মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_১১(সিজন ২)

0
748

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১১(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে বসা থাকা রেহানের হঠাৎ মনে হলো তাকে চাচ্চু ডাকছে। খুব গম্ভীর সেই ডাক। মায়ের কিছু হলোনা তো? রেহানের ভেতরে কাজ করল ভয়,আতঙ্ক। শীত শীত অনুভূত হওয়ায় গায়ে জড়ানো চাদরটি খুলে রেখে দিল। তারপর কাঁপাকাঁপা পা চলতে না চাইলে ও চলতে হলো তাকে। সিড়ি ধরে ডাকল আদিকে।
‘ চাচ্চু ডেকেছ?
আবার ভেসে এল আদির ডাক। ‘ নিচে নেমে এসো।
রেহান বলল, অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। তুমি অন্ধকারে কেন দাঁড়িয়ে আছ?
আদি বলল,
‘ কথা কম। হাতঁড়ে হাতঁড়ে নিচে নেমে আসো।
রেহান দু তিন পা নিচে নামল। ফোনের লাইট জ্বালানোর আগেই ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বলে উঠল। দেখা গেল পিহু দাঁড়িয়ে আছে পিছু করে। রেহান ডাকল পিহুকে। পিহু সাড়া দিল না। রেহান বলল,
‘ পিহু চাচ্চু কোথায়? তুমি এতরাত অব্ধি ঘুমাওনি কেন?
রেহান দেখল মাহিদকে ও। সোফায় শুয়ে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ দুটো বন্ধ করে আছে। হাত নেড়ে পিহুকে কি যেন বলছে। পিহু তার কথা শুনল কি শুনল না কে জানে?
পিহুর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রেহান নিচে নেমে এল। বলল,
‘ পিহু,মাহিদ তোমরা এখনো ঘুমোওনি? কি করছ?
পিহু তার কথার জবাব দিল না। রেহান পিহুর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। পিহু সরে দাঁড়াল। সাদা কাপড় মোড়ানো সামনের টেবিলটা। রেহানের ভ্রু কুঞ্চন হলো। মাহিদ আর পিহু একসাথে বিরাট একটি চকচকে কাগজ নিয়ে এল তার সামনে। রেহান বিস্মিত হতে না হতেই ড্রয়িংরুম মুখোরিত হলো জন্মদিনের শুভেচ্ছান্তে। হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না রেহান। ইশা সামনে এসে পায়েসের বাটি থেকে এক চামচ পায়েস তুলে মুখের কাছে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘ শুভ জন্মদিন প্রিন্স।
রেহান আচমকা তার হাতের কব্জি দিয়ে রাখল চোখের উপর। সবাই মাথা নামিয়ে হাসল। ইশা বলল,
‘ হাত সরাও। খাও। নিজ হাতে পায়েস বানিয়েছি।
মাহিদ বলল,
‘ রেহান ভাই তাড়াতাড়ি খাইলে খাও। এইখানে একটা পেটুক ও আছে।
পিহু বিড়বিড় করে বলল,
‘ রাক্ষস কোথাকার।
মাহিদ ঠাসস করে মারল পিহুর মাথায়। বলল,
‘ রাক্ষস ডাকছস তাই এখন তোরে খামু।
পিহু সরে দাঁড়াল। বলল, খবরদার আমাকে ছুঁবেনা। আমি তোমার সাথে কথা বলিনা।
মাহিদ বলল, কথা আগে কে বলছে??
তুই আমারে আগে রাক্ষস ডাকছস। বেহায়া বেডি। আবার বলে,আমও তোমার সাথে কথা বলিনা। ডংয়ের শেষ নাই তোর। সিনেমার নায়িকারা ও এত ডং করেনা।

পিহু মুখ মোচড়ে বলল,
‘ আমি নায়িকা নয়,নায়িকা হওয়ার কোনো ইচ্ছা ও নাই। ভুয়া নায়িকা হওয়ার কোনো বাসনা নাই আমার। হুহহহ।
মাহিদ দুহাত দিয়ে পিহুর মাথা জোরো ঠেলে দিল। গর্জে বলল,
‘ আরেকবার মুখ মোচড়ালে তোর মুখ আমি ওই কেক কাটার ছুরি দিয়ে কেটে ফালাফালা করে ফেলব।
পিহু রাগে ফুঁসে ফুঁসে উঠল। আদি ইশা না শোনে মত ফুঁপাল। নাকটা ঘনঘন কাপঁতে লাগল। মাহিদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টেনে কেঁদে দিল নিঃশব্দে।
মাহিদ ভ্রু কুঞ্চন করে তাকিয়ে থাকল। বলল,

‘ মুখে মুখে তর্ক করলে আর ও বেশি মাইর খাবি। সারাক্ষণ আমার সাথে তর্ক করতে থাকস। বড় ভাই আমি তোর। সম্মান দিয়া কথা কইবি।
পিহু আবার মুখ মোচড়াল। বলল,
‘ দিব না সম্মান টম্মান। ঠাসস ঠাসস।
মাহিদ ঘুরিয়ে মারল চড়। পিহু দূরে ছিটকে পড়ল। হু হু করে কেঁদে উঠল। মাহিদ চোখ লাল করে বলল,
‘ সবসময় আমার সাথে লাইগ্যা থাকস। তোর সমস্যা কি? মাইরা ফেলুম এক্কেবারে।

পিহু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। আদি ইশা ফিরে তাকাল তাদের দিকে। ইশা বলল,
‘ আবার শুরু করেছিস দুজন? সরে সরে থাকতে পারিস না দুজন দুজনের থেকে। সারাক্ষণ ঝগড়া।
আদি বলল,
‘ তোমরা এই টাইমে ঝগড়া করছ? পিহু কি হয়েছে?
পিহু মুহূর্তে কান্না থামিয়ে দিল। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে,
‘ নাথিং পাপা। আ’ ম ওকে।
মাহিদ তাকে ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ আ’ম অকে।
তারপর পরই অট্রহাসি দিল কোমরে হাত দিয়ে। পিহু নাক ফুলিয়ে তাকিয়ে দেখল সেই হাসি। বহুকষ্টে কান্না থামাল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ সারাক্ষণ শুধু মারে। একটু ও,,,,,
পরক্ষণে আবার ও ফুঁপিয়ে উঠল পিহু।
মাহিদ নাক মুখ ছিটকে সেখান থেকে গেল।
পিহু আর জোরে ফুঁপিয়ে উঠল।

______________

রেহানকে পায়েস খাইয়ে দিল ইশা।
রেহান মৃদু হাসার চেষ্টা করল। বলল,
মায়ের হাতের স্বাদ পাচ্ছি। খুব মিস করছি মাকে।
ইশা বলল,
‘ আমি কি মা নই? ইনডাইরেক্টলি আমি কিন্তু তোমার শ্বাশুড়ি হয়। হুমম।
রেহান কিঞ্চিৎ পরিমাণ হাসার চেষ্টা করল। বলল,
‘ তুমি আমার কাকিয়া হিসেবেই বেস্ট।
ইশা হেসে দিল। বলল,
‘ কাকিয়ার মেয়েটার উপর খুব রাগ তাই না??
রেহান মাথা দুলিয়ে কিঞ্চিৎ বাঁকা হেসে বলল,
‘ রাস্তার ছেলেদের রাগ থাকতে নেই কাকিয়া।
ইশার মুখ মলিন হয়ে এল। নীরবতাকে দমিয়ে দিয়ে মাহিদ ছুটে এল। টেবিলের উপর থেকে সাদা কাপড়টি সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ রেহান ভাই তাড়াতাড়ি কেক কাইট্যা লন। আমার আর তর সইতেছে না।
পিহু সাথে সাথে আবার ও মুখ মোচড়ালো। মাহিদ কাপড়টি পিহুর দিকে ছুড়ে মেরে বলে,
‘ তোর মুখটা আমারে আর দেখাস না বাপ। আমার গা জ্বইলা উঠে। মুখটারে মোচড় ব্যারাম আছে নাকি? হাঁটতে,বসতে এত মোচড়ায় কেন?
ইশা বলল,
‘ পিহু তুমি আবার শুরু করেছ?
পিহু রেহানের পাশে এসে দাঁড়াল। কেক কাটার পর্যায় শুরু হলো। রেহানের হাত থেকে কেক কেড়ে নেওয়ার প্রতিযোগীতা চলছে পিহু আর মাহিদের মধ্যে। আলিয়া ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে নেমে এল।

আদি ইশার পাশে এসে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল,
‘ পরী আসবে না?
ইশা বলল,
‘ না। রেহান তো কিছুই বলছেনা। না ডাকলে আসবে কেন?
আদি বলল, তোমার মেয়ে একদম তোমার মতো হয়েছে। বজ্জাত।
ইশা হেসে দিল। বলল,
‘ ভালো। আপনার মতো লুইচ্চা হয়নি, এতেই শুকরিয়া।
আদি মন খারাপ করে ফেলল। ইশার সাথে আর কথা বলল না।
‘ ও একটু বেশি বেশি ভালোবাসে। এজন্য লুইচ্চা বলতে হবে? কোনোকথা নেই মিষ্টির সাথে।
ইশা হাসতে লাগল দাঁত দেখিয়ে। আদি চোখ ফিরিয়ে নিল। আদি রেহানকে কেক খাইয়ে দিল। ইশাকে খাইয়ে দিল। তারা ও রেহানকে খাইয়ে দিল।
আফি আসল ঘুম চোখে। কোমরে হাত দিয়ে এত এত আয়োজন দেখে বলল,
‘ কি সমস্যা। এত আয়োজন কার জন্য? এই মাঝরাতে কি আর কোনো কাম নাই? পরী মা কোথায়? সবাই তাকে ছাড়া এনজয় করতেছে? বাহঃ। তার মা বাবার ও তো বোধহয় খেয়াল নেই।
আদি কেক হাতে নিয়ে আফির গালে পুড়ে দেয়। বলে,
‘ আজ তোমার ছেলের জন্মদিন দাভাই। ওকে উইশ করো। আর তোমার মতো এত দরদি বড়পাপা থাকতে পরীর কথা আমরা কেন ভাববো। যাইহোক আজকের দিনে ছেলেটার সাথে খারাপ বিহেভ করোনা।

আফি বলল,
‘ কিসের জন্মদিন। সে কোনদিন হয়ছে সেটা আমরা জানি নাকি? তার পালিতা মা তারে যেদিন কোলে নিছে সেদিন জন্মদিন পালন করছে। সেইদিনটা এত আয়োজন করে পালন করার কি আছে? আমরা না আনলে রাস্তায় তার জন্মদিন পালন হতো।

আদি ক্ষেপে গেল। রেহান বলল,
‘ চাচ্চু প্লিজ। আমার এসব ভালো লাগছেনা।

ইশা বলল,
‘ গায়ের জ্বর তো এখনো কমেনি। ডক্টর আপনি দেখেছেন?

আদি ইশার সাথে কোনোকথা বলল না। রেহানের কপালে হাত দিয়ে বলল,
‘ একটু ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করো। কাল সকালেই তো বেরোতে হবে।

রেহান চলে গেল। আদি আফিকে বলল,

‘ রাস্তার ছেলে, ফকিরের ছেলে কাকে বলছ? পালিত সন্তান কাকে বলছ? রেহানকে? নিজেকে আয়নায় একবার ভালো করে দেখেছ? তুমি কোথা থেকে উঠে এসেছ? তুমি ও তো পালিত সন্তান। তুমি ও তো এবাড়ির কেউ নও। তোমাকে ও দত্তক নিয়েছিল আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী। সন্তানস্নেহে তোমাকে মানুষ করেছে। তোমার চাওয়াপাওয়াকে মূল্য দিয়েছে। তোমার নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েছে। তুমি যা চেয়েছ তাই দিয়েছে। তোমার অন্যায় আবদার মেনে নিয়েছে। তুমি ও তো তাদের রক্ত নও।
তুমি তো রেহানের নখের ও যোগ্য ছিলেনা তখন। মদ,গাজা খেয়ে ঢলে ঢলে বাড়ি ফিরতে। রাস্তায় মেয়েদেরকে টিজ করতে। কই তখন ও তো আজিজ চৌধুরী তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেইনি?
তোমাকে নিজেদের সন্তান বলে অস্বীকার করেনি? তোমাকে বরঞ্চ আগলে রেখেছে। তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে ভালো পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তুমি কি করছ?

আফি বলল,
‘ যে কথা আজ পর্যন্ত আমার মা বাবা বলেনি সেটা তুই বলছিস?

আদি বলল,

‘ বলতে বাধ্য হয়েছি। মায়ের বাধ্য ছেলেটাকে তুমি আর কতভাবে আঘাত করবে? তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করেছ কখনো? তার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা শ্রদ্ধাটুকু দেখেছ? যার কারণে তুমি এত অপমান করা স্বত্বেও ও উঁচুগলায় একটা জবাব দেইনা। তোমাকে ও ভালোবাসে বলে, তুমি আঘাত পাও এমন কোনো কাজ করেনা। এমন কোনোকথা বলেনা।
কিন্তু তুমি কি করো? বারবার তাকে আঘাত করো। যেভাবে তার মাকে করতে। সে তো হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে, তোমার দেওয়া আঘাত সে সহ্য করে এসেছে এতগুলো বছর। কিন্তু তুমি এখন আঘাত করছ তার ছেলের উপর। চেয়ে দেখো সে সইতে না পেরে কি অবস্থা হয়েছে? তুমি এতটা পাষাণ কি করে দাভাই? তোমার ছেলে ও। রাস্তায় চলার সময় সবাই তোমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,
‘ ওই দেখ রেহান চৌধুরীর বাবা যাচ্ছে হেঁটে।
তোমার ছেলের জন্য আজ সবাই তোমাকে উঁচু পদস্থ মানুষ হিসেবে চেনে। তার আগে চিনত মদখোর গাঁজাখোর নামে।
যেই ছেলের জন্য তুমি আজ মাথা উঁচু করে চলো তাকে হাঁটতে বসতে রাস্তার ছেলে বলতে বুক কাঁপেনা। রাস্তার ছেলে ও নয়, তোমার ব্যবহার দেখে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি দাভাই রাস্তার ছেলে তুমি।

আফি বলল,
‘ তুই আমাকে বললি?
আদি বলল,
‘ হ্যা। ওকে রাস্তার ছেলে বলার আগে দুটো কথা মনে রাখবে। এক, ও তোমার নয়, আমাদের ছেলে। এ বাড়ির প্রাণ। আর দুই, ও আমার মেয়ের বর। তাকে এভাবে অপমান করলে আমি সহ্য করব না। হয়ত তুমি থাকবে এ বাড়িতে, নয়ত আমরা।

আফি মাথায় হাত দিল। সোফায় বসে বলল,
‘ তুই পিহু মা র সামনে আমাকে মদখোর বলতে পারলি? আমি রাস্তার ছেলে বলতে পারলি? আমি এ বাড়ির কেউ না?

আদি গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। ইশা তার পিছু পিছু গেল। আদি ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিতে গিয়ে বলল,
‘ বেরিয়ে যাও আমার রুম থেকে। লুইচ্চা মানুষের সাথে থাকলে তোমার রুচিতে বাঁধবে না?
ইশা অবাক হলো। একটা সামান্য কথায় এভাবে রাগ করতে হয়? এ ডক্টরটা কি পাগল?
আদি ধমকে উঠল,
‘ যাও। সরো। দরজা বন্ধ করি।
ইশা সরে দাঁড়াল। আদি তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। বেশিকিছুক্ষণ পার হয়ে গেলে ও যখন দেখল ইশা দরজায় টোকা দিল না আদির আর ও রাগ বাড়ল। সে চেঁচিয়ে বলল,
‘ কারো যদি ইচ্ছে হয় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে, তাহলে থাকুক। রুমে ডুকলে আজ খবর আছে।
ইশা বলল, ডুকব না। ঘুমোবো না। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব।
আদি ধুমধাম ওয়ারড্রব খুলল। আওয়াজ করে শুনিয়ে শুনিয়ে সব কাজ করতে লাগল। ইশা দরজা ধাক্কাল না তারপর ও। আদির আর ও রাগ বাড়ল। বলল,
‘ কেউ কি আসবে নাকি আমি বাইরে ঘুমোবে ?
ইশার আওয়াজ এল না। আদি ডাকল,
‘ মিষ্টি,,,,,,,,
ইশার আওয়াজ তারপর ও এলনা। আদি আর ও জোরে ডাকল,
‘ এই মিষ্টি? তোমাকে আমি,,,
আদি দরজা খুলল। হেঁটে বারান্দায় গেল। দেখল ইশা বারান্দার চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছে। আদি তাকে কোলে তুলে নিল। বলল,
‘ এই মহিলা,,, এটা কি ঘুমোনোর জায়গা??? ইশা পিটপিট করে চোখ খুলল। খিক করে হেসে দিল। আদি হাঁটা থামিয়ে দিল।
ইশা গলা জড়িয়ে ধরল তার । গলায় নাক ঘষে ঘষে বলে,
‘ এই লুইচ্চা ডাক্তারকেই আমি বেশি ভালোবাসি। বেশি বেশি।
আদি আবার হাঁটা ধরল। ইশাকে বিছানায় ধপ করে বসিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আর আমি? দিনশেষে এই অসভ্য মহিলাটাকে ভালোবাসতে যাই। সারাক্ষণ বেয়াদব লোক,নির্লজ্জ লোক, লুইচ্চা ডাকতে থাকে।
ইশা হাসতে হাসতে বিছানায় ঢলে পড়ল। আদি তার দিকে বালিশ ছুড়ে মারল। বলল,
‘ একদম হাসবে না মিষ্টি।
ইশা হো হো করে হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ল।

_____________

সকালের ব্রেকফাস্টের সময় রেহান কিছু খেতে চাইল না। জ্বরের কারণে মুখে অরুচি। ইশা বলল,
‘ ঝাল কিছু খাও। ভালো লাগবে। কিছু না খেলে তো ঔষধ খেতে পারবেনা?
রেহান মাথা দুলাল। এক হাত দিয়ে মুখে মুছে নিল। চোখদুটো এখনো জ্বলজ্বলে। বলল,
‘ পরে খাব কাকিয়া। এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছেনা।
পিহুর হাত থেকে জেলির বোতল কেড়ে নিল মাহিদ। বলল,
‘ একা একা লইয়্যা বইসা আছা ক্যান?? বড় ভাই বইস্যা আছে তোর পাশে তোর খবর নাই?
পিহু বোতলটা দিয়ে দিল মাহিদকে। বিড়বিড় করে বলল,
‘ আরেকবার ভাই ভাই করলে বোতলটা দিয়ে মাথা পাঠায় ফেলব।
মাহিদ বলল,
‘ জোরে কহ কি কইতাছোস? মিনমিন মার্কা আমার সামনে কইবি না খবরদার।
পিহু খাবার টেবিলে কোনো ঝামেলা চাইল না। চুপচাপ খেতে লাগল। মাহিদ এক চেয়ার খালি রেখে বসল খেতে। বলল,
‘ তুই বাপের লগে খাইতে মন চায়না। নজর দিয়া আমার পেট খারাপ করবি। সবকিছুতেই তোর নজর দেওয়া লাগে। তুই হিরোর পাশে বইসা খাওনের যোগ্যতা রাখস না।
পিহু চুপচাপ খেতে লাগল। মাহিদ বলল,
‘ তুই এত ভাব লস ক্যান বাপ?
পিহু একদম চুপ থাকল। মাহিদ বোতলটা দিয়ে মারল পিহুকে।
পিহু টলমলে চোখে তাকাল। টু শব্দ করল না।
মাহিদ অবাক।
‘ এই ডক্টরের বাচ্চির হলো কি?
পরী আসল আদির পিছু পিছু। আদি চেয়ার টেনে বসল। রেহানকে বলল,
‘ এখন কেমন ফিল হচ্ছে??
রেহান মাথা তুলতেই পরীকে দেখল। তারপর আদিকে বলল,
‘ বেটার দেন বিফো ‘ র।
পরী চেয়ার টেনে আদির পাশে বসল। ইশা পরীকে খেতে দিল। পরী হাত নাড়ল না। আদি বলল,
‘ চোখমুখ এমন কেন পরী? কেঁদেছ?
পরী চমকাল। সবাই পরীর দিকে উৎসুক হয়ে তাকাল। শুধু একজন ছাড়া। পরী বলল,
‘ নাআআআ।
আদি বলল,
‘ না বললেই হলো? তুমি কেঁদেছ তা তোমার চোখমুখ বলে দিচ্ছে।
পরী চুপ থাকল। মাহিদ বলল,
‘ এইখানে আইসা তুমি এত ছিঁচকাঁদুনে হইয়া গেলা ক্যান? আমাগো এখানে থাকতে তো বহুত ভালা ছিলা। ছিঁচকাঁদুনে মাইয়্যাগুলারে আমার অসহ্য লাগে। সারাক্ষণ প্যাঁ প্যাঁ। পরী মাহিদকে ধমক দিল। বলল,
‘ মাহি?
মাহিদ চুপ হয়ে গেল। বলল,
‘ ঠিক আছে বাপ। আর কিছু কইতাম না। আমি আজ চইলা যামু। তখন আবার ভাই ভাই কইরা কাইন্দো না। আমার পড়ালেখার বিরাট ক্ষতি হইতাছে। ভালা ভার্সিটিতে এডমিশন না পাইলে বউ পাইতে কেয়ামত হইব।
সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠল। আদি বলল,
‘ ঠিক ঠিক। ভালো বউ পাওয়ার জন্য হলে ও ভালো করে পড়তে হবে। মাহির কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
মাহিদের প্রশংসা করায় তার দাম যেন বেড়ে গেল। শার্টের কলার ঝাকিয়ে পেছনে করে শার্টের গুটাতে গুটাতে বলল,
‘ এতদিন পর একটা ভালা কথায় সাপোট করলেন ডক্টর সাহেব। গুড। গুড ইমপ্রুভ।
ইশা হেসে উঠে বলল,
‘ একটু খাবার ও কি মুখে দিয়েছিস? বসছিস পর্যন্ত বকবক করে গেলি।
মাহিদ বলল,
‘ এইখানে কিছু মাইনষ্যের খাওন দেইখ্যা আমার পেট বাপ আর খাইব না কয় দিছে।
পিহু রেগেমেগে তাকাল মাহিদের দিকে। মাহিদ বলল,
‘ না পেট বাপের কথা হুইনা লাভ নাই। পেট ভাবের একটু ভাব বেশি। তার ভাবের গুষ্ঠিরে কিলাই।
ইশা পরীকে খাইয়ে দিতে দিতে হাসল। বলল,
‘ তুই বাড়িতে রিপদার সামনে এতকথা বলতে পারিস?
মাহিদ নড়েচড়ে আয়েশ করে বসে বলল,
‘ তোমার ভাইটা একটা খাটাশ। ব্যারিস্টারি ঘরে দেখায়। শালার বাপ। সারাক্ষণ আমার সাথে খ্যাঁক খ্যাঁক করতে থাকে।
আদি ইশা একসাথে হেসে উঠল। রেহান ও হেসে উঠল। হাসতে হাসতে আবার থেমে গেল ওই মুখটি দেখে। রেহান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আদি বলল,
‘ খাওয়া শেষ?
রেহান মাথা নাড়ল। তারপর নিজের রুমে চলে গেল।
হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে আদি পরীকে ডাকল। বলল,
‘ তুমি আজ ভার্সিটিতে যাবে বলেছ চলো আমাদের সাথে।
রেহান যেতে যেতে থমকাল। পিছু ফিরে পরীকে দেখল। আবার আদিকে বলল,
‘ চাচ্চু তুমি এসো। আমি বাইরে আছি।
আদি মাথা নাড়াল। পরী বলল,
‘ আমি যাব না।
আদি বলল, কি হয়েছে। কারো উপর রেগে আছ মনে হচ্ছে।

গা হেলিয়ে দুলিয়ে মাহিদ আসল। সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলল,
‘ কাল রেহান কেক কাটতে ডাকে নাই তো, তাই রেগে আছে। রেহান ভাই কামডা কি ঠিক করল? একমাত্র বউ ছাড়া জন্মদিন সেলিব্রেট করল। বউ আর দুই তিনটা থাকলে একটা কথা।
পরী অবাক হলো।
‘ এই ছেলেটা কি তার মন পড়তে পারে? ভাগ্যিস রেহানের সামনে কিছু বলেনি।
পরী বলল, মিথ্যা কথা। উল্টাপাল্টা বলবি না মাহি।

রেহান মাত্রই বাইরে পা দিতে চেয়েছিল। কথাটা শুনে থমকে গেল। আবার এসে বলল, চাচ্চু তাড়াতাড়ি এসো।
মাহিদ জিহ্বায় কামর দিল। ইশশরে রেহান ভাই সব শুইনা ফেলছে?

তারপরে আবার ভয় কাটিয়ে বলল,
‘ রেহান ভাই হুনছেন ভালা কথা। এইবার থাইকা যেটাই করেন বউরে লইয়া করেন। আপনার বউডা বুমমমম। মুখে কিছু কইবো না। রাগে ফুলতে ফুলতে ফুঁস কইরা ফাইটা যাইব। তখন সবাই আপনারে রাস্তায় দেখলে বুমমমের জামাই ডাকব।
পরী চোখ রাঙিয়ে তাকাল মাহিদের দিকে। মাহিদ রেহানের পিছু গিয়ে দাঁড়াল। বলল,
‘ ভাই দোষ করছেন আপনে। মাইর খামু আমি এটা কি সঠিক বিচার? আপনে কন?
রেহান আদিকে বলল,
‘ চাচ্চু দেরী হয়ে যাচ্ছে। আদি হু করে আওয়াজ করল। রেহান বেরিয়ে গেল।
আদি পরীর দিকে তাকাল। বলল,
‘ তোমার উচিত ছিল সবার আগে ওঁকে উইশ করা। তুমি করোনি, তাই হয়ত ও তোমাকে ডাকেনি। যাইহোক কি চাইছ সেটা তোমরা ডিসাইড করে নাও। সম্পর্কটা কি আগাবে,নাকি এখানেই?
পরী নাকের উপর হাত দিয়ে ঘষা মারল। চোখের তাজা তাজা গরম জল মিশে গেল গালে। নাক টানতে টানতে উপরে চলে গেল।

______________

রেহান হসপিটালে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আধঘন্টার মধ্যে রাইনার জ্ঞান ফিরল। আদি সব রিপোর্ট চেক করার পর জানাল, রাইনার বাম পা প্যারালাইজড। রাইনা অবাক হলোনা। হাসিমুখে গ্রহণ করে নিল। বলল,
‘ হুইলচেয়ার এখন আমার ভরসা।
রেহান শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রাইনাকে। বলল,
‘ মা তুমি আমার পায়ে ভর দিয়ে হাঁটবে। তুমি হাঁটতে পারবেনা এটা আমি ভাবতে পারছিনা। আমি মানতে পারছিনা।
আদি বলল,
‘ সিরিয়াস কিছু নয় রেহান। তোমার মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন। বাম পায়ে স্পাইনাল কর্ডের টিসুতে চাপ পড়ার কারণে প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছে। পেনটস্রিফাইলিন, ভিমপোসিটিন, এসপিরিন নিতে হবে নিয়মিত। সবকিছু ঠিকঠাক চললে দেড় দুইমাসে পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। সোজা বাসায় নিয়ে যাবে। মিষ্টি,পরী, পিহু দেখাশোনা করবে। যত্নের অভাব হবেনা। তুমি তো আছই।
রেহান রাইনাকে বাসায় নিয়ে গেল। ইশা আর পিহু রাইনাকে বাড়ি ফিরতে দেখে খুশি হলো। আফি দূরে দূরে থাকল। পরী সারাটাদিন ঘর থেকে বের হলোনা। রাতে যখন দেখল রেহান বের হয়েছে বাড়ি থেকে। চুপিসারে ডুকে পড়ল রাইনার রুমে। রাইনা মাত্রই চোখবন্ধ করেছে। পরী এসে ঝাপিয়ে পড়ল তার বুকের উপর। বলল,
‘ বড়মা তুমি রেগে আছ আমার উপর?
রাইনা অন্যদিকে মুখ করে বলল,
‘ এসেছি দুপুরবেলা। দেখতে এসেছিস রাতে? না রেগে নেই। তুই কে আমার?
পরী শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ তোমার ছেলে তো আঠার মতো লেগে থাকে। আমি আসতাম কি করে?
রাইনা বলল, কেন? আমার ছেলে থাকা অবস্থায় আসলে কি হয়েছে? রাস্তার ছেলেদের মুখোমুখি হতে ভালোলাগেনা তাই না?
পরী বলল,
‘ তোমার ছেলে আমাকে ডাকেনি কেক কাটার সময়। আমি কষ্ট পেয়েছি ভীষণ। রাস্তার ছেলে কখন বললাম?
রাইনা হাসল। বলল, আমার ছেলে তোকে ডাকেনি,তুই তাকে সহ্য করতে পারিস না তাই। তোর কেন কষ্ট হবে?
পরী কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর রেহান এল। মা বলে ডেকে রুমে ডুকার সাথে সাথে চোখ কপালে উঠল। পরী রাইনাকে চেপে ধরল। বলল, আমাকে যদি এখন বের করে দেই? বড় মা??
রেহান ঠিক সেটাই করল। হাত ধরে রুম থেকে বের করে দিল। মুখের উপর দরজা বন্ধ করার সময় বলল,
‘ আমার মায়ের এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ী। লজ্জা হওয়া উচিত তোমার । আমার মাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবে না একদম। তোমার দয়া চাইনা আমার।
রাইনা ডাক দিল।
‘ কি করছিস রেহান? কেন করছিস?
রেহান দরজা বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাইনার দিকে তাকাল রাগী চোখে। বলল,
‘ তুমি ও বলবে নাকি রাস্তার ছেলে হয়ে কার সাথে এভাবে কথা বলছিস? বলতে ইচ্ছে হলে বলে দাও। আমার গায়ে লাগেনা এখন। সহ্য হয়ে গেছে।
রাইনা ডাক দিল, রেহান?
কিছুক্ষণ পর রেহান রাইনার সাথে কথা না বলে বেরিয়ে পড়ল। মা টা ও তার পক্ষে কথা বলেনা আজকাল।
রেহানন বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইকে চেপে বসতে তাকাল ওই ছাদের উপর। আলো আঁধারিতে একটি মেয়ের অবয়ব দেখা যাচ্ছে মৃদুমৃদু আলোয়। ঘনঘন চোখ মুছছে মেয়েটি। রেহানকে দেখার সাথে সরে গেল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here