মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_১৪(সিজন ২)

0
682

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৪(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

পরী হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। রেহান আর ও শক্ত করে ধরল। পরী রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল,
‘ বাবা সাজার খুব শখ না?
রেহান ঠোঁট এলিয়ে হাসল। বলল,
‘ খুবব। বউ নাই তাই পূরণ হচ্ছেনা।
পরী ফুঁসে উঠল। বলল,
‘ আলগা পিরিত।
রেহান বলল
‘ একদম নয়।
পরী বলল,
‘ বেঁচে আছি কিনা সেটা একবার ও খোঁজ নিয়েছেন? এখন আলগা পিরিত দেখাতে আসছেন?
রেহান আবার হাসল। বলল,
‘ মাহিদ সাহেব থাকতে খোঁজ নিতে হয়না।
অটোমেটিক চলে আসে। এমনকি ভেতরের খবর ও। চারদেওয়ালের মাঝে কেউ একজন নাকি ফে ফু করে কাঁদে সেসব ও আসে।
পরী অবাক হয়ে রইল। চেঁচিয়ে ডাকল মাহি?????
মাহিদ তখন বাচ্চা ছেলেটিকে একহাত তুলে উপরে ঝুলিয়ে রাখল। বলল,
‘ শালার বাচ্চা আর পুঁচা আন্কেল বলবি? বল? আর বলবি?
রেহান পিছু ফিরে এই অবস্থা দেখে মাহিদকে ডাক দিল। মেয়ে বাচ্চাটি মাহিদের পা জড়িয়ে ধরে কামড় বসাইতে চাইল। তার ভাইকে মারছে কেন পুঁচা আন্কেল।
মাহিদের সুড়সুড়ি লাগল। মাহিদ সাথে সাথে ছেলেটিকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ শালার সুড়সুড়ি। এত গায়ে লাগোস ক্যান বাপ?
বাচ্চা ছেলেটি তার এক হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
‘ পুঁচা আন্কেল ভিলেন। পুঁচা আন্কেল ভিলেন।
মাহিদ এক পা দুম করে মাটিতে ফেলে রেগে বলল,
‘ শালার বাচ্চা আমারে হিরো কইবি বাপ। হিরো ডাক বাপ।
রেহান ডাকল, মাহিদ এদিকে এসো। বাচ্চাদের সাথে কি শুরু করেছ?

মাহিদ শার্টের কলার পেছনে ঠেলে হিরোর মতো হেঁটে হেঁটে আসল। বলল,
‘ সব কাজে হিরো মাহিদ খানকে কেন লাগে বাপ? তারে ছাড়া কি চলে না?
রেহান হাসল। বলল,
‘ হিরোকে ছাড়া আমরা জিরো বাপ।
মাহিদ ঠোঁট ভেঙে হাসল। বলল,
‘ ঠিক ঠিক। এখন কি চাই? বউয়ের লগে কি আবার আমারে বউ সাইজা যাইতে হইব?
রেহান বলল, ঠিক ধরেছ। চলো।
পরীর রাগ আকাশ ছুঁল। এতদিন ভুলে ও একটা ফোন দেয়নি। খোঁজ নেইনি। এখন নিয়ে যেতে এসেছে?
পরী রেহানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, যাবোনা আমি। আপনি যান।
পরী হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। মাহিদ তার অন্য হাত ধরে রেহানকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ওই হাতটা ছাইড়া দেন বাপ। অন্য হাত আছে কিল্লাইগা? এটা না ধরলে ওটা ধরবেন। ওটা না ধরলে এটা ধরবেন। ব্যস। বউ আপনার ভালা, রাগ বেশি আর কি। বুঝেন না?
রেহান বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়াল। বলল, বুঝেছি,বুঝেছি।

পরীকে জোর করে গাড়িতে বসাল মাহিদ। বলল,
‘ ভাইডারে জ্বালায় খাইতাছো কেন বাপ? এট্টু মায়াটায়া হয়না? তোমার জ্বালায় বিষ খাইয়া পটল তুলতে যাইতে ইচ্ছা করতাছে বাপ। বুঝোনা ক্যান? মাহিদ খানের কত কাজ পইড়া আছে।
পরী ঠোঁট বাকিয়ে কাঁদল। বলল, তুই সর। কথা বলবি না আমার সাথে।
মাহিদ সাথে সাথে সরে গিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসল। বলল,

‘ যাইতাছি শ্বশুড়বাড়ি
সাথে নিয়া নতুন দাড়ি
চইড়া চইড়া মার্সিডিজ গাড়ি
আহা খুশিতে আমি কি আর করি?

রেহান হাসল। বলল,
‘ দাড়িতে ভালোই লাগছে মাহি। গুড গুড। হিরোর মতো লাগছে।
মাহিদ নড়েচড়ে সাহেবের মতো করে বসল। বলল,

‘ বাপ আমার বড্ড জ্বালায়
দাড়ি রাখন ফরজ,
বুঝেনা ব্যারিস্টার শালায়।

পরী ধমক দিল।
‘ মাহি চুপ করে বোস। ভাল্লাগেনা।
মাহিদ হো হো করে হাসল। বলল,

‘ আমার এসব কিছুই ভালো লাগেনা
বর আর আমার মাঝে ভাইডা কেন এল বুঝিনা।
এট্টু রোমাঞ্চ ও জমেনা।
আহা কি দুক্কু।

পরী নিজের মাথা গাড়ির কাচের সাথে বাড়ি লাগাল। রেহান মিটিমিটি হাসল। পরী বলল, মাথা ফেটে ফেলব। আরেকবার উল্টাপাল্টা কথা বললে।
মাহিদ বলল,
‘ না না আর কিছু কমুনা বাপ। মাথা ফাটাইও না। আমি চুপ মেরে গেলাম। পরী শান্ত হলো।
মাহিদ বিড়বিড় করে বলল,
‘ শালার বইন।

_________________

চৌধুরী বাড়িতে আসতে না আসতেই পিহু দৌড়ে এল। পরীকে দেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল। পরী চুপ করে অনুভব করল বোনের সংস্পর্শ। পিহু বলল,
‘ আমি তোমাকে খুব খুব মিস করেছি দিদিয়া।
রেহানকে বলল,
‘ থ্যাংকস দাভাই সবার অনুরোধ রাখার জন্য।
রেহানের দিকে অগ্নিচোখে তাকাল পরী। ওহ তারমানে নিজ থেকে যায়নি। সবার অনুরোধ রাখতে গিয়েছে। রেহান আগেআগে বাড়িতে ডুকে পড়ল। ইশা দৌড়ে এল যেন। হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়ের কাছে এসে থেমে গেল। পরী নিজ থেকে জড়িয়ে ধরল ইশাকে। ডাকল, আমমা।
ইশা যেন খুশিতে কেঁদে দিল। বলল,
‘ এবার আর কোথাও যেতে দেবনা মাটাকে। রেখে দেব।
পরী বলল, বেয়াদব ছেলেটা আমাকে নিজ থেকে আনতে যায়নি। সবার অনুরোধে গিয়েছে তাই না?
ইশা বলল,
‘ সে তো অনেক আগে থেকে বলে যাচ্ছে সবাই। যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে তখন যেত। হয়ত এখন রাগ একটু কমেছে তাই গিয়েছে। তুমি আর রাগ করোনা। বরং নিজে গিয়ে রাগ ভাঙাও। দেখো দোষ তোমাদের দুজনের। অভিমান ও করেছ দুজনই। রাগ ও দুজনেরই আছে। আর এই রাগ অভিমানগুলো সম্পর্কটাকে একটু একটু করে ভাঙছে। রেহান মুখে যাই বলুক, দিনশেষে কিন্তু ও তোমাকেই ভালোবেসে যাবে। হয়ত তুমি ও।
পরী চমকে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল, আমি ও?
ইশা মৃদু হাসল। বলল, ভুল বললাম?
পরী চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকল ইশার দিকে। ইশা বলল
‘ যাই বলো তুমি,,, ছোট্ট পরী কিন্তু নেআানকেই ভালোবাসত। তখন কি ও জানত নাকি ভালোবাসা কাকে বলে? কিন্তু তারপরে ও তো নেআনকে সে মিস করত। ভালোবাসতে ভালোবাসার সংজ্ঞা জানতে হয়না।

মিননি যদি থাকত তাহলে সবার আগে সে বলে উঠত, পরী বউ রেহান বর।
পরী বলল, মিননি ও জানত??
আমমা আমি মিননিকে খুব মিস করছি।
ইশা পরীর মুখ হাতে আগলে ধরে বলল,
‘ তুমি নও আমি ও মিস করছি। তার চাইতে বড় কথা তোমার আব্বা আর ও বেশি মিস করছে। তুমি জানো মিনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা রিপদার পরে আমি মিনির পেয়েছি। মিনি আমাকে খুব বেশিই ভালোবাসত। তাই তিনবছর পর ও যখন সে আমাকে প্রথম রাস্তায় দেখেছিল চিনে ফেলেছিল। ডক্টর তখন চেনেনি। যাইহোক অনেক কথাই বলে ফেলেছি। চলো ভেতরে যাই।
পরী ইশার ভিজে উঠা চোখ দেখে ঝাপটে আবার জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ আমমা তোমার তখন খুব কষ্ট হতো তাইনা? আববা তোমায় কি করে ভুলে যেতে পারল?
ইশা বলল, ধুর পাগলী কে বলেছে আমার কষ্ট হতো। আমার তো একটা মা ছিল তখন। তার মুখের দিকে তাকালেই সব কষ্ট দূর হয়ে যেত। একটু ও কষ্ট হতোনা আমার।
পরী তাকে জোরে চেপে ধরল। বলল,
‘ আমমা আমি তোমাকে আববাকে,পাপা মাম্মা,ছোট পাপা আর ছোটমাকে খুব ভালোবাসি। বড়মা আর বড়পাপাকে ও খুব খুব ভালোবাসি। আমি

মাহিদ গাড়ির দরজা খুলে এতক্ষণ পর বের হয়ে এল। চোখে কালো চশমা। এক মাটিতে আরেক পা গাড়িতে রেখে উঁকি দিল বাইরে। হিরোদের মতো বসে বলল, হ আমরা উগান্ডা থেইকা আইছি। সবাইরে ভালা টালা বাসো। আমি, ডাক্তারের বাচ্চি আর রেহান ভাই কি মারা গেছি। মারা গেলে ইন্নালিল্লাহ পড়ো বাপ।
পিহু চোখ বড় বড় করে তাকাল। ইশা আর পরী খিক করে হেসে দিল। পিহু ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ ওলেবাবা হিরো মাহিদ খান। আপনি ও আসছেন? দাড়ি,কালা চশমায় তো আপনাকে চেনা যাচ্ছে না। বাহঃ।
মাহিদ গাড়ি থেকে নেমে এল। চশমা খুলে সামনের শার্টের কাছে ঝুলিয়ে রাখল। চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়িয়ে ইশাকে বলল,
‘ ফুপী তোমার বাচ্চিরে কও আমি ভালা মানুষ। ঝগড়া টগড়া করিনা বাপ। আমার সাথে ঝগড়া করতে বারণ কইরা দেও বাপের বইন।
ইশা মাহিদের মাথায় চাটি মারল। বলল, তোর দুষ্টামি গেলনা মাহি।
মাহিদ ঠোঁট এলিয়ে হাসল। বলল, আমি ভালা মানুষ বাপ। এই শালীর লাইগা ভালা থাহিত পারিনা। আমারে দেখলে তার। জততভমথজগৃবৃও বাপ।
পিহু মুখ ভাঙাল। বলল, মাহিদ খান নামটিই একটা এলার্জি। শুনলোই গা চুলকায়। আর নামটা উচ্চারণ করলে তো গলা চুলকায়। বাপরে বাপ।
মাহিদ হেলিয়ে দুলিয়ে ডুকে পড়ল চৌধুরী বাড়িতে। আফিকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরল। আফি বলল,
‘ হিরো মহাশয় এসেছেন? আসেন। আসেন।
মাহিদ বলল,
‘ হ ভাই আইছি। তবে চইলা যামুগা বাপ। আমার বহুত কাজ।
পিহু বলল,
‘ কিছুক্ষণ ভাই আবার কিছুক্ষণ বাপ ডাকো। তোমার সমস্যা কি মাহিদ ভাই? বড়পাপা কি তোমার বাপ ভাই লাগে?
মাহিদ রাগল। কিন্তু হজম করল বহুকষ্টে। বলল,
‘ তোর পঁচা নাক যেখানে সেখাতে গলাতে আসিস ক্যান বাপ? দূরে গিয়ে গলা না।
পিহু নিজের নাক ধরল। বলল, আমার নাক পঁচতে যাবে কেন? মুখ সামলায় কথা বলো মাহিদ ভাই।

মাহিদ হাত নেড়ে বলল,
‘ ধুররর তোর সাথে কথা বলতে কে যাই বাপ? আমার সাথে লাগতে আসিস ক্যান সবসময়??

পিহু মুখ ভাঙাল। চুল নাড়তে নাড়তে চলে গেল। আয়নার সামনে সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ মাহিদ ভাইয়ের চাইতে আমি বেশি সুন্দর। হুহহ।

পরক্ষণে লজ্জায় নিজে নিজে মরল। ধুরর ওই ছেলেটাকে দেখলে তার এত লজ্জা লজ্জা পায় কেন? বেয়াদবটা বুঝে ও না। হুটহাট হাত ধরে টেনে টেনে যখন নিয়ে যায় তখন ও তো লজ্জা হয় ভীষণ। হুটহাট হাত ধরবে, গালে মারবে, মাথায় মারবে। উফ পিহুর তখন ভারী লজ্জা হয়। যার কারণে মাইরগুলোকে মাইর মনে হয়না।
পিহু নিজেকে আয়নায় খেয়াল করল। দেখল নাকের মাথা টকটকে লাল লাল দেখাচ্ছে। ধুরর লজ্জা পাওয়ার সাথে নাকের মাথা লাল হওয়ার কোনো বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি নেই। এসব গাঁজাখুরি অযৌক্তিক মার্কা কথা পিহু বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হয়ে মানে না। মানা ঠিক ও নয়। কিন্তু মাহিদ ভাইয়ের জন্য যেমন অযৌক্তিক মার্কা কথা বলে বেড়ায়, ঠিক তেমন পিহুর সাথে এমন আজগুবি আজগুবি অযোক্তিক ব্যাপার ঘটে। নাকের মাথা লাল হওয়া ও অযৌক্তিক ব্যাপারগুলোর মধ্যে একটা।
পিহু আয়নায় নিজেকে দেখে বলল,
‘ এই পিহুর বাচ্চা শোন নাকের মাথা লাল কেন হয়েছে সেটা না ভেবে, নাকের মাথা যার কারণে লাল হয়েছে তাকে নিয়ে ভাব। বেশি বেশি ভাব। ভেবে ভেবে মরে যাহ। একদম মরে যাহ।

মাহিদ তার রুমের দরজায় টোকা মেরে চলে যেতে যেতে বলল,
‘ তুই বাপ আবার কারে মাইরা ফেলতাছোস?
পিহু নিজেকে আয়নার সামনে শক্ত করে দাঁড় করাল। মাথায় নিজের হাত দিয়ে চাপড় মেরে বলল,
‘ ওই ব্যাটাকে তুই আর ভাববি না পিহু। ভাববি না। দেখ ভাবার কথা বলতে না বলতে ব্যাটা এসে হাজির। তোর রাতের ঘুম হারাম করার জন্য ব্যাটাকে চরম মূল্য দিতে হবে।
পিহু শোন তুই একচুল ও ছাড় দিবিনা তাকে। বুঝেছিস।
আয়না থেকে কোনো আওয়াজ এল না। পিহু হাতের চিরুনি আয়নায় ছুড়ে মেরে বলল,
‘ কথা কস না ক্যান বাপ????
পরে আবার নিজের চুল নিজেই টেনে ধরল। বলল,
‘ উফফ এই পাগলটা মেরে ফেলবে আমাকে। মরে যাচ্ছি আমি। মাহিদ্দের বাচ্চার ভ্যা ভ্যা।

________________

রেহান গেল যে আর এল না। পরী রাইনার কাছে ইনিয়েবিনিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ বড়মা তোমার ছেলে রাতে খাবে না? তুমি খেয়ে নিয়েছ কেন? তুমি তো তাকে ছাড়া খাও না।
রাইনা বলল,
‘ ওর অফিসে ওকে থাকার জন্য বাসা দিয়েছে। ওখানেই থাকে। সপ্তাহে দুবার। আসা যাওয়ায় সমস্যা তাই আমি আসতে বারন করি। আমাকে দেখার জন্য তো তোর মা আর পিহু আছে। এখন ছেলের বউ ও চলে এসেছে। চিন্তা কিসের?
পরীর মন খারাপ হয়ে গেল। ওই ব্যাটাকে কাছে পেলে এক্ষুণি সে জবাই করত। রাইনা বলল,
‘ হঠাৎ আমার ছেলেকে মিস করছিস নাকি?
পরী ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল,
‘ না না না একদম না।
রাইনা হাসল। বলল,
‘ যাহ ঘুমিয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে। যাহ।
পরী হনহন পায়ে হেঁটে চলে গেল। কি আশ্চর্য!!!

সে কি কেউ নয়। বউ মানেনা তাহলে ফিরিয়ে এনেছে কেন? হাতের কাছে একবার ফেলে মেরে ফেলবে।
ভাবতে ভাবতে চোখ গেল বিছানার উপর পড়ে থাকা ফোনের উপর। ফোন হাতে নিয়ে ফটাফট ফোন দিল। দু তিনবার রিং হয়ে গেলে ও কারো খোঁজখবর নেই। চারবার দেওয়ার আগে সেদিক থেকে কলব্যাক এল। হাসির কিংবা অনুতাপের গলা শোনা গেল না। যা শোনা গেল তা হলো কর্কশ।
পরী থমকে গেল। রেহান বলল,
‘ সমস্যা কি? রিসিভ যখন করছিনা তখন তো বুঝা উচিত যে কাজে বিজি আছি। নাকি এটা ভেবে রেখেছ যে আমি সারাদিন তোমার মতো ফূর্তি করায় ব্যস্ত থাকি। এসেছ ভালো কথা। নিজ থেকে তো আসোনি। আমাকে গিয়ে আনতে হয়েছে। আমার মাথাটাই নিচু করতে হয়েছে। তুমি তো করোনি। তোমার কাছে তোমার জেদটাই সব। আর আমার কোনোকিছুর মূল্য নেই। চাপে পড়ে তোমাকে আনতে হয়েছে। আমার আর কিচ্ছুই করার ছিল না। তা বলে এটা ভেবে রেখোনা, তোমার জন্য আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। কিংবা তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। আমার দিনগুলো বেশ ভালো কাটছে। তোমাকে ছাড়া। তুমিহীন।
নিজ থেকে আমাকে একটিবার সরি বলেছ??
তোমার কারণে কতবার আমাকে অপদস্থ হতে হয়েছে। প্রতিটা পদে পদে হতে হয়েছে অপমানিত। এমনকি কাল ও। আফি চৌধুরী বলেছে তোমাকে ফিরিয়ে না আনলে আমার মাকে থাকতে দেবে না সেই বাড়ি। বের করে দেবে আমাকে সহ। মায়ের এই অবস্থায় আমি কি করতাম?
কাকিয়ার কাছে আছে বিধায় মা ভালো দুটো রান্না খেতে পারছে। পিহু আছে বলে সেবা পাচ্ছে। তাকে যদি অন্য বাসায় রাখতাম আমি তাহলে কি হতো? বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে মা আর ও অসুস্থ হয়ে পড়ত। মায়ের জন্য হলেও আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছি। কিন্তু সেখানে ও তোমার নাটক। না, তুমি আসবে না।
তোমার জেদ তুমি, আমি গিয়েছি তোমাকে আনতে তারপরে ও আসবে না। মা কি জিনিস বুঝো পরী? এই মায়ের জন্য আমি এতকিছু সহ্য করছি মুখবুজে। হাসিমুখে সব মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। শুধু মায়ের জন্য। কারণ এই মা ছাড়া এই পুরো পৃথিবীটাতে আমার আপন বলতে কেউ নেই। আমি নিজে ভালো থাকার জন্য আমার মাকে চাই। আমার মাকে আমি যেকোনো মূল্যে ভালো রাখতে চাই। যদি হয় তোমার সাথে অভিনয় ও। তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভালোবাসার চেষ্টা করেছিলে না?

দেখো বিধি ঠিক সেটাই কবুল করে নিয়েছে। আজ আমার মাকে ভালো রাখার চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমার তোমাকে ইউজ করতে হচ্ছে। তাও তোমাকে বলে বলে। আমি দুঃখিত পরী। তুমি এসময় আমায় বিরক্ত না করলে এতকথা শুনতে হতোনা। সো আমাকে ফোন দিওনা। দূরে থাকার চেষ্টা করো।

পরী কেঁদে দিল আওয়াজ করে। ফোনটা ও কেটে দিল তাড়াতাড়ি। ওয়াশরুমে গিয়ে ঘনঘন পানির ঝাপটা দিল মুখে।

‘ তার কথা না শুনে, না বুঝে কতকথা শুনিয়ে দিল। অথচ তার এককথায় সে এই বাড়ি ফিরে এসেছে। একটু রাগ সে দেখাতেই পারে। সে এমন না বুঝলে বিয়ে করতে গেল কেন??

পরী বিছানায় এসে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। সারারাত ওই শক্তপোক্ত কথাগুলো তাকে ঘুমাতে দিল না। নিজেকে নিজের দোষ গুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগল। সে আবার ও রেগে যাচ্ছে কেন? এই রাগ তার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছে। সবটা।

___________________

নীরা শোয়া থেকে উঠে পড়ল। রুমটা আলোকিত। ঘুমঘুম চোখে গালি দিল ওই চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে লিখতে থাকা মানুষটাকে। রাতের নিঃশব্দে কলমের প্যাঁচপ্যাঁচ শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে নীরা। বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ এই লোকটা নিজে ঘুমাবেনা। আমাকে ও ঘুমাতে দেবে না। সারাক্ষণ কাগজে প্যাঁচপুঁচ কি লিখে আল্লায় জানে। এসব ব্যারিস্টারির গুলিমার। একটা রিকশাওয়ালাকে বিয়ে করলে আমার এত দুর্দশা হতোনা। সারাদিন রিকশায় ঘুরতাম। আর রাতে একটু ভালো করে ঘুমাতাম।

ভেসে এল শান্ত কন্ঠস্বর নীরার কানে।

‘ এখনো যুবতীদের মতো সুন্দর আছ। বিয়ে দেব নাকি? পাত্র দেখব?

নীরা কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। সুন্দর বলেছে সেজন্য লজ্জা পাচ্ছে। আবার বিয়ে দেবে বলছে সেজন্য লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে মাথা পাঠাই ফেলতে ইচ্ছে করছে।

রিপ বলল,

‘ কি হলো চুপ হয়ে গেলে কেন?

নীরা ধপ করে বিছানায় শুয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ লাইট জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম আসেনা ব্যারিস্টার । আপনি কখন ঘুমোবেন? আসুন না।

রিপ বলল,
‘ আর ও আধঘন্টা লাগবে। তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।

নীরা চোখগুলো বড় বড় করে বলল,

‘ ব্যারিস্টারকে ছাড়া ঘুম আসছেনা বাপ। কয়বার কইছি?

রিপ দাঁড়িয়ে গেল বসা থেকে। নীরার দিকে এগোতে এগোতে বলল,
‘ কি বলেছ আবার বলো। কি হলো চোখ বন্ধ করলে কেন? বলো। তুমি মাহিকে এসব শিখিয়েছ না? ও এখন সুন্দর করে কথা বলতে গিয়ে আটকে যায়। ওসব হাবিজাবি কথা বলতে বলতে। তুমি কি নীরা? সারাক্ষণ বাপ বাপ। কি শুরু করেছ?

নীরা চোখ বন্ধ করে ফেলল খিঁচে। বলল,

‘ ব্যারিস্টার বাবু আমাকে এই শেষবার মাফ করুন। আর বলব না। প্রমিজ। তিনবার প্রমিজ।

রিপের রাগী চোখ শান্ত হলো। নীরার করুণ অবস্থা দেখে সে মনে মনে হাসল। আওয়াজ করল না। নীরা পিটপিট করে চোখ খুলে দেখল ব্যারিস্টার বাবু তাকিয়ে আছে অন্যরকম দৃষ্টিতে। নীরা বলল,

‘ আমি কি দেখার মতো কেউ নাকি? এভাবে কি দেখছেন??

রিপ মাথা নেড়ে বলল,

‘ দেখছি। তোমার ছেলে বড় হয়েছে অথচ তোমার বাচ্চামো গেলনা। আমাকে ঠিক আর কত কত বছর তোমার বাচ্চামো সামলাতে হবে নীরা?

নীরা হাসল নতবদনে। ব্যারিস্টারের পান্জাবীর কলার চেপে নিজের কাছে আনল। ফিসফিস করে বলল,

‘ মরণের আগ পর্যন্ত। পারবেন না?

রিপ হাসল। নীরা এতকাছ থেকে কতদিন পর যে হাসিটা দেখল?
লোকটার সবকিছু এত মোহনীয় কেন? হাসি,রাগ,অভিমান, শাসন আর ভালোবাসাগুলো। এতটা ভালোবাসে কিন্তু দেখায় না। এভাবে এতটা ভালোবাসা কি লুকোনো যায়? মাঝেমাঝে তাই তো বেরিয়ে আসে নীরার সামনে। নীরা মানেই তো রিপ। তাই নীরা বুঝে ফেলে রিপ নামক কঠিন বইটার ভাষা। একদম খুব ভালোভাবে বুঝে ফেলে। বইটার পৃষ্ঠা উল্টাতে না উল্টাতে নীরা বুঝে ফেলে ভালোবাসা হারায় না। ভালোবাসা হারায় না।
কিন্তু নীরা পারেনা। নীরা ভালোবেসে সেটা না দেখিয়ে থাকতে পারেনা। এই মানুষটা যে পুরোপুরি তার।

মাঝেমাঝে মনে হতো এই মানুষটাকে ভালোবেসে সে ভুল করেছে। কিন্তু না! এই মানুষটাকে ভালোবেসে সে ভুল করেনি বরঞ্চ লোকটারই ভুল হয়েছে তাকে ভালোবাসার সুযোগ দেওয়ার।

লোকটা কি জানত না নীরা বড্ড অবুঝ। সারাক্ষণ বাচ্চামো আর একটুখানি ভালোবাসার জন্য তাকে জ্বালিয়ে মারবে। কেন জানল না?
লোকটার জন্য তার মায়া হয়। কতটা জ্বালায় সে আর তার ছেলে। লোকটা দেখায় সে বিরক্ত হয়। সত্যি বলতে এই বাচ্চামোগুলোকেই লোকটা এতটা ভালোবাসে। কিন্তু দেখায়না। কি লোকটা! এমন কেন? নিজে নিজে ধুঁকে ধুঁকে মরে নিজের মনের কথা কাউকে বলতে না পারায়।

মাঝেমাঝে নীরাকে তো বলেই ফেলে আর না পারতে। নীরা বলে দিও তো তোমার ছেলের মা টাকে। আমি তাকে ভালোটালো বাসিনা। সে কেন বাসে? আমি ভালো বাসিনা। সে ও বাসবে না। বাসে কেন? আমার কাছে সবকিছু সমান সমান হতে হবে। দেনাপাওনার হিসাব ও সমান সমান।
তখন নীরা ফেলে,

‘ সমান সমান হলে,আপনার বেলায় কেন সমান হলোনা। আপনি দিলেন কিন্তু পেলেন না কেন? দেখুন না আমি ও ঠিক আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। দিয়েই গেলাম। কই পায়নি তো। কিছু মানুষের কপাল কি তাহলে এমনি পোড়া থাকে?
যে তাদের সমসময় দিয়েই যেতে হয়। পাওয়ার খাতাটা শূন্য পড়ে থাকে।

পরম আবেশে নীরা বন্ধ করল চোখ। রিপ একটি ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিল অর্ধাঙ্গিনীর ললাটে। তারপর পরই বেরিয়ে গেল রুম থেকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল বারান্দার কাছে।

জীবনের হিসাবগুলো মেলাতে চেষ্টা করল । তার জীবনে তার মা বাবা পরিবারের পর সত্যি তিনটা মানুষ।
যেমন ছিল তার ইশু। আজ তেমন সত্যি নীরা আর মাহিদ। প্রথম যাকে সে ভালোবেসেছিল। দ্বিতীয় তার স্ত্রী যে তাকে দুচোখ বন্ধ করে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর মাহিদ। তার সন্তান। মাঝেমাঝে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে তার। এতটা ভালোবাসে সে এই মানুষগুলোকে। কোনোদিন দেখাতে পারল না। বুঝাতে পারল না। কেন সে পারেনা? কেন সে পারেনি?
জীবনের এই এতগুলো বছর কাটাতে কাটাতে জীবন সম্পর্কে তার কত যে অভিজ্ঞতা হলো।
তার অভিজ্ঞতার ভাষা তাকে বলে,

ভালোবাসা হারায় না। ভালোবাসতে মানা নেই। ভালোবাসতে কোনোকিছু লাগেনা। ভালোবাসলে তা দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না। নীরবে নিঃশব্দে ও ভালোবাসা যায়।

যেমন সে বাসে নীরা আর মাহিদকে। বেসেছিল তার ইশুকে। আজ ও বাসে। তার জীবনের এই তিন সত্যিটাকে সে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। কিন্তু দিনশেষে নিজেকে ঋণী লাগে নীরার কাছে। নীরার মতো ভালোবাসতে রিপ কি কখনো পেরেছে? রিপ পারেনি। কিন্তু সে ভালোবাসতে জানে। হয়ত একটু কম। থাক না। নীরা এই কম নিয়েই ভালো থাকতে জানে। তার মাঝে অদ্ভুত এক শক্তি আছে। বিপরীত মানুষটার কাছ থেকে নিজের মতো করে ভালোবাসা না পেয়ে ও ভালোবেসে যেতে পারার মতো শক্তি কয়জনেরই বা আছে। নীরার তা আছে।
রিপ হয়ত বুঝল না।
এই অদম্য শক্তিটা তার ও আছে। সে ও ভালোবেসে যেতে জানে। পেরেছে ও।

___________

প্রায় তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পর পরী দেখা পেল কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। সবার সাথে হেসেখেলে দু চারটা কথা বললে ও তারদিকে ফিরে ও তাকাল না মানুষটি। দরকারি প্রয়োজনে শুধু বলেছিল,
‘ পরী আমি একটু একা থাকতে চাই। তুমি কি একটু মায়ের রুমে যাবে? সকাল সকালই চলে যাব আমি। তোমাকে আর ডিস্টার্ব করব না।
পরী চুপচাপ বেরিয়ে গেল। রাইনা বুঝতে পারল। চেঁচিয়ে বলল,
‘ আমি একা থাকব। তুই যাহ তোর ঘরে। তুই থাকলে আমার ঘুমোতে অসুবিধা হবে।

তার চেঁচামেচিতে আদি, ইশা পিহু ছুটে এল। রেহানে পরীর হাত ধরে টেনে নিয়ে এল। বলল,
‘ যেতে না যেতে অশান্তি লাগিয়ে দিয়েছ না? সবাইকে শোনাচ্ছ দেখাচ্ছ যে আমি তোমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি?

পরীর গাল বেয়ে নীরবে জল গড়াল। রেহান চরম বিরক্ত হয়ে মাথা চেপে শুয়ে পড়ল। পরী গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল খাটের অন্যপাশে। নিস্তব্ধ রাত যখন একেবারে নেমে আসল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ কানে লাগল ছেলেটির। আজ ও তাকে সরি বলল না মেয়েটি। অভিমানগুলো পরিণত হলো রাগে। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি পাশফিরে শুয়ে রয়েছে। ঘনঘন নিঃশ্বাসের আওয়াজ বুঝিয়ে দিল মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। রেহান ছুঁতে গিয়ে ও ছুঁল না। অভিমান তার ও হয়।
রেহান পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। রাগগুলো ঘুমন্ত মুখটা থেকে উঁবে গেল। পরী পাশ ফিরল। খানিকটা উঠে ছেলেটির ঘুমন্ত মুখটা দেখার চেষ্টা করল। দেখল। মনে হলো এই নিষ্পাপ চেহারাটার মানুষটা ভালো ছিল। তার জন্য রাখা একরাশ ভালোবাসাগুলো সে সে হারিয়ে ফেলেছে। ঘুম থেকে উঠার পর সে আবার আগের রূপে ফিরে আসবে। পরী অভিমান আর ও গাঢ় হলো। সে বুঝলই না ছেলেটি তার উপর রেগে নয়। অভিমান করে আছে।

চলবে,,,,,

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here