#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৭(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
সেদিনের পর প্রায় দুমাস পেরোলো ৷ পিহুর বার্ষিক পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল। মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করল। সবাই সবার লক্ষ্যের দিকে ছুটছে। সে কেন থেমে থাকবে? ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন তার পূরণ করতে হবে। দিনশেষে সে একটি ছেলের জন্য নিজে নিজে আনমনে হাসত। ছেলেটির পাগলামিগুলো মনে পড়তেই সে হাসত। কি পাগল না ছিল?
তার এখন ও হাসি পায় পাগল ছেলেটার কথাগুলো ভাবলে। ও-ই দূরন্ত ছেলেটা ও কারো মনে কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে?? তার আবোল তাবোল এলোমেলো কথাগুলো ও কারো ভালোলাগার, ভালোবাসার কারণ হয়?
ছোট্ট পিহু যতই বলুক ওইকথাগুলো তার বিরক্তির কারণ, দিনশেষে ও-ই কথাগুলোই তার ভালো লাগার অন্যতম কারণ। ভালোবাসার ও। ও-ই কথাগুলোকে সে ভালোবাসে। আর সে কথা বলা ছেলেটাকে ও। হয়ত এটি তার আবেগ৷ আবেগের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। আবেগের তাড়নায় সে ভালোবেসেছে তার মাহিদ ভাইকে৷ আর এই মাহিদ ভাই যদি আবেগের অপর নাম হয়ে থাকে হোক না৷ ক্ষতি কি?
আবেগ ফুরিয়ে যায় একেবারে নিঃশেষ তো হয়ে যায় না। মাহিদ ভাই থেকে যাক। কিন্তু একেবারে নিঃশেষ না হোক৷
স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সময় তার চোখ আটকে গেল ও-ই জায়গাটিতে। কয়েকটা বাইক পার্ক করা জায়গাটিতে। বাইকে হেলান দিয়ে গেমস খেলছে একটি ছেলে৷ পিহুকে দেখার সাথে সাথে বলে দিল,
‘ ওইভাবে কি দেখস বাপ? তোর টাকাওয়ালা জামাইরে গিয়া দেখ৷
পিহু হেসে উঠল। কিছু বলার আগেই কপালের একপাশে ঝিনঝিন করে উঠল। কপাল চেপে তাকাতেই দেখা গেল সেই বাইকটা খালি পড়ে রয়েছে। পিহু উচ্চারণ করল,
‘ মাহিদ ভাই?
কিন্তু আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না কারো৷ পিহু পা টিপে টিপে হাঁটল। আচমকা কেউ এসে মাথায় চাটি মারল না৷ পিহু বারবার ফিরে তাকাল ওই বাইকটার দিকে। খালি পড়ে আছে জায়গাটা। খালি খালি মনে হলো চারপাশ৷ কিছু একটা নেই। কেউ একজন নেই। পিহুর মন কাঁদল। কিন্তু আওয়াজ করে চোখেরজল পড়ল না। আবেগকে অত প্রশয় দেওয়া মানায় না যে!
______________
এক পা এক পা করে রাইনা পা ফেলে হাঁটতে চাইল৷ পরী এসে তাকে ধরল৷ মাথার চুলগুলো তার হাতখোঁপা করা। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে৷ রাইনা তাকে দেখে বলল,
‘ রান্না করছিলি?
পরী বলল,
‘ না, ওই এমনি আমমাকে সাহায্য করছিলাম। রান্না শিখছিলাম৷ আমার হাতের রান্না তুমি খাবে?
রাইনা হাসল। বলল, কেন খাবোনা? তুই রান্না করলে সবার আগে চেটেপুটে খাব।
পরী আমতাআমতা করে বলল,
‘ তোমার ছেলে খাবে?
রাইনা বলল, খাবে। কেন খাবেনা?
পরী বলল, আচ্ছা৷
রাইনা বলল, তুই আমাকে নিজে নিজে হাঁটতে দে। আর কতদিন এভাবে,,,,?
পরী বলল,
‘ তোমাকে আমি আবার নতুন করে হাঁটা শেখাব৷ একদম ছোট বাচ্চাদের মতো৷
রাইনা হাসল। বলল,
‘ তুই আমার মা না?
পরী বলল,
‘ আমি তোমার সেবা না করলে কে করবে? আমি তোমার,,,,,
পরী বলতে পারল না। রেহান রুমে চলে আসল৷ রাইনার ঔষধগুলো ড্রয়ারে রাখতে রাখতে জবাব দিল,
‘ মা যার জন্য তোমার এই অবস্থা, সে সেবা করবে না কে করবে? তার জন্য কেউ হওয়া লাগেনা৷
সাথে সাথে পরীর মন খারাপ হয়ে গেল৷ রাইনা পরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ রেহান?
পরী রাইনাকে ছেড়ে দিল৷ স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে।
রাইনা ডাক দিল,
‘ পরী যাস না। আমি স্যুপটা খাইনি তো।
পরী শুনল না। যাওয়ার সময় পিহুর সাথে ধাক্কা লাগল৷ পরীর চোখে জল দেখে সে অবাক হলো৷ কিছু জিজ্ঞেস করার আগে পরী দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল৷ রান্নাঘরে ইশার সামনে গিয়ে ধপ করে রাখল বাটিটা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
‘ আমমা আমি আর কারোজন্য রান্না করব না।
ইশা বলল, কি হয়েছে? কাঁদছ কেন? কেউ কিছু বলেছে?
পরী কাঁদল। কিছু বলল না।
রাইনা রেহানকে ডাক দিল।
‘ তোর কি আর কোনো কাজ নেই?
রেহান বলল,
‘ সত্যিটা বলেছি মা। আমাকে বকোনা। সত্যিটা তুমি ও অস্বীকার করতে পারবেনা।
রাইনা বলল,
‘ আমি মরে যাই, তুই সেটা চাইছিস না?.
রেহান বলল,
‘ মাআআ?
রাইনা বলল,
‘ মা ডাকবি না আর। সম্পর্কটা একটু একটু করে ঠিক হচ্ছে তুই আবার সব উল্টাপাল্টা করে দিচ্ছিস। আমার আর এসব দেখতে ভালো লাগছে না। আমি বরং মরে যাই।
‘ আমি যা বলি তা ভুল হয়ে যায় মা। সত্যিটা ও তখন ভুল হয়ে যায়৷
রাইনা বলল,
‘ যাহ মেয়েটাকে গিয়ে সরি বলে আয়। যাহ। আমার সামনে বলবি৷ আমি যাচ্ছি তুই যাহ। যাহহ ।
‘ মা!!!
‘ তারআগে আমাকে মা ডাকবি না। আগে পরীকে সরি বলে আয়।
রেহান রেগে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। একদম বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল৷ তার বউ। যেমন ইচ্ছা তেমন করে বলবে। কেঁদে দিতে হয় কেন? আশ্চর্য!
রাতে সবাই খেতে বসল। পরী আর ইশা সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। পরী রেহানের পাশ থেকে বাটিটা নিয়ে ইশাকে বলল
‘ আমমা আমি যাই?
ইশা বলল, ওটা রাখো৷ তোমার আববা খাবে,রেহান খাবে। কত শখ করে রেঁধেছ?
পরী বলল, কারো খাওয়া লাগবে না৷ ভালো হয়নি৷
আদি বলল, এদিকে নিয়ে এসো৷ আমি টেস্ট করে দেখি৷
পরীর হাত থেকে ইশা বাটিটা নিয়ে আদিকে দিল৷ আদি খেতে খেতে বলল,
‘ দারুণ হয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলোর রান্না তো ভারী মজা৷
ইশা হেসে বলল,
‘ এখন ছোট্ট নেই। আপনার মেয়ে এখন বড় হয়েছে৷ দেখুন হাতদুটো ও বড় হয়েছে৷
আদি হাসল৷ পরী হেসে বলল, আববা রান্না আমমা শিখিয়েছে। আমমার মতো হয়েছে?
আদি বলল, তোমার আমমার রান্নার চাইতে ও বেশি ভালো হয়েছে৷
ইশা হাসল৷
‘ আমার মেয়ের রান্না অবশ্যই বেশিই ভালো হবে ডক্টর।
আদি মনে মনে বলল,
‘ ধুরর মিষ্টি তো রাগল না৷।
আদি রেহানকে বলল,
‘ রেহান তুমি নিচ্ছ না কেন? চিংড়িটা পরী রেঁধেছে৷ নাও।
রেহান খেতে খেতে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ আমার খাওয়া হয়ে গেছে।
পরী সাথে সাথে ইশার দিকে তাকাল। ইশা বলল,
‘ আচ্ছা আচ্ছা কাল খাবে৷ খাবেনা রেহান??
রেহান বলল,
‘ হ্যা হ্যা পরে দেখা যাবে।
পিহু পরীকে বলল,
‘ দিদিয়া আমাকে দাও৷ আমি খাব। দাও।
পরী দিল। বলল, মজা না হলে ও বলবে মজা হয়েছে৷ ঠিক আছে৷
পিহু হেসে দিল৷ বলল
‘ হ্যা হ্যা ঠিক আছে৷ ঠিক আছে৷
____________________
গিটার দিয়ে দরজায় টোকা মারল রেহান। দুবার দরজায় টোকা দিতেই দরজা আপনাআপনি খুলে গেল৷ রেহান রুমে উঁকি দিল৷ পুরো ঘর ফাঁকা ৷ সমস্যা কি এই মেয়ের? এতরাতে কই গেল?
রেহান ডাকল,
‘ পরী কোথায় তুমি? পরী?
কোনো আওয়াজ এল না। রেহান আবার ও ডাকল,,, পরী??
কোথাও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রেহান গিটারটি খাটের উপর রাখল। রুম থেকে বের হয়ে পিহুর ঘরে গেল৷ পিহু তখন ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। রেহান আর কোনো কিছু না ভেবে ছাদে পা বাড়াল।
পড়নের খয়েরী রঙের শাড়ির আঁচলটা তখন লেপ্টে আছে ছাদের মেঝেতে। লোহার চেয়ারটাতে বসা মেয়েটি মাথা ফেলে রেখেছে পুরোনো টেবিলটার উপর। ছাদের লাইট বন্ধ। মেয়েটির সামনে জ্বালানো একটি মোমবাতি। মোমের নরম আলোর ছিটে মেয়েটির মুখে এসে পড়ছে৷ মোমবাতি গলে পড়ছে দ্রুত। একদম নিভে গেলে সে চলে যাবে৷
রেহানের রাগ উঠল ছাদের লাইট বন্ধ রাখায়৷ গর্জে বলল
‘ রাত-বিরেতে এখানে এভাবে বসে আছ কেন পরী? ছাদের লাইট অফ কেন?
পরী মাথা তুলল৷ কিন্তু কিছু বলল না৷ রেহান দেখল মোমবাতির মোম গলে আসছে৷ মৃদুমৃদু বাতাসে নিভু নিভু। রেহান বলল,
‘ চলো৷
পরী নড়ল না। রেহান বলল,
‘ কি বলেছি শুনতে পাওনি?
পরী কিছু বলল না। রেহান চাপাস্বরে বলল, চলো।
পরী উঠল না। নীরবে কেঁদে টেবিলে মাথা ফেলে রাখল৷ রেহান ডাকতে গিয়ে ও ডাকল না৷ চেয়ার টেনে বসল পরীর সামনে। পরীর দিকে ঝুঁকে শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি সমস্যা???
পরী মাথা তুলল না। আড়চোখে তাকাল তার সামনে বসা ছেলেটির দিকে৷ সাদা শার্ট পরিহিত সুঠাম দেহের পুরুষটি তার স্বামী। উৎসুক চোখদুটো দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে কৌতূহল নিয়ে।
ছলছলে চোখদুটো দেখে রেহানের কন্ঠ হয়ত নরম হয়ে আসল৷ এবার নরম কন্ঠে বলল,
‘ কি হয়েছে?
পরী মাথা তুলল৷
থমথমে মুখটা খুলল এবার।
‘ কিছু হয়নি। আপনি যান।
রেহান বলল,
‘ তুমি এখানে বসে বসে কি করবে? চলো৷
পরী কিছু বলল না।
রেহান বিরক্ত হলো। বলল,
‘ যাবে কি যাবে না?
পরী তার ধমকে কেঁপে উঠল। চোখ তুলে তাকানোর সাথে নাক টেনে ফুঁপিয়ে উঠল। বলল,
‘ না গেলে কি করবেন? আমি গিয়ে কি করব ? আমি যাচ্ছি না এতে তো আপনার জন্য ভালো হচ্ছে। আপনাকে সোফায় ঘুমোতে হচ্ছে না৷ যান আরাম করে বিছানায় ঘুমোন। আমি ঘুমোবো না৷ যাব না।
রেহানের চাপা রাগ ফুঁসে উঠল। তারপর ও সে তার রাগ চেপে ধরল। বলল,
‘ এখানে নয়,কথাটা ঠিক ড্রয়িংরুমে বললে বেশ খুশি হতাম৷ বিশেষ করে মায়ের সামনে।
পরী কেঁদে দিল সাথে সাথে।
রেহান বলল,
‘ কেন কাঁদছ পরী? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? তুমি নিজেই আমাকে বারণ করেছ তোমার কাছে না ঘেঁষতে। তোমাকে না ছুঁতে৷ তাহলে? এখন? কি চাইছ তুমি? আমি বাসায় একদম না আসি৷ যদি তাই চাও তাহলে তাই হবে। আমি বাসায় আসা বন্ধ করে দেব। তুমি ভালো থাকবে। এবার চলো। আজ কোনোমতে কাটাও।
পরী একদম চুপ হয়ে গেল।
‘ এই বেয়াদব লোকটা কি পাগল? সে আর কোনোকথা বলবে না লোকটার সাথে। কিচ্ছু বুঝেনা। কিচ্ছু না।
পরী উঠে চলে গেল৷ রেহান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আজব মেয়েমানুষ। কিছু বলা ও যায় না।
____________
তারপরের দিন রাতে পিহু মাথা ব্যাথার কারণে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল। রাত দশটার দিকে চট করে তার ঘুম ভেঙে গেল।
ঘুম ঘুম চোখে সে পুরো রুমে এলোমেলো হাঁটল। বালিশের নিচে রাখা ক্যালেন্ডারটি বের করে রেড পেন দিয়ে আর একটা তারিখ ক্রস করে দিল৷ কপালের একপাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল বিড়বিড় করে বলল,
‘ মাহিদ ভাই ছবছর অনেক সময়৷ দেখোনা এখনো মাত্র দুমাস পেরিয়েছে। তুমি ছমাস পর চলে এসো৷ নিহার সাথে প্রেম করো, আনিসার সাথে প্রেম করো, আমি কিচ্ছুটি বলব না৷ আমি চিঠিগুলো তাদের দিয়ে দেব। আমি চিঠিগুলো দিতাম না তা তুমি জেনে গেছ তাইনা? সেজন্য রেগে,,,, চলে যাওয়ার সময় তুমি আমার সাথে কথা বলোনি৷ দেখো তুমি চলে আসো, আমি তোমাকে সরি বলব। কিন্তু এতগুলো বছর কখন ফুরোবে? এতগুলো বছর আমি কিভাবে থাকব? মাহিদ ভাই তুমি আমাকে ভালো বেসোনা। ও-ই দূরে থাকলে ও আমি খুশি। দিনশেষে তুমি ভালো আছ এটুকু দেখে আমি ও ভালো থাকব। কিন্তু তুমি দূরে থেকোনা।
পিহু রুম থেকে বেরিয়ে গেল। হাতের কব্জি দিয়ে ভেজা চোখ মুছল। পরীর রুমের কাছাকাছি গিয়ে সে থমকে গেল৷ পরী কথা বলছে ফোনে৷ পিহু ডুকে পড়ল রুমে। পিহুকে দেখে চট করে চোখমুছে বলল,
‘ ভাই তুই কবে আসবি? তোকে ছাড়া আমার একটু ও ভালো লাগছেনা৷ ওখানে গেলে খালি খালি লাগে৷ তোকে ছাড়া কেউ ভালো নেই৷
ওপাশ থেকে আওয়াজ এল।
‘ এখন যাইতে পারুম না বাপ। বুঝোনা ক্যান?
পরী বলল, ‘ তুই আমাকে একটুও ভালোবাসিস না।
ওপাশ থেকে আবার ও আওয়াজ এল,
‘ আরেহ তোমার লগে মনপুড়ে তাইতো কল দিই রোজ৷ নইলে দিতাম নাকি?
পরী একটুখানি হাসার চেষ্টা করল। বলল,
‘ আমার জন্য তুই কি আনবি আসার সময় ?
ওপাশের ছেলেটি অট্রহাসি দিয়ে বলল,
‘ ভাইয়ের বউ। কেমন হবে?
পরী হাসল৷ ছেলেটি বলল,
‘ এখন রাখতাছি বাপ। আমারে ফোন দিতাছে।
পরী বলল,কে দিচ্ছে? মাহি? এই মাহি??
পরী পিহুকে বলল,’ দেখেছ ছেলেটা কি পাগল? ওমা তোমার সাথে তো কথা বলতে দেওয়া উচিত ছিল৷
পিহু হাসল। বলল, না দরকার নেই। পরী বলল,
‘ তোমার ও মন খারাপ?
পিহু মাথা নাড়াল। তার এলোমেলো চুলগুলো দেখে পরী বলল,
‘ এদিকে এসো চুলগুলো বেঁধে দিই ভালোকরে৷
পিহু চিরুনি দিল৷ পরী তার চুলগুলো বেঁধে দিল৷ বলল, এখন ভালোলাগছে।
পিহু পরীর দিকে তাকাল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পরীকে। পরী চুপ হয়ে তাকে ও জড়িয়ে ধরল। পিহু বলল,
‘ দিদিয়া তুমি ভালো আছ?
পরী কিছু বলতে পারল না। পিহু বলল,
‘ তুমি দাভাইকে ভালোবাসো দিদিয়া?
পরী কিছুই বলল না। পিহু পরীকে ছাড়ল৷ পরীর মুখ দু’হাতে আগলে ধরল। টলমলে চোখে হেসে বলল,
‘ দিদিয়া তুমি জানো? তুমি কতটা লাকি?
তুমি এখন যাকে ভালোবাসো, সে তোমাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসে৷ তুমি খুব লাকি দিদিয়া যে দাভাই তোমাকে ভালোবাসে। সো লাকি ইউ।
পরী বলল, আমি লাকি??
পিহু মাথা নাড়াল। পরী বলল,
‘ তুমি কেন কাঁদছ পিহু?
পিহু চট করে চোখ মুছল৷ বলল, ওই না একটু।
পিহু পরীর দুহাত দেখল৷ বলল,
‘ দিদিয়া তোমাকে মেহেদী পড়িয়ে দিই??
পরী বলল,
‘ না না।
পিহু একটুখানি হেসে পরীকে জড়িয়ে ধরল৷ পরী বোনের গালে আদর দিল৷ পিহু ও দিল। পিহু বলল,
‘ আমি মেহেদী পড়াবো তোমায়৷ তুমি চুপচাপ বসে থাকো৷
পিহু মেহেদী আনল৷ পরীর দুহাতের তালুতে মেহেদী পড়াল৷ বারবার চোখ ভিজে উঠল। কত জায়গায় যে মাহি মাহি লিখে ফেলল সে নিজে ও টের পেলনা৷ ফুল এঁকে সেই নাম আবার ঢেকে দিল। রেহান রেহান লিখে দিল।
তারপর মেহেদী বিছানায় ছুড়ে মেরে দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের রুমে চলে যাওয়ার আগে রেহানের সাথে দেখা হলো। পিহুকে দেখে রেহান বলল,
‘ কি হয়েছে পিহু?
পিহু ঝাপটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,
‘ দাভাই দিদিয়া তোমাকে ভালোবাসে। তুমি বাসো৷ তুমি দিদিয়াকে কষ্ট দিওনা। দিদিয়াকে তুমি না বুঝলে কে বুঝবে? প্লিজ দাভাই সব ঠিক করে নাও৷
পিহু চলে গেল দৌড়ে দৌড়ে। রেহান ডাকল, কেন কাঁদছ পিহু? দাঁড়াও৷ পিহু?
পিহু চলে গেল৷ ফিরল না। দাঁড়াল না৷ পিহু চাইল না কেউ তার কষ্টগুলো দেখুক। তার এই কষ্টগুলোর কোনো মানে নেই। একপাক্ষিক ভালোবাসার কোনো দাম নেই। চিরকাল তাদের একাই ভালোবেসে যেতে হয়। তাদের মনের কথাগুলো চেপে রাখতে জানতে হয়। পরী রেহানের মতো কয়জনই বা তাদের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পায়?
পিহু আজ থেকে আর চাইল না তার মাহিদ ভাইকে। শুধু চাইল মাহিদ ভাই যাকে চাই তাকে নিয়ে ভালো থাকুক৷ মাহিদ ভাই যেখানে থাকুক ভালো থাকুক৷
___________________
রেহান পিহুর কথা ভেবে ভেবে রুমে পা রাখল৷ দেখল গাঢ় গোলাপি রঙের শাড়ি পড়া মেয়েটি দুহাত ভর্তি মেহেদী পড়া হাতে ফুঁ দিচ্ছে ঘনঘন। তাকে দেখে একবার চোখ তুলে তাকাল। আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ রেহান গায়ের শার্ট ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য শার্ট গায়ে দিল। ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে পরীর পাশে শুয়ে পড়ল। পরীর সাথে জড়ানো কাঁথাটা টেনে নিজের গায়ের উপর রাখল৷ তারপর চোখের উপর হাতের কব্জি রেখে ঘুমোনোর চেষ্টা করল৷ পরপর কয়েকবার চেষ্টা করে ও তার চোখে ঘুম নামাতে সফল হলোনা৷ কারণটা উদঘাটন করে দেখতেই দেখা গেল তাঁর পাশের মেয়েটি এখনো বসে আছেওইভাবে পা গুটিয়ে। হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। রেহান কিছু বলল না। চুপচাপ উঠে বসল। তার পাশের মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে মেয়েটির সামনাসামনি গিয়ে বসল। বলল,
‘ ঘুমোবে কখন?
পরী মাথা তুলল না। হাতের মেহেদী গুলোর দিকে তাকিয়েই থাকল৷
রেহান বলল, কি বলেছি আমি?
পরী মাথা তুলল। এবার চোখাচোখি হলো চারচোখ। পরী নাক টেনে বলল,
‘ আমি আপনাকে ভালো টালো বাসি না। সবটা মিথ্যে। আমি এমন একটা লোককে কখনোই ভালোবাসিনা।
রেহান এমন প্রত্যুত্তরে অবাক হলো। ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ভাসল। রেহান একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল
‘ আপনার হাতের মেহেদীতে লেখা নামটি তো অন্য কথা বলছে ম্যাডাম।
পরী আবার ও নাক টানল। বলল,
‘ না আমি ভালোবাসি না আপনাকে। কখনোই বাসব না। আপনি ছুঁবেন না আমাকে।
রেহান একটুখানি দূরে সরার মতো করে বলল,
‘ ছুঁবোনা। বলেছি না তুমি না বলা পর্যন্ত ছুঁবোনা। তাই ছুঁলাম না৷
পরী ফুঁপিয়ে উঠল। চোখের জলগুলো তাড়াতাড়ি লুকোতে গিয়ে ও পারল না। হাতদুটো যে বন্দী। হাতের কব্জি দিয়ে মুছার অব্যর্থ প্রয়াস চালালো। রেহান হাতের কব্জি ধরল তার। পরী শিহরিত হলো। বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো রেহানের কান অব্ধি পৌঁছালো না। রেহান হাতের উল্টোপাশে তার ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিল৷ পরী চট করে হাত সরিয়ে নিল। কাঁপা কাঁপা পায়ে নিচে নামতেই রেহান তার পা দুটো নিজের দখলে নিয়ে নিল৷ ধমক দিয়ে পরীর ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বলল,
‘ একদম চুপ।
পরী একদম চুপ হয়ে গেল। ভয়ার্ত চোখে রেহানের দিকে তাকিয়ে থাকল৷ রেহান তার শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা পড়িয়ে দিল। গায়ের শার্ট ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
‘ এটা কি মেহেদী পড়ার সময়? সবসময় আমার শার্ট নষ্ট করার ধান্ধা তাই না?
পরী চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে রাখল। মুখের উপর তপ্ত নিঃশ্বাস পড়তেই রেহান বলল, চলে যাচ্ছি আমি।
পরী সাথে সাথে চোখ খুলল। দুটো গম্ভীর চোখের চাহনি দেখে সে ভড়কে গেল। আশপাশ তাকাতেই বুঝতে পারল সে একেবারে ফেঁসে গিয়েছে।
ঘোমটা পড়া বধূটির মুখ আগলে ধরে থুতনি, ঠোঁট আর নাকের উপর চট করে ব্যাক্তিগত কাজটি সেড়ে ছেলেটি মেয়েটির কানে কানে বলে দিল, আজ খুব গভীরভাবে ছুঁয়ে দিলাম। এই অপরাধের শাস্তি কি হবে?
কাঁপাকাঁপা গলায় মেয়েটি কিছু বলতে পারল না। ঠোঁটের উপর দ্বিতীয় আক্রমণ শেষে সে লজ্জায় মুখ লুকোনোর চেষ্টায় ঝাপটে জড়িয়ে ধরল ছেলেটিকে। ছেলেটির গলার কাছে মুখ ঘষতে ঘষতে মিনমিন করে বলল,
‘ আমি,, বাসি।
ছেলেটি একগাল হাসল। মেয়েটির গলার পাশে মুখ রেখে বলল,
‘ আমি আর ও আগে থেকে বাসি৷
মেয়েটি নড়তে পারল না৷ আবেশে বন্ধ হয়ে এল চোখ৷ হয়ত হৃৎস্পন্দন ও। মান অভিমানের পালা শেষ হয়ে দুটি মন দুটি হৃদয় আজ এক হলো। খোলা ব্যালকণির ফাঁক দিয়ে একটুকরো জ্যোৎস্না উঁকি দিয়ে দেখল তাদের। রচিত হলো একটি ভালোবাসার গল্প। আজ ভালোবাসার দিন। ভালোবাসায় ভেসে যাওয়ার রাত।
চলবে,
( গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি),