। তাই গল্প করার মতো একমাত্র বাড়িতে অন্বয়ের আম্মু ব্যাতীত কোনো মানুষ নেই। আম্মু খুব ভালো, আমাকে বোঝেন আরকি। বিয়ের আগে শুনেছিলাম শাশুড়ীরা না কি বউদের ওপরে খুব অত্যাচার করেন। কিন্তু, অন্বয়ের আম্মু কখনোই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি। বরং কীভাবে একটা সংসারে বরকত হয়, কী ভাবে সংসার সামলাতে সেটা বলেছেন।
~~~~~~~~~~~~
আম্মুর ঘরে গিয়ে দেখি উনি বসে বসে সুপারি কাটছেন। ওনার হাতে একটা ছরতা। ছরতার মধ্যে একটা একটা করে সুপারি রেখে চাপ দিচ্ছেন। আর সুপারি গুলো দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এরপর তিনি ওগুলো আবার ছরতা দিয়ে টুকরো টুকরো করছেন। আমার এই ছরতা দেখলে ভয় লাগে।একবার এই ছরতা দিয়ে সুপারি কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছিলাম। তারপর আর সাহস হয়নি ওই ছরতা ধরার। আমি গিয়ে আম্মুর পাশে চুপচাপ বসলাম। আম্মু আমাকে দেখে গল্প করা শুরু করলেন। অন্বয় ছোট বেলায় কী করতেন না করতেন সেগুলো নিয়ে গল্প করছেন। হঠাৎ এসবের মাঝখানে আম্মু বললেন,
” আমার ছেলেটা খুব ভালো মা।কখনো মুখ ফুটে কিছু বলবে না। তুমি ওকে যতই কথা শোনাও ও কখনো তোমাকে একটা পাল্টা উত্তর দেবে না। পানি লড়বে কিন্তু ও লড়বে না। ছোট বেলায়-ই ওর বাবা মারা গেছে। অনেক সময় অনেকে কথা বলেছে। ও কখনো কারোর মুখের ওপরে একটু টু শব্দ করেনি। ওর যা থাকবে সব মনে। মুখে কখনো কিছু প্রকাশ করবে না। তুমি কখনো ওকে কষ্ট দিও না মা। আমিও একটা সময় থাকবো না। তখন তুমি ছাড়া কেউ থাকবে না ওর। তুমিও ওকে কষ্ট দিও না কখনো”।
আমি চুপ করে সব শুনলাম। আমি জানি অন্বয় খুব ভালো একজন ছেলে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে উনি আমাকে ভালোবাসেন না। ওনার হয়তো কোনো পছন্দ ছিল। ওনার আম্মুকে বলতে পারেননি। তাই হয়তো আমার সাথে বিয়েটা হয়েছে। নাহলে উনি যাকে ভালোবাসেন তাঁর সাথেই ওনার বিয়েটা হতো। আচ্ছা, উনি কাকে ভালোবাসেন? জিজ্ঞেস করবো ওনাকে? না থাক, এভাবে সরাসরি বলাটা ঠিক হবে না।
~~~~~~~~~~~~
অন্বয় অফিস থেকে এসেই রুমে ঢুকে ফ্রেস হলেন। ফ্রেস হয়ে এসে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে শুরু করলেন।হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি ওখানে কয়েক মুঠ চুড়ি রাখা। আমার চুড়ি খুব পছন্দ। আমি চুড়ি গুলো হাতে ঢোকাতে ঢোকাতে অন্বয়কে জিজ্ঞেস করলাম,এই চুড়ি গুলো আপনি এনেছেন? অন্বয় টিশার্ট পরতে পরতে বললেন হুম। আমি অবাক হয়ে অন্বয়কে বললাম কেন এনেছেন? অন্বয় বললেন সাজিয়ে রাখার জন্য। এটা বলেই অন্বয় রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি রাগে হাত থেকে চুড়ি গুলো খুলে আবার আগের জায়গায় রেখে দিলাম। আমি নিশ্চিত উনি এই চুড়ি গুলো ওনার সেই ভালোবাসার মানুষটার জন্য এনেছেন। আমি আমার মনে করে হাতে পরেছি তাই উনি রাগ করে বেরিয়ে গেছেন। তো এটা তো আগে বললেই হতো যে সাবিহা আমি তোমার জন্য চুড়ি গুলো আনিনি। শুধু শুধু রাগ করার কী দরকার ছিল?
~~~~~~~~~~~~
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে দেখি, অন্বয় আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে; আমার গায়ের উপরে হাত পা তুলে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। আমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম ওনাকে। যত ভালোবাসা সব ঘুমের পরই। কেন এমনিতে আমাকে এভাবে একটু জড়িয়ে ধরা যায়? কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো আমাকে একটু জড়িয়ে ধরলে? না, আমাকে কেন জড়িয়ে ধরবেন উনি? ওনার তো জড়িয়ে ধরার মতোন মানুষ আছে অলরেডি। তাঁকে গিয়ে জড়িয়ে ধরবেন। কোলে তুলে নেবেন। আমি তো কেউ না। সাগরের পানিতে ভেসে এসেছি আমি।
~~~~~~~~~~~~
রাগে, অশান্তিতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করলাম কিছু সময়৷ কিন্তু আমার তখনও ঘুম আসছিল না। এরপর আবার অন্বয়ের কাছে গিয়ে ওনার বুকের ওপরে গিয়ে মাথা রাখলাম। এই মানুষটা আমাকে ভালোবাসে না। কিন্তু, ওনার জন্যই আমার সবচেয়ে বেশি মায়া কাজ করে।
~~~~~~~~~~~~
ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে দেখি, আমার স্কুল জীবনের এক বান্ধবী তাঁর হাসবেন্ডের সাথে পিক তুলেছে। হাতে হাতে রেখে দু’জনে একসাথে বসে আছে। ক্যাপশনে লিখা ছিল, ঘুরাঘুরি with hubby। আমার এই পোস্টটা দেখে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। কই অন্বয় তো একটা দিনও আমার সাথে এভাবে ছবি তুললো না। ছবি তোলা দূরের কথা আমার দিকে ঠিকঠাক ভাবে তাকায় ও না। আচ্ছা, আমি কী এতই কুৎসিত যে আমার দিকে একটু তাকানো যায় না?
~~~~~~~~~~~~
আম্মু অনেকদিন ধরেই বলছিলেন দেশের বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসবেন। আজকে অন্বয় অফিসে যাওয়ার সময় আম্মুকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে গেছে। এখন বাড়িটা আরও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আম্মু থাকলে আম্মুর সাথে টুকটাক কথা বলে গল্প করে সময় কেটে যায়। এখন আম্মুও নেই। অন্বয়ও আসবে সেই রাতের বেলা। এতটা সময় একা একাই কাটানো লাগবে।

সময় কাটছিল না তাই পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীদের বাসায় গেলাম। বাসায় কেউ নেই একা একা ভয় লাগে আমার। তাই ভয় কাটাতে ভাবীদের বাসায় গেলাম। অন্বয় আসার আগেই আবার চলে আসবো।

গিয়ে দেখি ভাবী ব্যাগ গোছাচ্ছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছেন ভাবী? ভাবী বললেন কালকে না কি উনি ওনার বাবার বাড়িতে ঘুরতে যাবেন।

ভাবীর সাথে গল্প করতে করতে ভাবী একটা নতুন শাড়ির প্যাকেট বের করে। শাড়ির প্যাকেটটা থেকে শাড়ি বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন, এটা না কি ভাইয়া নিজে পছন্দ করে আমার জন্য কিনে এনেছেন। আমি শাড়িটা দেখে বললাম খুব সুন্দর। কিন্তু, মনে মনে আমার খুব আফসোস হলো। কই অন্বয় তো আমার জন্য নিজে পছন্দ করে শাড়ি কিনে আনেনি। হ্যাঁ কিছু লাগলে অন্বয়কে বললে ঠিকই এনে দেয়। কিন্তু, আমাকে না জানিয়ে তো কখনো আমার জন্য কিছু কিনে আনেনি। আচ্ছা, অন্বয় কী আমাকে খুব অপছন্দ করে? তাই এমন করে আমার সঙ্গে?
~~~~~~~~~~~~
আজকে মনস্থির করে ফেললাম যে, অন্বয় আসলে ওর সাথে খুব ঝগড়া করবো। আমি এমন কী করেছি যে, আমাকে এত অপছন্দ ওনার? কেন আমাকে একটুও ভালোবাসেন না উনি? এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি অন্বয় এসে পড়েছে। আমি মুখ গোমড়া করে বাসার গেট খুলে দিলাম। অন্বয় চুপচাপ ঢুকে পড়লো। একটা বার তাকালোও না আমার দিকে। এবার অভিমানে রাগে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি হেঁটে রুমে গেলাম। অন্বয়ের সাথে আজ ঝগড়া করবোই! কিন্তু, গিয়ে দেখি অন্বয় শার্টের বোতাম গুলো খুলে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ঘেমে একাকার অন্বয়ের শরীর। আমার মনে মায়ার উদয় হলো। আমি ফ্যানের পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঠান্ডা লেবুর সরবত বানালাম। অন্বয়ের সাথে যত রাগ করার চেষ্টা-ই করি না কেন। আমার দ্বারা হয় না। প্রচন্ড মায়া কাজ করে ওনার উপরে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here