#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৬(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আকাশটা ও গম্ভীর হয়ে আছে। সকাল থেকে পড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। থামার নামগন্ধ নেই। পরী ব্যালকণির থাইগ্লাস সরিয়ে দিল। বৃষ্টির ঝাপটায় মুখটা আধভেজা হয়ে গেছে। আজকের দিনে বৃষ্টি হতে হলো? মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো রেহান। পরী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বলল,
‘ শুনুন।
রেহান কোনো আওয়াজ করল না। পরী চেঁচাল।
‘ ডেকেছি না?
রেহান বলল,
‘ কি সমস্যা?
পরী মুখ ভাঙাল। বলল,
‘ কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছি। আপনি কখন রেডি হচ্ছেন?
রেহান বলল,
‘ আমার আটা ময়দা মাখতে হয়না। তাই সময় ও বেশি লাগবে না।
পরী রাগে ফুঁসে উঠল। কিন্তু আমমা বলেছে যখন তখন রেগে যাওয়া যাবেনা। তাই রাগ করা ও যাবেনা। কিন্তু পরীর ভীষণ রাগ লাগছে। এই হাঁদারামটা তাকে পিঞ্চ করে কথা বলেছে। পরীর কষ্ট লাগল। বর বউকে এভাবে বলে নাকি?
সে একটু ও সাজেনি। শুধু শুধু বলছে। । পরী পা দিয়ে মেঝেতে দুম করে আঘাত করল। নাকিসুরে বলল,
‘ উহু। আমার রাগ লাগছে। মেরে ফেলব।
রেহান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
‘ কি হলো আবার পাগলটার?
পরী চোখবন্ধ করে মাথাটা দেয়ালে ঠেকিয়ে বলল,
‘ উহু রাগ লাগছে।
রেহান বলল,
‘ ডাক্তার বাসায় আছে। দেখিয়ে নাও মাথায় কি সমস্যা।
পরী রেগে গেল এবার। তড়িৎ গতিতে ছুটে রেহানের কাছে গেল। রেহানের গলায় ঝুলে থাকা তোয়ালে শক্ত করে ধরল। রেহান চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল, পাগলামি বেড়ে গেছে নাকি?
পরী মুখটা কাঁদোকাঁদো করল। বলল,
‘ আরেকবার পাগল ডাকলে মেরে ফেলব। আমমাকে বলে দেব। আমমার কাছে তো আপনি ভদ্রলোক।
রেহান হাসল। বলল,
‘ শ্বাশুড়ি মা ঠিকই ধরেছে। ভদ্রকে ভদ্র বলছে আর পাগলকে পাগল।
পরীর মাথা খারাপ হয়ে গেল। রেহানকে টেনে তার মাথা দিয়ে রেহানের মাথায় দুম করে বাড়ি খাওয়াল। রেহান কপাল ঢলতে ঢলতে বলল,
‘ পাগল কি সাধে বলি?
পরী বলল,
‘ আরেকবার পাগল বললে মেরে ফেলব। সত্যি সত্যি মেরে ফেলব।
রেহান নিঃশব্দে হাসল৷। পরী বলল,
‘ আমমা বারণ করেছে নইলে মেরেই ফেলতাম । রেহান বলল,
বিধবা সাজার এত শখ?
পরী নাক ফুলালো।
পিহুর ডাক ভেসে এল
‘ দিদিয়া দাভাইকে তাড়াতাড়ি বের হতে বলো।
পরী রেহানের গলায় ঝুলিয়ে থাকা তোয়ালে ছেড়ে দিল। বলল,
‘ বের হোন আমার ঘর থেকে। তাড়াতাড়ি।
রেহান হেঁটে হেঁটে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছল। বলল,
‘ আমার ঘর থেকে তুমি বের হ। তাড়াতাড়ি।
পরী চেঁচাল।
‘ এটা আমার ঘর৷। রেহান আস্তে করে তার হাত ধরল৷। পরী চমকে তাকাল। রেহান চুপচাপ তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল৷ মুখের উপর ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
‘ এটা আমার ঘর।
পরী দুমদাম দরজায় আঘাত করল। চেঁচিয়ে ডাকল,
‘ আমমমা?
রেহান নিঃশব্দে হাসল।
‘ শেষমেশ কপালে কিনা একটা পাগল বউ জুটল?
পরী চোখ কচলাতে কচলাতে চোখ লাল করে ফেলল। বেয়াদব ছেলেটা তাকে বের করে দিল?
পিহু পরীকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
‘ বেরোনোর সময় ও ঝগড়া করেছ দিদিয়া? তুমি কখন শোধরাবে৷ দাভাইকে তুমি সত্যিই জ্বালাচ্ছ।
পরী বলল,
‘ ওই ছেলেটা ওই মানে,,,,
পিহু চলে গেল৷ পরী আদির কাছে গেল। আদি কিছু বুঝে উঠার আগে জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ আবববা আমি মেরে ফেলব।
আদি হেসে দিল৷ বলল, কাকে মাববেন?
পরী তার দিকে তাকাল৷
বলল,
‘ ওই ছেলেটা আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে। তুমি বকে দেবে। বেয়াদব ছেলে৷ এটা আমার আববার বাড়ি৷ আমার বাড়ি।
আদি হাসল। বলল,
‘ এটা তোমার বরের ও বাড়ি।
পরী আববার সাথে ও রাগ করল। ইশার কাছে গেল।
ইশাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আমমা ওই ছেলেটাকে আমাদের সাথে নেবেনা ৷ আমরা একা যাবো।
ইশা হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা।
পরী খুশি হলো। বলল,
‘ আমমা ওই ছেলেটা আমাকে বউ মানেনা৷ কাজের লোক মনে করে।
ইশা হাসল। পিহুর চুল বেঁধে দিতে দিতে বলে,
‘ কাজের লোক তো সবাই। আমি ও।
পরীর আমমার উপর ও রাগ লাগল। গেল আলিয়ার কাছে।
আলিয়া তাকে দেখে বলল,
‘ তুমি কি খাবার টাবার খাও না পরী? গলার হাড় সব ভেসে উঠছে৷
পরী বলল, ওগুলাই সুন্দর।
আলিয়া বলল, ওগুলা সুন্দর না। খেয়ে দেয়ে মোটা হয়ে যাও৷ এত শুকনা ভালো না। শাড়ি যে পড়েছ সেটা তো দেখে মনে হচ্ছে খুলে পড়ে যাচ্ছে।
পরী বলল,
‘ আমি এভাবেই সুন্দর। সবাই বলে।
আলিয়া বলল, তোমার বর বলেছে?
পরী চুপ হয়ে গেল। বলল, নাআআআ। বলে না৷
আলিয়া বলল, তো?
পরী বলল,চেঁচাচ্ছ কেন? ভয় করেনা?
আলিয়া শক্ত গলায় বলল,
‘ তুমি ছোটবেলায় খুব ভালো ছিলে৷ এখন খুব অসভ্য হয়ে গেছ। যার কারণে রেহান তোমাকে সহ্য করতে পারছেনা৷
পরী কাঁদকাঁদো হয়ে বলল,
‘ সে বলে ছোটবেলায় আমি মুটু ছিলাম৷ এখন ও মোটা হলে আবার ও মুটু বউ ডাকবে।
আলিয়া বলল,
‘ ডাকবেনা। আরেকটু স্বাস্থ্য আসলে আরও ভালো লাগবে৷ দেখো এখন নতুন বউ তুমি,সবসময় সেজেগুজে থাকবে। শাড়ি পড়বে।
পরী বলল, শাড়ি পড়লে আমি হাঁটতে পারিনা।
আলিয়া ধমক দিল।
‘ যাও এখান থেকে। কোনোকিছু বুঝিয়ে শান্তি নেই৷ মুখে মুখে কথা ফিরিয়ে দিতেই হবে। যাও।
পরী কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল৷ আমমা ঠিকই বলে,
‘ দাদুর মাথা ঠিক নেই আগের মতো। বয়স হয়েছে।
পরী তারপর ও কান্না থামাতে পারল না। সবাই তাকে বকে। বরটা ও৷
রেহান রেডি হয়ে দরজা খুলে বের হয়ে যেতেই তার বুকের উপর হামলে করল কেউ একজন। ফেঁ ফু করে কেঁদে পরী বলল,
‘ আপনি নড়বেন না। নাহলে মেরে ফেলব।
রেহান মাথা নামিয়ে বুকের এতকাছের মেয়েটিকে দেখল৷
তার পড়নের শার্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে চোখের পানিতে। তা বলার সাথে সাথে পরী দুমদাম বাড়ি লাগাল মাথা দিয়ে। কেঁদেকেটে বলল,
‘ আমি সুন্দর নই??????
রেহান মনে মনে হাসল৷ কিন্তু উপরে তা দেখালো না। বলল, ছাড়ো।
পরী বলল, নাআআ ছাড়ব না।
রেহান বলল,
‘ ঠেলে দেব এখন। ছাড়ো।
পরী নাক মুছে দিল তার শার্টে ৷ চোখ মুছে দিল৷ তারপর বলল,
‘ এবার যান৷
রেহান বলল, তুমি যাও। আমার আবার চেন্জ করতে হবে৷
পরী বলল, কেন?
রেহান বলল, মাহিদ যদি আমার শার্টের এই অবস্থা দেখে কি বলবে???
পরী চুপ হয়ে গেল। মাথা দুলিয়ে চলে গেল। ইশা আদি আর পিহুকে গিয়ে বলল
‘ ওই ছেলেটার শার্ট নষ্ট করে দিয়েছি।
আদি বলল, কিইই??
ইশা তাড়াতাড়ি কথা ঘুরাল। বলল, ডক্টর রেহানকে নিয়ে আপনি বেরোন। আমরা আসছি। যান৷ যান না!
আদি পরীর দিকে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে চলে গেল৷ আদি বেরোতেই ইশা বলল,
‘ তোমার বুদ্ধি কখন হবে পরী? বাবার সামনে কেউ অমন কথা বলে?
পরী বলল, ছেলেটা ওইদিন আমার ওড়না টেনে তার ভেজা চুল মুছেছিল। তাই আমি আজ তার শার্ট নষ্ট করে ফেলেছি। এখানে বুদ্ধির কি আছে আমমা? আজ আমি ভীষণ বকা খাচ্ছি। কারো সাথে কথা বলবো না আর।
ইশা পিহুকে বলল, এই পাগল মেয়েটা আমার?
পিহু হাসল৷ বলল, মাম্মা দিদিয়া দাভাইয়ের প্রেমে পড়ছে ৷ একটু একটু করে। এগুলো সেসবের লক্ষ্মণ।
ইশা অবাক হয়ে বলল, তুমি প্রেম মানে কি বুঝো? বেশি পাকনা হয়েছ৷
পিহু নিঃশব্দে একটুখানি হাসল৷ ইশা বলল, আজ তো তোমার মাহিদ ভাই চলে যাবে। মিস করবে না?
পিহু বলল,
‘ নাহ। আমি তো খুব খুশি। আর মাইর খাবো না। একটু শান্তিতে থাকব৷ ভালো থাকব। কারো চিঠি ও আর বহন করতে হবেনা।
ইশা অন্যকিছু জিজ্ঞেস করার আগে পিহু চলে গেল। ইশা বলল, চিঠি কি পিহু?? বলে যাও।
______________
গাড়ির পেছনের সিটে পরী পিহু আর ইশা। সামনে রেহান আর আদি। রেহান ড্রাইভিং সিটে বসা। ড্রাইভিং করছে। পরী পেছন থেকে চুল টেনে দিল রেহানের। রেহান মাথায় হাত দিল। আদি ইশার কারণে কিছু বলতে পারল না৷ পরী আবারও টান দিল। পিহু দেখল। ইশা বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে পিহুর দিকে তাকাল৷ পিহু কিছু বলল না৷ পরী হাত তালি দিল,
‘ এখন কেমন লাগছে? টিট ফর ট্যাট।
আদি বলল, কাকে বলছ?
পরী বলল, ড্রাইভারকে।
রেহান কিচ্ছুটি বলল না। চাচ্চু আর কাকিয়ার সামনে কি কি বলে ফেলে মেয়েটা কে জানে? তার পাগল বউ৷ উফফ।
ইশা ডাক দিল পরীকে।
‘ চুপচাপ বসো পরী। কি হচ্ছে এসব?
পরী মুখ কালো করে বসে থাকল। গাড়ির মিররে রেহানকে দেখা গেল। সে মুখ মোচড়ে দিল৷ রেহান ইশারায় ইশারায় বুঝিয়ে দিল
‘ হাতের নাগালে একবার পাই??????
পরী ভয় পেল৷ ফিসফিস করে পিহুকে বলল,
‘ পিহু ওই দেখো ছেলেটা কিভাবে তাকাচ্ছে। আমি একটু ও ভয় পাচ্ছি না।
পিহু বলল,
‘ দিদিয়া ভয় না পেলে চুপ করে থাকো। দাভাইকে আর জ্বালিও না। ড্রাইভিং করছে।
পরী বলল, আচ্ছা। জ্বালাব না। এটা আগে বলবে না?
_____________
খান বাড়ি পৌঁছাল সবাই। আদি ইশা, পরী আর রেহান বেরিয়ে পড়ল গাড়ি থেকে। পিহু থেকে গেল৷ বলল,
‘ যাচ্ছি কিছুক্ষণ পর। তোমরা যাও৷
আদি বলল, শরীর আবার খারাপ লাগছে?
পিহু মাথা নাড়িয়ে না বলল। আদি মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা আসো। জ্বর এখনো পুরোপুরি কমেনি। সাবধানে এসো৷
পিহু মাথা ঝাঁকাল।
রেহান পেছন থেকে পরীর মাথায় জোরে চাটি মেরে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল৷ পরী ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়ে বলল
‘ আববা আমাকে মেরেছে। জোরে মেরেছে।
আদি জিজ্ঞেস করল, কে মেরেছে?
পরী বলল,
‘ ওই ছেলেটা৷
ইশা কপালে হাত দিল, কোথায় রেহান? রেহান এমন ছেলেই নয়। তুমি কি ছেলে ছেলে লাগিয়েছ? ওর নাম রেহান। রেহান ডাকবে৷
পরী কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ তুমি আববাকে নাম ধরে ডাকো। আমি ও ডাকব।
ইশা জিভে কামড় দিল। এই মেয়েটা ছোট আর কতদিন থাকবে?
ইশা যেতে যেতে আদিকে বলল,
‘ মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে না দেওয়া উচিত ছিল।
আদি বলল, তোমার মতো কলেজ পাস করে তো হয়নি। তুমি আর ও আগে করেছ বিয়ে। বরের জন্য নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছিলে ???
ইশা রেগে থাকাল আদির দিকে৷ বলল, আপনাকে আমি পরে দেখে নিচ্ছি ডক্টর। বিয়ে আপনার ভালোর জন্য করেছি। আমার তো ক্ষতিই হয়েছে।
আদির মন খারাপ হলো। মিষ্টি সবসময় এই কথাটাই বলে। সব ভুলে সে যে এখন তাকে ভালো রেখেছে এটা মনে রাখা যায়না??
কখন কষ্ট দিয়েছে বারবার শুধু সেটা দেখিয়ে দেই। মিষ্টির সাথে সে আর কোনো কথাই বলবে না। সারাক্ষণ তাকে শক্ত শক্ত কথা বলে।
______________
ইশা আদি যেতে না যেতেই দেখল নীরার অবস্থা। মাহিদকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কাঁদতে কাঁদতে হয়ত এবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মাহিদ নীরার মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে বলল,
‘ মেরি মা তোমার ছেলে শ্বশুরবাড়িত যাইতাছে না বাপ। বুঝোনা ক্যান?
নীরা আবারও আওয়াজ করে কাঁদল। মাহিদকে আর ও শক্ত করে ধরে বলল,
‘ মাহি, আমাকে নিয়ে যাহ। তুই কি খাবি? তুই কি পড়বি? কোথায় থাকবি৷ তোকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব? কিভাবে খাব?
মাহিদ বলল,
‘ মা চিন্তা করো ক্যান? রাঁধতে না জানলে একটা বিয়া কইরা নিমু৷ বউ রান্ধাবাড়া করে খাওয়াইবো।
নীরা বলল, না না আমার একটা মাত্র বাচ্চা। আমি তারজন্য পছন্দের মেয়েকে বউ করে আনব।
মাহিদ হাসল। বলল, আচ্ছা। বিয়া করুম না। এমনে এইহানে লয় আসুম৷
নীরা বলল, আমার তোকে ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। আমি ছাড়তে পারছিনা। যাস না মাহি।
মাহিদ আলতো আলতো করে মাকে ছাড়াতে বলল, ওরে বাপের বউ ছাড়ো না বাপ। তুমি এভাবে ধরে রাখলে কি করে হইবো বাপ?
নীরার হাত থেকে মাহিদ নিজেকে ছাড়াল। মায়ের মুখ আগলে ধরে ফিসফিস করে বলল, মাআ এই দেখো।
নীরা তাকাল। মাহিদ চোখ মেরে দিল। নীরা খিলখিল করে হেসে উঠল। সবাই অবাক হয়ে নীরার হাসি দেখল। এখন না কাঁদছিল??
মাহিদ হেসে দিল। বলল, এইভাবে হাসতে থাকো মা৷ আমি আসব।
নীরা হাসতে হাসতে আবার কেঁদে দিল। মাহিদের মুখ আগলে ধরে কপালে মুখে স্নেহের পরশ এঁকে দিল। এই ভালোবাসাময় মুখটা আর ছুঁতে পারবেনা কাছ থেকে৷ নিজ হাতে খাওয়াতে পারবেনা কতদিন। কোলে মাথা রেখে ঘুম পাড়াতে পারবেনা কতদিন৷ কি করে থাকবে নীরা? পুরো বাড়িটাই যে খালি হয়ে যাচ্ছে। সবাইকে হাসাবে কে? পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখবে কে?
নীরা ডুকরে উঠে নিজের ঠোঁটজোড়া চেপে ধরল ছেলের কপালে। চোখের জল ও পড়ল বোধহয়৷ মাহিদ মায়ের গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলল, মাআআ আমি আসব তো৷
নীরা তাকে আর ও চেপে ধরল৷ মাহিদ মায়ের কপালে ভালোবাসার এঁকে দিয়ে বলল, যাও তো বাপ, কত ভালোবাসা দিলাম। এবার ছাড়ো। এত পেটুক কেন? এত আদর খাইলা এতক্ষণ ধরে।। নীরা আর ও জোরে কাঁদল। মাহিদ মাকে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ এভাবে কাঁদলে তো আমি যেতে পারব না মা। কেন কাঁদছ? পাপা কোথায় গিয়েছে? আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে অথচ তার দেখা নেই। আর তুমি কি শুরু করেছ?
নীরা চোখ মুছল। চোখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ না কাঁদছি না। কোথায় কাঁদছি। আমি কাঁদছি না। মাহিদ নীরাকে ছেড়ে মুনার কাছে গেল। মুনাকে জড়িয়ে ধরে নীরাকে উদ্দেশ্য করল বলল,
‘ বড়মা একটা বাচ্চার দায়িত্ব দিয়ে যাইতাছি তোমারে । বাচ্চাটাকে দেইখা রাইখো ।
মুনা বলল,
‘ আর আমাদের বাচ্চাটাকে কে সামলে রাখবে?
মাহিদ ঠোঁট এলিয়ে হাসল। বলল,
‘ বাচ্চাটা বড় হইছে। বুঝোনা ক্যান বাপ?
মুনা হেসে দিল৷ মাথায় হাত রেখে বলল, অনেক বড় হ তুই। আমাদের আশ্রয় ও তো তুই। আমাদের সবার। এই বাড়িটার। তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে?
মাহিদ মুনাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। মুনার কপালে ঠোঁট ঢলে বলল, যাও আর কাইন্দো না বাপ৷ তোমারে ও আদর দিলাম। যাও কাইন্দো না।
মুনা মাহিদের কপালের একপাশে গাঢ় স্নেহের স্পর্শ দিল। বলল,
‘ বেঁচে থাক। ভালো থাক। সবাইকে ভালো রাখ৷ হাসিখুশি রাখ।
রিকের কাছে গেল মাহিদ। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল, বাপের ভাই আদর টাদর দেওয়ার থাকলে দিয়া দাও বাপ। তোমার ভাইডা গেল কই?
রিক আদরটাদর দিয়ে দিল। চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলল, সাবাশ ব্যাটা হিরো হিরো লাগছে। সুপারস্টার হয়ে ফিরে আয়৷
মাহিদ হাসল। রিক বলল,
‘ এদিকে আয়। কানটাকে একটু আদর করে দিই। অনেক মারলাম তোর কান বাপকে৷
মাহিদ হাসল। বলল, দাও দাও আদর। আমার কান বাপ রেগে আছে৷
রিক বলল, যাহ। আমাদের লাঠিটা।
মাহিদ আবারও হাসল। বলল, লাঠি এখন ও মজবুত। তোমরা চারজনকে আমি একাই সামলাতে পারব।
রিক বলল, আর ও মজবুত হয়ে আয়৷ চারজনের ভার কিন্তু কম না৷
মাহিদ আদি ইশার কাছে এল। ইশাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,’ বাপের বইন তুমি ভালা থাইকো।
ইশা হেসে দিল। বলল, এই মাহি তুই চলে যাওয়ার আগেই তো সব কেমন কেমন লাগছে৷ তুই চলে গেলে তো একটু ভালো লাগবেনা।
মাহিদ বলল, ভালার বাপেরে ধইরা লইয়্যা আসবা। ব্যস। তোমার ডাক্তার জামাই আছে কিল্লাইগ্যা বাপ? ভালার ঔষধ খাইলেই তো হয়।
আদি হেসে দিল। মাহিদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ আসো আসো ডাক্তারের কাছে আসো৷
মাহিদ হাসল হো হো করে। বলল, ডাক্তার মশাই ভালা থাহনের ঔষধ লাগব সবার। দিয়া দিবেন। ফিউচার সুপারস্টার মাহিদ খানের আদেশ।
সবাই একসাথ হেসে উঠল মাহিদের কথায়। পরী নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ তোর বোন টোন মারা গেছে।
রেহান পরীর কথায় হেসে দিল। ব্যঙ্গ করে বলল, ইন্না-লিল্লাহ।
মাহিদ চোখ পাকাল। বলল, ওই মহিলা তুমি নাক ফুলায়ছো ক্যান? তোমার ভাইডা এই আণ্ডাবাচ্চাদের সামলাতে সামলাতে মইরা যাইতাছে। আর তুমি নাক ফুলাও৷ তোমার নাক বাপ এত ফুলে ক্যান?
রেহান হেসে উঠল৷ পরী ফুঁসে উঠল৷ মাহিদ গিয়ে তাকে টেনে নিয়ে গেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আহারে রাগো ক্যান বাপ? মাথা ঠান্ডা করো। জামাইরে লইয়া ভালা থাহো। ভাইডারে আর পাইবা না কইলাম। কানাডা থেইকা লাফ দিয়া আইতে পারুমনা৷ তোমার জামাই বড্ড ভালা৷ আমি ভালা মানুষ দেহি তোমারে তার সাথে বিয়া দিছিনা? তুমি তারে দেখতে পারোনা ক্যান? হুনো ভ্যা ভ্যা লাগবো আমার৷ হিরোইন বা হিরো লাগবো। আমারে হিরো মামা ডাকবো। আমি আইসা তোমারে মুটি না দেখলে খাইছি৷ আণ্ডাবাচ্চা না দেখলে খাইছি।
পরী বলল, ইননননা।
মাহিদ বলল, কাঁদবানা কইলাম। প্যাঁ পুঁ ভাল্লাগেনা বাপ৷
পরী বলল,
‘ তুই কবে আসবি ভাই? আমি তোকে খুব মিস করব।
মাহিদ বলল,
‘ আসুম৷ বিয়া কইরা চইলা আসুম। বউ নিয়া আসুম।
পরী তাকে দুম করে মারল৷ বলল,ইয়ার্কি করবিনা। তোকে আমি আমার পছন্দের মেয়ে বিয়ে করাবো। ওখানকার কোনো মেয়েটেয়ের প্রেমে পড়বিনা ভুলে ও। নইলে মেরে ফেলব৷
মাহিদ বলল, ডরাইছি বাপ। মেরে ফেলব ” এটা ছাড়া কি আর কোনো কথা নাই বাপ? মুখে মুখে তুমি কয়জনরে মারো?
পরী বলল, উহু। এখনো মারিনাই৷ মারব।
মাহিদ হা হু করে হাসল। বলল, যাইবার আগে তুমি হাসাইলা বাপ। সরো তোমার বাচ্চার বাপের সাথে কথা কয় আসি। পরী বলল
‘ না৷ ওই ছেলেটা আমাকে মারছে৷ কথা বলবি না৷
মাহিদ রেহানের সামনে গেল৷ রেহান হাসল৷ মাহিদ বলল, আমার বোনেরে মারছেন কিল্লাই পাগলির বাচ্চাকাচ্চার বাপ?
রেহান হেসে দিল। বলল,
‘ শালাবাবু তুমি তো বাপ,, সবাইকে বানাও তাই অবাক হলাম না৷
মাহিদ বলল, ধুরর মিয়া খুশি হও৷ খুশি হও৷ মিষ্টি খাওয়াও বাপ।
রেহান হাসল। দুজন দুজনকে হেসেহেসে জড়িয়ে ধরল। মাহিদ বলল,
‘ বাপ এবার আমি যামু। কানাডার বউ আমার জন্যি কাঁদতেছে৷ আমার ব্যারিস্টার বাপরে আসতে কও৷ বাপ আমার লুকাইছে ক্যান?
রিক বলল,
‘ তোর বাপ বাইরে। গাড়ির কাছে৷ যাহ তোর বাপকে একটু আদরটাদর কইরা দে৷ যাহহহ।
নীরা বলল, দরকার নেই। তার এসবের কি দরকার? তার বউ বাচ্চার দরকার নেই।
মাহিদ নীরার কাছে গেল৷ বলল,
‘ মা আমার ব্যারিস্টার বাপ আমারে ভালোবাসে তো।
নীরা চোখতুলে তাকাল৷ বলল,
‘ ভালোবাসলে দূরে পাঠাই দিতনা ?
মাহিদ বলল, ভালোবাসলে মুখ ফুটে বলতে হয়না বাপ। বুঝোনা ক্যান। তোমারে বলেনি তাই বলে কি ভালো বাসেনা? বাসে বাপ। তুমি বাচ্চা ক্যান ব্যারিস্টারের বউ?
নীরা চোখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ তোর বাপকে আমি ছাড়ব না। আমার বাচ্চাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরায় দিছে। আমি ছাড়ব না।
মাহিদ নীরাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল৷ আরেকবার জড়িয়ে ধরে সোজা চলে গেল তালহা বেগমের কাছে। তালহা বেগম তাকে দেখে বলল,
‘ আমার জানাজার খাটিয়া তুই ধরবি না? আমি মরলে আসবি নারে ভাই ?
মাহিদ হাঁটুগেড়ে বসল তালহার কাছে৷ বলল,
‘ একটু আদর কইরা দাও তো বাপ। আমি আসা পর্যন্ত কি বাইচা থাকবানা?
তালহা বেগম বললেন,
‘ মনে হইতাছে তুই চলে যাওয়ার পর পরই মইরা যামু৷ আমারে এত হাসাইবো কে?
মাহিদ বলল, ধুরর বুড়ি। নাতবউ দেখবানা বাপ? চইলা যাওয়ার লগে এত তাড়া ক্যান?
তালহা বেগম কেঁদে দিলেন। হাত বাড়িয়ে বললেন,।
‘ আয় বুকে আয়৷ একটু শেষ আদর কইরা লয়। আর তো পামু না বাছাটারে ৷ আয়।
মাহিদ তালহার কাছে গেল৷ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ বুড়ি তুমি এত নরম কেন? শক্ত হও বাপ ৷ এত নরম হইলে তো চলবো না বাপ। তোমারে বাঁচতে হইবো৷ নাতবৌ দেখার লাইগা৷ বুঝোনা ক্যান???
তালহা বেগম মাহিদের কপালে চুমু দিল৷ বলল,
‘ হাসিখুশি থাক সবসময়৷ ভালো থাক৷ বেঁচে থাক৷ আমার দুই ছেলেরে ভালো রাখ৷ দুই বউকে ভালো রাখ। তোর উপর কতজনের যে দায়িত্ব। তোর বড়আব্বা আর বড়আম্মারে কখনো পিছু রাখিস নারে ভাই। আমার ছেলেটা তার মাইয়্যাটারে বিয়া দিয়ে আর ও একা হয়ে পড়ছে। তুই ও চলে যাইতাছোস। তোর মা বাবার লগে তারা দুইজনেরে ও রাখিস ভাই। সবাইকে ভালো রাখিস। আর তোর বউ? বিদেশি মাইয়্যাদের বউ করিস না ভাই। যে তোরে ভালাবাসব তুই ও তারে ভালোবাসিস। কারো মন লইয়্যা খেলা করিস না ভাই।
মাহিদ চুপ করে থাকল। এই বাড়ি, বাড়ির মানুষগুলো ছেড়ে কেন যেতে ইচ্ছে করছেনা। ফিরে এসে সব কি সে এখনকার মতো ফিরে পাবে? কিছু পাল্টে যাবে না তো?
মাহিদের তো কোনোকিছুই ভয় লাগেনা। কিন্ত আজ কেন এত ভয় হচ্ছে? কেন?
মাহিদ বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে৷ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল নিজ বাড়িটার দিকে৷ ছয়বছর পর ফিরে আসবে সে৷ আসবে৷ এই বাড়ি,এই মানুষগুলো তার। তার থাকুক৷ ভালো থাকুক৷ মাহিদ বাড়ির বাইরে পা রাখার সাথে সাথে আর্তনাদ শোনা গেল নীরার৷ মাহিদ পা বাড়াল৷ পেছন পেছন সবাই বেরিয়ে এল৷ মাহিদ গাড়ির কাছাকাছি গেল। রিপ তাকে দেখে একবার দেখল। আবার চোখ ফিরিয়ে কথায় ব্যস্ত হয়ে গেল৷ মাহিদ হেঁটে রিপের কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। দুচোখ ভরে দেখল বাবার অভিনয়। কথাগুলো কি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে বলছেনা??
মাহিদকে এভাবে তাকাতে দেখে রিপ একবার তাকাল। আবার চোখ সরিয়ে নিল। মাহিদ তাকিয়েই থাকল৷ রিপ এবার সরাসরি তাকাল ৷ বলল,
‘ এভাবে কি দেখিস??
মাহিদ একটুখানি হাসল। বলল, আমার ব্যারিস্টার বাপকে।
রিপ বলল, ‘ দেখার কি আছে?
মাহিদ বলল, আচ্ছা দেখব না।
রিপ মাথা নাড়াল। ‘ হুমম৷
মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। রিপ দেখল, সেই ছোট্ট মাহিটা চলে যাচ্ছে। যে রিপের কোলে উঠে সারাক্ষণ বসে থাকার বাহানা করত৷ কতবার কোর্টে ও তাকে নিয়ে যেতে হয়েছে৷ বাবা পাগল ছেলেটা চলে যাচ্ছে বুকে একরাশ অভিমান নিয়ে৷ বাবার উপর ও কি অভিমান হয়?
রিপ ডাক দিল, এই মাহি?
মাহিদ সাথে সাথে ফিরল৷ না ফিরে কি থাকা যায়?
খুব ভালোবাসার একটি ডাক৷ রিপ হাত বাড়িয়ে ছেলেকে বুকে নেওয়ার জন্য ডাকল,
‘ আয়।
মাহিদ যেন উল্কার গতিতে ছুটে গেল৷ রিপ দুই তিন পা পিছু হটল৷ মাহিদ চেপে ধরল বাবাকে। ডাকল, পাপা।
রিপ যেন কতবড় করে শ্বাস নিল৷ যে রিপ জানেনা দুঃখ কিভাবে প্রকাশ করতে হয়,জানেনা মনের কথা কিভাবে বলতে হয় সেই রিপ আজ কাঁদল। মাহিদ চুপ করে থাকল৷ বাবার কাছে এই পর্যন্ত তো সে কিছুই চায়নি৷ আজ চেয়ে বসল৷
‘ আমি যাব না পাপা৷ আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি যাব না। আমার সবাইকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে।
রিপ কিছু বলল না। রিপের কোনো সাড়া না পেয়ে মাহিদ ছেড়ে দিল তাকে। গাড়ির কাছাকাছি চলে গেল। গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল৷ অভিমানে বুক ভার হলো৷ শেষমেশ সেসব জল হয়ে পড়ল দুফোঁটা। চোখ হাতের কব্জি দিয়ে ঢলে দিতেই চোখদুটো লাল হলো৷ থমথমে মুখটা বের করে দিল গাড়ির কাচ ভেদ করে৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু কিছুক্ষণের মধ্যেই ৷ নীরা বৃষ্টির মাঝে দৌড়ে এল৷ ছেলের মুখ হাত দিয়ে ছুঁতে না ছুঁতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। মাহিদ ডাকল, মাআআ,,,
গাড়ি ছেড়ে দিল।
মাহিদ বাড়ি,বাড়ির মানুষ আপনজনের সাথে দেখা করল৷ হেসেকেঁদে দুটো কথা বলল। কিন্তু বাকি পড়ে গেল একজন৷ গাড়ির ভেতর বসা মেয়েটির কথা কেন যেন ভুলে ও মনে পড়ল না ছেলেটির৷ গাড়ি চলতে এসে পড়ল কিছুটা দূরে পার্ক করা গাড়িটার কাছাকাছি। গাড়ির কাচ ভেদ করে মুখ বের করা মেয়েটিকে দেখে মাহিদ লাল চোখে ছোট ছোট করে তাকাল। তার সাথে সাথে মেয়েটির চোখ ও কেন ফোলা????
মেয়েটি গাড়ির কাচের সাথে মাথা এলিয়ে তাকিয়ে রইল হাসিহাসি মুখ করে। মাহিদ নিজে ও ভেবে পেলনা এই মেয়েটির কথা সে ভুলে গেল কি করে?
পিহুর সাথে একটুখানি হাসল সে। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল৷
কিন্তু ওপাশের মেয়েটি হাসল না৷ কেন হাসল না সেটির কারণ জানতে মাহিদ লাল চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল যতক্ষন ওই মেয়েটিকে দেখা যায়। কিন্তু কারণটি জানা হলোনা। পিহু গাড়ি থেকে নেমে পড়ল গাড়িটি অদৃশ্য হওয়ায়৷ এদিকওদিক তাকিয়ে ডাকল, মাহিদ ভাই? মাহিদ ভাই কি তাহলে চলে গেছে? তারসাথে কথা বলল না? তার সাথে দেখা করল না?
পিহু হাউমাউ করে কেঁদে দিল। বৃষ্টিজল জ্বর গায়ে পড়ায় কেঁপে কেঁপে উঠল সে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে এলোমেলো সুরে কেঁদে বলল,
‘ আমি কি তোমার কেউ নই মাহিদ ভাই? আমার কথা কি তুমি ভুলেও ভাবো না? আমি কেন তোমার কেউ নয় মাহিদ ভাই?
________________
সবাই থেকে গেল খান বাড়ি। ইশার পাশ থেকে মাঝরাতে উঠে গেল পিহু। নিস্তব্ধ রাতে পিহু ভয় কেটে চলে গেল ছাদে। ছাদে থাকা চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। বৃষ্টি হওয়ায় ঠান্ডা হাওয়া বইছে। তার শীত শীত অনুভব হলো। তাকে অনুসরণ আর ও একজন আসল ছাদে। এত রাতে মেয়েটির কি হলো?
পিহু তার ওড়নার আঁচল থেকে কয়েকটা টুকরো টুকরো কাগজ বের করল। চিঠিগুলো মাহিদের হাতের লেখা৷ রাইসাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। পিহু একটা চিঠি ও দেইনি রাইসাকে৷
চিঠিগুলো দিয়ে নৌকা বানাল পিহু৷ চোখের বিন্দু বিন্দু জল পড়ল সেই কাগজের উপর৷ পিহু জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছল৷ আবার ও নৌকা বানাতে মনোযোগ দিল৷ নৌকা বানিয়ে সেগুলো সাজিয়ে রাখল। ছাদের লাইটের আলোয় তার চোখের বিন্দু বিন্দু জলগুলো স্ফটিকের দানার মতো দেখাল। সামনে এসে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে মানুষটার পেছনে তাড়াহুড়ো করে তাকাল। কেউ কি এসেছে পিহুর জন্য?
পিহুকে ওভাবে তাকাতে দেখে রিপ বলল,
‘ নেইইই।
এই ” নেইই ” শব্দটা বারবার কানে আঘাত করল পিহুর৷ পিহু ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল রিপকে। কাঁদার কারণে কিছুই বলতে পারল না। পিহু জিজ্ঞেস করল,
‘ নেইই???
রিপ বলল, নাআআআ। ওরকম ছন্নছাড়া ছেলেকে ভালোবাসা বারণ জানো না?
পিহু মুখ তুলে তাকাল রিপের দিকে। ছেড়ে দিল রিপকে৷ চেয়ারে বসে ওই দূরের আকাশের গোলাটে চাঁদটার দিকে চেয়ে রইল।
‘ চোখের নির্লজ্জ জলগুলোতো ওই ছেলেটার নামেই গড়ায়। যে ছেলেটাকে নাকি ভালোবাসাটাই বারণ৷ কিন্তু তারপরে ও পিহু ভালোবেসেছে। ছন্নছাড়া ছেলেটাকে ভালোবেসে সে কি খুব বড় ভুল করল? ভালোবাসা কি অত বুঝেশুনে হয়। অত ক্যালকুলেট করে কি ভালোবাসা হয়? বরঞ্চ ছন্নছাড়া ছেলেগুলোর সবকিছুকে ভালোবাসা যায়। তাদের দেওয়া আঘাত গুলোকে ও ভালোবাসা যায়। পিহু ও বেসেছে। ভুল কিছু তো করেনি?
গোলাটে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে রইল পিহু একদৃষ্টে।
‘ মাহিদ ভাই আমার এই বয়সটা বড্ড আবেগের। আবেগ কেটে গেলে তুমি ও মুছে যাবে৷ কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো, আমি চাই এই আবেগ আমার হাজারবছর থাকুক। এই আবেগ নিয়ে আমি হাজার মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতে পারব। কিন্তু তারপরেও তো তোমাকে ভালোবাসব।
রিপ কিছু বলতে পারল না পিহুকে। মাথায় হাত দিয়ে রাখল৷ মেয়েটা কেঁদেই গেল৷ আজ নিজেকে ওই মেয়েটার জায়গায় ভাবতে ভালো লাগছে তার।
মেয়েটি কি জানে? অপেক্ষার ফল অনেক সময় মধুর হয়না। তিক্ত ও হয়৷ রিপ জানে, সেই তিক্ততার কতটুকু গভীরতা। রিপ বুঝে। রিপ আবার সইতে ও শিখে গেছে৷ হয়ত এবার এই মেয়েটিকে ও শিখতে হবে। বুঝতে হবে।
তার পাগলা ছেলেটা যে এখনো মন বুঝতে শেখেনি। হয়ত শেখার সুযোগটুকু ও আর আসবেনা।
মন কেমনের বৃষ্টি আজ তো একবার হলো। হয়ত আবার অন্য একদিন আসবে এই মেয়েটির দুঃখে কিংবা সুখে। রিপ অবাক হয়। নিজের ছেলেকে তার খুব করে সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়
‘ মাহি মেয়েটাকে কেন ভালোবাসিস না? তার চোখের ভাষা কেন বুঝিস না?
পিহু আর রিপদের মতো মানুষগুলোর চোখের ভাষা কি ঝাপসা দেখায়? না হলে এতটা ভালোবাসার পরে ও অপর মানুষটি তাদের ভালোবাসা দেখেনা কেন? বুঝেনা কেন? হয়ত ঝাপসা দেখায় তাই। নয় কি?
চলবে,,