#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৮(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
স্বচ্ছ ফকফকা নীল আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে দু একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে দূরের ওই সুপারিবনের দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিল রেহান৷
ছাদের রেলিংয়ে হাত দিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল বহুদূরে। কফির মগে আর ও চুমুক দিতে না দিতেই সে টের পেল পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক রমণী। পাতলা গড়নের মেয়েটির ঠোঁটে ভাসছে মৃদুমধুর হাসির ছটা৷ পড়নের কালো কুর্তির ওড়নাটি বাতাসের দোলায় নাচছে। চুলের এলোমেলো লম্বা বেণুনিটা সামনে ফেরানো। কয়েক গাছি চুল মুখ আর কপালের আশেপাশে পড়ে রয়েছে৷ হাতের আর ও একটি কফির মগ৷ অন্য হাতে কি তা দেখা যাচ্ছে না। রেহান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল
‘ কি চাই? কাকে চাই?
মেয়েটি এমন প্রশ্নে লজ্জা পেল৷ মাথা নিচু করে হাসল৷ বলল,
‘ কিছু না৷ কাউকে না৷
‘ তো আমার পিছু পিছু কি?্
মেয়েটি মাথা তুলল। কিঞ্চিৎ রাগ করে বলল,
‘ চলে যাচ্ছি তাহলে৷
রেহান হেসে দিল৷ বলল,
‘ একটু মজা ও করতে পারিনা৷ এ কেমন বউ আমার?
মেয়েটি তার চোখদুটো ছোট ছোট করল। বলল,
‘ মজা করবেন না। সবসময় মজা আমার পছন্দ না৷ আপনি আমাকে নিয়ে মজা করলে আমার ভালো লাগেনা৷
রেহান কফির মগ রেখে দিল৷ বলল,
‘ আচ্ছা আচ্ছা আর মজা করব না। এদিকে আসো। আসো।
মেয়েটি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে পা টিপে টিপে আসল। বলল,
‘ কি?
রেহান বাঁকা ধনুকের মতো ঠোঁট এলিয়ে হাসল। মেয়েটি কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
‘ এই রহস্যময় হাসির কারণটা আমি বুঝতে শিখে গেছি মিঃ রেহান৷ কাজ হবেনা।
রেহান নিঃশব্দে হাসল৷ মেয়েটির হাত থেকে কফির মগ কেড়ে নিয়ে দু তিন চুমুক একনিশ্বাসে খেয়ে নিয়ে বলল,
‘ এক মগ কফিতে আমার হয়না ম্যাডাম৷ কতবার বলেছি।
মেয়েটি হাসল৷ কাছে এসে ছেলেটির শার্টের উপরের বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে বলল,
‘ সুদর্শন বর আমার। একটা গান করুন তো৷ গান শুনব৷
রেহান মেয়েটির কোমর টেনে আর ও কাছে আনল৷ পকেট থেকে কয়েকটা তাজা বকুল ফুল বের করে মেয়েটির এলোমেলো বেণুনীতে এক এক করে গুজে দিল। মেয়েটি আবেশে চোখবন্ধ করে মিনমিন করে বলল,
‘ কেউ দেখে ফেললে আপনার নামে আমি মামলা করব৷ আমি লজ্জা সামাল দিতে পারিনা৷ এই লজ্জা জিনিসটাকে আমি ভয় পাই৷
রেহান হাসল৷ মেয়েটিকে ঘুরিয়ে মেয়েটির কাঁধে থুতনি রাখল৷ বলল,
‘ সামাল দিতে শিখে নিন। কারণ এই লজ্জা আপনাকে বারবার পেতে হবে। সামাল দিতে না জানলে আমি আপনার বিরুদ্ধে মামলা করব।
মেয়েটি হাসল৷ সামনে ফিরে ছেলেটির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আপনাকে একটি জিনিস দেখানোর আছে। চোখবন্ধ করুন তো৷
ছেলেটি কৌতূহল নিয়ে বলল, কি?
‘ চোখবন্ধ করুন।
রেহান চোখবন্ধ করল।
পরী ওড়নার আড়াল থেকে একটি ছবি বের করল। রেহানের সামনে ধরে বলল, চোখ খুলুন৷
রেহান চোখ খুলল। ছবিটার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
‘ কোথায় পেয়েছ?
পরী হাসল। রেহানের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল
‘ বলব না।
রেহান ছবিটা হাতে নেয়৷ দেখে খুব ছোট্ট একটি ছেলে গিটার বাজাচ্ছে, আর পুঁচকু ছোট্ট মেয়েটি গালে দুহাত দিয়ে সেই গিটারের টুংটাং সুর শুনছে।
রেহান তার বুকের কাছের মেয়েটির কানে ফিসফিস করে বলল,
‘ আমি আর তুমি।
মেয়েটি চোখবন্ধ করে আঙুল দিয়ে কপাল দেখিয়ে দিল৷ রেহান হেসে ঠোঁট নিবদ্ধ করল সেই কপালে৷ মেয়েটি চট করে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ এই ছবিটার মতো আর একটা ছবি ক্যামরাবন্দী হোক৷ ছবি হোক৷ স্মৃতির পাতায় অক্ষত থাকুক৷ দাঁড়ান আমি গিটার নিয়ে পিহুকে ডেকে আনছি।
পরী গিটার নিয়ে আসল৷ রেহানের হাতে গিটার দিয়ে দিল। রেহান রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গিটারে টুংটাং সুর তুলল। পরী সেই ছোট্ট পরীর মতো চেয়ার বসা অবস্থায় গালে দু হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখল আর শুনল গিটারের টুংটাং সুর৷ আর রেহানের সেই ছোট্টবেলার স্মৃতি গুলো সতেজ হয় উঠল চোখের সামনে৷ সামনে বসা রমণীটিকে খুব ছোটবেলায় সে ভালোবেসেছিল৷ তাইতো বিদেশের কোনো সাদা চামড়ার রমণী তার মন কাড়তে পারেনি৷ সেই ছোটবেলার মতো আজ ও এই গিটারের এলোমেলো সুরটাকে তার বড্ড মোহনীয় আর সুন্দর মনে হলো৷
এই সুন্দর মনমাতানো দৃশ্যটি আবার ও ক্যামেরাবন্দী করল পিহু। কি অপূর্ব এই দৃশ্য! দিদিয়া কত লাকি? দাভাই তাকে কতটা ভালোবাসে। এত ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তো কপাল নিয়ে জন্মাতে হয়৷ পিহুর তো পোড়া কপাল৷ ওই দুজনের সাথে হেসে উঠতে না উঠতেই পিহু খেয়াল করল নীল আকাশটাতে একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে। পিহু হাসল। সাথে সাথে দুচোখের কোণা ভেজা তার৷ পিহু পাখিটিকে ইশারা করে মনে মনে বলল,
‘ তুই একা কেন? তোর বন্ধু কই? আমার মতো তুই ও কি অভাগী। তোর বন্ধু কি তোকে ভালোবাসেনা?
পাখিটি উড়ে উড়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল৷ আর ও একটি পাখি দেখা গেল৷ পিহু পাখিটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ জানিস সে আমার খবর নেই না। আমার অভিমানী মন ও তার খবর নিতে বাঁধা দেই। কিন্তু আমার খুব করে তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে। আমার মনের কথাটা তুই তাকে গিয়ে বলে আসতে পারবি? শোন পাখি, তুই কি আমাকে তার খবর এনে দিবি?
____________________
সময় তার নিজস্ব গতিতে এগোতে লাগল। পিহুর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো৷ প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী দেয়ালের গায়ে ঝুলে থাকা ক্যালেন্ডারে আর ও একটি দিন রেড পেন দিয়ে ক্রস করল পিহু৷ ফোনের টুংটাং আওয়াজে দৌড়ে গেল মায়ের রুমে। ফোন হাতে নিয়ে কানে দিয়ে হেসে বলল,
‘ দিদিয়া হানিমুন কয়দিনে শেষ হয়? কবে আসবে তুমি আর দাভাই? একা একা আমার আর ভালো লাগছেনা।
ওপাশের মেয়েটি হাসল৷ বলল,
‘ তোমাকে তো আসতে বলেছি তুমি তখন আসোনি কেন?
পিহু বলল, তোমাদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই বাপ। এত কথা না বলে কখন আসবে সেটা বলো।
পরী হা হয়ে পিহুর কথা শুনল।
‘ কাবাব মে হাড্ডি মানে কি পিহু? আমি তো জানিনা৷
পিহু হাসল৷ বলল, থার্ড পারসন মানেই হচ্ছে কাবাব মে হাড্ডি।
পরী হেসে উঠল। বলল,
‘ তুমি খুব পাকা হয়ে গিয়েছ পিহু। তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।
পিহু সাথে সাথে ফোন কেটে দিল। পরী বুঝে ফেলো না পিহু ফোন কেটে দিল কেন?
_________________
তাড়াহুড়ো করে টিফিন বানাতে ঘাম ছুটে গিয়েছে ইশার৷ নাকের ডগার ঘামটুকু মুছে পেছনে ফিরতেই সুঠাম দেহের লোকটির সাথে দুম করে বাড়ি খেল নাক৷ ইশা সেভাবেই ঘর্মাক্ত নাকটা মুছে নিল ডক্টরের শার্টে৷ আদি বলল,
‘ মিষ্টি আমাদের হানিমুন তো হয়নি৷ তোমাকে নিয়ে হানিমুনে যাব৷
ইশা চোখ পাকিয়ে তাকাল।
‘ ফালতু কথা বলবেন না। অনেক জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি আমরা৷ সেগুলোকেই হানিমুন বলে৷ বুড়া বয়সে এসে হানিমুন করার শখ জাগছে।
আদি পেছন থেকে শক্ত করে ইশাকে জড়িয়ে ধরল৷ বলল, মিষ্টি আর ও একটু রাগ করো। আমি দেখি। তোমাকে রাগলে ভালো লাগে৷
ইশা বলল, কেউ চলে আসবে। ছাড়ুন। বেরোনোর আগে আপনার ঢং না করলে চলেনা না?
আদি হাসল৷ মিষ্টিকে ছাড়ল না৷ আর ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের কাছে কাছে নাক দিয়ে সুড়সুড়ি দিল৷ বলল,
‘ ছাড়ব না।
ইশা বিরক্ত হলো।
‘ ডক্টর পাগলের মতো কথা বলবেন না।
আদির রাগ হলো৷
‘ সবসময় পাগল ডাকো কেন মিষ্টি? আমি পাগল না।
ইশা হা করে তাকিয়ে থাকল।
‘ পাগলামি করবন আর পাগল বলব না? আমি বলব না তো কে বলবে?
আদি গটগট পায়ে হেঁটে কিচেন থেকে বের হয়ে গেল। ইশা তার পিছুপিছু দৌড়ে গেল৷ আদিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে নাক ঘষে দিয়ে বলল,
‘ ডক্টর রাগেন কেন? মিষ্টিকে রাগাতে পছন্দ করেন। আর মিষ্টির কথায় রাগতে পছন্দ করেন না?
আদি তার বুকের কাছে ইশার হাত দুটো ধরল। বলল, হাত সরাও৷ যেতে হবে।
ইশা বলল, না ছাড়ব না। হাসেন। মিষ্টি ডাকেন। তারপর ছাড়ব৷
আদির রাগ লাগল। গর্জে বলল,
‘ মিষ্টি ছাড়ো৷
ইশা ছেড়ে দিল। আদির সামনে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ পাগল ডাক্তার আমার। একশবার পাগল ডাকব। আমি তো এই পাগল ডাক্তারকেই ভালোবেসেছি।
আদি হাসল। বলল,
‘ আর তোমাকে এই পাগল ডাক্তারকে সামলাতে হবে। তা না করে সারাক্ষণ পাগল ডাকো। আমার রাগ হয়৷
ইশা বলল,
‘ আমার রাগাতে ভালো লাগে।
_________________
হাসিখুশি সবার মুখে হঠাৎই অন্ধকার নেমে আসল ইশার মুখে শোনা সংবাদ শুনে। তালহা বেগম মারা গিয়েছেন। ইশা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। মায়ের আদর ভালোবাসা কি জিনিস তা তো তালহা বেগমের কাছ থেকে পেয়েছে। মুখে না বলুক, উপরে না দেখাক তার মামি তাকে ভালোবাসত। মহিলাটি এমন ছিল যে সবসময় জাহির করতে ব্যস্ত থাকত যে সে ইশাকে ভালোবাসেনা। পরের মেয়েকে খাইয়ে দাইয়ে বড় করছে এই তো অনেক৷ কিন্তু ইশা তো জানত৷ না খেলে ঘাড় চেপে খাওয়াতো। অসুস্থ হলে বকে বকে তার কাপড়চোপড় কেড়ে নিয়ে ধুয়ে দিত। কোনোদিন রান্নাঘরে ডুকে দুটো হাঁড়িপাতিল মাজতে ঘষতে বলেনি৷ পড়ার টেবিল থেকে তুলে কোনোদিন রান্না করে খাওয়াতে বলেনি৷ একহাতে পুরো সংসারটা সামলেছে। সেই মামি আজ নেই আর। মামাটা ও চলে গেছে এভাবেই৷
ইশা ছুটে গেল খান বাড়ি। সবার আগে যার আর্তনাদ বেশি শোনা গেল সে পরী। তালহা বেগমের মুখ ধরে সে ডেকে গেল,
‘ দাদু এটা কি হলো? আমাকে এত আদর কে করবে? আমাকে দিদিভাই বলে কে ডাকবে? আমি কার সাথে এত গল্প করব? বাড়িটা খালি করে কেন চলে গেলে দাদু। দাদু উঠো।
পরীকে কেউ বুঝাতে পারল না তার দাদু না ফেরার দেশে চলে গেছে৷ আর ফিরবে না। কথা বলবে না। বকবে না। লাঠি দিয়ে মারবে না। ইশা কাঁদতে কাঁদতে একবার বেহুঁশ হলো আর একবার যখন হুশ ফিরল। রিক এসে বলল,
‘ মায়ের জান যাওয়ার আগে তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল৷ তোর কথা বলেছিল। কিন্তু……
ইশা বলল, কিন্তু কি বড়দা?
সে আমার মামি নয় মা ছিল। আমাকে পেটে ধরেনি কিন্তু আমাকে সেই ছোটবেলা থেকে বড় করেছে৷ মাতৃস্নেহে আমায় বড় করেছে। তোমরা কতটা পাষাণ মামি অসুস্থ আমাকে জানাওনি। রিপদা? কোথায় রিপদা? সে কোথায়? সে কেন বলেনি? আমি তোমাদের এতটা পর কি করে? মামি আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল তোমরা আমাকে ফোন করে জানাওনি কেন? আমি কি তোমাদের কেউ নয়? কেউ না?
ইশা রিকের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ কেন বলোনি? বলো৷ কেন বলোনি?
রিকের চোখে জল। সে গর্জে বলল,
‘ আমি নই,তোর রিপদা বারণ করেছে। তাকে বল।
ইশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। দূরে মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকা রিপকে গিয়ে যেভাবে পারল সেভাবে হাত দিয়ে আঘাত করে বলল
‘ পাষাণ। তুমি আমাকে এতটা পর ভাবো রিপদা। আজ যদি তোমার নিজের বোন হতাম তুমি পারতে এমনটা? পারতে?
রিপ অগ্নিচোখে চেয়ে থাকে রিকের দিকে। কেন বলেনি তা ভালো করে জানে বড়দা তারপরে ও???
ইশা কেঁদেই গেল৷ রিপের বুকে ঢলে পড়ল৷ কাঁদতে কাঁদতে তার হিঁচকি উঠে গেল৷ রিপ ধমক দিল,
‘ বলিনি বেশ করেছি৷ পাগলামি করবিনা ইশু। আমাকে কিছু বলবি না৷
ইশা দূরে চলে যায় পিছু হেঁটে হেঁটে৷ ডুকরে কেঁদে উঠে বলে,
‘ ঠিক আছে৷ তোমাকে ও রিপদা বলে ডাকব না আমি। ইশু মরে গিয়েছে। আমাকে ইশু বলে ডাকবেনা আর।
রিপ তাড়াতাড়ি কেটে পড়ল সেখান থেকে। ভিডিও কলের স্ক্রিনে কেঁদে কেঁদে তালহা বেগমকে শেষ দেখা দেখালো নীরা তার ছেলেকে৷ নীরব হয়ে ছেলেটি দেখল ওই ভালোবাসাময় মুখখানি। দাদু কথা রাখল না৷ সে ফিরে আসার আগেই চলে গেল৷ সবকিছু একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে কেন? সে কি ফিরে গিয়ে কিচ্ছু ফিরে পাবেনা?
ছলছলে চোখদুটো ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল। তা লুকিয়ে বহুদূর থেকে দেখল আর ও একটি মেয়ে। তার ও গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।
সব বদলে যাচ্ছে। সময়ের গতিতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কাছের মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। পিহু দেয়াল পিঠ ঠেকিয়ে সবার আড়ালে কাঁদল৷ মা আর বোনের কান্না তার কানে ভেসে আসছে৷ নীরা আর মুনা আজ মা হারা হলো৷ হাঁটতে বসতে তাদের সাথে খ্যাঁক খ্যাঁক করার মানুষটা ও নেই। তাদের কাজের খুঁত ধরার মানুষটি আজ পরপারে চলে গেছে। তারা যে বড্ড একা হয়ে গেল। তাদের আগলে রাখবে কে? তারা যে অভিভাবকহীন হয়ে গেল।
_______________
জানাজা পড়ার সময় রিক রিপ দুইভাই কান্নায় ভেঙে পড়ল। আজ মা টা তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আব্বা আব্বা করে কেউ ডাকবে না৷ আদি আর রেহান দুইভাইকে সামলাতে ব্যস্ত। রিক রেগে রিপের কলার চেপে ধরে বলল,
‘ তুই আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করিসনি৷ তোকে আমি ছাড়ব না।
রিপ কবরের মাটি দিতে দিতে চোখের জল ঝড়ায়। বলে,
‘ মা আমায় ক্ষমা করো। তোমার শেষ ইচ্ছে টুকু পূরণ করতে পারলাম না৷ ইশুর সাথে তোমার দেখা করালে তুমি যে সব সত্যিটা বলে দিতে মা। ইশুকে আমি ভালোবেসেছি সত্যি, কিন্তু কখনো তাকে পাওয়ার লোভ করিনি মা। আমি সবসময় চেয়েছি ইশু ভালো থাকুক৷ তার ভালোথাকার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমার ভাগ্যে ছিলনা মা। ইশু আমায় ভালোবাসেনি। আমি জানি তুমি কেন ইশুর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলে৷ সবটা বলে দিতে চেয়েছিলে। যাওয়ার আগে এই মহৎ কাজটা আমি তোমাকে করতে দিতে পারলাম না মা। আমায় ক্ষমা করো। উপর থেকে আমার জন্য দোয়া করো। যাতে ইশুকে আমি শেষ পর্যন্ত ভালো রাখতে পারি। নীরাকে নীরার প্রাপ্যটুকু দিতে পারি। একজন দায়িত্ববান স্বামী আর বাবা হয়ে উঠতে পারি।
তুমি আমায় ক্ষমা করো মা৷ তোমার রিপকে তুমি কখনোই শাপ দিতে পারোনা। তুমি তো ভালোবাসো আমাকে। তোমার ছোট ছেলেকে। আমি তোমাকে ভালোবাসি মা। তুমি আমাকে এই শেষবারের মতো ক্ষমা করো। তুমি ইশুকে এসব বললে ইশু শুধু শুধু কষ্ট পেত। ইশুর এখন সংসার আছে। তার স্বামী সংসার নিয়ে সে ভালো আছে। আমি ও ভালো আছি। নীরা আমাকে ভালো রেখেছে মা৷ তুমি তো এটাই চেয়েছ। আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি তাই তুমি যাওয়ার আগে সত্যিটা বলে দিতে চেয়েছ না? বিশ্বাস করো মা আমি তোমার উপর রেগে নেই, কারো উপর রেগে নেই। তোমার কোনো হাত ছিল না তাতে। কারো কোনো দোষ ছিল না। সব দোষ আমার কপালের। কিন্তু আমি এখন ভালো আছি৷ রিপকে রোজ ভালো থাকতে হয় সবাইকে ভালো রাখার জন্য। আমি ভালো আছি। তুমি চিন্তা করো না মা। আমরা ভালো থাকব৷ তুমি যেখানেই থাকো সবার জন্য দোয়া করো মা৷ সবাই যাতে ভালো থাকে। তুমি ও ভালো থেকো মা। আমরা ও যাব তোমার কাছে। খুব শীঘ্রই যাব মা।
_________________
আপনজন হারালো৷ পরিস্থিতি পাল্টালো। সবকিছু বদলালো। সময়ের তালে তালে সবকিছু চলতে চলতে একসময় সবকিছু স্মৃতির পাতায় বন্দী হলো৷ স্মৃতির পাতায় ঢাকা পড়ল হাসিখুশি, আনন্দ উল্লাস,দুঃখকষ্ট সবকিছু। দিনের পর দিন,সপ্তাহের পর সপ্তাহ, বছরের পর বছর কেটে গেল। এক, দুই, তিন,চার,পাঁচ করে করে ছয় ছয়টি বছর চোখের পলকে কেটে গেল। কেউ যদি এসে দেখে, তাহলে চোখবন্ধ করে বলে দেবে, সব পাল্টেছে। চিরচেনা মানুষগুলো পাল্টেছে। চিরচেনা জায়গাগুলোতে বসতি গড়েছে। চিরচেনা মুখগুলো আজ বড্ড অচেনা।
ভক্তদের কারণে রেহান ঢাকা পড়ে গেছে৷ সবাই অটোগ্রাফের জন্য তার উপর হামলে পড়েছে৷ দুইজন লোক ভক্তদের বুঝিয়ে সুজিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে৷ রেহান প্রায় ঘেমে উঠেছে৷ ভীড়ের মাঝে ফোন ও করা যাবেনা৷ মাথায় রাগ চেপে বসেছে। মাথার রগ দপদপ করছে৷ কিছুটা দূরে সরে ওই কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে ফোন দিল। ফোন তুলল না কেউ। রেহানের রাগ আকাশ ছুঁল৷ আশ্চর্য! সে কি সারাক্ষণ রং তামাশায় থাকে। এত রাগ দেখানোর কি আছে?
রেহান অন্য নাম্বারে ফোন দিল ৷ চিকন গলার একটি মেয়ে বলল,
‘ দাভাই হসপিটালে ক্লাসে আছি৷ পরে ফোন দিচ্ছি।
রেহান ফোন দূরে ছুড়ে ফেলল৷ একটি ছেলে এসে ফোনটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ স্যার এনি প্রবলেম?
রেহানের সম্বিত ফিরল। রাগের মাথায় কি করে ফেলেছে কে জানে?
ফোনটা পকেটে পুড়ে রেহান বলল,
‘ আজ আর কোনো ফাংশনে এটেন্ড করতে পারব না। বাসায় ফিরব।
ছেলেটি মাথা নাড়াল। রেহান বাসায় ফিরল৷ মুখ গোঁমড়া করে রাখা মেয়েটিকে দেখে রাগগুলো উঁবে গেল মুহূর্তে। মেয়েটি তার দিকে রিমোট ছুড়ে মেরে বলল,
‘ যান সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদেরকে বেছে বেছে অটোগ্রাফ দেন৷ এখানে কেন এসেছেন?
রাগ করবে সে৷ আর করছে এ?
রেহান হেসে দিল৷ হেঁটে গিয়ে মেয়েটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল৷ হাতের তালু নিয়ে সেখানে ঠোঁট বসিয়ে বলল,
‘ এই যে আপনার অটোগ্রাফ দিলাম।
মেয়েটি মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ কালকে আমার ফাংশন আছে। দেখিয়েন আমি কাকে কাকে অটোগ্রাফ দিই।। রেহান হাসল৷ বলল,
‘ যাকে তাকে দিতে পারো। মনটা আমার থাকলেই হলো৷ আমি তোমার মতো অতটা হিংসুটে না৷
মেয়েটি কেঁদে দিল যেন৷ রেহান শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ আরেহ তোমার বাচ্চা ছেলে আছে। কিন্তু তুমি নিজেই বাচ্চা সেজে বসে আছ। দেখো পরী, আমার সাথে বড্ড অন্যায় হচ্ছে। আমি অডিশন ক্যান্সেল করে তোমার রাগ ভাঙাতে চলে এসেছি৷ কিন্তু তুমি এখনো রেগে আছো। ওরা আমার ভক্ত, বউ না৷ বউ একটা। শুধু একটা৷ বুঝোনা কেন?
পেছন থেকে চিকন সুরে ছোট্ট বাচ্চার একটি কন্ঠস্বর ভেসে আসল,
‘ বাপ ও একটা। অ্যাম আই রাইট?
পরী সাথে সাথে হেসে দিল৷ সামনে তাকিয়ে রেহান বলল, রাইট মাই বাপ৷
__________________
মেডিক্যাল রিপোর্ট গুলো চেক করে মেয়েটি তার ক্লাসমেটদের সাথে ডক্টর আদির কাছে গেল৷ আদি তাকে দেখে হেসে বলল,
‘ জি একজন একজন করে বলুন।
মেয়েটি হাসল। রিপোর্ট গুলোর সাথে একটি ফাইল দিল৷ বলল,
‘ পাপা দেখোতো, আমি সবকিছু ক্যাচ করতে পেরেছি কিনা?
আদি বলল,
‘ সরি?
মেয়েটি জিভে কামড় দিয়ে পেছনের ক্লাসমেটদের দিকে তাকাল৷ বলল,
” সরি স্যার৷ আর ভুল হবেনা৷
আদি হাসল। বলল,
‘ ইটস ওকে আরিশা।
ফাইলগুলো চোখ ভুলিয়ে সবাইকে একেক কথা বলে পাঠিয়ে দিল৷ পিহুকে বলল,
‘ তুমি বসো৷
পিহু বসল৷ বলল,
‘ তাড়াতাড়ি বলো পাপা৷ আজকে দাভাইয়ের অডিশন মিস গেছে৷ এখন গিয়ে দেখব৷
আদি বলল,
‘ তুমি সাকসেস স্টুডেন্ট, আমাদের মেডিকেল কলেজে। প্রাউড অফ ইউ মাই প্রিন্সেস৷। পিহু ঠোঁট এলিয়ে হাসল৷ বলল, সব তোমার জন্য পাপা। আমি তোমার মতো আদর্শবান ডাক্তার হতে চাই৷ সবাইকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিতে চাই।
আদি বলল,
‘ কিন্তু বাবা হিসেবে তোমাকে ভালো রাখার জন্য ও আমারও একজনকে দরকার। আমি একজনের হাতে তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব দিতে চাই । তোমার আপত্তি আছে???
পিহুর চোখগুলো আপন শক্তিতে বড় বড় হলো। পিহু বলল,
‘ পাপা??
আদি হাসল। মেয়ের মাথায়, মুখে বুলিয়ে দিল মেয়ের। বলল,
‘ শুনতে খারাপ লাগলে ও সত্যি। তুমি মেয়ে। পরের বাড়ি তোমাকে যেতেই হবে। আজ নয়ত কাল। তাই আমি তাকে খুঁজে নিয়েছি। তোমাকে সে ভালো রাখবে।
পিহু উঠে পড়ল। বলল,
‘ পাপা আমি বাসায় যাই? পরে কথা বলি?
আদি মাথা নাড়াল। পিহু বেরোনোর আগে আদি তাকে পিছু ডাকল,
‘ তোমার কোনো পছন্দ আছে?
পিহু সাথে সাথে পিছু ফিরল৷ স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘ নাহহ পাপা। তোমার পছন্দ আমার পছন্দ।
____________________
রাত নামল। নিয়ম মেনে চলা মেয়েটি নিয়ম ভেঙ্গে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বসল। রাত বারোটা ভেজে গিয়েছে। এলার্ম বন্ধ করে মেয়েটি ছুটে গেল দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারটির কাছে। আজ শেষ দাগটি কেটে দিল রেড পেন দিয়ে৷ ক্যালেন্ডারটির মেয়াদ ফুরিয়েছে দশদিন আগে৷ আর ও দশটা তারিখ নিজ থেকেে লিখে লিখে সে আবার কাটছে এই দশদিন যাবত । আর ও কত অপেক্ষা? এই অপেক্ষার অবসান কবে ঘটবে?
কলমটি সে ছুড়ে ফেলে দিল। ক্যালেন্ডারের পাতা এক এক করে ছিঁড়ে ছাদে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। জ্বলন্ত আগুন দেখে রাতের নিশাচর পাখি পিহুর মাথার উপর ডানা ঝাপটালো। জ্বলন্ত আগুনের আভায় পিহুর চোখের জল শুকিয়ে গেল৷ জ্বলতে জ্বলতে এক পর্যায়ে সব ক্যালেন্ডারের পাতা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। রাতের নিশাচর পাখি ডেকে উঠল আবার৷ পিহু ওই রূপোলী থালার মতো চাঁদকে ইশারা করে বলল,
‘ আমি রাতের বুকে চাঁদ হতে চেয়েছি বলে আমার দোষ হয়ে গেল? ঠিক আছে, আজ থেকে না হয় আমি রাত হয়ে গেলাম। তুমি চাঁদ হয়ে থেকো মাহিদ ভাই। কি তা ও থাকবেনা? আমি শুনেছি তুমি ফিরবে না বলেছ, ভালো। তুমি আর এসো না। কারজন্য ফিরবে তুমি? তুমি যে তোমার বসতি গেড়েছ সেখানে। তুমি জানলে না,তুমি বুঝলে না আমি তোমার কাছে আমার বসতি গড়তে চেয়েছি। তুমি যে অন্যকারো মনে বসতি গেড়েছ মাহিদ ভাই৷ এবার আমার পালা। আমি কেন বসতিহীন থাকব? আমার ও যে ভালো থাকতে ইচ্ছে করে মাহিদ ভাই। আমি ও ভালো থাকতে চাই। আমি ভালো থাকব। তুমি ভালো থেকো৷
চলবে
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি