#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আদি গাড়ি চালায় ফুল স্পীডে। চৌধুরী বাড়ির সামনে গাড়ি দাড় করায়। ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর ডুকে পড়ে। আলিয়া দৌড়ে আসে তাকে দেখে। বলে,
‘ আদি আজকে ইমির বাসায় যাওয়ার কথা ছিল না? যাওনি ? শপিংয়ে যাবে বলেছিলে না?
আদি পুরোটা সময় চুপ থাকে। কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনা। কি বলবে সে? সে আজ একটা বাইরের মেয়ের কাছ থেকে অপমানিত হয়ে এসেছে? এই মেয়েটা তাকে নির্লজ্জ বলল? তাকে বেহায়া বলল?
এত এত কথা তাকে বোধহয় আজ অব্ধি কেউ শোনায়নি। কিন্তু তারপর ও সে ভয়ংকরভাবে রেগে যেতে পারছেনা। কিসের এত দেমাক মেয়েটির? মেয়েটির এমন কি আছে যার জন্য আদি চৌধুরী অমন একটা মেয়ের জন্য পাগল হয়ে যাবে। তার পেছনে ঘুরঘুর করবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তো আদির নিজের কাছে ও নেই।
সে নিজের রুমে চলে গেল। আলিয়া হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আদি এত চুপ কেন?
রুমে ডুকে সে বিছানায় বসল। কি থেকে কি হয়ে গেল সে বুঝে উঠতে পারছেনা। মেয়েটাকে তো সে সাহায্য করতে গিয়েছিল। এত এত কথা শোনানোর মানে কি?
আদি মেয়েটার চাইতে নিজের উপর বেশি রেগে যাচ্ছে। সে কেন তখন মেয়েটাকে দুটো কথা শোনাতে পারেনি?
বিছানার একপাশে বসানো পুতুলটি। তাতে চোখ পড়ল আদির। সে হাত দিয়ে টেনে সেটিকে তার সামনে বসাল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সেটিকে দেখল। হঠাৎ তার কিছু একটা মনে পড়ল। সে দ্রুত গতিতে তার ওয়ারড্রবের কাছে গেল। আলব্যামটি হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টালো। ছবি ছাড়া সে যখন কিচ্ছু পেলনা তখন ছবিগুলোর দিকে চোখ গেল। ছবিতে থাকা মেয়েটির মাথা তার কাঁধে। বাহু জড়িয়ে কি সুন্দর করে মেয়েটি হাসছে? এটিই ইমি।
আদি ছবিটা আলব্যাম থেকে খুলে নেয়। হাসিমাখা মুখটির দিকে সে চেয়ে থাকে । ইমি সুন্দর। অপূর্ব সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দর। কিন্তু এই সুন্দর কোনোভাবেই আকৃষ্ট করছেনা আদিকে। সে কেন চেষ্টা করে ও মুগ্ধ হতে পারছেনা। দৃষ্টি স্থির রাখতে পারছেনা? এত বিব্রতভাব কেন? কেন এত আড়ষ্টতা?
ছবিটা খানিকক্ষণ দেখে সে রাখতে যায়। চোখে পড়ে আর ও একটি চিরকুট। ছবির নিচে ও চিরকুট?
আদি তাড়াহুড়ো করে সামান্য উত্তেজিত হয়ে বের করে সেই চিরকুট। ভাঁজ খুলে গুটিগুটি হাতের সেই লেখাগুলো চোখে পড়ে। তাতে লেখা,
‘ মিষ্টির জন্য টেডিবিয়ার এনেছেন তো ডক্টর?
আদির অবাক হয়ে পুতুলটির দিকে তাকায়। এটির কথা বলেনি তো মিষ্টি?
বাকি ছবিগুলোর ভাঁজে আরো চিরকুট পাওয়ার আশায় আদি সব ছবিগুলো বের করে। তার অনুমান ঠিকই হয়। একটি একটি চিরকুট বেরিয়ে আসে ছবির নিচ থেকে। চাপা উত্তেজনা কাজ করে আদির মধ্যে। একটি একটি চিরকুট হাতে নিয়ে সে চোখ বুলায়।
‘ ডক্টর,
আপনি যদি সত্যিই মিষ্টির খোঁজ পেতে চান তাহলে এক মন কেমনের বৃষ্টিতে মাঝরাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবেন। কিংবা বকুল তলায়। কোনো না কোনো ভাবে হয়ত মিষ্টির সাথে দেখা হবে কিংবা আপনি তাকে অনুভব করতে পারবেন।
আদি কোনোকিছু ভেবে উঠতে পারেনা। উত্তেজনা তার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সে আবার চোখ বুলায়,
‘ আপনি কি এখন আর পায়েস খান না ডক্টর? শুনেছি আপনি নাকি মিষ্টি ভালোবাসতেন না। ঝাল খেতে পছন্দ করতেন। মিষ্টির সাথে সাথে মিষ্টি খাওয়া ও ভুলে গেছেন আপনি? তাহলে সেইসময় কেন এত ভালোবেসেছিলেন ডক্টর? এটা কি সত্যিই ভালোবাসা ছিল,নাকি এই অসহায় মেয়েটিকে ফাঁদে ফেলেছেন। ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে আপনি আমার সাথে অন্যায় করেননি তো?
আদির হাত কেঁপে উঠে। সে ঘনঘন শ্বাস নেয়। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে, অন্যায় কেন হবে? আমি সত্যিই ভালোবেসেছি নিশ্চয়। কিন্তু মিষ্টি যদি এতই ডক্টরকে ভালোবাসে তাহলে সে অন্য কারো সাথে সংসার। অন্য কাউকে বিয়ে? না সে তো অনেক আগে থেকেই বিবাহিত ছিল। তাহলে ভালোবাসার প্রশ্ন কেন আসছে? একটা বিবাহিত মেয়েকে কি করে? মা আর বাবা তাকে মিথ্যে বলেনি তো?
প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আদির মাথায়। সে আবার চিরকুট গুলোতে চোখ বুলায়।
‘ আপনি জানেন ডক্টর আমার প্রত্যেকটা রাত নির্ঘুম কাটে। কারণ হুট করে কেউ একজন আমার মাথার ছোট্ট বালিশে এসে মাথা রাখেনা। বলেনা, মিষ্টি আমি ও এভাবে ঘুমোয়?
তার উষ্ণ নিঃশ্বাসের আওয়াজ তো আমার ঘুমের ঔষধ ছিল। ঔষধটা ও নেই আমার চোখে ঘুম ও নেই।
কেউ আচমকা ঘুমের মাঝে আমাকে বুকে টেনে নেয়না। ঘুম ঘুম জড়ানো কন্ঠে কেউ বলেনা, মিষ্টি তুমি এভাবে ঘুমো। এটা তোমার পানিশ। কারো উষ্ণ চুম্বন ঢেউ খেলেনা আমার কপালে। আমার ঘুম আসেনা ডক্টর। আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। আপনাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার শাস্তি আমি পাচ্ছি। প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। এই দেখুন না আপনি চলে গিয়েছেন মাত্র কয়েকদিন হচ্ছে, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি আপনাকে কতদিন দেখিনা। কতকাল দেখিনা। কতকাল ছুঁই না। আপনার রাগগুলোকে আমি খুব মিস করি ডক্টর। আপনার অভিমানী চোখগুলোকে আমি মিস করি। আপনার মুখের ‘মিষ্টি’ ডাকটাকে আমি খুব মিস করি। আপনার মুখের সেই ভালোবাসি শব্দটাকে আমি খুব মিস করি। আমি আপনাকে খুব খুব মিস করছি ডক্টর। আপনার কি মনে পড়েনা মিষ্টিকে? এ কেমন শাস্তি ডক্টর? আমার কষ্ট হয়। কষ্ট হচ্ছে। আপনি কি কখনো ছুটে আসবেন না এই মিষ্টির কষ্টগুলো লাঘব করে দিতে? ভালোবাসি শব্দটা কি শুধু মুখের কথা ছিল? কখনো কি ভালোবাসেননি আমায় আপনি?
আদির মনে হলো এই চিরকুটের লেখা শেষ না হলেই ভালো হত। বাকি চিরকুট গুলো আজ সে আর পড়বে না। সেগুলো সে খুব যত্নে রেখে দিল আলব্যামের পাতায়। এত আবেগ ভালোবাসা মেশানো কথাগুলো মিষ্টি লিখল ডক্টরের উদ্দেশ্যে। প্রশ্ন ও ছুড়ল। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তো কোনো অপশন রাখল না। আদি চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থাকে অনেকক্ষণ। আচ্ছা যদি উত্তর দেওয়ার অপশন থাকত। যদি চিরকুট মিষ্টির কাছে পাঠানো যেত তাহলে সে কি লিখে পাঠাত?
আদির চাপা উত্তেজনা বেড়ে যায়। সে খাতা কলম নিয়ে বসে। গুটিগুটি হাতে লিখে ফেলে,
‘ ডক্টর আপনাকে আজ ও ভালোবাসে মিষ্টি।
পরক্ষণে নিজের হাতের লেখা দেখে সে নিজে নিজেই চমকে যায়। এটা কি লিখল সে? যদি ইমি এসব দেখত এখন?
ভেতর থেকে বিদ্বেষী স্বত্বার তিক্ত কথা বেরিয়ে এল।
‘ এসব কি উল্টাপাল্টা লিখছ আদি? তোমার জীবনে ইমিই সত্যি। ইমিই শুরু। ইমিই শেষ। তুমি ইমিকেই ভালোবাসো।
আদি মাথা ঝাকায়। বলে, হ্যা আমি ইমিকেই ভালোবাসি। অন্যকাউকে না।
_______________________
আফাজ আহমেদের সম্ভিৎ ফিরল দরজার কড়াঘাতে। চোখের চশমা ঠিক করে তিনি দরজা খুলতে গেলেন। আইমিকে হঠাৎ এতরাতে নিজের রুমে আসতে দেখে তিনি ভড়কে গেলেন। উদগ্রীব হয়ে বললেন,
‘ কোনো সমস্যা হয়েছে মা?
আইমির চোখ শান্ত। সে হেসে বলে, এমনি কি আসতে পারিনা বাবা?
আফাজ আহমেদ গিয়ে বিছানায় বসেন। বলে,
‘ আয়। হঠাৎ কি মনে করে? ডক্টর কি বিজি নাকি?
আইমি হাসে। বলে,
‘ না। কিছুক্ষণ আগেই তো কথা হলো। ভাবলাম তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে যাই।
‘ ওহহ। এই কথা। চেয়ার পেতে বোস।
আইমি চেয়ার নেয়না। মেঝেতে হাঁটু ভেঙ্গে বাবার কোলে মাথা রেখে বসে। আফাজ আহমেদ ভড়কে যান মেয়ের এমন কান্ডে। তার কষ্ট হয়। আইমির যখনি মা বোনের কথা কথা মনে পড়ে তখনি সে বাবার কাছে আসে। আজ ও কি তার মা বোনের কথা মনে পড়ছে?
আফাজ আহমেদ ভয়ে ভয়ে ডাকে। ইমি…….
আইমি মাথা তুলে তাকায়। বলে,
‘ বলো বাবা।
আফাজ আহমেদ মুখে হাত বুলিয়ে দেন। বলে,
‘ মা বোনের কথা মনে পড়ছে?
চেহারা দেখে নিজের ভেতরের কষ্টগুলো বুঝে ফেলায় আইমির গাল বেয়ে অশ্রুধারা বেয়ে পড়ে। সে ঝরঝর করে কেঁদে ডাকে,
‘ বাবা।
আফাজ আহমেদ অশ্রুসিক্ত নয়নে হাসে। বলে,
‘ আমি তোর বাবা। তোর কষ্ট গুলো আমি অনুভব করতে পারি।
আইমি ডুকরে কেঁদে উঠে বলে,
‘ মা আর বোন থাকলে আমাদের বাড়িটা পরিপূর্ণ থাকত। তাইনা বাবা? আমার বিয়ে শুনে তারা কত খুশি হতো? বোনটা ও কত খুশি হতো। তুমি জানো আমার মাঝেমাঝে নিজেকে খুব একা লাগে। খুব কষ্ট হয় বাবা। পৃথিবীতে কেউ সুখী নয় বাবা। আমি ও সুখী নয়। আমার মা নেই। একটা ভাইবোন নেই। এই একাকীত্ব আমার ভালো লাগেনা বাবা। মা বোন যদি আবার ফিরে আসত? আয়মান যদি থাকত, আমাকে আপু বলে ডাকত। সারাক্ষণ আমার সাথে সাথে থাকত।
আফাজ কান্নাহাসিতে ভাসে। বলে,
‘ যা কখনোই হওয়ার নয়। তা নিয়ে কেন এত ভাবছিস? তোর কেন একা লাগবে। আমি তো আছি। সবচেয়ে বড় কথা আদি আছে। তোর পৃথিবীটা তাকে ঘিরে হওয়া উচিত। তুই একা কোথায়?
আইমি বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আদি কি সত্যিই আছে বাবা? যদি সে থাকে তাহলে আমি তার চোখে আমাকে কেন দেখিনা? তার মুগ্ধ চাহনি কেন দেখতে পায়না? তার চোখে আমি আমার জন্য শুধু বন্ধুত্বটা দেখতে পায়। ভালোবাসা নয়। আদি নিজের উপর চাপিয়ে দেয় একটিই কথা, সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু সত্যিটা তো এই যে, সে আমায় কখনো ভালোবাসেনি। না ভাসে। না ভাসবে। ওর চাওয়া ও নিজেই বুঝে উঠতে পারছেনা। আমি এখন কি করব বাবা? আদিকে তো আমি সত্যিই ভালোবাসি। যদি কোনোদিন আমি নিশ্চিত হয়ে যায় আদি আমাকে ভালোবাসেনা তখন? তখন আমি কোথায় যাব? কার কাছে যাব? আদি সারাক্ষণ জপে যায় যে সে আমায় ভালোবাসে। কিন্তু তার মন বলেনা এই কথা। আমি তাকে ভালোবাসি তাই আমি বুঝতে পারি। সে অন্যের কাছ থেকে নিজেকে লুকোনোর জন্য বলে বেড়ায় আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে কে বাবা? যাকে সে শুরু থেকে ভালোবাসে। এখন ও বাসে। তাকেই ভালোবাসবে। ইমিকে কক্ষনো নয়। আমি তো ভালোলাগা। বন্ধু।
আফাজ আহমেদ মনোযোগ দিয়ে আইমির কথা। বলে, এসব তুই কি বলছিস ইমি? আদি শুধু তোকেই ভালোবাসে? অন্য কেউ কে হবে? আদি তো তোকে ছাড়া আর কারো সাথেই মিশেনা। আদি তোকেই চায়। তুই ওকে বুঝতে পারছিস না।
‘ আমি ওকে বুঝতে পারি বাবা। ও নিজেই নিজেকে বুঝতে পারেনা। ও নিজে কি চায় সেটা বুঝতে পারেনা। ও নিজেই নিজেকে পড়তে পারেনা?
‘ কিন্তু আদি তো তোকেই বিয়ে করবে বলেছে। অন্য কাউকে নয়। প্রশ্নই আসেনা।
আইমি হাসে। বলে,
‘ ও বলছে তাই আমি ও করছি। আমি ওকে ভালোবাসি বাবা। ও যা বলছে তাই আমি তা মেনে নিচ্ছি। কারণ আমি ওকে হারাতে চাইনা। আমার ভয় হয় খুব, বিয়ের পর যদি আমি বুঝতে পারি সে অন্যকাউকে ভালোবাসে তখন আমি কি করব?
ও কখনো বলবে না আমায় সত্যিটা। কিন্তু নিজে ধুঁকে ধুঁকে মরবে। আমায় ও মন থেকে মেনে নিতে পারবেনা। কখনো পারবেনা।
আফাজ আহমেদ চিন্তায় পড়ে যান। এসব কি বলছে ইমি?
আইমি বেরিয়ে যায় রুম থেকে। নিজের রুমের দিকে এগোয়। তার কানে বাজে,
‘ যেকোনো কিছুতেই আমার তোমাকে চায় ইমি। আমার পাশে আমি সবসময় তোমাকে চায় ইমি। আমার ভালো সময়ে ও আমি তোমাকে চায় । আমার হাসিতে ও আমি তোমাকে চায়। কিন্তু আমার মন খারাপের দিনগুলোতে আমি তোমাকে পাশে রাখতে পারব না ইমি। কারণ এই মন খারাপ গুলো আমার একান্ত ব্যক্তিগত। আমার মন খারাপের সময় আমি তোমাকে পাশে এ কারণেই চায়না, কারণ তুমি কষ্ট পাবে। আর আদি কখনো ইমির কষ্ট সহ্য করতে পারবেনা। কিন্তু আমার অজান্তে তুমি আমার মন খারাপের সময় আমার পাশে চলে আসো। আমি ব্যাথিত হই ইমি। আমার কষ্ট হয়। তুমি থেকো আমার বন্ধু হয়ে। আমার ছায়া হয়ে। আমার ঢাল হয়ে। আমার জীবনসঙ্গী হয়ে। আমি তোমাকে ভালো রাখব। সুখে রাখব। কিন্তু ওই ভালোবাসা নামক শব্দটা তোমার থেকে উচ্চারিত হোক। আমারটা খাঁচায় বন্দী থাকুক। কোনোদিন যদি মনে হয় ওই খাঁচার দরজা তুমি খুলতে পারবে সেদিন আমার পক্ষ থেকে সত্যি সত্যি উচ্চারিত হবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তো সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। তুমি বিশ্বাস করোনা সেই কথা। বিশ্বাস করতে চাওনা। কেন করতে চাওনা সেটা আমি জানিনা। কোনোদিন যদি সে কারণ তুমি খুঁজে পাও আমায় প্লিজ বলো ইমি। আমি জানতে চায়। শুনতে চায়। বুঝতে চায়।
আইমির চোখের জল গড়ায়। আদি কি কখনো কোনোভাবে মিষ্টিকে ভালোবাসে?
না সে কি করে হতে পারে? আদি তো তখন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। মিষ্টির আগে, ইমির আগে যদি কেউ থেকে থাকে সেই আদির ভালোবাসা। কিন্তু কে সে? তার কাছ থেকে আদি কেন নিজেকে লুকোয়?
সে কোন মন কেমনের বৃষ্টি? সেই বৃষ্টি কোথায় হয়। কার কাছে গিয়ে রয়? কোথায় থেমে যায়? কোথায় তার শুরু? আর কোথায় তার শেষ?
__________________________
নিচে হাসি ঠাট্টার আওয়াজ শুনতে পায় ইশা। এই ভরসন্ধ্যায় কারা আসর জমালো নিচে? রিপদার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আর একটি পরিচিত গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইশা হাতের চিরুনি টেবিলে রেখে চুলগুলো কোনোমতে হাত খোঁপা করে রাখে। পরী মেঝেতে বসা। খেলছে মিনির সাথে। মিনিকে অদৃশ্য কিছু খাইয়ে দিচ্ছে। আর খিলখিল করে হাসছে। ছোট্টছোট্ট আওয়াজ বের করে ডাকছে,মিনননি মাম?
মিনি লাফিয়ে লাফিয়ে ডাকে, মাম। পরী ছোট একটি প্লাসটিকের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে মিনিকে বলে, মিনননি মাম।
মিনি গ্লাসটাতে ঠোকর দেয়। পরী খিলখিল করে হাসে। হাতের বাটি থেকে মুনা যেভাবে ওকে খাওয়ায় সেভাবে অদৃশ্য কিছু একটা আঙুলের মুঠোয় ধরে মিনিকে বলে,
মিনননি আম।
মিনি তার ছোট্ট হাতে সামান্য ঠোকর দেয়। পরী তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেয়। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে মিনিকে মারতে চায়। আওয়াজ করে বলে, উফফ।
মিনি আরেকটা ঠোকর দিয়ে উড়ে যায়।
পরী কাঁদেনা। ইশার দিকে টলমলে চোখের পানি নিয়ে তাকায়। ইশা যেতে যেতে থেমে যায়। পরী ঠোঁট বাকায়। হাতটা দেখিয়ে বলে,
‘ ফিপি দুঃক্কু।
ইশা আদর করে বলে, মিনননি দুঃক্কু দিয়েছে?
পরী মাথায় নাড়ায়। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়ে ইশার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে নেওয়ার জন্য। ইশা বলে, কিন্তু আমিতো নিচে যাচ্ছি পরী। তোমাকে কি করে নেব? এখানে খেলা করো। আমি এক্ষুণি আসছি। পরী আরো জোরে কাঁদে। যেন তাকে কে মেরেছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল বানিয়ে ফেলে। ইশা তা দেখে হাসে। পরী আবার ও হাত বাড়িয়ে দেয় ইশার দিকে। ইশা তারপর ও কোলে নেয়না। গলার স্বর উঁচু করে ডাকে,
‘ ভাবী তোমার মেয়ে কাঁদছে নিয়ে যাও।
মুনা দৌড়ে আসে। ব্যস্ত হয়ে পরীকে কোলে নিয়ে বলে, তোর বড়দা আছে। আর তুই ওকে কাঁদাচ্ছিস?
ইশা চুপ থাকে। পরী গলা জড়িয়ে ধরে মুনার। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে। মাথা তুলে মুনাকে আঙুল দিয়ে ইশাকে দেখিয়ে দেয়। বলে, মাম্মা ফিপি।
মুনা বলে, ফিপি মেরেছে?
ইশা তারপর ও চুপ থাকে। মুনা আবার ও জিজ্ঞেস করে, ফিপি কি করেছে?
পরী আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, দুঃকককু।
ইশা আড়চোখে তাকায় পরীর দিকে। চোখ লাল করে তাকায়। মনে মনে হাসে। পরী তার ধমক দেখে আর ও জোরে কাঁদে। মুনার চুল টেনে ধরে। নখ দিয়ে মুনাকে আঁচড় দেয়। মুনার গালে গাল লাগিয়ে রাখে জোরে ঠেসে। মুনা হেসে কুটিকুটি হয়। এত রাগ মেয়েটার?
ইশা হেসে উঠে। পরীর চোখের কাছ গিয়ে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে, একটা দেব!
পরী এবার পুরো রুম কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে। মুনা চিন্তিত হয়ে বলে, কি হয়েছে আমার মায়ের? কে মেরেছে?
পরী কাঁদে জোরে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ইশাকে। মুনার গালে কামড় লাগাতে যায়। মুনা হাসতে পরীকে সোজা করে তার দিকে তাকানোর জন্য চেষ্টা করে। পরী সর্বশক্তি দিয়ে চেপে যায় তার ঘাড়ের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে ডাকে, ফিপপি।
মিনি ডেকে উঠে,
‘ মিষ্টি, পরী ব্যাড গার্ল। ব্যাড গার্ল।
ইশা হাসে। পরীকে আরেকটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য মুনার পিছু গিয়ে দাঁড়ায়। হাত দেখিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘ খুব খুব মারব।
পরী হাত পা ছুড়ে এবার। গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠে। মুনার মাথায় তার মাথা ঘনঘন বাড়ি খাওয়ায়। মুনা নিজে আঘাত পায় । পরী ও আঘাত পায়। পরী কাঁদে জোরে জোরে।
হুড়মুড় করে রুমে ডুকে পড়ে রিক। গম্ভীর কন্ঠে বেশ রাগ নিয়ে উচ্চারণ করে,
‘ কি হয়েছে?
মুনা ভড়কে যায়। আমতাআমতা করে বলে,
‘ ওই এমনি মিনির সাথে ঝগড়া হয়েছে।
রিক উৎকন্ঠিত গলায় বলে,
‘ আজ কি আবার ও ঠোকর মেরেছে? ব্যাথা পেয়েছে? রক্ত এসেছে?
মুনা না না করে বলল, না না তেমন কিছুনা।
পরী রিকের গলার আওয়াজ শুনে মাথা তুলল। রিক পরীর চোখমুখ দেখে চোয়াল শক্ত করে মুনার দিকে তাকাল। মুনা মাথা নামিয়ে নিল। বলল, কাঁদলে ওর এমন হয়।
রিক গর্জে বলে, তাহলে কাঁদাও কেন?
পরী ঠোঁট বাকায়। গাল ফুলায়। নাক ফুলায়। ঠোট টেনে টেনে বলে,
‘ পাপপপপপা দুঃককু।
ইশা নীরবে হাসে। রিক এগিয়ে যায় পরীর কাছে। বলে, কোথায়?
পরী হাত বাড়িয়ে দেয়। হাত দেখিয়ে বলে, দুঃকককু।
রিক হাত বাড়িয়ে কোলে নেয়। পরী ঝাপিয়ে পড়ে। রিক জিজ্ঞেস করে, কে মেরেছে?
পরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। রিককে জড়িয়ে ধরে। অনেকক্ষণ পর বেশ রাগ নিয়ে ঝেড়ে বলে, ফিপপপি।
কি রাগ? কি ঝংকার মেশানো ডাকটিতে।
রিক ভড়কে যায়। বলে, ফিপপি মেরেছে?
পরী মাথা দুলায়। ইশার দিকে একটিবার ও আর তাকায় না। রিক পিঠে হাত বুলিয়ে ইশার দিকে ফিরে। ইশা অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, নিচে কে এসেছে বড় দা?
রিক বলে,
‘ রিপের বন্ধুবান্ধব মনে হয়। আমি যাইনি।
মুনাকে বলে, মুনা রান্নাঘরে মা বোধহয় একা।
মুনা বেরিয়ে যায়। ইশা ও বেরিয়ে যায় তার পিছু পিছু।
পরী রিকের উপর রাগ করে। কেন ইশাকে বকা দেয়নি?
রিকের চুল টানে। দুহাতের তালু দিয়ে রিকের মুখে তবলার মতো আওয়াজ করে করে মারে। ঠোট টেনে টেনে বলে, ফিপপফি দুক্কু পাপপপা।
রিক হেসে ছোট ছোট হাত দুটোতে আদর করে। বলে, দুঃক্কু কোথায় এগুলো তো আদর ছিল মা। মা কখনো তার বাচ্চাকে দুঃক্কু দিতে পারে?
পরী ছোট ছোট চোখ করে রিকের দিকে তাকায়। রিকের মুখে মুখে বলে, আমমমমমা।
রিক হাসে। পরীকে চেপে ধরে বুকে। বলে, না তুমি শুধু আমার মা। শুধু আমার। আমার মা। আমার বাচ্চা। আর কারো না।
________________________
হাতখোপা করতে করতে ইশা নিচে নেমে আসে। মুনার সাথে গায়ের ধাক্কা লাগায় সে বলে কি হয়েছে ভাবী?
মুনা ইশাকে সাইড করে দাঁড়ায়। বলে, না কিছুনা।
ইশা শেষ সিড়িতে নিচে নেমে আসে। বামকোণায় সোফায় রিপের সাথে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখে তার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠে। হাত পা কেঁপে উঠে তার। গায়ের ওড়না ঠিক করে সে মাথা ঢেকে নেয় ওড়না দিয়ে। যখনি ছেলেটি ও রিপের সাথে কথা বলতে বলতে তার দিকে তাকাল তার বেহাল দশা হলো। সে না পারল সরে যেতে। না পারল নড়তে। সিড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু একটা ভেবে দৌড়ে উপরে চলে আসল।
রিক আর পরীর পিছু পিছু মিনি বেরোতে চাইলে তাদের সবাইকে আবার ভেতরে ডুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল ইশা। রিক অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ইশু?
ইশা হাঁপাতে থাকল বুকে হাত দিয়ে। পরী ইশাকে এভাবে হাঁপাতে দেখে খিলখিল করে ভার কন্ঠে হাসল। চোখমুখ এখনো লাল। গাল এখনো ভিজে। তারমধ্যে হাসছে পরী। রিক ও হাসল। বলল, পরী মজা পেয়েছে?
পরী হাত তালি দিল। ইশা তাকালে পরী রিককে জড়িয়ে ধরল। ইশার দিকে আর তাকাল না। ইশা দরজায় খিল দিয়ে মিনির কাছে গিয়ে মিনিকে খাঁচায় বন্দী করল। মিনি ডানা ঝাপটে ঝাপটে বলল, মিষ্টি ব্যাড গার্ল। ব্যাড গার্ল।
রিক জিজ্ঞেস করল,কি হয়েছে বন্দী করলি কেন?
ইশা ফিরল রিকের দিকে। সাত পাঁচ না ভেবে বলল, ডক্টর আদি চৌধুরী রিপদার বন্ধু। এসেছেন। দেখলাম।
রিক যেন এমন অপ্রত্যাশিত কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলনা। তার হাতের বাঁধন জোড়াল হয়। পরীকে শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সাথে। বলে, কখন?
ইশা মাথা নামিয়ে বলল, জানিনা।
রিক অভয় দিয়ে বলল, কোনো সমস্যা নেই। এভাবে বলার কি আছে?
রিক বেরিয়ে যায় রুম থেকে। পকেট থেকে ললিপপ বের করে পরীকে দেয়। পরী ললিপপ হাতে নিয়ে দীর্ঘ চুম্বন বসায় রিকের গালে। খিলখিল করে হাসে।
ইশার বারণ শোনেনা রিক। মিনি খাঁচার ভেতর ডানা ঝাপটায়। ডাকে, মিষ্টি, পরী।
ইশা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে উপরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকায়। নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ায়। হেসেহেসে কথা বলা মানুষটাকে লুকিয়ে দেখে।
রিক নিচে নেমে আসে পরীকে নিয়ে। আদি চোখ তুলে তাকায় রিকের দিকে। কুশলাদি বিনিময় করে। রিক আদিকে দেখে পুরোপুরি অবাক হয়। এই কি সেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেটি? আকাশপাতাল তফাত।
আদি হেসে পরীকে ডাকে,হেই প্রিন্সেস।
পরী মাথা তুলে তাকায়না। মাথা নিচু করে ললিপপের উপরে চকচকে কাগজটি খুলতে সে ব্যস্ত। ঠোঁট দুটো ফুলানো।
আদি সাড়া না পেয়ে বলে, বিজি?
রিপ হেসে উঠে। বলে, আমার মাকে ডিস্টার্ব করিস না তো। কাজ করছে।
রিকসহ আদি ও হেসে উঠে।
রিক এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। তালহা বেগম অসহায় হয়ে তাকায় রিকের দিকে। শান্ত হয়ে বলে, কি দরকার ছিল বলতো আব্বা?
রিক হাসে। বলে, রক্তের সম্পর্কটাকে দেখলে শুধু মা? আমার ভালোবাসাটাকে দেখলে না। কেন এত ভয় পাও? পরী আমার মেয়ে। আমার ভালোবাসার জোর আছে। পরী কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেনা। এটা আমার জেদ নয় মা, এটা আমার বিশ্বাস। আমার পিচ্চি মায়ের উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। সে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে পাপা ডাকবে না কখনো।
পরী ললিপপের উপরে চকচকে কাগজ খুলে ফেলে অবশেষে। রিকের গালে লালা লাগিয়ে দিয়ে বলে, পাপপপপা লিলি।
মুনা তার ছলছলে চোখ আড়াল করে ঘুরে দাঁড়ায়। তালহা ও আড়াল করে তার চোখের নোনাজল। মনে মনে প্রার্থনা করে তার ছেলেটার বিশ্বাস যাতে কখনো ভেঙ্গে না যায়। পরী যাতে তাকে কখনো ছেড়ে না যায়। রিক হেসে দেয় পরীর কথায়। বলে, লিলি না মা ললি।
পরী ললিপপ দিয়ে রিকের নাকে বাড়ি মারে। ঠোঁট টেনে বলে, নান না লিলি।
রিক কান্না না করার জন্য তাড়া করে বলে, হ্যা, হ্যা লিলি, লিলি।
পরী হাসে ঠোঁট এলিয়ে। অপূর্ব সুন্দর সেই হাসি। মায়া,সোহাগ, আদর ঝড়ে পড়ে সেই হাসিতে। রিক সরিয়ে দেয় তার কপালের চুল। দীর্ঘ চুম্বন এঁকে দেয় মেয়ের কপালে।
আদি উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমাদের বাসায় যাবি কিন্তু। প্রিন্সেসকে ও নিয়ে যাবি।
রিপ বলে, ঠিক আছে। কিন্তু রাতে খেয়ে গেলে ভালো হতো। আদি ঘড়ির টাইম দেখে বলে, কেউ যদি খাবারে বিষটিষ দিয়ে মেরে ফেলে। আমি ভাই মরতে চায়না।
রিপ অবাক হয়। ইশা দ্রুত চেপে যায় পিলারের পেছনে। ছিঃ এই লোকটা তাকে কখন দেখে নিল? কত বড় কথাই না বলে দিল? মারব কেন? সে নিজেই তো আমাকে মেরেছে?
রিপ অবাক হয়ে বলে, কি আবোলতাবোল বকছিস আদি? মাথা খারাপ?
আদি হাসে। রিপের পিঠ চাপড়ে বলে, বুঝবিনা।
রিপকে অবাক করে দিয়ে আদি উপরে তাকায়। রিপ ও তার সাথে সাথে উপরে তাকায়। দেখা যায় ওড়নার কিছুটা অংশ। রিপ হেসে বলে, ইশা মনে হয়।
আদি ঠোঁট গোল করে বলে, ওহহহহ।
কথা বলতে বলতে আদি এগিয়ে যায়। জহির মিয়া পত্রিকা দিয়ে রাখে মুখের সামনে। আর ভালো লাগছেনা এসব? এই ছেলেটা কেন আবার সামনে আসছে?
আদি বেরিয়ে যাওয়ার আগে কারো ডাকে পিছু ফিরে। পরী রিপকে ডাক দেয়, রিইইইইই,,,,
রিপ হাসে। কাছে গিয়ে রিকের কোল থেকে পরীকে নিয়ে নেয়। আদির সাথে বাইরে যেতে যেতে বলে,
‘ রিইইই নয়,, বলো রিপ।
পরী ডাকে, ইপ।
রিপ আবার বলে, বলো চাচ্চু।
পরী বলে, চুচু।
আদি হেসে উঠে। রিপ রাগ করে বলে, চাচ্চু ডাকো মা।
পরী বলে, চুচুমা।
আদি হো হো করে হেসে উঠে। পরী ও খিলখিল করে হেসে উঠে। রিপ গাল ফুলিয়ে তাকায় পরীর দিকে। পরী আদি দুজনই হাসে। দুজনের হাসির আওয়াজ কম্পন তুলে খান বাড়ির সদর দরজায়। ইশা দৌড়ে নিচে নেমে আসে। রিপ আর আদি হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে যায়। ইশা সদর দরজা দিয়ে উঁকি দেয়। আদি আর পরীর হাসি ভেসে আসে তার কানে। চোখে জল টলমল করে উঠে। বুকে ব্যাথা হয়।
আদি গাড়িতে উঠে বসে। পরীর দিকে তাকায়না। প্রয়োজন মনে করেনা।
রিপকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। কিছুদূর যেতে না যেতেই আবার গাড়ি পিছু ঠেলে রিপ আর পরীর সামনে আসে। পরীর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলে, বাই প্রিন্সেস।
পরী এই প্রথম ভালোভাবে তাকায় আদির দিকে। আদি ও তাকায়। পরী হাত তুলে,কি বলবে মনে করতে নানা পেরে রিপের মুখের দিকে তাকায়। রিপ বলে, টা টা বলো মা।
পরী হাত নেড়ে বলে, তা তা।
আদি হাসে। পরীর গাল ধরে আদর করতে মন চেয়েছিল। পরে নিজের মনের এই বাজে আবদারকে সে নিজেই অগ্রাহ্য করে দিল। গাড়ি ছেড়ে দেয়। চলে যায় বহুদূর। পরী তাকিয়ে থাকে। গাড়ি যখন ধোঁয়াশা হয়ে যায় পরীর রাগ হয়। তাকে কেন নিয়ে গেলনা গাড়িতে করে। সে গাড়িতে চড়বে। সে ঠোঁট বাকাল। রিপ জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে মা?
পরী ঠোঁট টেনে গাড়ি যেদিকে গেল সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বলল, ওতততো।
রিপ আদর দিল। বলল, গাড়ি?
পরী মাথা দুলাল। রিপ বলল,আমি ছড়াব আমার মাকে গাড়ি।
বলতে বলতে দরজার কাছাকাছি আসে। ইশাকে ডেকে বলে, ইশু পরীকে নে তো।
ইশা বলল, এডভোকেট সাহেব কি বেরোবেন?
রিপ মাথা দুলাল। বলল, হ্যা। খুব ইমার্জেন্সী।
ইশা বলল, কিন্তু এখন কেন?
রিপ বলল, কাজ আছে। পরীকে নে।
পরী যেতে চাইনা ইশার কোলে। ইশা নিয়ে নেয়। বলে, মা রাগ করেছে?
পরী ইশার দিকে তাকায়। ওই বাইরে রাস্তার দিকে দেখিয়ে বলে, ফিপপফি ওতততততো।
ইশা গলা উঁচিয়ে বলে, কি ওতো?
পরী মাথা দিয়ে ইশার মাথায় বাড়ি খায়। বলে, ওতো। ড়িইইইই।
ইশা মাথা উপর নিচ করে বলে, গাড়ি??
পরী মাথা নাড়ে। ঠোঁট টেনে বলে,,, ড়িইইইইইই…………
ইশা হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে বাইরে। বাড়ির গেইট বন্ধ করার আগে দেখতে পায় কালো গাড়ির কাচ ভেদ করে আসা মুখটিকে। তার বুক কেঁপে উঠে। পরীকে সে চেপে ধরে। পরী আওয়াজ করে বলে, দুঃক্কু। ইশা তার ওড়না দিয়ে পরীকে ডেকে নেয়। বুকের সাথে চেপে ধরে। কালো গাড়ির ভেতরে থাকা লোকটি ফোন কানে দেয়। সাথে সাথে ইশার হাতে থাকা ফোনটি বেজে উঠে। শোনা যায় পুরুষালী কন্ঠস্বর। ভেসে আসে ঘৃণিত শব্দমালা।
‘ আদি এখানে, সেটা ও তোমার দোষ। এত নির্লজ্জ মেয়ে আমি দেখিনি। আদিকে এখানে পর্যন্ত নিয়ে এসেছ তুমি? কোলে থাকা মেয়েটিই কি তোমার ভাইয়ের মেয়ে? নিজের সন্তানকে মেরে ভাইয়ের মেয়েকে আগলে রাখছ? যদি এই মেয়েটাকে ও বাঁচিয়ে রাখতে হয় তাহলে আদির থেকে একশহাত দূরে থাকবে। দূরে রাখবে আদিকে। নাহলে এই মেয়েটা ও শেষ। এত অনুতাপ কোথায় রাখবে?
ইশার বুক কেঁপে উঠে। সে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে উচ্চারণ করে,
‘ আপনি মারবেন আর আমি আপনাকে ছেড়ে দেব ভেবেছেন? আইন আদালত কি নেই দেশে? অন্যায় করে কেউ কখনো পার পায়না।
ফোনের ওপাশ থেকে লোকটি হাসে। বলে,
‘ আইন আদালত তো পরে। আগে তো মারব। আগে তোমার ভাইয়ের মেয়ে মরবে। ভেবে দেখ, বাড়িটির দিকে একটিবার ফিরে দেখো এই মেয়েটি ছাড়া বাড়িটা কতটা অসহায়,অন্ধকার,নিষ্প্রাণ।
ইশা সাথে সাথে ফিরে তাকায় বাড়িটির দিকে। সত্যিই তো পরী ছাড়া এ পুরো বাড়িটা অন্ধকার,নিষ্প্রাণ। বাড়িটা হাসবে না। বাগানের ফুল ফুটবে না। খিলখিল করে পুরো বাড়ি কেউ মাতিয়ে রাখবে না। গালের সাথে গাল কেউ ডেকে উঠবেনা,আমমমমমা।
ইশা হু হু করে কেঁদে দেয়। পরী চোখ পাকিয়ে দেখে ইশার কান্না। সে ভেবে নিল সে মাথা বের করেছে সেজন্য ইশা কাঁদছে। সে আবার ইশার বুকে চেপে গেল। ইশার বুকে মাথা রেখে ডাকল, আমমমমমা।
ইশা আওয়াজ করে কেঁদে দেয়। ফোনের ওপাশের লোকটি হাসে। বলে, কষ্ট হচ্ছে। আরেহ এখন কেদোঁনা। আগে মারি তারপর কেঁদো। এভাবে চোখের পানি শুকিয়ে কোনো লাভ আছে?
ইশা কান্নার আওয়াজ থামিয়ে অনুরোধের সুরে বলে, না দয়া করুন। মারবেন না ওঁকে। চেষ্টা করবেন না। আমি চাইনা আপনার ছেলেকে। সে আজ নিজ থেকেই এসেছে। আমার কাছে নয় রিপদার কাছে এসেছে। ওঁনি আমাকে চেনেনা। আপনি মারবেন না আমার পরীকে। দোহাই লাগে আপনার। আপনারা কেন এত পাষাণ? আপনার বড় ছেলেকে আল্লাহ এজন্যই কোনো সন্তান দেইনি। আপনাদের নিষ্ঠুরতার কারণে আপনাদের পরিবারে কোনো সন্তান আসছেনা। আপনারা এর ফল পাবেন। উপরওয়ালা কাউকে ছাড় দেন না।
ফোনের ওপাশের লোকটি ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় ইশাকে। বলে, বেশি কথা বললে। এখনি মেরে দেব দুটোকে।
দুর্বল জায়গায় হাত পড়ল লোকটির। চোয়াল শক্ত হয়ে এল। গাড়ি ছেড়ে দিল। ইশার উপর একরাশ ক্রোধ, আর ক্ষোভ নিয়ে গাড়ি চালালো এলোমেলো। ইশা বুকে চেপে ধরল পরীকে। বলল, আমি তোকে সেদিন কেন মেরে ফেলিনি। এখন তোর মৃত্যু মানে খান বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের মৃত্যু। আগে মেরে ফেললে কিচ্ছু হতো না। এখন কি করে মারব আমি তোকে। কি করে মারতে দিতে পারি তোকে? শোন যদি ও তুই মরে যাস তার দায়ী ডক্টর আদি চৌধুরী। আমি নই। তোর মা নয়। তোর সো কল্ড বাবা। ডক্টর আদি চৌধুরী। পরী পিটপিট করে তাকায় ইশার দিকে। প্রশ্ন করার মতো করে বলে, ফিপফি বাববববা?
_____________________
কেটে গেল কতগুলো দিন। তারমধ্যেই ঘটল বিরক্তিকর সব ঘটনা। ইশা যতবার চায় ওই লোকটি থেকে পালিয়ে থাকতে ততবার তাকে মুখোমুখি হতে হয় লোকটির সাথে। কলেজ গেইটে, ফুচকার দোকানে, রাস্তায় রিকশা ডাকার সময়, কলেজ যাওয়ার পথে ফেরার পথে। আশ্চর্যজনক হলে ও আদি সেদিনের কথা মনে রেখে দিয়েছে। ইশার সাথে যেচে কথা বলেনি একদিন ও । ইশার দিকে সরাসরি তাকায় ও নি। ইশা মনে মনে শুকরিয়া জানাল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। লোকটি অন্তত তাকে তো আর ফলো করছেনা। কিন্তু তারপর ও দেখা হয়ে যাচ্ছে বারবার। ইশার বিরক্তি চরম পর্যায়ে। কিন্তু লোকটির উপর রাগ দেখানোর কোনো কারণ না থাকায় রাগ ও দেখাতে পারছেনা। সেদিন ও তো পাশ কাটিয়ে চলে গেল। গাড়ি নিয়ে চলে গেল। অসহ্য।
ইশার বিরক্তি বাড়ছে তরতর করে। সাথে ভয়। ফোন করে বারবার ওই লোকটির সতর্কবাণী শুনতে হচ্ছে তাকে। সে কি ইচ্ছে করে ওই লোকটির সামনে এসে পড়ছে? লোকটির সাথে আচমকা দেখা হয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসলে ও চাঁদের জ্যোৎস্নায় আলোকিত রাস্তা। হাতে তার ফোন। ফোনের লাইট জ্বলছে। ভয়ে ভয়ে দ্রুত গতিতে সে হাঁটছে। বড়দা আর রিপদা বাসায় ফেরার আগেই তাকে বাসায় ফিরতে হবে। হাতে ঔষধের পাতা। ঔষধ শেষ হয়ে গেছে তার। পিঠের ব্যাথায় আর থাকতে পারছেনা। এত যন্ত্রণা তো হওয়ার নয়। কাউকে না বলে সে ফার্মিসির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। শুধু মুনা জানে। মুনা সামলাবে জহির মিয়া আর তালহা বেগমকে।
ভীড়ের মাঝে ইশা বিব্রতবোধ করল ফার্মিসিতে যেতে। তার মুখ ওড়না দিয়ে ঢাকা। তারপর ও তাকে চিনে ফেলল এক বৃদ্ধ লোক। বলল, জহির মিয়ার ভাগিনা না? এসময় তুমি এখানে কেন? তোমার ওই দুই ভাই কই? মাইয়্যা মানুষ এমন সময় ঘর থেকে বের হয়?
ইশা মাথা নামিয়ে বলল, ঔষধটা জরুরি প্রয়োজন তাই এসেছি কাকা।
ইশা দেখল রাস্তায় এপ্রোন পড়া, বোরকা পড়া অনেক মেয়ের হাঁটাচলা। গাড়িতে ও দেখা গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, এরা মেয়ে না? প্রয়োজনে বের হলেই এদের প্যানপ্যানানি শুরু হয়ে যায়। যত্তসব।
বৃদ্ধ প্রশ্ন ছুড়লেন। তোমার বিয়াশাদী দিতাছে না? এত বড় মেয়ে ঘরে রাইখা কি করবে জহির মিয়া। মা বাপ ও তো নাই।
কয়েকজন লোক ও তাতে সম্মতি জানাল। ইশা তাদের মুখের উপর বলে দিল , আমি বিবাহিত। আবার বিয়ে কেন দেবে?
উপস্থিত সবাই হতবাক। বোরকা পড়া একটি মেয়ে ও এসে দাঁড়াল ফার্মিসিতে। ঔষধের জন্য বোধহয়। ইশা মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বৃদ্ধ লোক হায় হায় করে বললেন,
‘ জহির মিয়া ভাগনিরে কখন বিয়া দিল? ব্যাটা তো চুপিচুপি কাজ সাড়ল দেখতাছি। কখন হয়ে বিয়ে হলো তোমার মা?
ইশা মুখ ফিরিয়ে নিল। বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, অনেক আগে। আপনারা তো এলাকায় নতুন এসেছেন তাই জানেন না।
বৃদ্ধ লোক অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে ইশার দিকে তাকালেন। বললেন,
‘ দুই বছর হইতাছে এখানে আইছি। তোমার বিয়ে কি তার আগেই হয়ছে?
ইশা মাথা নাড়িয়ে বলল, জ্বী।
‘ তো তোমার জামাই কি করে? তুমি শ্বশুড়বাড়ি থাকোনা?
তোমারে তো দেখার মুখে লাগেনা যে তুমি বিবাহিতা।
ইশা বিরক্ত হয়। বলে,
‘ না আমি শ্বশুড়বাড়ি থাকিনা। আমার স্বামী বাইরের দেশে তাই আমাকে এখানে রেখেছেন।
বৃদ্ধ বললেন, বিদেশে থাকে? তার খোঁজখবর রাখো তো? নাকি অন্য কোথাও সংসার পেতে বসে আছে?
ইশা গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলে, ‘ বাজে কথা বলবেন না। মুখ সামলে কথা বলুন।
বৃদ্ধ মন খারাপ করে তাকালেন। মেয়েটা এত বিরক্ত হচ্ছে কেন? নিজের মেয়ের মতো তাই তো জানতে চাইল। দেখতে দেখতে আর ও লাইন পড়ল ফার্মিসিতে। মোটা একটা মহিলা এসে ইশাকে পেছনে পাঠিয়ে দিল। বলল, আমার একটু ইমার্জেন্সি লাগবে।
ইশার পিঠের ব্যাথা আর ও বাড়তে লাগল। দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার পা ব্যাথা হওয়ার উপক্রম। সে অন্য ফার্মিসিতে যেতে চাইল। কিন্তু বাকিগুলোতে সবগুলো পুরুষ। তাই আর গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। হসপিটালের পাশে এই ফার্মেসিগুলোতে প্রচুর ভীড় থাকে সবসময়। বিরক্তিকর। ইশার পিঠের ব্যাথা ছড়াতে লাগল। সে বলল, এই ভাই আমারটা দিয়ে দিন। শুধু মাত্র একটি ঔষধ। কেউ শুনলই না তার কথা।
উগ্র রোষে ফার্মেসির সামনে থাকা গাড়িটা থেকে নামল আদি। কেউ ভুলে ও ভাবেনি গাড়িটাতে কেউ বসেছিল। হসপিটালের সুনামধন্য ডক্টর আদি চৌধুরী হঠাৎ ফার্মিসির দিকে এগোতেই লোক সাইড দিল। অনেকেই আদিকে চেনে বলে কুশলসংবাদ জানতে চাইল। ফার্মেসিওয়ালা বললেন, ডাক্তারকে সাইড দিন। মনে হয় কোনো প্রয়োজনে এসেছেন।
আদি প্রথমেই মাস্ক খুলল। ছুড়ে ফেলল। ইশা চমকাল। পিছু হটল। এ তো?
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আদি কেড়ে নিল ইশার হাত থেকে সেই ঔষধের পাতা। ভ্রুকুঞ্চন করে দেখল সেই ঔষধের নাম। চোখ তুলে তাকাল ইশার দিকে। ইশা স্পষ্ট দেখল, ছেলেটির চোয়াল শক্ত। কপাল বেয়ে পড়ছে ঘাম। থরথর করে কাঁপছে ঠোঁট। চকচক করছে চোখ। বুঝা দায় লোকটা কি চাইছে? কেন চাইছে?
ঔষধের পাতা দেখানোর সাথে সাথে ঔষধ বিক্রেতা চট করে ঔষধ বের করে দিল আদিকে। জিজ্ঞেস করল, আর কিছু লাগবে ডাক্তার সাহেব?
আদি কারো কোনো প্রশ্নের জবাব দিল না। গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। ইশার হাত পা কাঁপা থামেনি এখনো। তাকে নিয়ে গুণগুণানি শুরু হয়ে গেল। সে সেসবের তোয়াক্কা না করে আদির পিছু পিছু ছুটল। লম্বা লম্বা ফেলে হাঁটা আদির পিছু দৌড়াতে গিয়ে তার পিঠে খিঁচে ধরল। সে একহাতে পিঠ চেপে ধরে বিড়বিড় করে ডাকল, ডক্টর?
লোকজন গাড়ির হর্নের আওয়াজে সেই আওয়াজ শোনা গেলনা। সে দৌড়াল আদির পিছু পিছু আবার ও । আদি একবার ও পিছু ফিরল না। হঠাৎ তার মনে হলো তাদের পিছু নিচ্ছে একটি গাড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে আদি ডুকে পড়ল অন্য রাস্তায়। দু একজন লোকের আনাগোনা। গাড়ির আওয়াজ নেই তেমন। চাঁদের জ্যোৎস্নায় আলোকিত রাস্তা। ইশা জোরে জোরে শ্বাস নিল। দাঁড়াল। আবার দৌড় লাগাল। আদির সাথে পেরে উঠল না। আদি তারপর ও হেঁটে যাচ্ছে লম্বা লম্বা পা ফেলে।
ইশা রাস্তার পাশে বাঁকা হয়ে গাছটার সাথে পিঠ এলিয়ে দিল। ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছে ঝি ঝি পোকার ডাক। ইশা জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। গাছটাকে সম্বল বানিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পিঠের ভার ছেড়ে দিল গাছটার উপর।
পেছনে পায়ের আওয়াজ না পেয়ে আদি পেছন ফিরল। রক্তবর্ণ চোখ নিমেষেই আতংকে পরিণত হলো। নীরবে নিঃশব্দে সে খুঁজতে লাগল সেই পাষাণ মেয়েটিকে। কোথায় সে? কোথায় সে হৃদয়হীনের মুখ? কোথায় সে ভয়ংকর নুপূরের আওয়াজ? সে শুনতে পাচ্ছে না কেন? তাকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
ইশা ছুটতে ছোটাছুটি করল দুইজন লোকের হাত থেকে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল গাড়ির ভেতর বসা লোকটিকে। লোকটি কি সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখে? নিজের ছেলের দোষটা দেখতে পাচ্ছে না সে?
লোকদুটি তার মুখ চেপে ধরল। ঝোপঝাড়ের ভেতর টেনে নিয়ে গেল। ইশার শক্তি আর তাদের সাথে পেরে উঠল না। সে ডাকতে পারল না ডক্টরকে। লোকদুটি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ঝোপঝাড়ের ভেতর। ইশা আঘাত পেল। হাত পা কোমর নিশ্চয় কিছু ভেঙ্গেছে। তার হাত মুখ বেঁধে দিল কাপড় দিয়ে। কাটা জাতীয় কিছুর জন্য তার হাত পা মুখ ছিড়ে রক্ত বেরোলো। তার ভয় লাগল। বাঁচার জন্য সে ছটপট করল। লোকদুটো তাকে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে রাখল ঝোপঝাড়ের ভেতর। নীরব হয়ে বাঁচার আকুতি,ভয় নিয়ে ইশা তাকিয়ে রইল,পড়ে রইল অন্ধকার ঝোপঝাড়ে। কিসের এত শাস্তি পাচ্ছে সে? কে তার এত কষ্টের কারণ? ডক্টর নয় কখনো। ডক্টরকে তো সে ভালোবেসেছিল? ভালোবাসার শাস্তি এতটা ভয়ংকর কি করে হতে পারে? নাকি বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে যাওয়ার শাস্তি?
আদি লোকদুটোকে পালাতে দেখল। আবছাআলোয় দূরের সরু রাস্তার মাথায় গাড়িটির ভেতর বসে লোকদুটোকে পালাতে দেখল। সে দৌড় লাগিয়ে ও কোনো লাভ হলোনা। অজানা অচেনা ভয় তাকে ঘিরে ধরল। ঝোপঝাড় লতাপাতা সরিয়ে সে কি ডাক দিবে বুঝে উঠতে পারল না। কি নামে মেয়েটিকে সম্বোধন করবে বুঝে উঠতে পারল না সে। মেয়েটি তার কেউ না। কেউ হয়না। আদি শেষমেশ দিশেহারা হয়ে পড়ল। ডাকল, শুনছেন, কোথায় আপনি। সামনে আসুন। লুকিয়েছেন কেন? বেরিয়ে আসুন।
উু উু শব্দ বেরোলো ইশার মুখ দিয়ে। হাত পা নাড়ানোর শক্তি নেই তার। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে এগোনোর আগেই তার পায়ের নিচে নরম কিছুর নড়াচড়া টের পেল সে। হাতের উপর ভয়ংকর চাপ পড়ায় ইশার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। শ্বাস যেন এবার বন্ধ হয়ে এল। নিভু নিভু হয়ে এল যেন তার পৃথিবীর আলো। আদি পা সরিয়ে বসে পড়ল ইশার মাথার কাছে। গভীর অনুনয় করে বলল, সরি,সরি, আমি দেখতে পায়নি। হাত মুখ বাঁধা দেখে আদি ভড়কাল। তাড়াতাড়ি খুলে দিল হাত মুখ। সামনে ফিরাল ইশাকে। ইশা মুখ থুবড়ে পড়ল তার বুকে। লেগে গেল। আদির পড়নের সাদা শার্টে লেগে গেল রক্ত। ইশা নিভু নিভু চোখ নিয়ে তাকাল আদির দিকে। আদি দেখল ঠোঁট, মুখে রক্ত। গলার একপাশে রক্ত। আদি গর্জে উঠল, কিছুক্ষণ আগে ও তো আপনি ঠিক ছিলেন। কি করে এসব হলো? কখন হলো?
ইশা বহুকষ্টে একটি আঙুল তুলে। ডুকরে উঠে সেই আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁটের রক্ত নিল। নিজেই নিজের রক্ত দেখে ঢোক তুলে কেঁদে উঠল। আদির বুকের পাশে সেই রক্তের ফোঁটা লাগিয়ে দিল। তারপরই ঢলে পড়ল আদির বুকে। আদির বাহুডোরে।
আদি শক্ত হয়ে শুধু বসে রইল। তার বুকে পড়ে থাকা রমণী অচেতন। অজ্ঞান। আদির তারপর ও রাগ লাগল মেয়েটির উপর। কি করে সে বলল সে বিবাহিত? কখন হলো বিয়ে? কার সাথে? কবে? কিভাবে?
আদি এসব একটু ও বিশ্বাস করেনা। বিশ্বাস হচ্ছেনা। হওয়ার নয়। আসল কথা তো সে স্বীকার করতে চাইছেনা, বিশ্বাস হচ্ছেনা নয়। বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। রক্তক্ষরণ যদি কেউ খুব গভীরভাবে দেখত তবে দেখতে পেত মেয়েটির নয় বরঞ্চ ছেলেটির বুকেই বেশি রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যা থামার নয়। সহনীয় নয়। অসহ্য। যন্ত্রণার।
চলবে