মন_কেমনের_বৃষ্টি,পর্ব-৪১ সমাপ্ত (সিজন 2)

0
1214

#মন_কেমনের_বৃষ্টি,পর্ব-৪১ সমাপ্ত (সিজন 2)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

[ সমাপ্তি, সমাপ্তি ]

মাঝরাতে হঠাৎ করে রিক অসুস্থ হয়ে পড়ল। হসপিটালে এডমিট করানো হলো দ্রুত। পিহু মাহিদ আর রিপ ছুটল রিকের সাথে। নীরা মুনাকে সামলাতে ব্যস্ত। সুস্থ সবল হাসিখুশি মানুষটা হুট করে কি করে অসুস্থ হয়ে পড়ল? মুনার মুখ দিয়ে কোনোসরূপ আর্তনাদ বেরোনো ছাড়া নিঃশব্দে জল গড়াল কপোল বেয়ে। পরীকে জানানো হলো তারপরের দিন সকালে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পরী হাজির হলো হসপিটালে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা রিকের বুকের ঝাঁপিয়ে পড়ে উরুধুরা হাত ছুড়ল পরী। পিহু আটাকতে পারল না। পরী রিকের মুখ নিজের দুহাতে আগলে ধরে ডাক দিল,
‘ এই পাপা, তুমি অসুস্থ। তোমার শরীর খারাপ আমাকে বলোনি কেন? কেন বলোনি? আমি তোমার কেউ নই বলে? এতটা পর আমি তোমার?
আদি এসে পরীকে কোনোমতে ছাড়িয়ে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ উঠবে। আর কিছুক্ষণ। প্রেশার হাই হয়ে গেছে। ঠিকমতো ঔষধ খায়নি তো তাই। কেঁদোনা আর।
পরীর কান্না থামল না। পরীর কান্না দেখে রাহি কাঁদল।
‘ মাম্মা কাঁদছে কেন? নানাভাইয়ের কি হয়েছে?
মাহিদ রাহির প্রশ্নের জবাবে কিছু বলল না। নিঃশব্দে হেঁটে রিকের মাথার কাছে গিয়ে বসে। রিকের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। মুখটা,চোখদুটো চেপে ধরে রিকের হাতের উল্টোপাশে। বিড়বিড় করে ডাকে,
‘ তুমি আমার বাবা তো। আমার দুই বাবা না? আমাদের মাথার ছাদ কেড়ে নিওনা এত তাড়াতাড়ি। ঢাল হয়ে থেকে যাও প্লিজ। খুব একা হয়ে যাব আমরা। খুব। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসো প্লিজ। যাওয়ার কথা ভেবোনা। রিপ এসে ছেলের মাথায় হাত বুলায়। বলে,
‘ কিচ্ছু হবেনা বড়দার।

প্রায় অনেকক্ষণ সময় পর রিকের জ্ঞান ফিরল। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় মাহিদের দিকে। নিজের ভেজা হাতটার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ কার জন্য এত চিন্তিত?
মাহিদ বলে,
‘ তুমি কে হও আমার?
রিক বলে,
‘ জ্যাঠা।
মাহিদ বলল,
‘ জ্যাঠা কাকে বলে আমি তো জানিনা । আমি তো বরাবরের মতো তোমাকে আমার বাবা বলেই জানি।
রিক হাসল। বলল,
‘ বাব কি ডাকবি? ইচ্ছে করে রে শুনতে।
মাহিদ গালভরে ডাকল,
‘ তুমি আমার বাবা। বাবা। বাবা।
রিক যেন হাসতে হাসতে আবার কাঁদল। শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখল মাহিদকে। এ তারই সন্তান।
পরী নাক, গাল ফুলিয়ে একাকার হয়ে বলল,
‘ আমি কেউ না। তোমার তো কেউ নেই। কোনে সন্তান নেই তোমার। নিঃসন্তান তুমি।
রিক হাসল।
‘ মা রাগ করেছে? শুধু শুধু অপবাদ দিচ্ছে কেন? কে বলেছে আমি সন্তানহীন। এই যে একটু চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই প্রমাণ পেলাম আমি সন্তানহীন কিনা? নিজেকে সন্তানহীন ভাবাটা ও পাপ মা। আসো।
পরী দেরী না করে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল রিককে। ভালোবাসা নিয়ে ভালোবেসে ডাকল,
‘ পাপা তুমি আর মাম্মা কিছুদিন ভাইয়ের সাথে কিছুদিন আমার কাছে থাকবে। ভাই তো তোমাকে ছাড়েনা। আমি মেয়ে হয়েছি বলে পর হয়ে গিয়েছি।

রিপ হেসে ফেলল। বলল,
‘ তুমি পারোনা পুরো খান বাড়িটাকে চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে যেতে।
পরী রেগে বলল,
‘ তোমার সাথে খুব রেগে আছি আমি।
রিক,রিপ একত্রে হাসে। রিক বেড থেকে নিচে নেমে দাঁড়াল। মাহিদ ফার্মেসির উদ্দ্যেশ্যে গেল। পরী মুনার কাছে। রিপ বলল,
‘ বড়দা তুমি এখন হাঁটাহাঁটি কম করো। একটু রেস্ট নাও। আদি আসুক। কি বলে দেখি?
রিপ বেরোতেই রিক পিছু ডাকল।
‘ রিপ?
রিপ সাথে সাথে পিছু ফিরল। রিকের স্নেহের চাহনি উপেক্ষা না করে দ্রুত জড়িয়ে ধরল ভাইকে। রিক হেসে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখল ভাইকে। রিপ যেন ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গেল আজ। চুপটি মেরে পড়ে থাকল ভাইয়ের কাঁধে। রিক রিপের পিঠ চাপড়ে চাপড়ে বলে,
‘ আমি আছি। আছিরে ভাইটা।
রিপ মুখ তোলার আগেই রিকের চোখ গেল কেবিনের দরজার কাছে। ইশু!

দু চোখের কোঠায় আটকে রাখা টলমলে জল গড়িয়ে পড়ল সহসা ইশার গাল বেয়ে। কন্ঠে একরাশ অভিমান, অভিযোগ নিয়ে ইশা ডাকল,
‘ বড়দা?
রিক হাত বাড়িয়ে ডাকল
‘ ইশু আয়।
রিপ মাথা তুলে ইশাকে দেখে হাসল। ইশা রিকের কাছে গিয়ে ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এলোমেলো সুরে কেঁদে কেঁদে বলল,
‘ স্বার্থপর মা বাবা গুলো আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে আমার বুদ্ধি হওয়ার আগে। মামা,মামি ও ছেড়ে চলে গিয়েছে। এই আমার সম্বল, আমার মাথার উপর ছায়া তুমি আর রিপদা। তোমরা ছাড়া আমি কতটা অসহায় বুঝোনা কেন?
রিক হেসে ইশার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ কেন এভাবে কাঁদছিস রে ইশু। আমি কোথাও যায়নি তো। তোরা যেতে দিচ্ছিস কই? তোদের সাথে যে হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে৷
ইশা কেঁদেই গেল৷ রিপ তার হাত ইশার মাথায় রেখে বলল,
‘ ইশু আর কাঁদিস না। ভালো লাগেনা৷
ইশা কান্না থামিয়ে রিপের হাত নিজের মাথায় চেপে ধরে। বলে,
‘ রিপদা এই আশ্রয়টুকু আমার কাছ থেকে কেড়ে নিওনা প্লিজ। স্বামী, সংসার, সন্তান এরা সবাই থাকলে ও এই আশ্রয় টুকু আমার খুব করে চাই। তোমরা আমাকে একা করে দিওনা।
রিপ হাসতে হাসতে ইশার মাথায় হাত বুলায়। বুকে আগলে ধরে বলে,
‘ ইশু তোর রিপদা তোর মাথার উপর ঢাল হয়ে ছিল। আছে। থাকবে। কেন কাঁদছিসরে পাগলী? তুই কি বাচ্চা? তোর না বাচ্চা নাতি,নাতনি আছে?
ইশা হেসে উঠল। সাথে রিক, রিপ ও।
ইশা মাথা নামিয়ে বলল,
‘ ধুরর।

________________

কেবিনের দরজা পর্দা ঠেলে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে রিকের কাছে এল মেরিনা। গাল ফুলিয়ে রিককে বলল
‘ দাদ্দাই বিথা।
রিক তাকে পাঁজাখোলা করে কোলে তুলে পেটে মুখ দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল,
‘ দাদ্দাই কুথাই বিথা দিয়েছে?
মেরি হাসল। বুক দেখিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ইখখানে।
সবাই একসাথে হেসে উঠল মেরির কথা শুনে। রিক আদিকে বলল,
‘ আদি তোমার বোনের বুকে এত ব্যাথা কেন? একটু দেখো তো কার জন্য এত ব্যাথা হয়।
সবার মাঝে মুহূর্তেই হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল। কি মনোরম দৃশ্য!

_________

হসপিটাল থেকে সবাই বাড়ি ফিরল। চৌধুরী বাড়িতে।
মুনার গা কাঁপিয়ে জ্বর এল। নীরা জলপট্টি দিতে দিতে বকল।
‘ জ্বালিয়ে খাই সবাই আমাকে। ব্যারিস্টার এক জ্বালা জ্বালায়। ব্যারিস্টারের ভাই এক জ্বালা জ্বালায়। ব্যারিস্টারের ভাইয়ের বউ এক জ্বালা জ্বালায়।

মুনা হাসল। বলল,
‘ তোকে জ্বালাতে সবার ভালোলাগে নীরু।
নীরা বলল,
‘ আমি আছি বলে, নইলে? হুহহ।
মুনা বলল,
‘ নইলে কি? তুই না থাকলে কি?
নীরা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ আমি না থাকলে ভালো হতো?
মুনা হাসল। নীরাকে বুকে জড়ালো। বলল,
‘ তুই বোন না আমার? রাগিস কেন? তোরে ছাড়া কি আমার চলে?

পরী ঔষধ নিয়ে আসল। মুনাকে দিয়ে বলল,
‘ মাম্মা তোমাদের জ্বালায় কোনদিন আমি মরে যাই।
মুনা রেগে বলল,
‘ চড় খেয়েছ দেরী হয়েছে।
পরী চুপ মেরে গেল৷ রাগ করল। নীরা বলল,
‘ যাও। তোমাদের মা মেয়ের রাগ দেখার সময় নাই বাপু।
মুনা পরীকে টান দিল। বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
‘ রাগগুলো কমার নয়। শুধুই বাড়ে। রেহান কিভাবে সামলায় এই মেয়েকে? ছেলেটার কাছে দিনদিন ঋণী হচ্ছি।
পরী বলল,
‘ কচু হচ্ছে। আমি ভালো। বরং আমি তাকে সামলায়। হুহহ।
রেহান এসে বলল,
‘ একদম ভুল কথা। আমি আপনার মেয়েকে সামলায় মা।
মুনা হেসে বলল,
‘ একদম ঠিক কথা বলেছ রেহান । এ মেয়েকে সামলাতে কত কাঠখড় পোহাতে তা আমি আর তার বাবা জানে।
পরী মুখ ফুলালো। মুনা হেসে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ রাগ করলে খুব মাববো।
পরী হাসল। রেহান বলল,
‘ এ নাকি বাচ্চার মা। বিশ্বাস হয় আদৌ?

_____________

হসপিটালে বেরোনোর সময় আফি আদিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমার ঔষধ শেষ। আনিস তো।
আদি রাগানোর জন্য জবাব দিল।
‘ আনব না।
আফি কটমট করে বলল,
‘ যাহ। আনিস না। তোর ঔষধ খামুনা আমি। বাইর হ ঘর থেকে। যাহ৷
আদি আফিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ রাগ করো কেন?
আফি আদিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
‘ তোর ঔষধ খাইয়া আমারে বাঁচতে হইবো না। যাহ।
আদি মুখ কালো করে রাখল। পানি খেল ঢেলে৷ রাইনা বলল,
‘ ওকে এভাবে বলেছেন কেন? ছোট ভাইকে কেউ এভাবে বলতে কখনো দেখিনি।
আদি মিটিমিটি হাসল। আফিকে দেখালো না।
আফি আদির মুখ দেখার চেষ্টা করল। আদি মুখ কালো করে বলল,
‘ আমি যাচ্ছি।
আফি বলল,
” ঔষধ আনিস।
আদি কিছু বলল না। আফি আদিকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে বলল,
‘ রাগিস কেন ব্যাটা? তোর এসব ঢং দেখলে আমার মাথা খারাপ হয়৷
আদি চুপ করে থাকল। ইশা আসতেই দুই ভাইকে এই অবস্থায় দেখে হাসল। রাইনা বলল,
‘ ছোট দেখেছিস কি অবস্থা?
ইশা বলল,
‘ একদম ভালো হয়েছে। ডক্টর ও কম না।
আদি হেসে দিল। আফি জড়িয়ে ধরে রাখল আদিকে। বলল,
‘ আমি না থাকলে বুঝবি, এই ভাই কি ছিল তোর।
আদি বলল
‘ যাবে কোথায় আমাদের ছেড়ে?
ইশা বলল,
‘ দাভাইয়ের মুখে আর কথা নেই।
রাইনা মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ বুড়া হচ্ছে। মৃত্যুকে স্মরণ করা ভালো।
ইশা বলল,
‘ অতটা ও বুড়ো হয়নি। তোমাদের মুখে সবসময় বাজে কথা। রাহি,আলো আর মেরির বিয়ে খেতে হবেনা?
রাইনা ইশার মুখে হাত বুলালো। বলল,
‘ আচ্ছা আর বলব না।
ইশা হাসল।

_________________

বইয়ের পাতায় আঙুল টিপে টিপে মেরি পড়ল,
‘ ই, বি, চি, দি,
পিহু শিখিয়ে দিল।
‘ এভাবে না মা। এ, বি, সি, ডি, এভাবে পড়ো।
মেরি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ ই, বি, চি ইভাবে!!!!
পিহু হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা সিভাবে পড়েন।
মেরি দাঁত দেখিয়ে হাসল। পিহু বলল,
‘ এ ফর আপেল। বি ফর বল।
মেরি পড়ল।
ই ফু ইখানে। বি ফু বিখানে। চি ফু চিখানে।
পিহু মাথায় হাত দিল।
‘ এসব কি মা? এগুলো কোনো পড়া?
মেরির মুখ কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল৷ বইটা তুলে নিজের মুখে ধপধপ বাড়ি খেল। তারপর ধপ করে বিছানায় শুয়ে গিয়ে বলল,
‘ বিথা। আমমা বিথা।
পিহু হাসতে হাসতে মেরির পাশে পড়ল। একহাতে জড়িয়ে ধরল মেরিকে। তুলতুলে শরীরের মেয়েটার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,
‘ ই ফু ইখানে। বি ফু বিখানে। চি ফু চিকানে।
মেরি তার ছোট্ট হাত দিয়ে পিহুকে ধরল। পিহুর বুকে মুখ গুজতে গুজতে বলে,
‘ আমমা পুঁচা। আমমা বেড গাল।

মাহিদ রুমের দরজা আটকালো। বলল,
‘ মেরিজান কোথায়?
কন্ঠস্বর শোনার সাথে সাথেই পিহুর কাছ থেকে সরে এক মেরি। মাহিদকে দেখে একগাল হেসে ডাকল,
‘ আববা মিরি ইখানে।
মাহিদ বলল,
‘ বই খোলা রেখে ঘুম কেন? তোমার আমমা শিখাইছে?
পিহু বলল,
‘ হুহহহ। সব এখন আমার দোষ? তোমার মেয়ে ই ফু ইখানে, বি ফু বিখানে, চি ফু চিকানে পড়ে। আমি বারণ করায় বই খোলা রেখে ধপ করে শুয়ে পড়ল।
মেরি চোখ কচলে কচলে বলল,
‘ বিথা আমমা।
মাহিদ বলল,
‘ আমি তোমার আম্মাকে মাইর দেব।
মেরি তৎক্ষনাৎ হাসে। পিহু বলল,
‘ আমি তোমার আববাকে মাইর দেব।
মেরি চেঁচিয়ে বলে,
‘ এননননা। মিরে দেব। আমমা পুঁচা।
পিহু বলল,
‘ মারি। দাড়াঁও তোমার আব্বাকে আজকে দুমদাম মারব।
মেরি তাড়াতাড়ি হাত টানে মাহিদের দিকে। মাহিদ বিছানায় মেরির পাশে এসে বসে। পিহু মাহিদকে পেছন থেকে ধরে মাথার চুল ধরে বলল,
‘ এই দেখো মারছি। মাহিদ ভাই কাঁদো। কাঁদো।
মেরি চেঁচিয়ে হাত ছুড়ে।
‘ আমমা বিথা। আমমি বিথা পাবু। আমমা বিথা। আববা বিথা।
মাহিদ পিহু একত্রে হো হো করে হেসে উঠে। পিহু বলল,
‘ তুমি আমার মেয়ে না। শুধু তোমার আব্বার মেয়ে। যাও কোনো কথা নেই তোমার সাথে।
মেরি মাহিদের দিকে তাকাল। মাহিদ বলল,
‘ রাগ করেছে।
মেরি পিহুর গায়ের উপর উঠে দুহাত দিয়ে পিহুর মুখ ধরল। বলল,
‘ আমমা ভালু। আমমা মিততি। আমমা গুত গাল।
পিহু হাসতে হাসতে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল মেরিকে। বলল,
‘ এত পাম্প দিতে জানে এই মেয়ে?
মাহিদ ধপ করে শুয়ে পড়ে পাশে। মেরিকে টেনে বুকের উপর রেখে বলে,
‘ সর ডাক্তারের বাচ্চি, মাইয়া কার দেইখা কথা কইবি? বুঝছস?
মেরি মাহিদের মুখের দিকে তাকায়। বলে,
‘ আববা বিথা।

________________

পানির গ্লাস থেকে পানি খাওয়ার সময় রাহিকে ডাক দিল মেঝেতে বসে থাকা ছোট্ট মেয়েটি। হাতের মুঠি দিয়ে চুল সরিয়ে রাহিকে ডাকল,
‘ আ আ আ আ।
রাহি বলল,
‘ পানি খাবে?
আলো মাথা নাড়ায়। হাত দিয়ে রাহিকে ডেকে বলল,
‘ আ আ আ আ।
রাহি পানির গ্লাস নিয়ে গেল। পানি খাইয়ে দেয়ার সময় সবটুকু পানি পড়ে গেল৷ আলোর সামনের দিক ভিজে গেল। মেঝেতে পানি পড়ে গেল। রাহি জিভে কামড় দিয়ে বলল,
‘ এমন করেছ কেন ? সব পানি ফেলে দিয়েছ কেন?
আলো তাকিয়ে থাকে রাহির দিকে । ভাই বকছে দেখে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকল।
রাহি সরতেই পানির উপর দুহাত তড়পাতে লাগল। তারপর হাত দিয়ে মেঝেতে আঁকিবুঁকি আঁকল।
পরী এসেই মাথা হাত দিয়ে বলল,
‘ আলো? তুমি পানি নিয়ে খেলছ? রাহি?
রাহি দৌড়ে এসে বলল,
‘ পানি খাওয়াতে গিয়ে পড়েছে।
পরী আলোকে কোলে তুলে নিল। হাত মুখ মুছিয়ে বলল,
‘ খুব মারব। পানি ফেলে হইছে তার?
আলো দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল। রেহান এসে বলল,
‘ কাকে বকছ?
পরী বলল,
‘ আপনার মাদারকে।
রেহান বলল,
‘ কোথায় মাদার?
আলো মুখ থেকে হাত সরিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিল।
রেহান বলল,
‘ তুমি আমার মেয়েকে মেরেছ পরী?
পরী বলল,
‘ মারিনি। বকেছি।
রেহান আলোকে কোলে তুলে নিল। আদর করল। বলল,
‘ সব তোমার ছেলের দোষ। ও পানি দিয়েছে কেন?
পরী বলল,
‘ সব আপনার মেয়ের দোষ। পানি ফেলে দিয়েছে কেন?
রাহি হাসল এককোণায় দাঁড়িয়ে। আলো রেহানের শার্টের কলার গালে দিয়ে চুষে ডাকল,
‘ এপপে এপপে।
রেহান বলল,
‘ খিদে পেয়েছে?
পরী তাড়াতাড়ি কেড়ে নিল আলোকে। বলল,
‘ খিদে পেয়েছে?
আলো পরীর দিকে তাকিয়ে থাকল। পরী তার গালে টুপ করে চুমু বসিয়ে বলল,
‘ এভাবে কি দেখেন?
আলো বকল,
‘ এমমে এমমে।
পরী হাসল। রেহান রাহিকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ চলেন আব্বা আমরা আমাদের কাজে যাই?
পরী আলোকে ডাকল,
‘ মা রাগ করেছে?
আলো আওয়াজ করল না। জিহবা একবার বের করে আবার ডুকিয়ে জানান দিল খিদের কথা।

___________________

জালিশার কোল থেকে নেমে সোফায় কোনোমতে উঠে বসল নাবিদ। তারপর জালিশাকে ডেকে বলল,
‘ আম্মায় আতো। আতো।
জালিশা বলল,
‘ সোফায় যদি খাবার ফেলেন। আপনার দাদু খাইছে আপনাকে।
নাবিদ হাত দিয়ে তার এক পা তুলে আরেক পায়ের উপর বসালো। ঠিক নিয়াজ সাহেবের মতো করে বসল। সবাই আড়চোখে নাবিদের কান্ড দেখতে লাগল। নিয়াজ সাহেব ফিসফিস করে নিনিতকে বলল,
‘ দেখ তোর পোলা আমাকে কপি করছে।
নিনিত বলল,
‘ আমার আরেক বাপ।
নাবিদ হাসল। জালিশাকে ডেকে বলল,
‘ আমমায় আতো না? আতো।
জালিশা বলল
‘ যাব না। এখানে আসো।
নাবিদ কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ আতো না? আতো। আম্মায় আতো।
জালিশা আবার হাসল। বলল,
‘ ওখানে ভাত পানি পড়লে দাদু বকবে।
নাবিদ হাত উপরে তুলে বলল,
‘ নিব্বিলকে বুকবে না বুকবে না।
নিনিত বলল,
‘ কেউ বকবে না। জালিশা যাও। ওকে খাইয়ে দাও।
নাবিদ হাসল। নিকিতা বেগম ডেকে ডেকে সারা হলো নাবিদকে।
‘ নিব্বিল সোনা কোথায়?
নাবিদ সোফা থেকে নেমে সোফার পেছনে লুকিয়ে থাকল। বলল,
‘ নাই নিব্বি নাই। কিউ নাই।
নিকিতা বেগম ফোন হাতে বলল,
‘ আইমি ফোন দিয়েছে। নিব্বিলের সাথে কথা বলতে চাই। নাবিদ দৌড়ে এল। ফোন কেড়ে নিল নিকিতা বেগমের কোলে উঠে। ফোন কানে লাগিয়ে বলল,
‘ ইমম্মি? হাউআ্ই ইউ? জাব্বি হাউআই ইউ?
ফোনের ওপাশে আইমি আর জাবিরের সাথে উপস্থিত সবাই হাসল।
নাবিদ সবার হাসি দেখে রাগ করল। ফোনে বলল,
‘ ইমমি উখানে। নিব্বি ইকানে?
আইমি বলল,
‘ ইমমি চলে আসবে নিববি সোনাকে দেখার জন্য। কোলে নেওয়ার জন্য। শীঘ্রই আসবে।
নিব্বিল হেসে বলল,
‘ ইম্মি আতো।

__________________

পরিশিষ্টঃ

➤➤➤➤➤➤➤➤➤

আকাশে রোদ মেঘের লুকোচুরি। পাল্লা দিয়ে বইছে শাঁ শাঁ বাতাস। বেয়ে উঠা রাস্তার পাশের গাছগুলো এপাশ ওপাশ দুলছে। বাতাসের দাপটে হয়ত গাছের ডালপালা ও ভেঙ্গে ভেঙে পড়ছে।
পিঠের ব্যাগের ফিতা ধরে হেলিয়ে দুলিয়ে হেঁটে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফেরা মেয়েটি পিচঢালা রাস্তায় আচমকা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। বাতাসের শাঁ শাঁ ঝাপটার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মন কেমনের বৃষ্টিরা। মুখ থুবড়ে পড়া যাওয়া মেয়েটি কেঁদে ফেলল। আচমকা মেয়েটির সামনে এসে থামল এক বাইক। বাইকের ছেলেটি দ্রুত গতিতে নেমে হাত বাড়িয়ে দিল আলোর দিকে। আলো কে, কেন না ভেবে না বুঝে হাতটাকে ভর করে উঠে দাঁড়াল। মুখ তুলে দেখল অনাকাঙ্ক্ষিত একটা মুখ। সাথে সাথে পিছু হেঁটে বলল,
‘ আপনি?
নাবিদ বাঁকা হাসল। বলল,
‘ ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছ কেন ?
আলো বলল,
‘ খুশি লাগছে তাই।
নাবিদ এক ধমক দিল। কন্ঠে শাসনের কিঞ্চিৎ আভাস। আলো ভড়কে গেল। নাবিদ বলল,
‘ বাইকে ওঠো।
আলো নাকচ করল।
নাবিদ বলল,
‘ উঠবে নাকি উঠবে না?
আলো বলল,
‘ আমি যেতে পারব।
নাবিদ বাইকে চেপে বসে বসল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ উঠবে?
নাকি
উঠবে না?
আলো ভয়ে ভয়ে উঠে বসল। নাবিদের শার্ট জোরে খামচে ধরে টানল। অসভ্য ছেলে!
নাবিদ আলোর উদ্দেশ্য বুঝে হাসল। আলো বাইকের মিররে তাকাতেই নাবিদের হাসি দেখল। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। মাথা নিচু করে ঠোঁট টিপে হাসল।
মন কেমনের বৃষ্টিতে দুজনই ভিজে হলো একাকার।
এই বৃষ্টি সেই বৃষ্টি নয়, জানান দেয় বারবার।
আজ ও জানান দিল আবার।

_________________

ছেলেটি যখনই খান বাড়ি যখন পৌঁছাল তখন রাত দেড়টা। মিউজিক ক্লাব থেকে থেকে সোজা খান বাড়ি আসতে বলেছে পরী। রাহি হাতের কব্জিতে পড়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল
‘ দরজা খোলা থাকবে?
আজ সারাদিন বৃষ্টি পড়ল। থামার নাম গন্ধ নেই একদম।

বৃষ্টি ভিজে ছেলেটি জবজবে অবস্থা। আশপাশ লাইটের মৃদুমন্দ আলোয় আলেকিত। খান বাড়ির দরজা খোলা বোঝায় গেল দরজা ঠেলামাত্রই খুলে যাওয়ায়। রাহি অবাক হয়ে বলল,
‘ দরজা খোলা রেখেছে কে? মা?
না। ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাহি ফোন হাতে নিল মাকে কল দেওয়ার জন্য। বৃষ্টির কারণে ডাকলে ও শুনতে পাবেনা। ফোন হাতে নিতেই রাহির চোখ গেল বকুল তলায়। সাদা কাপড় পড়া মেয়েটি কে? এতরাতে ওখানে কি করছে?
রাহি কৌতূহল দমাতে পারল না। এক পা এক পা করে এগোলো। সাদা ফ্রক পড়া মেয়েটির ওড়না গলায় ঝুলছে। ছোট্ট একটি ঝুড়িতে করে কুড়াচ্ছে বকুল ফুল। যেগুলো টাটকা সতেজ। রাহি অবাক হলো। কি আশ্চর্য মেয়েটি কি পাগল?
মেয়েটি খুব সুন্দর করে কানের পেছনে চুল গুজল। মুখ মুছল। আবার বকুল ফুল কুড়াতে লাগল।
রাহি আর ও কয়েক পা এগোলো। মেয়েটি থেমে গেল। ঝুড়ি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পেছনে ফিরে আবিষ্কার করল প্রিয় একটি মুখ। কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। অপলক।
মেরি উশখুশ করল। ছেলেটি এগোতেই পিছু হাঁটল। রাহির ঠোঁটের কোণায় ভাসল দুষ্টুমির হাসি। চোখে বেশ গাম্ভীর্যতা। মেরিনা ভয়ে ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল। মাটিতে পড়ে থাকা ইটের সাথে লেগে উল্টো হয়ে পড়ে যেতেই রাহি টেনে ধরল একহাত। মেরিনার হাত থেকে খসে পড়া ঝুড়িটা ও ধরল। মেরিনা চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করল কি যেন। রাহি হেসে ঝুড়িতে থাকা ফুলগুলো ছিঁটালো মেরিনার মুখের উপর। মেরিনা বিড়বিড় করে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ কি করলেন এটা?
রাহি হেসে হেসে বলল,
‘ যার জন্য কুড়ালে, সেই ছিটিয়ে দিল।
মেরিনা চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল,
‘ ভালো হয়নি একদম।
রাহি হাসল। মেরিনাকে টান দিয়ে কিছুটা কাছে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,

‘ প্রেমিকের জন্যেই প্রেম কুড়াতে হয়।
কুড়ানো প্রেমেই কিন্তু মুগ্ধতা রয়
মন কেমনের প্রেম কুড়াতে
বেশি কিছু নয়
একটুখানি প্রেম, ভালোলাগা থাকলেই হয়।
সেই একটুখানিকেই করতে হয় জয়।
তাহলেই ভালোবাসা, ভালোবাসাই হয়।

মেরিনার হৃৎস্পন্দন নাচল ছন্দ তুলে। সামনে খুব কাছে থাকা ছেলেটির দৃষ্টি বড্ড আকর্ষিত। বড্ড নেশালো। বড্ড মনকাড়া। মেরিনা চোখ নামিয়ে নিল নিচে। এই বৃষ্টি বুঝি, মন কেমনের বৃষ্টি? আচ্ছা, মন কেমনের বৃষ্টি মানে কি?

মেয়েটি কি জানে?

মন কেমনের বৃষ্টি মানেই
পাওয়া না পাওয়ার হিসেব বুঝিয়ে দেওয়া
অপূর্ণ ভালোবাসাকে পূর্ণতায় ঘিরে দেওয়া
মন কেমনের বৃষ্টি মানেই
স্বপ্ন সত্যি হওয়া
মন কেমনের বৃষ্টি মানেই
চাওয়াটাকে পাওয়া
মন কেমনের বৃষ্টি মানে
হাসিকান্নার খেলা
মন কেমনের বৃষ্টি মানেই
হাজার তারার মেলা
মন কেমনের বৃষ্টি মানে
মনমাতানো সৌরভ
মন কেমনের বৃষ্টি মানে
ভালোবাসাবাসির গৌরব
মন কেমনের বৃষ্টি মানে
দুষ্টুমিষ্টি কথা
মন কেমনের বৃষ্টি মানেই
ভালোবাসার কাব্যগাঁথা।
মন কেমনের বৃষ্টি মানেই একবুক আশা
মন কেমনের বৃষ্টি মানেই একটু ভালোবাসা।

দরজা খুলে বেরিয়ে আসা লোকটি বকুলতলায় ছেলেমেয়ে দুজনকে দেখে গলার আওয়াজ উঁচু করে বলল,
‘ তোমাগো পেরেম পিরিতি শেষ হইলে চইলা আসো বাপ। জ্বর-টর লাগাইওনা মেরিজান, জামাই বাবাজি। চইলা আসো।
মেরিনা জিভে কামড় দিয়ে মাথা নামিয়ে ফেলল। রাহি হাসল। রাহির সাথে সাথে মাহিদ ও হাসল।

বিঃদ্রঃ আজ পুরোপুরি শেষ করলাম। শুরু থেকে যারা পাশে ছিলেন সবাইকে ধন্যবাদ ভালোবাসা। সবাইকে এভাবেই পাশে চাই সবসময়। পাশে থাকবেন। আবারও বলছি ভালো থাকবেন। ভালো রাখবেন। ভালোবাসা নেবেন। আল্লাহ হাফেজ।
মন্তব্যের আশায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here